#
পর্ব -৪৩
” ভালবাসার যুদ্ধ ঘোষণা দিলাম তিতি, এই যুদ্ধের অবসান একমাত্র অবাক মাহবুব ই করতে পারবে বুঝলি?বোঝা লাগবে না, আমি হারিয়ে যাচ্ছি নিখোঁজ হচ্ছি।কেন হচ্ছি? তোর বোঝা লাগবেনা যার বোঝার সে বুঝে গেছে।”
টেবিলের উপর রাখা চিরকুট টা পড়ে কোনকিছু না ভেবে চিরকুট টা হাতে ভোঁ দৌড় লাগাই তিতিয়া।শরিফ স্যার এর ক্লাস শেষ করে বের হতেই হন্তদন্ত সূর্যকে দেখে অবাক হয়ে গেছিল তিতিয়া। তখন না বুঝলেও চিরকুট টা পড়ে বেশ বুঝতে পারছে সূর্য কেন এতো চিন্তিত।এইমূহুর্তে পুতুলের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তিতিয়ার।এতো পাগলামি কেন করবে? অসুস্থ শরীরে নিজে কষ্ট পাচ্ছে আর এই যে গেটের বাইরে টলটলে চোখ দুটা নিয়ে অস্থির হয়ে পায়চারী করা ছেলে টা। সুন্দর ছেলের কষ্ট পাওয়াও দেখতে অপূর্ব সুন্দর, মায়াময় লাগে। সূর্য কে দেখে তিতিয়ার ও মনে হলো সূর্যর জন্য তার খারাপ লাগছে, ভীষণ মায়া লাগছে।এই দুইটা ব্যক্তির জন্য তার ভীষণ মায়া, কেন সে জানেনা।শুধু এতুটুকু চায়, এই এতো ভালবাসার দুটি মানুষকে শ্রষ্ঠা যেন এক করে দেন।
তিতিয়া কে আসতে দেখে ঝটপট এগিয়ে গেল সূর্য। তিতিয়া কে কিছু বলবে তার আগেই তিতিয়া চিরকুট টা সূর্যর দিকে বাড়িয়ে দিল।সূর্য একটু অবাক হলেও চিরকুট টা হাতে নিয়ে পড়ল।চিরকুট টা হাতে শক্ত করে ধরে কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” তিতিয়া,ছোট মাকে ফোন দাও তো। ”
সূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে তিতিয়া ঝটপট মিসেস প্রীতি কে ফোন লাগাই,
-“হ্যা তিতিয়া বল, কি খবর, কেমন আছিস?
– আন্টি আমি ভালো আছি। বলছি পুতুল কি বাসায় গেছে থাকলে একটু দাও তো, কখন থেকে ফোন করছি বন্ধ পাচ্ছি ।
– পুতুল বাসায় হবে কেন, ওর নাকি ২৫ তারিখ ল্যাব ফাইনাল তাই ফোন অফ করে রেখেছে।আমাকে মেসেজ করলো সকালে।কেন ও রুমে নেই? তোকে জানাই নি কিছু?
-” না আন্টি আমাকে তো জানাই নি, আসলে আমি রুমে এসে ওকে পায়নি তাই ভেবেছি বাসায় গেছে।ও হয়তো লাইব্রেরি তে আছে।আচ্ছা সমস্যা নেই আমি খুজে নিচ্ছি আন্টি। আল্লাহ হাফেজ।
-” আচ্ছা ঠিক আছে।”
ফোন স্পিকারে থাকায় সবই শুনেতে পেল সূর্য। মাথাটা রাগে ফেটে যেতে চাইছে তার, এবার পুতুলকে পেলে নিজে হাতে খুন করে সবকিছুর শেষ করবে সূর্য। ওর এই নতুন নতুন পাগলামি ছুটিয়ে ছাড়বে এবার। ভাবনার মাঝেই ফোনের টুং শব্দ শুনে ফোনের
দিকে তাকিয়ে দেখলো পুতুলের ফোন থেকে মেসেজ এলার্ট এসছে।( I can be reached now at……..)
মেসেজ এলার্ট দেখেই ঝটপট কল দেয় সূর্য।
নবীনগর সংলগ্ন মহাসড়কে ফরিদপুর গামী বাসটার খারাপ ভাবে একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।প্রচুর চেঁচামেচির আওয়াজে পুতুল তার ভারী চোখের পাতা গুলো তোলার চেষ্টা করলেও কিঞ্চিত খুলতে পারলো। চারদিকে ধোয়া, মানুষের হুড়োহুড়ি,কান্না, বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে পুতুল।আরেকটু ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তাদের বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে এবং সে ভীষণ ভাবে ইনজিউরড।তার চারপাশে রক্তে লাল হয়ে আছে। তার চোখমুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে, শরীরটা একদম অসাড় হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, চোখ গুলো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে।এসবের মাঝেই তার ফোনটা ভীষণ জোরে বাজছে, কোনরকম হাতরে ফোনটা হাতে নিয়ে ঝাপসা চোখে সূর্যের নাম্বার টা দেখতে পেলেও রিসিভ করার সামর্থ্য হলো না পুতুলের।
-” ভাইয়া, ভাইয়া!! একটু শান্ত হোন প্লিজ, ভাইয়া দেখেন এভাবে চালালে আমরা এক্সিডেন্ট করবো।ভাইয়া, পুতুলের কিচ্ছু হবেনা ভাইয়া আপনি প্লিজ একটু শান্ত হন।”
তিতিয়ার কথা সূর্য শুনছে কিনা বোঝা গেল না সে গাড়ির স্পীড একই রেখে চালিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, পুতুলের ফোন অন পেয়ে বেশ কয়েকবার কল করার পরে অচেনা কোনো ব্যক্তি তাদের কে জানিয়েছে পুতুল গুরুতর ভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে।তারপর থেকে সূর্য একরকম পাগলামি করছে বলতে গেলে।খবরটা পেয়ে গাড়ি রেখেই দৌড়ানো শুরু করেছিল।তিতিয়া না বললে হয়তো দৌড়েই যাওয়া শুরু করতো। সূর্য ড্রাইভ করতে করতে বারবার বাম হাত দিয়ে চোখ মোছবার বৃথা চেষ্টা করছে, দৃশ্যটা দেখে তিতিয়ার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। তার এখন নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে, সে ক্লাসে না গেলে হয়তো পুতুল কোথাও যেতে পারতো না আর এক্সিডেন্টও হতো না। আর এই ছেলটাও এতো কষ্ট পেতো না ভেবে নীরবে কেঁদে ওঠে তিতিয়া।
নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি অসহায় ব্যক্তি মনে হচ্ছে সূর্যের।নিশ্বাস গুলো মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে, চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে।কি হচ্ছে বা হবে কিচ্ছু ভাবছে না মনে মনে অনবরত আল্লাহ’র কাছে পুতুলের জীবন ভিক্ষা চাইছে।পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময় এখন তার শুধুমাত্র পুতুলকে চায়, আর কিচ্ছু চায় না। এইমূহুর্তে সৃষ্টিকর্তা যদি তাকে শর্ত দিয়ে বলতো তোমার প্রাণের বিনিময় পুতুলকে ফিরিয়ে দেব।সেই শর্ত পূরণ করতেও মনে হয় সে সময় নিতো না চট করে রাজি হয়ে যেতো।
অচেনা ব্যক্তির ঠিকানা অনুযায়ী নবীনগর সদর হাসপাতালে এসে সারা হাসপাতাল তন্য তন্য করে খুঁজেও যখন পুতুলকে পাওয়া গেল না।একজন লাশ রুমে দেখতে বললে সূর্যের তখন দম বন্ধ হয় হয় অবস্থা।দুজনের সাহস না থাকলেও বাধ্য হয়েই সবগুলো লাশ দেখে, সবগুলো লাশ দেখে দুজনেই বড় নিশ্বাস নিয়ে শ্বাস ফেলল। সূর্য দুহাতে মুখ মুছে আবারও মানুষের ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায়।দুজন মিলে আরো দুবার খুজলো পুতুলকে। সূর্যর অবস্থা দেখে তিতিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে একজন নার্সকে খুজে ফোন থেকে পুতুলের ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলো। কিন্তু তাতেও কোন ফল পেল না।এভাবে আরো দুজনকে জিজ্ঞাসা করার পর একজন জানালো- এখানে লাইফ সাপোর্টারের অভাবে বেশি আশংকাজনক রোগীদের কয়েকজনকে নিরাময় হসপিটালে পাঠানো হয়েছে।
নার্সের কথা শোনামাত্র দুজনে আবার দৌড় লাগাই গাড়ির দিকে।এবারও একইরকম ভাবে দিক্বিদিক শূন্য হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সূর্য, তবে এবার আর চোখ মোছবার বৃথা চেষ্টা করছে না জলকণা গুলো কে আপন গতিতে ছুটতে দিচ্ছে। পাশে বসে তিতিয়াও কাঁদছে, পুতুলের কিছু হয়ে গেলে সে নিজেকে কখনো হ্মমা করতে পারবেনা।
অনেক কসরত করে প্রায় আধাঘণ্টা পরে নিরাময় হসপিটালের তৃতীয় তলায় ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট এ পুতুলের সন্ধান পেল সূর্য। তবে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। মোট ছয়জন রোগীর মধ্যে দুজন রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ।সে দুজনের মধ্যে একজন একটা বাচ্চা ছেলে আর আরেকজন পুতুল।বাচ্চা ছেলটা অক্সিজেন নিতে পারছেনা, হঠাৎ হঠ্যাৎ ছটফট করছে। কয়েকজন ডাক্তার মিলে ছেলেটাকে দেখছে।বাইরে করিডোরে ছেলেটার মা হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। সূর্য ঝাপসা চোখে দরজার কাচঁ ভেদ করে পুতুলের দিকে একবার তাকিয়েই চট করে দরজা ছেড়ে করিডোরের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়লো।তিতিয়া দরজার সামনে দাড়িয়ে পুতুলের বড় বড় শ্বাস- প্রশ্বাস নেওয়া দেখছে আর নীরবে কাঁদছে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মোটামুটি সবাই চলে আসে হসপিটালে।পুরো করিডোর জুড়েই মানুষের ভীড়, সকলে নিজের আপনজনের জন্য অস্থির হয়ে বসে আছে। সেই বাচ্চা ছেলেটা মারা গেছে,ছেলেটার বাবা-মা বিলাপ করে কাঁদছে। সূর্য সেই থেকে একই জায়গাতে বসে আছে।সূর্যর সব বন্ধুরা তাকে ঘিরে বসে-দাড়িয়ে আছে। কিছু দূরে বাবা দাড়িয়ে আছেন, টুকটুকি বাবাকে ধরে কাঁদছে।ছোট মা এসেই পুতুলকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।মিসেস মধুমিতা তাকে সান্ত্বনা দিলেও তেমন কোনো কাজ হলো না। হঠ্যাৎই সূর্য উঠে মিসেস প্রীতির কাছে গিয়ে লাল টকটকে ফোলা চোখ নিয়ে কোনরকম বলল,
-” ছোট মা!(একটু নিশ্বাস ফেলে),,,,,,,, পুতুলকে আমায় দিয়ে দাওনা ছোট মা।”
কথাটুকু বলতে দেরি হলেও সূর্যর গালে থাপ্পড় দিতে দেড়ি করলেন না মিসেস প্রীতি।মিসেস প্রীতির এহেন কাজে সকলে অবাক হলেও সূর্য ধপ করে ফ্লোরে বসে ছোট মায়ের পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” ছোট মা, প্লিজ তোমার মেয়েটা কে আমায় দাও ছোট মা। নইলে আমায় মেরে ফেলো ছোট মা।”
ছেলের অসহায়ত্ব দেখে মিসেস মধুমিতা ডুকরে কেঁদে ফেললেন। ভাইয়ের কান্না দেখে টুকটুকি বাবাকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব -৪৪
রাত তিনটা বাজে, পুরো হসপিটাল জুড়ে নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে।মাঝেমাঝে দু’একজনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। করিডোরের একটা বেঞ্চে বসে আছেন মিসেস প্রীতি, তার ঠিক সামনে মেঝেতে বসে আছে টুকটুকি।বসে আছে বললে ভুল হবে কাঁদছে, অনেকক্ষণ ধরে ছোট মায়ের সামনে বসে কাঁদছে।মিসেস প্রীতি এবার রেগে বললেন,
-” টুকটুকি কান্না বন্ধ কর নইলে আমার সামনে থেকে চলে যা।”
ছোট মায়ের কথায় টুকটুকি নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করলো।কিছুক্ষণ পর ছোট মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ছোট মা একটা গল্প শুনবে? নকল রাজকন্যার গল্প?”
মিসেস প্রীতি কিছু না বলে চুপচাপ টুকটুকির দিকে তাকিয়ে থাকলো।টুকটুকি ছোট মায়ের হাত ধরে আরাম করে বসে বলল,
-” গল্পের মাঝে কথা বলবে না, চুপ করে শুনবে।”
মিসেস প্রীতির হঠাৎই টুকটুকির দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া লাগছে।মেয়েটার লাল টকটকে দুটো চোখে, বিষণ্ণ মুখটাই একরাশ কষ্টেরা খেলা করছে। টুকটুকি এবার মাথা নিচু করে গল্প বলতে শুরু করলো,
-” তো গল্প টা হলো,একটা ভীষণ সুখী রাজকন্যা ছিল।যার কোনকিছুর অভাব ছিলনা।রাজা-রাণী আর যুবরাজ মানে রাজকন্যার ভাইয়ের চোখের মনি ছিল রাজকন্যা টা।রাজ্যের সবাই রাজকন্যা কে ভীষণ ভালবাসতো।কিন্তু হঠাৎই একদিন রাজকন্যা জানতে পারে সে কোনো রাজকন্যা নই, সে একজন নকল রাজকন্যা।সে রাজা-রাণীর নিজের সন্তান নই, একজন খুনির সন্তান। এমন একজন খুনির, যে কিনা রাজার সন্তানতুল্য ভাইয়ের খুনি।”
একটু বলেই টুকটুকি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।মিসেস প্রীতি টুকটুকির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” কী হয়েছে টুকটুকি, তুই এমন কর কাঁদছিস কেন মা?”
টুকটুকি মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“ছোট মা, সেই রাজকন্যা টা কে জানো!,,,,, আমি, আমি সেই নকল রাজকন্যা। আর সন্তানতুল্য ছোট ভাই হলো ছোট বাবা।”
-” মানে! এই কি বলছিস টুকটুকি? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”
-” আমি সত্যি বলছি ছোট মা, সব সত্যি তুমি জানোনা ছোট মা।আমি ঠিক বলছি।আর সেই খুনি হলো আমার বাবা মুরাদ রহমান।”
বলেই মিসেস প্রীতির হাটু জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” ছোট বাবার প্রাণপ্রিয় বন্ধু মুরাদ রহমান, মানে আমার বাবা। পজিশনের লোভে ছোট বাবাকে খুন করেছিল ছোট মা। সেদিন ছোট বাবার কোনো অফিশিয়াল কাজ ছিল না, তাকে মিথ্যে বলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ছোট মা।”
টুকটুকির মুখের দিকে অবিশ্বাস্য ভঙিতে তাকিয়ে আছেন মিসেস প্রীতি।কী বলা বা করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছেন না।টুকটুকি ছোট মায়ের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে আবারও বলতে শুরু করল,
-” বিশ্বাস করো ছোট মা আমি সব সত্যি বলছি। তুমি চলে যাওয়ার চার বছর পরে আর্ম জুডিশিয়াল বোর্ডের তদন্তে সবকিছু জানতে পেরেছিল সবাই। কিন্তু তখন তোমাকে জানানোর কোনো উপায়ই তুমি রাখোনি। তবে এতবছর পরে তোমাকে সামনে পেয়েও না জানানোর একমাত্র কারণটা হলাম আমি। ছোট মা, আমি ছোট বাবার খুনির মেয়ে।,,,,, এইটা জেনে তুমি যদি আমাকে মেনে না নাও, সেই ভয়ে বাবা-মা, ভাইয়া তোমাকে কিচ্ছু জানাই নি ছোট মা।”
মিসেস প্রীতির সবকিছু এলোমেলো লাগছে, বুকটা ভীষণ ধড়ফড় করে, নিশ্বাস নেওয়াও কষ্টের মনে হচ্ছে। কি করবে, কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছেন না।হঠাৎই টুকটুকির হাত ছাড়িয়ে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মিসেস মধুমিতা কে খুজতে লাগলেন।মিসেস মধুমিতা কে দেখতে না পেয়ে টুকটুকির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” তোর আম্মু কোথায় টুকটুকি?”
প্রতিত্তরে টুকটুকি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।মিসেস প্রীতি টুকটুকির দুবাহু ঝাঁকিয়ে বললেন,
-” কিরে বল কোথায়?”
হাসপাতালের করিডোর ঘটে যাওয়া পুরো দৃশ্যপটের সাক্ষী আরো একজন ছিলেন।সে মিসেস প্রীতির প্রশ্নের উত্তর দিল,
-” খালামনি, আন্টি গ্রাউন্ড ফ্লোরে বসে আছে।”
মিসেস প্রীতি তার উত্তর পেয়ে ছুটে চললেন কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে।
-” বাবা, তুমি একটু বলো না বাবা। তুমি বললে ছোট মা ঠিক পুতুলকে আমায় দেবে বাবা।ও বাবা তুমি একটু বোঝাও না বাবা।”
সূর্যর তখনকার বলা কথাগুলো বার বার মনের মধ্যে কান্নার ঝড় তুলে দিচ্ছে মি. মাহবুবের। তার দুঃসাহসী, প্রাণবন্ত ছেলেটাকে এতো কেন কষ্ট দিচ্ছেন বিধাতা। তাকেই বা কেন বাবা হিসেবে এতোটা অসহায় করে দিয়েছেন বিধাতা।কথাগুলো ভেবে আবারও চোখগুলো জ্বলতে শুরু করলো, কান্না দমন করার জন্য জোরে নিশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেন মি. মাহবুব।মিসেস মধুমিতা চুপচাপ স্বামীর পাশে বসে হসপিটালের মেইন ডোরের দিকে চেয়ে আছেন।তখন সূর্যের পাগলামির কারণে হাইপার হয়ে অসুস্থ হয়ে যান মিসেস প্রীতি।ছোট মায়ের অবস্থা দেখে কখন যে সূর্য চলে গেছে কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু মিসেস মধুমিতা ঠিকই দেখেছিলেন তার ছেলেটা দরজার বাইরে দাড়িয়ে একপলক পুতুলকে দেখে কতটা নীরবে এখান থেকে চলে গেছে।তিনি জানেন তার ছেলেটা আর এখানে আসবে না, তারপরও চেয়ে আছেন। ভাবনার জগৎ ভেঙে গেল কারো আগমনে, পাশে তাকিয়ে হন্তদন্ত প্রীতি কে দেখে ভ্রূ কুচঁকে ফেললেন মিসেস মধুমিতা।
-” প্রীতি, তুই,,,,,”
-” ভাবি, টুকটুকি কি বলছে ভাবি? এসব মিথ্যা তাইনা? মুরাদ কিছু করেনি তাইনা,মিহির তো মিশনে গেছিল।টুকটুকি আমাকে রাজি করানোর জন্য এসব মিথ্যা বলছে তাইনা?”
অফিসের জরুরি কাজে চট্টগ্রাম গেছিল অর্ক।দুপুর নাগাদ পুতুলের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে আসার চেষ্টা করলেও আসতে আসতে রাত দুপুর হয়ে গেল।কিন্তু হসপিটালে এসে যে কোনো অযাচিত সত্যের সম্মুখীন হতে হবে, ভাবতে পারেনি অর্ক।একরাশ বিস্ময় নিয়ে টুকটুকির দিকে তাকিয়ে আছে সে।টুকটুকি তখনও মেঝেতে বসে ডুকরে কাঁদছে। অর্ক কাধের ব্যাগ থেকে পানির বোতল টা নিয়ে ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে টুকটুকির পাশে বসলো। কিছুক্ষণ নীরবে থেকে পানির বোতল টা টুকটুকি র হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
-” টুকটুকি, আমার মনে হয় তোমার এখন না কেঁদে খুশি হওয়া উচিত।”
অর্কর কথা শুনে জলভর্তি চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকালো টুকটুকি।অর্ক মৃদু হেসে বোতলোটা আবার নিজের হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলে টুকটুকির মুখের সামনে দিয়ে খাবার ইশারা করে বলল,
-” কথাটা ভুল বলিনি আমি।”
টুকটুকি এক ধোক পানি খেয়ে আগ্রহ নিয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
-” এই যে একটা ঘটনা কে কেন্দ্র করে সকলে কত কষ্ট পাচ্ছিল, তোমার কথায় কিন্তু সকলের কষ্ট না মুছলেও দুজন ভালবাসার মানুষের কষ্ট অবশ্যই ঘুচবে।আমি কি বলছি তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো।”
অর্কর কথার কোন উত্তর না দিয়ে টুকটুকি একই ভাবে অর্কর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।অর্ক একটু আরাম করে বসে বলল,
-” যে ভাই তোমাকে হারানোর ভয়ে এতোটা বছর ধরে সবকিছু লুকিয়ে রেখে নিজে কষ্ট পেয়েছে। তুমি সত্যি বলায় সূর্য আর পুতুলের কষ্ট গুলো তো তুমি কমাতে পারলে। তাহলে ভাইয়ের সুখে তোমার কান্না করাটা কি ঠিক? ”
অর্ক টুকটুকিকে কতটা বোঝাতে পারলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না।তবে টুকটুকিকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
-” টুকটুকি, তুমি সবকিছু কিভাবে জানলে? না মানে আমার যতদূর ধারণা কেউ তোমাকে এমনিতে জানাবে না।তুমি জানলে কিভাবে ?”
টুকটুকি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথা বলল,
-” দুবছর আগে আপু যখন সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল সে রাতে বাবা আর মার সাথে ভাইয়ার ভীষণ ঝগড়া হয়।ঝগড়ার কারণ আমি জানতাম না। শুধু ভাইয়ার বলা একটা কথায় শুনেছিলাম, ‘আমি বেচেঁ থাকতে কখনো ছোট মাকে জানাবো না, আর তোমরা জানালে আমাকেও হারাবে।’ তখন কথাটার কারণ বুঝতে না পারলেও পাচঁ মাস আগে কথাটার অর্থ বুঝতে পারি। হঠাৎই বাবা- মা সেদিন কলেজে এসে আমাকে নিয়ে ছুটে যায় নাটোর সেনা- কল্যাণ হসপিটালে।রাস্তায় জিজ্ঞাসা করলে জানাই বাবার কোন এক বন্ধু অসুস্থ তাকে দেখতে যাচ্ছি সবাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি বেশ অবাক হয়ে যায় বাবার বন্ধু নামক লোকটাকে দেখে।লোকটার চেহারার সাথে কোথাও একটা আমার চেহারার ভীষণ মিল।কিন্তু আমি খুজে বের করতে পারিনি।ছোট মা কিন্তু আমাকে প্রথম দেখেই আম্মুকে বলেছিল, ‘ টুকটুকির সাথে কোথাও একটা মুরাদের মিল আছে।’ আম্মুও কিন্তু খুব সহজে কথাটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ওহ কি যেন বলছিলাম,,,,,,, হুম বাবার বন্ধু। বাবার বন্ধু আমাদেরকে ঠিক আমাদের না আমাকে দেখেই ভীষণ কাঁদতে শুরু করেন।বাবার হাত ধরে বার বার হ্মমা চাইছিলেন। লোকটার জন্য আমার কেন যেন বেশ মায়া হচ্ছিল।কিন্তু আমি অবাক হয়ে যায় যখন লোকটা আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ মাগো আমায় হ্মমা করে দিও’।অবশ্য আমি বেশ ভয়ও পেয়ে যায়।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আম্মু লোকটা কে বিভিন্ন ভাবে সান্ত্বনা দেন।মজার ঘটনা কি জানেন অর্ক ভাইয়া? আমি কিন্তু সেদিনও বুঝতে পারিনি ওই লোকটা আমার বাবা, আমার বায়োলজিক্যাল ফাদার। ”
চলবে,,,
( গল্পটা খুব দ্রতই শেষ হয়ে যাবে)
চলবে,,,,,
( ব্যক্তি জীবনে ভীষণ ব্যস্ত থাকায় গল্পটা একদিন পরপর দিবো(সরি),,,,, হ্যাপি রিডিংস❤️❤️)