ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ২২

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব-২২

ফোনের নোটপ্যাডে করা লিস্টটা আরেকবার চেক করে নিলাম। এই দুইমাসে অনেক কিছু করতে হবে। ঢাকা টু চিটাগং পুরো জার্নি এই লিস্ট করতেই কেটে গেলো।
সাব্বির আর কল দেয়নি। কিন্তু ফয়সাল কল দিয়েছিলো অনেক বার। কিছু একটা ঘাপলা আছে।
কিন্তু ধরতে পারছি না কেনো।

হলে এসে ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখি মেজো ভাইয়ার অনেকগুলো মিসডকল। ঈদের দিনের পর আজকে ভাইয়া কল দিলো!!!
আমার মেয়েকে কখনোই বিয়ে দিবো না আমি।
এটা কি ভাবলাম আমি!! নিজেই হেসে উঠলাম। হাসবেন্ডের সাথে কথা হয়না ভালো করে তার আবার বাচ্চা হবে!!!
হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে ভাইয়াই আবার কল দিলো।
-আমি তো ভাবলাম আমার কথা বোধহয় ভুলেই গিয়েছ!!
– হা হা হা, ভুললে কি তোরে ফোন দিতাম নাকি!!
-হাসলে কিছুই মাফ হবে না। হে হে কইরা হাইসা লাভ নাই।
-হ, তুমি তো খুব ভালো একটা কাম করছ , প্রেম করবি ভালো একটা ছেলের সাথে কর, এমন ইন্টারন্যাশনাল প্রেমিক বানাইছস কেরে?
-কি করলাম আবার!! সব তো শেষই, আরকি বাকি আছে?
-তোমার এক্স আশিক এখন সবাইরে ফোন দিয়া বেরাইতেছে। বলতেসে তোর আর সাব্বিরের নাকি ডিভোর্স হয়ে যাবে আর তোরা নাকি বিয়ে করবি?
-কিহ!!!!!!! কি বললা তুমি?
কথার বদলে গলা দিয়ে ব্যাঙের মতো শব্দ বের হচ্ছে আমার।
-জি আফা। কিন্তু ডিভোর্স হওয়ার কথা কেন বলতেসে?
তোদের মাঝখানে কি সব ঠিকঠাক আছে? সত্যি করে বলতো তুই?
-সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করো। ও ফয়সালের ব্যাপারে সবই জানে। ও যদি বলে ঠিক আছে তাহলে সব ঠিক। না হলে নাই।
-কেন তুই বলতে পারতেছিস না?
-বিয়েটা কি আমাকে বলে ঠিক করছিলা তুমি? বিয়েটা যেহেতু ওর মতামত অনুযায়ী ঠিক করেছ, তাহলে ওকেই জিজ্ঞেস করো সব ঠিকঠাক আছে কি নেই।
– এভাবে কেন বলতেছিস তুই? আমরা কি তোকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলাম?
-মতামত নিয়েছিলে আগে? বিয়ে তো ঠিক হয়েছিলো রাতে, আর আমাকে কখন বলেছিলে তুমি? তাও তুমি বলো নাই, ভাবি বলেছিলো আমাকে।
তুমি রাতের বেলা বললে হয়তো আজকে ফয়সালকে
ইন্টারন্যাশনাল প্রেমিক হতে হতো না!!
-দেখ শুধু শুধু কথা পেচাবি না।
-আমি কথা পেচাচ্ছিনা ভাইয়া। সাব্বিরকে ফোন করে জিগ্যেস করো ওর কোনো প্রবলেম আছে কি না, ও যেটা বলবে সেটাই।
– তোর বলতে সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারছি না আমি।
-যদি বলি কিচ্ছু ঠিক নাই তাহলে কি ডিভোর্স করিয়ে দেবে আমাদের?
ফোনটা কেটে দিলো। সত্যি কথা সবসময় শুনতে ভালো লাগে না। আমারও পুরাতন কথা মনে করতে ভালো লাগে না। ফয়সালের যা মনে চায় করুক, আমার তাতে কি আসে যায়।

“মেহের, চেম্বারে আসো একটু। ” ল্যাবভর্তি স্টুডেন্টদের সামনে এই কথা গুলো বলে ফয়সাল ক্লাস শেষ করে চলে গেলো!!
বেশিরভাগ স্টুডেন্টই মুখ চেপে হাসলো, আর কেউ কেউ তো ফিসফিস করে পাশের জনকে কিছু একটা বলতে শুরু করলো!!
আর আমার ফোনের অপরপাশে থাকা সাব্বির ফোনটা কেটে দিলো।
ঘড়িতে বাজতেসে দুপুর ১২.৩০ মিনিট। ওর ক্লাস নেয়া শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো ১১.৪৫ মিনিটে। সেই হিসেব করেই প্রতিদিন ল্যাবে আসি।
কিন্তু আজকে সবকিছু বড্ড গোলমেলে হয়ে গেলো!!!
লিফটে থেকে বের হয়েই ল্যাব।
তাই সাব্বির কেনো ফোন দিয়েছিলো ভালোভাবে শুনতেও পায়নি।
অনেকবার কল করলাম ওকে। কিন্তু বার বার ফেনটা কেটে দিলো।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে খুব। আল্লাহ কবে জানুয়ারির ২ তারিখ আসবে???
চুপচাপ একটা টুলে বসে পরলাম। কান্না গলায় আটকে যাওয়ার প্রবলেম টা আবার শুরু হয়েছে।
“এখান থেকে চলে যান দিদি। পড়াশোনার চেয়ে নিজের মান সম্মান অনেক দামী। ”
ঝাপসা চোখে দিদির কথা শুনে তাকালাম,
-চলে যাবো দিদি। সব ছেড়ে চলে যাবো।
-ফয়সাল স্যার এমন কেনো করেন আপনার সাথে?
এতো আজেবাজে কথা শুনতেছি দিদি। এই মানুষটার সাথে আপনার সম্পর্ক ছিলো?
-কি করবো দিদি বলেন, পাঁচ বছর থেকেও যে ওর এই চেহারা টা চিনতে পারিনি!!!

হাতে সময় অনেক কম। এর মধ্যেই রিসার্চটা শেষ করতে হবে। সুপারভাইজার ম্যামের সাথে দেখা করতে গেলাম। ফয়সালের রুম বাইরে থেকে তালা মারা দেখে একটু শান্তি পেলাম।
-ম্যাম একটু হেল্প লাগবে
-হুম বলো।
-ম্যাম ডকুমেন্টস গুলো কি কি লাগবে আর থাকাটাকা নিয়ে যদি একটু ডিটেইলস বলতেন।
-পরশু এর মধ্যে এই ডকুমেন্টসগুলো চেম্বারে নিয়ে এসো। আমি সবসময় যে এজেন্সি থেকে সব এরেঞ্জ করি সেখানেই সব জমা দিবো। টেনশন নিয়ো না তুমি, আমি আগেই সব কথা বলে রেখেছি। আর ভিসা ফিটা নিয়ে এসো। টিকেটের টাকা ভিসা আসার পরে দিও।
খুশিতে চোখে পানি এসে গেলো।
-কান্নাকাটি করে লাভ নেই। সাব্বিরের সাথে খুশি থাকো এই আমি চাই।
এই কথা শুনেই হাসিটা চলে গেলো।
-ম্যাম সেটা মনেহয় আমার কপালে নেই।
সব কিছু ম্যামকে খুলে বললাম।
সব শুনে ম্যাম স্পিচলেস হয়ে গেলেন!!!
-তুমি অনেক স্ট্রং মেহের। এতো সহ্যক্ষমতা সবার থাকে না। কি করতে চাও সেটা নিয়ে তোমাকে কিছু বলার নেই আমার। তোমার যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করো, অবশ্যই নিজের দিকটা আগে ভেবে নিও।
-ম্যাম একটা রিকুয়েষ্ট করি?
-তুমি হলে এমন একজন পারসন যাকে আমার সবথেকে ক্রিটিকাল মোমেন্টে পেয়েছি। তুমি আমাকে সাপোর্ট না দিলে দুই বেবি নিয়ে এইখানে চাকরি করতে পারতাম না। আর এই চার কোটি টাকার প্রজেক্টও পেতাম না।
পুরো রিসার্চটা করলে তুমি, অথচ ঠিকই আমার নামে পাঠিয়েছ। আর আরেকজন হলো ৭ বছরের ফ্রেন্ড। আমার প্রেগ্ন্যাসির সময় আমার কাছে আসা রিসার্চটা নিজের ডিপার্টমেন্টে নিয়ে নিলো!!!!
যখন কিছুই করতে পারলো না পুরো রেসপনসেবলিটি আমার উপর দিয়ে দিলো!!!
যার ফলাফল আমি আজকেও ভুগছি। তুমি সেদিন আমাকে হেল্প না করলে এতো তারাতাড়ি প্রফেসর হতে পারতাম না মেহের!!
তুমি কেনো আমাকে রিকুয়েষ্ট করবে!! গাধি মেয়ে একটা। বল কি লাগবে তোমার।
মুচকি হেসে ম্যাম কে বললাম
-ম্যাম আমি যে বাইরে চলে যাবো এই কথাটা কাউকে বলিয়েন না প্লিজ।
-এই কথাটা আমি তোমাকে বলতাম। কিন্তু তুমি কি তোমার ফ্যামিলিকেও বলতে চাচ্ছো না?
-আপাতত না ম্যাম। আমার ফ্যামিলির সবাই অনেক সহজ সরল। কাকে না কাকে বলে ফেলবে। তার থেকে আগে যাই ওখানে, তারপর আস্তেধীরে জানাবো।
-হুম ঠিক আছে।
-ম্যাম একটা ইনফরমেশন জানার ছিলো।
-আবার শুরু করেছ?
এবার আর হাসি আসে নি। কারণ এই প্রশ্নটার উত্তরের সাথে অনেক কিছু নির্ভর করছে।
-ম্যাম, আমি যতদুর জানি ফয়সাল একটা প্রব্লেমের জন্যে টিচার হতে পারতো না। আর ওর জন্যে ঐরকম লবিং করার মতো কেউ ছিলোও না। আপনি কিছু জানেন এই ব্যাপারে?
-কি বলো তুমি!! আমি তো শুনেছি চিটাগং মেডিক্যালের কোন নেতা ওকে নিয়ে ডিরেক্ট প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীর কাছে গিয়েছে। আর ওর জন্যে নাকি তিনজন মন্ত্রীর ফোন এসেছে!!
নাহলে কি আর এতো তারাতাড়ি কারোর নিয়োগ হতে পারে!!
ভিসি স্যার তো ওকে নিজে স্যরি বলছে ওকে আগে কেন টিচার নিতে পারেনি সেজন্য…. আগের যে টিচাররা ওর নামে মিথ্যা ব্লেম দিসিলো…
ম্যামের লাস্ট কথা গুলো আমার মাথায় আর ঢুকছে না। চারপাশের সব কিছু ঝাপসা লাগছে।
চিটাগং মেডিক্যালের নামকরা একজন অাউটস্ট্যানডিং স্টুডেন্ট এবং নেতা আছে যার কথা গত তিন বছর ধরে আত্নীয়দের কাছে শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম । যে কিনা বর্তমানে আমার হাসবেন্ড।
সাব্বিরের সাফল্যে খুশি হবো নাকি ফয়সালকে হারানোর জন্যে কস্ট পাবো?????

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here