টুকরো স্মৃতির অতলে পর্ব -০৮

#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤
#পর্ব_০৮
লেখনীতে:আহানিতা

অর্কভাইয়ের সাথে সেদিনই আমার শেষ দেখা হয়েছিল।এরপর অার তার দেখা পাইনি।কখনো কাউকে জিজ্ঞেস ও করিনি উনার কথা।সময় সময়ের গতিতে চলতে লাগল।আমি অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে বিরক্ত হতে লাগলাম। কখন উনি আমার সামনে হাজির হবে তার অপেক্ষা।একটা বছরের অপেক্ষা।অথচ নিজেই জানি নাহ তার জন্য আমার অপেক্ষার কারণ।অপেক্ষা করার তো কথা নয় আমার।আমি তো ঘৃণা করি উনাকে। এভাবেই নিজের মন আর মস্তিষ্কের চরম লড়াইয়ে কেঁটেছে বেশ কয়মাস।কাঙ্খিত সেই একটা বছর পার হওয়ার পরও আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেলাম নাহ।কোন কোন দিন তীব্র মন খারাপে কেঁদে ভাসিয়েছি চোখ।কোন দিন বা অগোছাল হয়ে এলোমেলো চুল নিয়ে নিশ্চুপে ভেবেছি তার কথা।তার শেষ দিনের শেষ ইচ্ছেটা রাখতেই মাঝে মাঝে রাতে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আকাশ দেখার বাহানায়।সময় ঠিক সেভাবেই চলল আমার, যেভাবে আগের দুই দুটো বছর চলেছিল।তারপর হঠাৎ ঐ একদিন আহির সাথে রাস্তায় দেখা হলো।আমি ওকে দেখামাত্রই অর্কভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করব বলে মনকে স্থির করলাম।কিন্তু পরমুহুর্তেই মস্তিষ্ক চরমভাবে নিষেধ করল।আমি আর জিজ্ঞেস করলাম নাহ।আহির দিকে মিষ্টি হেসে শুধু কেমন আছে তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম।সেইদিনের পরও বেশ কয়দিন কেঁটে গেল।তারপর হঠাৎঐ আজ ভার্সিটি যাওয়ার পথে যা দেখলাম তাতে আমি আৎকে উঠলাম ক্ষনিকের জন্য। রাস্তায় আমার সামনেই একটা ছেলে এসে পড়ল হঠাৎ।চেহারাটা আমার চেনা।তবে ঠিক মনে পড়ছে নাহ কে এ।আমি আরো গভীরভাবে চেয়ে রইলাম। ছেলেটা ততক্ষনে কোনরকমে হাঁটু ঘেষে বসল আমার সামনে।হাতে পায়ে মারের চিহ্ন স্পষ্ট।মুখ আর হাত পা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ একে বেশ মেরেছে।নিজের ক্ষোভ যতক্ষন না মিটেছে ততক্ষনই বোধ হয়।কপালের দিকে লালচে দাগও পরেছে।পরনের শার্ট নোংরা হয়ে রয়েছে। ছেলেটা আমার পায়ের কাছে এসেই জোরে জোরে বলে উঠল,

‘ মে্ মেহুল, ক্ষমা করে দাও আমায়।প্লিজ ক্ষমা করে দাও।আমি তোমার সাথে যা করতে চেয়েছিলাম তার জন্য সত্যিই ক্ষমা চাইছি।ক্ষমা করে দাও মেহুল।’

আমি দ্বিধানিত চোখে চেয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে।আরো কিছুক্ষন তাকানোর পরই ছেলেটাকে চিনতে পারলাম আমি।ছেলেটা রিহান ভাই।অর্কভাইয়ের ফ্রেন্ডই হতো বোধ হয়।উনাদের ব্যাচেরই।যদিও কোনদিন অর্কভাইয়ের সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলতেও দেখিনি আমি উনাকে।তবে ভার্সিটি লাইফে দুই তিনবার উনাদের মারপিট দেখেছিলাম আমি।আমার সাথে রিহান ভাইয়ের আলাপটা ছিল ভার্সিটির সিনিয়র ভাই হিসেবেই। অবশ্য পরে সেই আলাপটাও আমি মুঁছে নিয়েছিলাম আমাকে প্রপোজ করার কারণে।কিন্তু ক্ষমা কেন চাইছেন উনি?সেদিন আমাকে প্রপোজ করার জন্যই ক্ষমা চাইছেন কি?কিন্তু এতদিন পর এই বিষয়টার জন্য ক্ষমা চাওয়াটা কি অদ্ভুত নয়?আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।উনি গড়গড়িয়ে মিনমিনে চোখ নিয়ে বলে উঠলেন,

‘ আমি যা করেছি ভুল করেছি মেহুল।তোমার সাথে এমন কিছু করার প্ল্যান করা অন্যায় হয়েছে মেহুল।কিন্তু আমি তো তোমার সাথে কিছু করিনি বলো?কিছুই তো করিনি আমি।তুমি তার আগেই পালিয়ে গিয়েছিলে।আমি তো তোমায় ছুঁয়েও দেখিনি মেহুল। ক্ষমা করে দাও আমায়।প্লিজ!’

আমি এবার চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম।কি বলছেন উনি? কোন বিষয়ের কথাই বা বলছেন?আমি ভ্রু কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম,

‘ কি বলছেন এসব?উঠুন। পরিষ্কার করে বলুন কি বলছেন।আমি বুঝতে পারছি নাহ।’

রিহান ভাই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বারকয়েক পেছন ফিরে চাইলেন আর শুকনো ঢোক গিললেন।আমি উনার দৃষ্টি বরাবরই পেছন ফিরে চাইলাম।নাহ!কেউ নেই ওখানে।তবে এত ভয় নিয়ে পেছন ফিরে এতবার চাইছেন কেন উনি?আমি কপাল কুঁচকে বললাম,

‘ আমার নাম নিয়ে সম্বোধন করে বলছেন যখন তখন আমাকেই বলছেন কথাগুলো নিশ্চয়।কিন্তু আমি আসলে আপনার কথা বুঝতে পারছি নাহ।দয়া করে বুঝিয়ে বলবেন?’

উনি কোনরকমে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর বারকয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলেই বলে উঠলেন,

‘ আ্ আ্ আমি রিহান।চিনতে পারছো?’

‘ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।কিন্তু কি বলছেন তা বুঝতে পারছি নাহ।’

উনি শুকনো ঢোক গিললেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ দুইবছর আগে আমিই তোমাকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করেছিলাম মেহুল।বিশ্বাস করো আমি তোমার সাথে খারাপ কিছু করার প্ল্যান কখনোই করিনি।কখনোই নাহ।আমি তো শুধু অর্কের সাথে শত্রুতা করেই তোমার আর অর্কের বিয়েটা ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম।তবে তোমার প্রতিও অবশ্য প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল।অর্কের সাথে আমার শত্রুতা টা সেই কলেজ লাইফ থেকেই চলে আসছিল। তাই যখন জানতে পেরেছিলাম অর্কের চেনাশোনা তুমি তাই তোমাকে পটানোর জন্যই পরিচিত হয়েছিলাম তোমার সাথে।বেশ ভালোই পরিচিতি গড়ে উঠেছিল।পছন্দ ও করতে শুরু করলাম তোমায়।কিন্তু তারপরও যখন প্রপোজ করার পর না করে দিলে আমার সম্মানে লেগেছিল বিষয়টা।তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই আমি এমনটা করেছিলাম।এর বাইরে কিছুই নয়।আমি তো তেমন কিছুই করিনি তোমার সাথে।বলো?করেছি কিছু?’

উনার সব গুলো কথা মন দিয়ে শুনেই থমকে দাঁড়ালাম।সব যেন মাথার উপর গেল আমার।কি বলছে এই লোক?এই লোকটা অর্কভাই আর আমার বিয়ে ভাঙ্গার জন্যই সেইদিন আমার সাথে এমনটা করেছিলেন?অদ্ভুত।অর্কভাইয়ের সাথে আমার বিয়েটা তো এমনিতেও হতো নাহ। উনি তো আমায় ভালোবাসতেন নাহ। তবুও এত ষড়যন্ত্র করার কি ছিল এই লোকের?আমি ছোটছোট চোখে তাকাতেই উনি আবারও বলে উঠলেন,

‘ আমি তোমায় অর্কের সাথে শত্রুতা করে পটাতে চাইলেও এক পর্যায়ে তোমায় পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম মেহুল।কিন্তু তুমি আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলে।আমি ভেবেছিলাম সেইদিন তোমার নামে এমন কোন বদনাম অথবা আমায় আর তোমায় নিয়ে কিছু একটা রটে গেলে তুমি আমায় বিয়ে করতে। আমার আর তোমার বিয়ে হতো।কিন্তু কিছুই হলো নাহ।কিছুই নাহ।’

অমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলাম কেবল।শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

‘ তারপর?তারপর আমি পালিয়ে আসার পর চুপ হয়ে গেলেন?আর এতগুলো দিন পরই বা ক্ষমা চাইতে আসলেন কেন?’

‘ তুমি পালিয়ে আসার পর ওদের তিনজনের উপর খুব রেগে গিয়েছিলাম।কিন্তু যখন অর্ক জেনেছিল ওরা তিনজন তোমার সাথে কিছু করার চেষ্টা করেছে তখনই ভয়ে গুঁটিয়ে গিয়েছিলাম।কারণ অর্ককে আমি চিনতাম।ও ওর প্রিয় কিছুর উপর আঘাত সহ্য করতে পারে নাহ।তাই কিছুদিন পালিয়ে ছিলাম।তারপরই হঠাৎ ইউ কে তে যাওয়ার ডেইট পরে গেল।আমি চলেও গেলাম।তারপর অতোসব আমার মনেই ছিল নাহ।এই কয়দিন আগেই দেশে ফিরেছি।জানতাম নাহ অর্ক এখনো ওটার মাসুল তোলার জন্য অপেক্ষা করছে।আমি সত্যিই আমার আগের কাজ গুলোর জন্য অনুতপ্ত মেহুল।ক্ষমা করবে না আমায়?’

আমি চুপ রইলাম।লম্বা শ্বাস ফেলে বললাম,

‘ আপনার এমন দশা কি অর্কভাই ঐ করেছে?এভাবে বিচ্ছিরি ভাবে কে মেরেছে আপনাকে?অর্কভাই?’

উনি আমার কথাটার উত্তর না দিয়েই বলে উঠলেন,

‘ ক্ষমা করবে না আমায়?’

আমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম।কিছুক্ষন উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ ক্ষমা?’

‘ হ্যাঁ ক্ষমা।’

কথাটা বলেই উনি আমার পা আগলে ধরলেন বসে পড়ে।আকস্মিক পা ধরায় আমি চমকে তাকালাম।উনার হাত পা থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়েই বললাম,

‘ এই,কি করছেন আপনি এসব।পা ছাড়ুন। ছাড়ুন বলছি।’

উনি আমার কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলতে লাগলেন,

‘ আমায় ক্ষমা করে দাও।প্লিজ।ক্ষমা করে দাও।একবার শুধু বলো ক্ষমা করে দিয়েছো।প্লিজ।’

আমি কিছুটা সময় চুপ থেকেই বললাম,

‘ ক্ষমা চাওয়ার কিছুই নেই রিহান ভাই।ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিয়েছি।আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এতেই খুশি।’

উনি পা ছাড়লেন তারপর।আমার দিকে তাকিয়েই কিছু বলবে তার আগেই আমি উল্টো প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘ ভয় পাচ্ছেন কেন আপনি?ভয় পাওয়ার মতো কিছু কি আপনার সাথে ঘটেছে?অর্কভাই?অর্কভাই কিছু করেছে আপনার সাথে?’

উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন,

‘ নাহ।না, অর্ক কিছ করেনি।’

কথাটা বলেই উনি খুব দ্রুত ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন যেন।আমি স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলাম কেবল। তারপই মোবাইলে অর্কভাইয়ের নাম্বারটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম নাহ।অবশ্য কোনকালে মোবাইলে অর্কভাইয়ের নাম্বার সেইভ করেছি বলেও মনে পড়ছে নাহ আমার।আহির নাম্বারটা পেয়ে ঐ নাম্বারেই কল লাগালাম আমি।আহি কলটা রিসিভ করতেই আমি কিছু বলার আগেই আহি বলে উঠল,

‘ তুমিও কি এখন তোমার বন্ধুর হয়ে সুপারিশ করার জন্য কল দিয়েছো মেহুল আপু?উনি আমাকে ভালোবাসবেন কেন?আজব!আমি তো কেবল বন্ধুত্ব করেছি উনার সাথে। তাই বলে উনি ভালোবাসতে যাবেন কেন আমায়? আমি রাজি না উনাকে ভালোবাসতে বলে দিও উনাকে।উনি একবার নাহ ছ্যাঁকা খেয়ে ছ্যাঁকাখোর হয়েছিলেন তাও এত ভালোবাসার শখ কেন উনার?আমি রাখছি।একদম সুপারিশ করার জন্য দ্বিতীয়বার কল দিবে নাহ মেহুল আপু।’

আমি অবাক হলাম।আহি যে রায়হানের কথাই বলছে তা বুঝতে
আমার বাকি নেই।কিন্তু কল ধরতে না ধরতেই এভাবে গড়গড় করে কথাগুলো বলে যাওয়ায় তব্দা খেলাম আমি।কল কাঁটার আগে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলাম,

‘ এই, শোন, আমার কথাটা শোন।’

ও আমার কথাটা শুনল নাহ।কল কেঁটেই দিল।আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে এবার কল লাগালাম রাতুল আঙ্কেলের নাম্বারে।উনি কল রিসিভ করতেই সালাম জানালাম।উনি সালামের উত্তর জানিয়েই বলে উঠলেন,

‘ হঠাৎ এই বুড়োর কথা মনে পড়লো কেন মা? এতদিন তো খবর নিস নি একবার ও। ‘

আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকেই বললাম,

‘ আপনিও তো নেন নি আঙ্কেল।’

‘ তা ঠিক।কিন্তু আমি তো জানতাম আমার মেয়েটা ভালো নেই।ঐ যে তখন বলেছিলাম, ধুঁকে ধুঁকে মরবি।তেমনটাই তো ছিলি।তাই না?’

আমি হালকা হাসলাম।তারপরই বললাম,

‘ তাও খবর নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না।আবার মেয়েও বলছেন?’

উনি হেসেই বললেন,

‘ তীব্র কষ্টের পর জীবনে সুখ আসলে সুখটা আরো ভলোভাবে গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করা যায়।আমি চেয়েছি আমার মেয়েটা নিজের সুখের জীবনটা নিজে বুঝে নিক।’

‘ মানে?’

‘ অতো বুঝে তোর কাজ নেই মা।বল কি বলবি মা?’

আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।অর্কভাইয়ের কথা এতদিন কাউকে জিজ্ঞেস করিনি।আজ হুট করেই অর্কভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করাটা বেমানান হবে না?কি না কি ভাবে।তাই আর জিজ্ঞেস করলাম নাহ।হেসেই বললাম,

‘ কিছু নাহ।রাখি আঙ্কেল।ভালো থেকো।’

উনি হাসলেন।তারপরই বললেন,

‘ অর্ককে খুঁজছিস?’

আমি কাঁপা কন্ঠেই বললাম,

‘ ক্ কি বলছেন আঙ্কেল?উনাকে কেন খুঁজতে যাব আমি?রাখছি।’

কথাটা বলেই কল কাঁটলাম।জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম। হাত পা কাঁপছে।যেন আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম আমি।আরেকটু হলেই যেন আমার সব সত্যি জেনে যাচ্ছিল।কি সাংঘাতিক ভয়!

#চলবে….
#টুকরো_স্মৃতির_অতলে❤️
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃআহানিতা

বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টুকু দেখছিলাম কেবল।কখন এই বাসা থেকে বেরোনো যায় সেটাই একপ্রকার চিন্তা এখন।হঠাৎই খাবার খাওয়ার জন্য ডাক পড়তেই সবাই গিয়ে খাওয়ার টেবিলে হাজির হলো।আমিও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।টেবিলে ঠিক আমার মুখোমুখি বসলেন অর্কভাই।এবার যেন অস্বস্তিতে দমে উঠল আমার মন।উনার দিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে না পেরেই খাবার খাওয়ায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা চালালাম দ্রুত।কিন্তু অবাধ্য চোখ জোড়া কি এত সহজে হার মানে?আমি না চাওয়া স্বত্ত্বেও চোখজোড়া উনার দিকেই দৃষ্টি ফেলল।তখন ও কোন সমস্যা ছিল নাহ কিন্তু যখন দেখলাম উনিও আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তখনই অস্বস্তিতে হাত পা ঘেমেউঠল।খাবার যেন আর গলা দিয়ে নামছে নাহ।চোখজোড়া চোখাচোখি হতেই আমি তৎক্ষনাৎ চোখ সরালাম।যেন কোন এক যুদ্ধ থেকে পলাতক কোন যোদ্ধা আমি।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মুখে এক গ্রাস খাবার দিয়েই আবারো তাকালাম উনার দিকে।উনি ঠিক সেভাবেই স্থির ভাবে তাকিয়ে ছিলেন।আমি দ্বিতীয়বার অস্বস্তিতে চটফটিয়ে উঠলাম।বিরক্ত যেন মাথার মধ্যে ভনভন করে উঠল। খাবার নিয়ে ঠিক সেভাবেই বসে রইলাম।আর কোন খাবার গলা দিয়ে নামল না আমার।উনি যে ঠিক সেভাবেই চোখ স্থির করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা বুঝতে পেরেই চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইলাম।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কেবল এই চেয়ারটা ছেড়ে উঠার অপেক্ষা!

ঠিক তখনই আহি বলে উঠল,

‘ এমাহ!মেহুল আপু?খাচ্ছো না কেন তুমি?’

আমি ড্যাবড্যাব করে তাকালাম আহির দিকে।আড়চোখে অর্কভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উনাকে সেভাবেই থাকতে দেখে দ্রুত চোখ সরালাম আবার।হালকা কেঁশেই বলে উঠলাম,

‘ এমনি, এমনিই।’

মেঘা বা হাত দিয়ে গুতা দিয়েই পাশ ফিরে চাইল আমার দিকে।ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ এমনিই?’

আমি কোনভাবে উত্তর দিলাম কেবল,

‘ হু।’

তারপর অবশ্য মেঘা আর কোন কথা বলল না।ও ওর মতো খেতে লাগল।অর্কভাই আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেই হয়তো মুচকি হাসলেন।আমি আরেকবার তাকাতেই চোখ টিপে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়েই বাঁকা হাসলেন উনি।আমি আর এক মুহুর্তও বসে না থেকে সোজা উঠে দাঁড়ালাম।লজ্জ্বা পাচ্ছি কিনা বোধগম্য নয় আমার। কিন্তু হাত পা হালকা কাঁপছে আমার।অস্বস্তি, লজ্জ্বা সব যেন একসাথেই কাজ করতে লাগল।তাই উঠে পড়েই হাত ধুঁয়ে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।আন্টিকে গিয়ে কিচেনে খুঁজেই বলে উঠলাম,

‘ আন্টি খাওয়া শেষ।আমি যাচ্ছি তবে?দেরি হয়ে যাবে।’

উনি মৃদু হেসেই বলে উঠলেন,

‘ উহ! এত তাড়া কীসের তোর?মেঘা তো ইহানের সাথে যাবে তাহলে তুই তো একা।’

আমি দ্রুত বললাম,

‘ সমস্যা নেই আন্টি।আমি পারব। পারব যেতে।’

আন্টি আমার কথাটাকে সেভাবে না নিয়েই বলে উঠলেন,

‘ উহ।চুপ করে বস তো গিয়ে।মাত্র তো খেলি।একটু বসে তারপর যাবি।অর্ক পৌঁছে দেবে।ওর তো আজ অফিস নেই।ফ্রীই আছে।তুই একা যাওয়ার থেকে অর্ক পৌঁছে দেওয়াই বেটার না মা?’

আমি মুখ কালো করেই বলে উঠলাম,

‘ নাহ আন্টি।আমি একা যেতে পারব আন্টি।’

‘ চুপ কর তো।গিয়ে বস।অর্ক পৌঁছে দেবে।বড়দের কথার উপর কথা বলতে নেই জানিস তো?’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম কেবল।তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।

.

দুপুরের তড়তড়ে রোদটা এখন আর নেই।হালকা পিনপিনে বাতাস বইছে চারপাশে।পাশেই অর্কভাই বেশ আরাম করে বসে ড্রাইভ করছেন।হেলেদুলে থাকা সূর্যের একটু আলো গাড়ির গ্লাস ভেদ করে এসে পড়ল উনার মুখে।আমি স্তব্ধ হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম।এক ধ্যানে তাঁকিয়ে উনার কপালে পড়া চুল, খোঁচা দাঁড়ি আর চোখজোড়া দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।কিন্তু হঠাৎ ঐ ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন অর্কভাই।বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম চলে এসেছি। নেমে পড়ার আগেই উনি আমার দিকে তাকিয়েই কড়া গলায় বলে উঠলেন,

‘ এভাবে হাবার মতো তাকিয়ে আছিস কেন তুই?’

আমি দ্রুত চোখ সরালাম।কাঁপা কন্ঠে দ্রুত মিথ্যে বলে উঠলাম,

‘ ক্ ক্ কী বলছেন?আমি?’

উনি বাঁকা হাসলেন।ভ্রু উঁচু করে বললেন,

‘ অবশ্যই তুই।এখানে কি অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছিস তুই?’

‘ ক্ কই নাহ তো।আমি তো ওপাশের রাস্তাটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।’

উনি সেভাবে থেকেই বললেন,

‘ তাই নাকি?লুকিং গ্লাসে বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল তুই যে ওপাশের রাস্তাটা দেখছিলি।কিন্তু আই হ্যাভ এ ডিপ কোইশ্চেন মিস মেহুলতা।কোনভাবে আমার প্রেমে টেমে পড়ে যান নি তো?তাহলে কিন্তু সাংঘাতিক বিষয় হয়ে যাবে।খুব সাংঘাতিক।’

কথাটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলেন উনি।আমি চোরের মতো দৃষ্টি সরিয়ে লজ্জ্বায় কাচুমাচু করে বসে রইলাম।আমি যে বারংবার ধরা পড়ে যাচ্ছি তা বেশ বুঝতে পারছি।মাথা নিচু করে বসে থাকার এক পর্যায়েই উনি ফিসফিসিয়ে কানের কাছে বলে উঠলেন,

‘ এত লজ্জ্বা কি তোকে মানায়?’

আমি বিস্ফোরিত চোখে চাইলাম।আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,

‘ ল্ লজ্জ্বা?’

উনি মৃদু হাসলেন।হাতের ঘড়িতে সময় দেখেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ হ্যাঁ।লজ্জ্বা। লজ্জ্বায় তোর মুখ লালরাঙ্গা হয়ে আছে।বিশ্বাস করিস না?আয়নায় দেখ।’

আমি চোখ তুলে সামনের আয়নাটায় তাকালাম।উনি লুকিং গ্লাসে নিরন্তর ভাবে চেয়ে আছেন।উনার দৃষ্টির এই চাহনিতে বারবার আমার হৃদয় কম্পিত হলো যেন।বারবার উনার চোখে চোখ পড়তেই যেন এক গাঁধা অস্বস্তি এসে ভর করল আমার মধ্যে।আমি হাত জোড়া বারংবার কছলে নিয়ে মাথা তুলে বললাম,

‘ ক্ কই নাহ তো।মিথ্যে বলছেন আপনি।’

উনি নিঃশব্দে হাসলেন।তারপরই বললেন,

‘ মিথ্যে তো তুই বলছিস।ভালোবাসা কি মিথ্যে বলতে শেখায় মিস মেহুলতা?শেষ পর্যন্ত প্রেমে ট্রেমে পড়ে গড়গড় করে মিথ্যা বলা শিখে গেলি মেহুল?তাও পাক্কা মিথ্যুকের মতো মিথ্যে বলা?আ’ম ভেরি শক্ড!’

‘ মিথ্যা?কি মিথ্যে বলছি আমি?’

উনি আমার দিকে হালকা ঝুকলেন।তৎক্ষনাৎ নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার প্রয়াস আমার।চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,

‘ যদি বলি সব মিথ্যে? যদি বলি এতক্ষন পর্যন্ত বলা সব কথা মিথ্যে তোর?যদি বলি তুই সবটা মিথ্যে বলছিস?সত্যতার কোন প্রমাণ কি অাধো আছে তোর কাছে?আমার কাছে কিন্তু সবটার প্রমাণ আছে।’

আমি তৎক্ষনাৎ কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলাম,

‘ প্ প্রমাণ?কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?কি প্রমাণ?কোন প্রমাণ নেই আপনার কাছে।’

উনি হাসলেন।আমার দিকে আরেকটু ঝুকেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ এই যে আমার চোখজোড়া।এই যে আমার হৃদয়।এই যে তোর অনুভূতি।তোর লালাভ মুখটা কিন্তু আমার চোখজোড়া একমুহুর্তেই ধরে নিয়েছে।তুই কি ঐ চোখজোড়াকে প্রমাণ হিসেবে ধরবি না?এই যে তুই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি সবটা পথ তাও কিন্তু আমার ঐ চোখজোড়ায় ধরে নিল।তুই কি বলতে চাস আমার চোখজোড়া প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয় তার?এই যে তুই ভালো্…’

কথাটা বলতে লেগেই উনি থেমে গেলেন আবার।তারপর একটা নিঃশ্বাস নিয়েই আবার বললেন,

‘ এই যে তুই আমায় ভালোবাসিস। এটা কিন্তু আমার হৃদয় বেশ ভালোই বুঝে। বুঝলি?এই যে আমাকে নিয়ে তোর অনুভূতি তাও তো আমি বেশ বুঝে নিয়েছি।অথচ তুই বললি আমায় ভালোবাসিস নাহ।এটা কি ঢের মিথ্যে বলা নয়?তাও বলবি আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই?এসব প্রমাণ কি যথেষ্ট নয় তোকে মিথ্যুক প্রমাণ করতে?’

আমি স্থির চোখে চেয়ে রইলাম।উনি একটু বেশি ঝোকায় উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ল আমার ঘাড়ে।কানের কাছে উনার ফিসফিসানো কন্ঠটা বারংবার বাঁজতে লাগল কেবল।উনি লুকিং গ্লাসে একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কয়েক সেকেন্ড পর চোখ বন্ধ করেই সিটে হেলান দিয়ে বসলেন।আমি উনার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম।উনি চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠলেন মৃদু কন্ঠে,

‘ একবার বলবি ভালোবাসি?’

আমি নির্বাক হয়ে তাকালাম।উনি করুন চাহনিতে তাকিয়েই বললেন আবারও,

‘ বলবি একবার? “ভালোবাসি” শব্দটা?’

আমি হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকিয়েই বললাম,

‘ মানে?’

উনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

‘ ওকে নো প্রবলেম। বলিস নাহ।জোর করছ নাহ।কিন্তু একদিন আসবে অবশ্যই যেদিন তুই আমায় ভালোবাসি বলবি।রাইট? ‘

আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে বসে রইলাম নাহ।দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে তড়িগড়ি করে পা বাড়ালাম ওখান থেকে।যার ফলে অর্কভাইকে বাই বলার প্রয়োজন বোধ ও করলাম না।উনার দিকে পেছন ফিরে দ্বিতীয়বার তাকালাম ও না।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here