ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ২৮

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব-২৮

“মেহের, সত্যি করে বলতো তোর আর সাব্বিরের মধ্যে সবকিছু ঠিক আছে??? ”
ফুপির এমন প্রশ্নে ব্যাগ গুছানো বাদ দিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে সোফায় বসালাম।
-এই পাঁচ মাস পরে তোমার এই কথা মনে হলো কেনো?
আর একটু আগে মনে করতে পারলে না?মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম ফুপিকে
– তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি নারে। কি বলতে চাইছিস একটু স্পষ্ট করে বলনা!
-এইখানে বলাবলির কিছু নাই আম্মু। সবকিছু ঠিক না হলে করে নিতে হবে। আর তাও না হলে ছেড়ে যেতে হবে। জোড় করে সম্পর্ক করা যায় কিন্তু টেকানো যায় না।
-কি বলতে চাচ্ছিস তুই?
কান্না কান্না গলায় ফুপি জিজ্ঞেস করলো আমাকে।
ইচ্ছে করছিলো ফুপিকে বলি, তোমার এই বাদর ছেলেটাকে কান ধরে নিয়ে এসে একটু বলোতো আমাকে ভালোবাসতে! বিয়ের পর থেকে অনেক কস্ট দিয়েছে আমায়। এখন আবার ডিভোর্সও দিয়ে দিচ্ছে আমাকে!! জানুয়ারির ২৭ তারিখে পারমানেন্টলি ডিভোর্স হয়ে যাবে আমাদের!!!
-কিছুই হয়নি ফুপি। তোমার ছেলেটাকে আমি বুঝতে পারিনা। তাই একটু ঝামেলা হয়। এখন থেকে আর হবে না ইনশাআল্লাহ।
হওয়ার জন্যে তো আর আমি থাকবোই না এখানে, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে বললাম।
চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
এতোক্ষনে ফুপির মুখে হাসি ফুটলো।
কিছুক্ষন চুপ থেকে ফুপিকে বললাম,
আচ্ছা আম্মু, একটা প্রশ্ন করি তোমাকে? সত্যি করে উত্তর দিবা? প্লিজ..
-কি জানতে চাস, বল আমায়।
-দেখো, বিয়ের কথা তো অনেক আগেই তোমরা বলাবলি করতে। তোমরা না, তোমার ছেলে আরকি।
এই ব্যাপারে তোমার সম্মতি ছিলো আম্মু? সত্যি করে বলো তো?
টেনশন নিও না, আমি কস্ট পাবো না।
মাথা নিচু করে ফুপি বললো
-না রাজি ছিলাম না।
-আর মেহনাজ আপুর বেলায়?
-তখনও রাজি ছিলাম না?
-কেনো? আমাদের স্টেটাস তোমাদের সাথে ম্যাচ হয় না বলে? আমি না হয় দেখতে শ্যামলা ,আপুদের মতো ফরসা না, কিন্তু মেহনাজ আপুর বেলায় কি সমস্যা ছিলো তোমাদের?
ফুপি চুপ করে শুনছে আমার কথা গুলো। মায়ের মতো এই মহিলাকে কস্ট দিতে চাইনি আমি। কিন্তু দুই ছেলের এই অবস্থার জন্যে তিনিই দায়ী।

তাহলে আর কি, আমি চলে গেলে তোমার ছেলেকে ফরসা একটা মেয়ে দেখে, স্টেটাস দেখে আরেকটা বিয়ে করিও। আমাদের আসলেই কোনো যোগ্যতা নেই তোমার ছেলেদের বউ হবার।
ফুপি কান্না করে দিলো আমার কথা গুলো শুনে।
-তুই যেমনটা ভাবছিস তেমনটা নয় রে মেহের। রিশাদ এর জন্যে আমি দায়ী। আর তোর ছোট ফুপু। ওর জন্যে তোর আম্মাকে কত কথা শুনিয়েছি আমি!!
তোর আব্বু আম্মু তোদের ভালোভাবেই মানুষ করতে পেরেছে। আমরা পারি নাই।
-বাদ দাও। তোমরা যোগ্যতার কদর করতে জানো না। মেহনাজ আপুর যোগ্যতা আছে বলেই এতো ভালো একটা জায়গায় বিয়ে হয়েছে।
-সত্যিই রে, ঐদিন যদি তোর ছোট ফুপির কথা না শুনতাম….!
-তাহলে আজকে তোমার ছোট ছেলেকে নিজের পছন্দে বিয়ে করাতে পারতে আরকি। আমার মতো শ্যামলা মেয়েকে আনতে হতো না।
-তুই ও অনেক সুন্দর। বাইরের সৌন্দর্যে কি আসে যায়। তুই অনেক লক্ষি একটা মেয়ে।
-কিন্তু যদি সুযোগ পেতে তাহলে আমাকে আর বউ বানাতে না আর কি।
-যাহ, ফাজিল মেয়ে একটা। খালি কথা পেচায়।
তোর সব গুছানো শেষ? তোর এতো জিনিস কেনো?
মাত্র তো অল্প কিছুদিন।
মনে মনে এই ভয়টায় পাচ্ছিলাম।
-আরে তোমরা চার তারিখে ব্যাক করবা আমি তো করবো না।
-কেন? কই যাবি তুই? সত্যি করে বলতো মেহের????
-আরে আমার একটা কনফারেন্সে এটেনড করতে হবে মালয়শিয়ার পেনাং স্টেটের একটা ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু আমাদের প্যাকেজ শুধু মাত্র কুয়ালালামপুর পর্যন্ত। তাই তোমরা চলে আসবা ৪ তারিখ। আর আমি আসবো ৭ তারিখ।
-ও, আগে বলিসনি তো!! সাব্বির জানে?
-হুম জানবেনা কেন? সবই জানে ও।
আল্লাহ আল্লাহ করছি মনে মনে যেনো সাব্বিরকে কিছু না বলে এই ব্যাপারে । সাব্বিরকে কিছু বললেই সব শেষ!!

কালকে আমাদের ফ্লাইট ,তাই রাতে রিতু আপু, আপুর হাসবেন্ড এলো বাসায়।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসলাম। রিশাদ ভাইয়া আর সাব্বিরও বসলো সাথে!!
এই প্রথম এই ফ্যামিলির সব মেম্বার এক টেবিলে খেতে বসেছে!!!
-কি মেহের, সাব্বির তোমাকে মান্থলি কতো টাকা দিতো যে তুমি একেবারে বাইরে যাওয়ার প্যাকেজ কিনে ফেললে!!!
এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে মাথায় ছিলো না।
-মুচকি হেসে বললাম, ওকেই জিজ্ঞেস করুন কতো দিতো। আর আব্বু আম্মুর জন্যে টাকা জমাইতে হয় না, এমনি এমনি ম্যানেজ হয়ে যায়।
সাব্বির অপরাধির মতো তাকালো একবার আমার দিকে। কারণ বিয়ের পর কাবিনের টাকা ছাড়া একটাকাও দেয় নি আমাকে।
বউ বলেই যে ব্যক্তি আমাকে স্বিকার করে না, তার থেকে টাকার আশা করবো আমি কোন দুঃখে!!
-জামাই ছাড়া ভালোবাসার কমতি পরবে না?
-হাসবেন্ড পরিবর্তন হয়, সাথে ভালোবাসাও পরিবর্তন হয়। কিন্তু এই ভালোবাসার কোনো পরিবর্তন নেই। আর সেই আসল ভালোবাসার সোর্সটায় তো আমি নিয়ে যাচ্ছি, তাহলে কমতি কেনো পরবে?
-হুম বুজলাম। কিন্তু হাসবেন্ড ছাড়া হানিমুনে যাচ্ছো কেমন না ব্যাপারটা??
– আমি মানুষটাই একটু কেমন কেমন জানি। এইগুলা ব্যাপার না ভাইয়া। তার যখন হানিমুনে যাওয়ার দরকার হবে, তখন সে আমাকে নিয়ে যাবে।
মুচকি হেসে বললাম আমি।

পরের দিন সকালে সাব্বির সি অফ করতে এলো আমাদের। ছোট ভাইয়াও এসেছে। সাব্বিরকে দেখতেই ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। কারোর সাথে কথাও বললো না।
সাব্বিরের দিকে তাকাতে পারছি না আমি। এমন ফিলিংস জীবনে প্রথমবার হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জীবনের সবথেকে দামি জিনিস ফেলে যাচ্ছি আমি।
সাব্বির একটু কিছু বললে কি করে ফেলবো আমি জানি না। তার জন্যে ভাইয়ার কাছ ঘেঁষে মাথা নিচু করে বসে আছি। আর একটু পর পর বাম হাত দিয়ে চোখ মুচছি।
ছোট ভাইয়া আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে আছে।
সাব্বির বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে বুঝতে পারছি আমি।
-তোর সাথে দেখা হবে না আর?
ছোট ভাইয়া কান্নাভেজা গলায় জিগ্যেস করলো আমাকে।
কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। কান্না মাছের কাটার মতো গলায় অাটকে গিয়েছে। কথা বলতে গেলে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলবো আমি।
তুই সাব্বিরকে অনেক ভালোবাসিস তাই না রে?
অসহায়ের মতো আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম।
এইবার চোখের পানি আর রাখতে পারলাম না।
-তুই চলে যা, তুই না গেলে কান্না থামাতে পারবো না আমি।
কাঁদতে কাঁদতে বললাম ওকে।
একটু পর কপালে একটা চুমু দিয়ে ভাইয়া কাউকে কিছু না বলে চলে গেলো।
বাকিরা অবাক হলেও কিছু বললো না।
চেক ইন এর টাইম হয়ে গেলো।
ফুপা ফুপিকে নিয়ে সামনে এগিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। এই পর্যন্ত সাব্বিরের সাথে একটা টু শব্দও করিনি। ভেবেছিলাম ওর সাথে একটা কথাও আর কোনোদিন বলবো না।
কিন্তু মানুষের মনতো!!!

ফুপা ফুপিকে ট্রলিটা দেখতে বলে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলাম। খুব করে চাইছিলাম যেনো এসে দেখি সাব্বির চলে গিয়েছে।
কিন্তু আমাকে আরও কস্ট দেয়ার জন্যে বদমাইশ টা দু হাত পকেটে রেখে ঠোঁটের কোনায় হাসি রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর দিকে যেতে যেতে কি বলবো মনে মনে গুছিয়ে নিলাম।
কিন্তু ওর একদম কাছাকাছি দাঁড়াতেই সবকিছু কেমন জানি গুলিয়ে গেলো!!!!!
আমার সমস্ত চিন্তা চেতনার বাইরে গিয়ে ওকে জীবনে প্রথমবারের মতো জড়িয়ে ধরলাম!!
জড়িয়ে ধরেই বুঝতে পারলাম আমি সত্যি ওর জন্যে আনফিট।
কি বলার জন্যে এসেছিলাম সব ভুলে গিয়েছি!!!

-আমি আগে ভাবতাম তোমাকে জড়িয়ে ধরলে বুঝি হাইটে তোমার থুতনি পর্যন্ত আসতে পারবো। কিন্তু আর বাকি সব কিছুর মতো এই ব্যাপারেও আমি তোমার জন্যে আনফিট। তোমার থুতনি পর্যন্ত আসতে পারবে এমন কাউকে ভালোবেসো।
বলেই চোখভর্তি পানি নিয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে পিছন ঘুরে চলে আসলাম।
আর এই সময়টাতে সাব্বির একবারও ওর হাত প্যান্টের পকেট থেকে বের করেনি।
ভালোবাসার অপমানের কস্টের চেয়ে বেশি ভারি জিনিস বোধহয় আর কিছু নেই!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here