ঝরাপাতার দিনগুলো পর্ব ৩১(শেষ)

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব-৩১ (লাস্ট পার্ট)

পাক্কা ত্রিশ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আর একটু পর পর সাব্বির এসে আমাকে কাতুকুতু দিচ্ছে। কান থেকে হাত সরালেই বলছে প্রতিবারের জন্যে কানে ধরা দুই মিনিট করে বাড়বে।
প্রথমে ছিলো দশ মিনিট। এখন সেটা বাড়তে বাড়তে ত্রিশ মিনিটে এসেছে!!
আজকে মনে হয়না সারাদিনেও কান থেকে হাত নামাতে পারবো।
বদমাইশ টা এসে ঠিক পেটের সাইডে শুড়শুড়ি দিচ্ছে!!
আর অটোমেটিক কান থেকে আমার হাত নেমে যাচ্ছে।
বেয়াদ্দপটা বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে আধশোয়া হয়ে দাত কেলিয়ে হাসছে!!!
গা জ্বলছে আমার ওর দাত কেলানি দেখে।
গা জ্বালা করলেও এটা মানতে হবে যে ও আগের থেকে অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে গিয়েছে!!! স্কাই ব্লু কালারের টি শার্টের উপর দিয়ে বুকের পেশি গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠছে!!! জিমে যায় মনে হয়!!
নাহ ওর প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি বোঝালে তো চলবে না।

চল্লিশ মিনিটধরে আমি কানে ধরে আছি!!!!
আর পারবো না আমি, চেচিয়ে বললাম ওকে।
-আরো ত্রিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি তুই। দাত কিড়মিড় করে বললো ও।
-কেন? কি করছি আমি? জীবনেও কোনোদিন কান ধরে কারো সামনে দাড়াই নাই আমি।
ঝাঝের সাথে বললাম ওকে ।
-কি করেছিস তুই?
তোর জন্যে দুই দুইটা মানুষের পায়ে পুরা একঘন্টা ধরে বসে ছিলাম!!! তাও আবার কতো গুলো মানুষের সামনে!!! তুই তো শুধু আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস।
– একটা তো মেজ ভাইয়া আরেকটা কে? গোমড়া মুখে ওকে জিগ্যেস করলাম আমি।
-তোর সুপারভাইজার ম্যাম। দুষ্টু মহিলা একটা!!! মামুন ভাইয়ার পায়ে বিশ মিনিট ধরে বসে থাকতেই কি সুন্দর রাজি হয়ে গিয়েছে!! আর এই মহিলার পায়ে পুরো চল্লিশ মিনিট ধরে বসে ছিলাম!!!!! সব হইছে তোর পাকনামির জন্য!! বলতে বলতে ও উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।

পারবো না আমি আর বলে ধপ করে বসে পড়লাম।
-ঠিক আছে আর কানে ধরতে হবে না। মুরগী হ এইবার।
-কিহহহ!!!!!
-মুরগী না হলে একপায়ে দাড়িয়ে থাক।
-কেন তোমারেও কি মুরগী বানিয়েছিল ভাইয়া?
-তুই যে কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি আমি ছাড়া কেউ দেখেছে? দেখে নাই। আর আমি? তোর তিন ভাইয়া, তিন দুলাভাই আমার বাপ মা সবার সামনে পায়ে পরে ছিলাম শুধু তোর জন্যে!!!!
তুই মুরগী হবি না তো আমি হবো? নো, নেভার।
-পারবো না, পারবো না, পারবো না।
-দাড়া তুই এইভাবে মানুষ হবি না।
বলে এসেই ও এক হাত দিয়ে আমার দুই হাত ধরে কাতুকুতু দেয়া শুরু করলো!!
কিছুক্ষন সহ্য করার পর আর থাকতে না পেরে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

-সেই তো ঘুরে ফিরে আমার কাছেই এলি!!! আরও আগেই আসতি!! এতো ঝামেলার কি দরকার ছিলো?
-আমি আসি নাই তুমি আসছো আমার কাছে। ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম আমি।
-তাতে তোর সম্মতি ছিলো না তাই বলতে চাইছিস?
-সেটা কখন বললাম আমি। কম কস্ট তো দাও নাই আমাকে। এতোই যখন ভালোবাসো, একটা বার বলতে পারলে না মুখে?
-আমি না হয় বলি নাই, কিন্ত তুই বললি না কেন একবারও?
-কথা প্যাচানো ছাড়া আর কিছু পারো তুমি?
-ও কিছু পারি না? সেদিন আসলে ভুল হয়েছিল আমার। দাগ গুলো শুধু ঘাড়ের তিল গুলোতে না বানিয়ে সারা শরিরের তিল গুলোতে দেয়া উচিত ছিলো। অবশ্য তাতে তো দাগে সারা শরির ভরে যেতো!!! যে সুন্দর সুন্দর তিল আছে!!!!
আমি হা হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে!!!
দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে দাগই ভালো!!! বিরবির করে বললাম আমি।
ফিসফিস করে বলা অনিচ্ছাকৃত বেফাস মন্তব্য ঠিকই ওর কানে পৌছে গেলো!!!
ফলাফল বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো আমাকে কাধে ফেলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো!!
-আরে নিচ্ছ যখন হিরোদের মতো নাও, ভিলেনদের মতো নিচ্ছ কেন?
-তোর জন্যে ভিলেনই ঠিক আছে। হিরোর মতো ভালো হয়ে তো এগারো মাসেও কিছু করতে পারলাম না!!!

“মেহের এটা তোর প্রথমবার ” চোখে মুখে প্রচন্ড বিস্ময় আর খুশি নিয়ে সাব্বির বললো।
চব্বিশ বছরের কুমারিত্ব সানন্দে বিসর্জন দেয়ার মুহুর্তে ব্যাথায় কাতর আমার মেজাজ সাথে সাথে চরম বিরক্ত হয়ে গেলো ওর কথা শুনে।
-এতো লাগে ব্যথা কেন? এই বা* করার জন্য মানুষ চৌদ্দটার সাথে রিলেশন করে?তুই আর জীবনেও আসবি না আমার কাছে। বাচ্চাকাচ্চার দরকার নাই আমার। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললাম আমি।
-সরি বাবু, আমি তো শুরুতে বুঝতে পারিনি এটা তোমার প্রথম বার।
– কেন? এটা তোমার কত নাম্বার?
-আমারও প্রথম। কিন্তু ফয়সাল তো বলেছিলো তুই ওর সাথে কক্সবাজার গিয়েছিলি। একসাথেও ছিলি।
আমাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো।
-তো এই কথা শুনেও বিয়ে করলে যে আমাকে?
-উপরওয়ালা তো বলেই দিয়েছে , আমি যদি যেমন আমার লাইফ পার্টনারও তেমন হবে। তোমাকে সাময়িক সময়ের জন্যে হারিয়ে আল্লাহ এর উপর থেকে সেই বিশ্বাসটা হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজকের পর থেকে সেটা আর হবে না ইনশাআল্লাহ।
-কেন? তুমি কি ভেবেছিলে? আমি ফয়সালের কাছে চলে গিয়েছি? আর তুমি নিজেই তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো। সেখানে আমার হারিয়ে গেলেই বা কি।
বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সাব্বির বলল
-কিহহহহহ!!!!!!! আমি কখন তোমাকে ডিভোর্স দিলাম?
-নতুন করে ঢং দেখানো শুরু করছ? তোমার বিছানার উপর রাখা ছিলো ডিভোর্স প্যাপার সেটা তোমার কোন বউয়ের জন্যে?
-ঐটা তো রিতু আপুর ছিলো!!!!!

শুনে আমি উঠে বসে হা হয়ে তাকিয়ে আছি!!!!
রিতু আপুর হাসবেন্ডের নামও সাব্বির। তারাতাড়ি ফোন নিয়ে ডিভোর্স প্যাপারের ছবি চেক করতেই সাব্বিরের বাবার নাম দেখে মাথা ক্লিয়ার হয়ে গেলো!!!!!
-আর তুই এইটাকে আমার আর তোর ভেবে এই সব আকাম কুকাম করছিস!!!! তোর খোজ জানতে তোর বাসায় গিয়ে মাইর খাইতে খাইতে বেচে গেছি আমি!
রাগী ভংগিতে বিছানায় উঠে বসে বলল ও।
এইবার তো শিওর তুই মুরগী হবি!!!!
আমি পড়িমরি করে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পরলাম।
কিন্তু দরজা লাগানোর আগেই ও ঢুকে গেলো!!!

-আম্মু, আব্বু, রিশাদ ভাইয়া সবাই কেমন আছে? লাঞ্চের জন্য বাইরে বেরিয়ে হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ও আমাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাটছে।
-আম্মু অনেক অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। সারদিন শুধু তোমার নাম নিতো আর কাদতো।
-সরি…
মনটা খারাপ হয়ে গেলো অনেক। মায়ের মতো এই মানুষটাকে অনেক কস্ট দিয়েছি আমি। ইচ্ছে করে তো দেয়নি।
-আম্মুর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার ছিলো। মামা মামিকে কম কথা বলেনি, মেহনাজ আপু আর সবশেষে তোমাকে নিয়ে। ওরা তো এই কস্টটা নিয়েই চলে গেলো। ভাইয়ার এই অবস্থার জন্যে শুধুমাত্র আম্মা দায়ী।
-তুমি কয়দিন আছো এখানে?
কিন্তু উত্তরে ও একটা রহস্যময় হাসি দিলো।

“তোমার সাহস অনেক বেশি। এতো সাহস পাও কোথা থেকে? ” সাব্বিরের এমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম
-কে বললো আমার অনেক সাহস !!! আমি একটা ভীতুর ছোট বাচ্চা।
-তোমাদের তাবলিগ ঘরে অনেক বেশি মশা।
-কথা ঘুরাচ্ছ কেন? আমাদের বাড়ির তাবলিগ ঘরে তুমি কবে ছিলা? বলেই ওর বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলাম।
সিডনি হারবার এর পাশে ওর বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
-তোমাদের উঠোনে অনেক সুন্দর চাঁদের আলো আসে!!!! তুমি দেশে আসলে এইবার একসাথে হালকা শীতের রাতে জোছনা দেখবো ।
-তার মানে তুমি…..!!!!
বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গেলো!!!!
-এক কাপ চা আমাকেও দিতে। এমনিতেও মশার কামড়ে সারারাত ঘুমোতে পারিনি । চা খেলে মন্দ হতো না।
বলেই ও আমার বুকে আঘাত করা সেই পুরনো হাসিটা দিলো!!
তাবলিগ ঘরে আম্মু বেচে থাকতে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে মাহফিল করতো। মাঝে মাঝে আশেপাশের মহিলারা নামাজ পড়তে আসে বলে এই ঘর কখনোই তালা দেয়া থাকে না।
-তুমি ওখানে না বসে থেকে আমার কাছে এসে বসতে!! অভিমানের স্বরে বললাম আমি।
-আমার প্রতি যে তোমার সেই পুরনো ভালোবাসায় আছে তখন বুঝতে পারলে ইউনিভার্সিটিতেও আমার সাথেই প্রেম করতে তুমি!!
-বাবা মায়ের মান সম্মান অনেক বড় জিনিস !!
-তোমার কস্টের পরিধি আমি কখনো আন্দাজ করতেও পারবো না। কিন্তু কথা দিচ্ছি এখন থেকে কোন কস্ট তোমাকে স্পর্শও করতে পারবে না।
আমাকে ওর বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো ও।

দশদিন কিভাবে কেটে গেলো টেরই পেলাম না।
হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখি ও পাশে নেই। বুকটা কেমন ধক করে উঠলো।
সারা ঘর খুজেও যখন পেলাম না, ফোনটা নিতেই দেখি ওর একটা ম্যাসেজ।
“হুট করে আবারও কোন একসময় চলে আসবো, কিন্তু বিদায়ের মুহূর্তের তোমার করুন চেহারা সহ্য করতে পারবো না। তাই তোমাকে ঘুমের মধ্যেই রেখে চলে আসলাম। আম্মু আর আব্বু তোমার এইখানে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। আমি জানি, আমার মেহের অনেক স্ট্রং। মন খারাপ করলে আমি থাকতে পারবো না দেশে। কান্নাকাটি করলে শিওর পরের বার এসে মুরগী বানাবো। ”

মুচকি হাসির সাথে চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

( বেচারি এখনো দেশের বাইরেই আছে 😁😁😁। পিএইচডির জন্যে আরও প্রায় দু বছর পরে আসবে। ওর আম্মু মানে শাশুড়ী আর ছোট ভাইয়া থাকে ওর সাথে। সাব্বির এফসিপিএস এর জন্যে দেশেই আছে।
তাই হয়তো প্রেমটা করা হয়ে উঠেনি তাদের। কিন্তু ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here