#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৭
#আফনান_লারা
________
শরবতটাকে সন্দেহ হলো ফারাজের।কিন্তু কি আর করার।এত স্বাদের শরবত তাও আবার এত গরমে তো হাত ছাড়া করা বোকামি।যদি পঁচা পানি দিয়ে বানিয়ে রাখে তো আল্লাহ বিচার করবে ওর।
শরবতটা খেয়ে শান্তি মতন দম ফেলে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে ফারাজ।
সিয়াম খালি গ্লাস নিয়ে পূর্ণার কাছে চলে এসেছে।
পূর্ণতা সিয়ামের কাছে জানতে চাইলো ফারাজ শরবতটা খেয়েছে কিনা।আসলে শরবতটা পূর্ণতা সাপ্লাই পানি দিয়েই বানিয়েছিল।ফারাজ শরবত খেয়েছে শুনে সে খুশি হয়ে দেয়ালে হাত রেখে দরজা দিয়ে উঁকি দিলো দেখার জন্য।তাকাতেই ফারাজের সাথে চোখাচোখি হলো তার।ফারাজ ও এদিকেই তাকিয়ে ছিল।
ফারাজের চোখে চোখ পড়তেই পূর্ণতা লজ্জা পেয়ে মুখ সরিয়ে নিলো।
এভাবে তাকাতেই ফারাজকে দেখবে তা ভাবেনি সে।ফারাজ ও ভাবেনি পূর্ণতা এমন করে উকি দেবে।
দুজনেই এখন বিড়ম্বিত।
সিয়ামের আরেকটা বাজে স্বভাব আছে।আর তা হলো সে দুটো ব্যাক্তির মাঝে প্যাঁচ লাগাতে নাম্বার ওয়ান।
তাকে কেউ কোনো কিছু গোপন রাখতে বললে সে ঐ কথা ঐ ব্যাক্তির সামনে গোপন রাখার নাটক করে,তারপর দিনশেষে সেই কথা গিয়ে লাগিয়ে দেয়।
এখন সে চলেছে দাদাজানের কাছে।পূর্ণতা ফারাজকে শরবত বানিয়ে খাইয়েছে,এটা বলতে হবে।
দাদাজান সেসময় তফসি নিয়ে বসেছিলেন।
দরজার কড়া নেড়ে সিয়াম ধীরে ধরে দরজা ফাঁক করে চেয়ে দেখে দাদাজান ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।
‘আসবো দাদু?’
‘এসো’
‘একটা জরুরি কথা বলার আছে’
‘বলো’
‘পূর্ণতা ম্যাম কি করেছো জানো?উনি ফারাজ ভাইয়াকে শরবত বানিয়ে খাইয়েছেন এবং সেটা তোমায় বলতে নিষেধও করেছে’
দাদাজনের মেজাজ গেলো বিগড়ে।সিয়াম মিথ্যে বলছেনা এটা নিশ্চিত তিনি।কারণ ওদের মাঝে যে কিছু একটা চলছে তা নিয়ে দাদাজান নিজেও অবগত।রাগ হচ্ছে ভীষণ।অরিন্দমকে খুব জলদি খবর দিতে হবে।তফসি রেখে ড্রয়ার খুলে একটা খাতা আর কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসলেন তিনি।
অরিন্দমকে পাঠাবেন।জরুরি কথা লিখছেন অক্ষরে অক্ষরে।সিয়াম ভেজাল লাগিয়ে চলে গেছে তার অন্য কাজে।দাদাজান গোটা চিঠিটা লিখে মতিনকে ডাক দিছেন।
মতিন আসার পর তার হাতে চিঠিটা দিয়ে তিনি বললেন পোস্ট করে আসতে।ঠিকানায় লিখেছেন অরিন্দমের শেষে পাঠানো চিঠিটার ঠিকানায়।
মতিন তার আদেশমতে চলে গেছে।দাদাজান মনে মনে ভীষণ খুশি।অরিন্দম আসলেই এই বিষয়ে একটা পথ বের হবে, আপাতত ফারাজের জন্য মেয়ে দেখা চালু থাকুক।
ফারাজ সোফাতেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।পূর্ণতা ডাইনিং টেবিলে খাবারের প্লেট সাজাতে গিয়ে ওকে ঘুমন্ত দেখে ডানে -বামে তাকিয়ে দেখে নিলো দাদাজান আছেন কিনা।যেইনা সে উপরে তাকালো ওমনি দাদাজানকে দেখলো দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।
পূর্ণতার মুখ ভর্তি ভয়ের ছাপ এসে গেলো,গলা শুকিয়ে গেলো।হাতের কাঁচের প্লেটটা শক্ত করে ধরে সে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু।দাদাজান মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছেন আবার।পূর্ণতাকে যেন আভাস দিয়ে গেলেন বিপদ সংকেতের।সে আর এক মিনিট ও ওখানে দাঁড়িয়ে থাকেনি।এক দৌড়ে পালিয়েছে,আর পেছনেও ফিরে দেখেনি।
ওদিকে ফারাজের ঘুমটা ভেঙ্গে গেছিল মশার কামড়ে।চোখ খুলতেই পূর্ণতাকে দৌড়ে যেতে দেখলো সে।মাথায় আসলো সে কোনো উল্টাপাল্টা কাজ করেনি তো??অনেকসময় দেখা যায় ছেলেরা ঘুমিয়ে থাকলে মেয়েরা ধরে মেকআপ করিয়ে দেয়।সেই ভয়ে ফারাজ নিজের গালে হাত দিয়ে,ঠোঁটে হাত দিয়ে সব চেক করে উঠে আয়নার দিকে ছুটলো।পূর্ণাকে একটুও বিশ্বাস নেই।এই কাজ আর কেউ না পারুক সে অবশ্যই পারবে।
আয়নার সামনে এসে নিজের মুখটা ঠিকঠাক দেখে দম ফেলে ফারাজ।তাহলে পূর্ণতা দৌড় দিয়েছিল কেন?
পূর্ণতা রান্নাঘরে বাটিতে ডাল নিচ্ছিল।দরজার কাছে এসে ফারাজ বললো,’আপনি ড্রয়িং রুমে কি করছিলেন?’
‘কিছু করিনি তো’
‘তাহলে দৌড় দিলেন কেন?পালানো তো চোরের লক্ষণ, নিশ্চয় কিছু একটা করেছেন।তা নাহলে দৌড় দেয়ার কারণ তো পাচ্ছিনা’
‘ঐ আসলে এমনি দিছিলাম।মাঝে মাঝে দৌড় দেয়া ভাল।রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকে’
‘ওহ। তাই আমার সামনে দিয়ে দৌড় দেবেন?আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন?’
‘চলে যান।দাদাজান দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিবে’
‘এত সহজ না’
পেছন থেকে দাদাজান এসে ফারাজের ঘাঁড়ে হাত রেখে বললেন,’খুব সহজ।শুধু মসজিদে গিয়ে বিয়ে পরিয়ে দিব। এর চেয়ে সহজ আর কিছু নেই’
———-
আনাফ চলে যাবার নাটক করে বসে আছে সারথি থেকে দশ হাত দূরে।
আনাফ চলে গেছে ভেবে সারথি সোফা থেকে উঠে দেয়ালে হাত রেখে অধরাকে বললো ওকে একটা রুম দেখিয়ে দিতে।
অধরা সেসময় আনাফের দিকে তাকায়।আনাফ ইশারা করে বলে সারথি যেন নিজে পছন্দ করে।
‘আপু তুমি নিজেই পছন্দ করে নাও না’
‘কি করে?আমি তো দেখতে পাইনা’
‘আমি তোমায় কি কি আছে বলে দিচ্ছি,তুমি বলবে কোন রুম তোমার পছন্দ হয়।
সামনে দুটো রুম আছে,একটাতে বারান্দা বড়,আরেকটাতে ছোট।ছোট বারান্দায় আবার গ্রিল নাই,বড় বারান্দায় গ্রিল আছে।ছোট বারান্দার রুমটা আবার বড়।অপরদিকে অন্য রুমটা ছোট।
বাকি ফার্নিচার সব সেম।
বলো কোনটাতে থাকবে?’
‘ছোট বারান্দা যেটাতে ওটাতে থাকবো।আমাকে দিয়ে এসো।মুখ ধুবো আমি’
অধরা ওর হাত ধরে সেই রুমটাতে দিয়ে এসেছে।সারথি দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমের দিকে চললো।আনাফ তখন সেই রুমে ঢুকা ধরতেই অধরা তাকে আটকে বললো,’তোমাদের এখনও বিয়ে হয়নি’
‘তো?আমি কি রোমান্স করতে যাচ্ছি নাকি?বউ আমার যদি পা পিছলে পড়ে যায়?’
‘এক কাজ করো,বিছানায় বসিয়ে তুমি পানি এনে মুখ ধুইয়ে দাও’
‘দরকার হলে সেটাই করবো।তোর কি?যা বুয়া কি বানায় দেখে আয়।আমি আমার বউ পাহারা দিচ্ছি’
অধরা বিড়বিড় করতে করতে চলে গেছে।
আনাফ যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ করে সারথির জন্য তোয়ালে লাগবে ভেবে আলমারিটা খুলে তোয়ালে নিয়ে বিছানায় রেখে আবার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো আনাফ।সারথি বেরিয়েছে।বিছানার কাছে এসে বসতেই হাতের কাছে তোয়ালে পেয়ে খুশি হয়ে মুখ মুছে নিলো।আনাফ আয়নার দিকে চেয়ে থেকে সারথিকে দেখছে।একটা মানুষ এত সুন্দর কেমনে হয়!এমন একটা মেয়েকে সজীব উপেক্ষা করে!!শুধুমাত্র মেয়েটা অন্ধ বলে?এটা ঠিক করেনি সজীব।একদিন পস্তাবে।
সারথি বিছানায় হাত দিয়ে চাপ দিয়ে বললো,’এত শক্ত!এই বিছানায় তো জীবনেও ঘুম আসবেনা।’
কথাটা শুনে আনাফ অন্য রুমে গিয়ে তার পরিচিত এক ফোমের দোকানদারকে কল দিয়ে বললো এক ঘন্টার মধ্যে ফোম নিয়ে আসতে।এরপর আবার সে রুমে গেলো দেখতে।এসে দেখলো সারথি দেয়াল ধরে ধরে রুমের প্রতিটা ফার্নিচারের অবস্থান চেক করছে।আনাফ ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল সেসময় ওর গায়ের সাথে লেগে ফুলের টব একটা পড়ে যাওয়া ধরতেই আনাফ সাথে সাথে ধরে ফেললো সেটা।কিন্তু আওয়াজ হওয়ায় সারথি থেমে গিয়ে পেছনে ফিরে বললো,’কে?’
আনাফ চুপ করে আছে।
সারথির সন্দেহ হলো।সে এদিকেই আসছে এবার।আনাফ যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।সারথি ওর একদম সামনে এসে হাত বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলটা ধরে দেখে আবার চলে গেছে।আনাফের বুকের ভেতর ডিপডিপ করছিল।আর একটুর জন্য ধরা খেতো সে।আর থাকা যাবেনা বুঝতে পেরে চলে আসলো আনাফ।
মা বারবার কল করছে।এবার রিসিভ করতেই তিনি হাজারটা বকা দিয়ে তারপর ক্ষান্ত হলেন।আনাফ ধীরে ধীরে বললো সে অধরার কাছে আছে।এবার মা আর কিছু বলেননি,বরং খুশি হলেন।অধরা কেমন আছে জানতে চাইলেন।আনাফ ফোন অধরাকে ধরিয়ে পুনরায় সারথিকে দেখতে আসে।সে তখন বারান্দাতে।আসলেই বারান্দাটা আকারে ছোট। আট কদম হাঁটলেই জায়গা শেষ।রেলিংয়ে হাত রেখে সারথি ভাবছে এর উচ্চতা কেমন হতে পারে।আনাফের আবার ভয় হলো।না জানি কবে ঝাঁপ দেয় এই মেয়ে।নিচে তাকিয়ে তার কলিজা কেঁপে উঠেছে।দোতলা বলে কম উঁচু না।ভালই উঁচু।
পড়লে মৃত্যু না হলেও হাঁড়গোড় ভাঙ্গতে পারে।কি করা যায়!!
সারথির বারবার মনে হচ্ছে তার আশেপাশে কেউ না কেউ আছে।কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছেনা,এমন কেন মনে হয়।অধরা তো থাকলে কথা বলতো।আর কে হতে পারে?
দেয়ালে হাত রেখে সারথি এগোতে এগোতে আবারও জানতে চাইলো ওখানে কে।আনাফ এবার কোথায় যাবে!সারথির সাথে সাথে সেও ছোট বারান্দায় ফেঁসে গেছে।এদিকে সারথি কদম ফেলছে আর জানতে চাইছে কে আছে এখানে।আনাফ পিঠ দেয়ালে লাগিয়ে ভয়ার্ত চোখ নিয়ে সারথিকে দেখছিল।সারথি আর এক কদম ফেললেই আনাফের বুকের সাথে লেগে যাবে তখনই অধরা এসে ওর হাত ধরে বললো,’আমি আপু।আমি আছি এখানে’
এই কথা বলে সে আনাফকে সরিয়ে ফেলে।আনাফ ও দম ফেলে চলে যায় ওখান থেকে।
———–
লেভেনের বাবার সাথে আজ সকালের নাস্তা খেতে যাওয়ার কথা সজীবের।ওনার সাথে দেখা করার কথা উঠলেই সজীবের সেই রাতে আর ঘুম হয়না।চিন্তায় চিন্তায় রাত কেটে যায়।উনি বড়ই কঠোর মনের মানুষ,তার ব্যবহারে গম্ভীরতা বেশি।ওনার করা প্রশ্নে সজীব প্রায় সময় এলোমেলো হয়ে পড়ে।ভুল হলেই তার এক কথা “সজীব লেভেনের যোগ্য না।”
এত এত চিন্তা মাথায় নিয়ে সজীব তৈরি হলো।লেভেন বলেছে সে বাবার কাছেই থাকবে।
লেভেনের বাবার অফিসে ঢুকতেই সজীব দেখলো সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। হঠাৎ এই কাজের মানে মতলব না বুঝে সজীব ওনার অফিস যে ফ্লোরে সেটার দিকে চললো।উপরের তলা বলে সে আর লিফটে ওঠেনি। লেভেনের বাবার অফিসের বাইরেও গার্ড দুজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা সজীবকে চেক করতে নিতেই লেভেন এসে বললো প্রয়োজন নেই।গার্ডরা তাই সজীবকে যেতে দিলো।
সজীব ভেতরে ঢুুকে গুড মর্নিং বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেভেনের বাবা জনাব কিয়াম মাথা তুলে বললেন,’বোসো’
সজীব বসলো।তিনি এবার হাত ভাঁজ করে একটু হেলান দিয়ে বসে বললেন,’কেমন আছো?’
‘ভাল আছি স্যার’
‘লেভেনকে শেষবার কবে দেখেছো?’
‘কাল’
‘তারমানে রীতিমত তোমাদের দেখা হয়’
‘জ্বী।’
‘আমি যে কাজ তোমায় দিয়েছি সেটা কি পূরণ করতে পেরেছো?’
‘আর স্বল্প বাকি’
‘ভাল।এক বছরের বেশি সময় আমি দিতে পারবোনা।লেভেনের জন্য তো ছেলের অভাব নেই।হাত বাড়ালেই লাইন ধরো যাবে।তোমাকে সেটা বুঝতে হবে।পরিশ্রম করো।’
‘অবশ্যই স্যার।আচ্ছা বাইরে এত গার্ড দেখলাম।কি হয়েছে?’
‘আমার উপর হামলা হয়েছিল।তাই সিকিউরিটি জোরদার করেছি।তোমরা সাবধানে থেকো।যে ক্ষতি করার সে সবার একসাথে ক্ষতি করে।’
‘স্যার আমি আগেই ব্রেকফাস্ট অর্ডার করছি।চলুন একসাথে খাবো’
‘ওটা ক্যানসেল করে দাও।আমি এখন আর বাইরের খাবার খাইনা।কে জানে কোথায় বিষ মিশিয়ে রাখবে।বোঝোই তো! এত এত প্রোপার্টি।সবার লোভ এই সম্পত্তির দিকে।’
সজীব ফোন নিয়ে অর্ডারটা ক্যানসেল করে লেভেনের দিকে এক নজর তাকালো।জনাব কিয়াম সেটা দেখে বিরক্ত হলেন।সজীবকে তার একটুও পছন্দ না।একমাত্র লেভেনের কারণে মুখে তালা দিয়ে বসে আছেন।তা নাহলে কবেই লেভেনের বিয়ে দিয়ে দিতেন অন্য জায়গায়।
এখন না পারছেন সহ্য করতে আর না পারছেন পিছু হটতে
———–
একটা ছেলে সেই চা দোকানদারের কাছে এসে চায়ের কথা বলে অনেকক্ষণ যাবত “হাবিজাবি ‘ বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।তাকে ওমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে দোকানদার জানতে চাইলো সে কি এই বাড়িতে যাবে নাকি।
তখন ছেলেটা বললো,’আচ্ছা এ বাড়ির তো অবিবাহিত একটা ছেলে আছে,নাম ফারাজ।তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন?’
‘ফারাজ কে আমি সেই কাল থেকে চিনি যেই কালে তার ভেজা কাঁথা তার মা ছাদে শুকায়তে দিতো।আহা কি সুন্দরী রমনি!!হলুদ শাড়ী পরে ছাদে আসতো জামাকাপড় শুকায়তে দিতে।রুপ যেন বাইয়া বাইয়া পড়তো।’
‘আপনি আমার কথা বুঝেন নাই।আমি তো ছেলের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি।ছেলের মায়ের ব্যাপারে না’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৮
#আফনান_লারা
________
ছেলেটির কথায় দোকানদার কোনো পাত্তাই দিলেননা। তার শুধু চোখের সামনে ভাসছে সেই সুন্দরী রমনীর রুপের হাওয়া।বেশ কিছুক্ষণ কল্পনায় সাঁতার কেটে তিনি ছেলেটির দিকে ফিরে পুরনো প্রশ্নের জবাবে বললেন,’গাছ ভাল হলে ফল ও ভাল হয়’
‘ছেলের মা সুন্দর,ছেলেও সুন্দর বুঝলাম।কিন্তু আমরা মেয়েপক্ষরা তো ছেলের রুপ দেখবোনা।আমরা দেখবো ছেলের চারিত্রিক গুণ,ছেলের ইনকাম আরও কত কি!রুপের সাথে তো মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিনা’
‘একটা কথা বলা ধরলে যদি কেউ মাঝখানে থামিয়ে দেয় ঐ ব্যাক্তিকে আমার মন চায় হাবিজাবির টাংকিতে চুবাই।যাই হোক,তুমি ছোট মানুষ।তোমায় বকা দিয়ে কি লাভ।চুপ করে খালি আমার কথা শুনো তারপর নিজের মত পেশ করবা।কারোর কাছে কিছু জানতে আসলে আগে তার কথাটা শুনে নিতে হয়।মাঝখান দিয়ে নিজের মত পেশ কেন করবা?’
ছেলেটা নড়েচড়ে বললো,’ঠিক আছে আপনি বলতে থাকুন।আমি শুনছি’
দোকানদার এবার ঠিকঠাক হয়ে বসে চায়ে চিনি দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন,’চেহারা তো সুন্দর,সেটা আপাতত বাদ।এবার বলি ছেলের ব্যবহার। খুব ভাল,অত্যন্ত ভদ্র।বলতে গেলে ভদ্র ছেলে এই ছেলেটাকে দেখলে শরম পাবে।এত বেশি ভদ্র!তারপর বলি চারিত্রিক গুণের কথা।হায়রে এত ভাল ছেলে আমি আর দেখি নাই’
দোকানদারের কথা শুনে ছেলেটার মুখে হাসি জমতে জমতে মনে হয় এইবার ব্লাস্টই হয়ে যাবে।পানসে চা টুকুও খুব ভাল লাগছে তার কাছে।দোকানদারের বলা কথা সাথে চা
আহা সব জমে ক্ষীর!!!
দোকানদার বলছেন,’মানুষ বাইরে প্রেম করে,জানাজানি হয়, পরিবার নিয়ে ঝামেলা হয়।কিন্তু এই ফারাজ ছেলেটা কত ভাল সে একেবারে বাড়ির ভেতরে মেয়ে রেখে প্রেম করে।এরকম জ্ঞান কজনের থাকে?’
এই কথা শুনে ছেলেটার চা খাওয়া আটকে গেছে।কপাল কুঁচকে বললো,’সেটা আবার কেমন কথা?ঠিক বুঝলাম না’
‘আহা বুঝলেনা?মানে হলো ফারাজদের বাড়িতে ওদের দূর সম্পর্কের একটা মেয়ে থাকে।সেই মেয়ের জন্য ফারাজের যে টান!একেবারে খাপে খাপ!!দুজনকে যা মানায়!!’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ফারাজ ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্কে আছে?’
‘তা নয়ত কি?দূর সম্পর্কের আত্নীয়র জন্য এত দরদ আসে কই থেকে হ্যাঁ?
আপন আত্নীয় গুলোর খবর নাই আর সে দূর আত্নীয়র জন্য জীবনে যা করে নাই তা আজ করছে’
‘কি করছে?’
‘দৌড়াদৌড়ি’
ছেলেটা কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালো।পেশায় সে একজন ব্যবসায়ী।রড,সিমেন্ট,বালুর ব্যবসা করে।চাঁদপুরে তার দোকান।ঢাকাশহরে তার বড়বোনের বাসা।যে বোনের জন্য ফারাজকে সে দেখতে এসেছে সে হলো ওর মেজো বোন।প্রতিবেশীদের থেকে আগে খোঁজ নেয়া ঠিক মনে করে আগে সে এই কাজটায় করেছে কিন্তু এরকম একটা ভাল প্রস্তাবের এমন নেগেটিভ রিভিউ আসবে,কে জানতো!আদৌ কি ছেলেটা এত খারাপ?
অনেকসময় দেখা যায় প্রতিবেশীরা সত্যি বলে আবার মিথ্যাও বলে।এখন এই দোকানদার কোনটা বলছে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা ঠিক হবেনা।আরেকটা কথা হলো নিজের চোখে দেখবেই বা কি করে!
ছেলেটা ওসবই ভাবছিল সেসময় দেখলো সুতির শাড়ী পরা একটি মেয়ে ওর সামনে দিয়ে হেঁটে গেট খুলে ভেতরে যাচ্ছে।আচ্ছা এই মেয়েটাই কে সেই?
অনেক ভেবেচিন্তে ছেলেটা ডাক দিলো মেয়েটিকে।মেয়েটি আসলে পূর্ণা ছিল।বাজারে ফেক্সিলোড করতে গিয়েছিল সে।ফেরার পথে তাই ছেলেটার সাথে দেখা।
‘আমি শাহেদ,ফারাজের ক্লাসমেট। আপনি কি বলতে পারবেন ওর বাসাটা কোনদিকে?আপনি তো এই বাসায় থাকেন তাইনা?আসলে আমি এ প্রথম আসলাম ওকে সারপ্রাইজ দিব বলে’
পূর্ণতা হেসে বললো,’আরে এটাই তো ওনার বাড়ি’
ছেলেটি এবার পূর্ণতার সাথে বাড়িতে যেতে যেতে বললো,’ফারাজ কি সেই আগের মতনই আছে নাকি বদলে গেছে?’
‘কি আর বলবো!! যে বদমেজাজি উনি।আগে কেমন ছিলেন জানিনা তবে আমার সাথে দেখা হবার পর থেকে হুমকি,দামকি ছাড়া কথাই বলেননি’
‘কিরকম হুমকি?’
‘এই যে ওনার থেকে দূরে দূরে থাকতাম।মনে হয় ওনার মেয়েদের উপর এলার্জি আছে’
‘হাহাহা।আগেও ছিল জানতাম।এখনও আছে বুঝি?’
‘হ্যাঁ আছেই তো। দাদাজান ওনার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন।এবার যদি তার এলার্জিটা কমে বউ পেয়ে’
‘আপনার কাছে ফারাজকে কেমন লাগে?’
‘করলার ভেতর লাল যে আবরণ থাকেনা?ঠিক সেটার মতন।’
———
সারথি অধরার হাত ধরে বলে,’আমার বারবার মনে হচ্ছে তোমার ভাইয়া আছেন।উনি কি সত্যি চলে গেছেন নাকি আওয়াজ না করে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন?’
অধরা মনে মনে ভাবলো সারথির অনুভব করার ক্ষমতা আছে অনেক।আপাতত সে কথা কাটিয়ে বলে এটা কেবলই সারথির মনের ভুল ধারণা।এই কথা বলে সে ওখান থেকে চলে যায়।সারথির মন তখনও মানছিল না বলে সে একটু একটু করে এগিয়ে রুমে ঢোকার যে দরজা আছে বারান্দাতে, সেটার কাছে এসে নাক টান দিলো।আনাফের গায়ের আতরের গন্ধ না থাকলেও যে গন্ধটা আছে তা খুব কম মাত্রায় পেলো সারথি।কিন্তু আনাফ কেন এমনটা করবে তা ভেবে মনের ভ্রান্ত ধারণা ভেবে সারথি চলে এসেছে রুমে।
বাড়ির কেউ একবার তার খোঁজ নেয়নি।
“তারা কি জানে আমি কোথায়?নাকি আমায় আর তাদের প্রয়োজন নেই?এটা হতে পারে তারা ধরে নিয়েছে আমি সজীবদের বাসায় ফিরে গেছি,নাহলে আর কেউ না দিক ফারাজ একবার হলেও কল করতো আমায়।”
আনাফ দূরে থেকে সারথির মন খারাপ দেখে ভাবছে মেয়েটা কি হাসতে জানেনা?সারাক্ষণ মুখটা ভার কেন করে রাখে?আচ্ছা কি করলে তাকে হাসানো যায়?ফানি কিছু দেখালে হাসতে পারে।কিন্তু সে তো দেখতে পাবেনা।
“তাহলে কি এমন করতে পারবো যেটাতে মেয়েটার মুখে হাসির বৃষ্টি ঝরবে?আমি তো এটাও জানিনা সারথি কিসে বেশি খুশি হয়।এ ব্যাপারে ফারাজ ভাল বলতে পারবে কিন্তু ওর নাম্বার কই পাবো!”
——–
মিসেস সোনালী আজ একবার সজীবের মাকে ফোন করেছেন।প্রথমবার তিনি ধরেননি কিন্তু পরেরবার ধরেছেন।দুজনে দুজনের খোঁজখবর নিলেন শুরুতে।পরে সোনালীকে বললেন,’সারথি কেমন আছে?’
সজীবের মা আশ্চর্য হয়ে গেছেন এই কথা শুনে।
“সারথি কেমন আছে মানে?সারথি তো আপনাদের বাড়িতে’
এই শুনে মিসেস সোনালীর হাত থেকে ফোনটাই পড়ে গেলো।ছুটে গেলেন ফারাজের কাছে।ফারাজ তখন অর্ককে অঙ্ক করাচ্ছিল।মা ঝড়ের গতিতে তেড়ে এসে বললেন,’ফারাজ রে।আমার সারথি তো আবার একা একা বেরিয়ে গেছে।আমি ভাবছিলাম সে সজীবদের বাসায় আছে।এখন তো শুনলাম ওখানেও নেই।তুই ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।কিছু একটা কর!কবে থেকে নেই তাও তো জানিনা।এত ব্যস্ততার মাঝে সারথির কথা মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছিলো’
ফারাজ হাতের কলম ফেলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।যাবার পথে শাহেদ আর পূর্ণতার সাথে দেখা হলো।পূর্ণতা চেঁচিয়ে বললো,’আরেহ দাঁড়ান!! আপনার ক্লাসমেট এসেছে’
ফারাজ কোনো কথা না শুনেই চলে গেছে।শাহেদ ওকে ছুটতে দেখে ভাবছে আবার কি হলো ফারাজ তো নাকি সচরাচর ছোটাছুটি করেনা।
পূর্ণতা শাহেদকে বসতে বললো।কিন্তু শাহেদ এখন বসবেনা বলে ঠিক করে এসেছিল।সে আসলে তার বড় বোনকে নিয়ে আসবে এই বলে দরজা অবধি এসেই চলে গেছে।পূর্ণতা আর জোরাজুরি করেনি।সে একাই বাড়িতে ঢুকে দেখলো মিসেস সোনালী মুখে আঁচল ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
পূর্ণতা কিছুই বুঝতেছেনা এই বাড়িতে আসলে কি হচ্ছে।মিসেস সোনালীর কাছে এসে তাই সে জানতে চাইলো কি হয়েছে।তিনি জানালেন সারথির কথা।
তখনই পূর্ণতার মনে পড়লো আনাফের কথা।সে বললো হয়ত আনাফের কাছে থাকতে পারে।আনাফের নাম্বার আছে কিনা।দূর্ভাগ্যবশত আনাফের নাম্বার তাদের কারোর কাছে নেই।ফারাজ বিনা ঠিকানায়,বিনা তথ্যে সারথিকে খুঁজতে রাস্তায় নেমে গেছে।
চোখের সামনে তার সব ঝাপসা লাগছে।সারথি গায়েব আর তারা এই ব্যাপারটা মাথাতেই নেয়নি।কবে থেকে গায়েব কে জানে,কেমন আছে কোথায় আছে সেসব ভাবতেই ফারাজের গা গুলিয়ে আসছে।
———
কলিংবেল বেজেছে। ফোমওয়ালারা এসেছেন ফোম দিয়ে যেতে।সারথির কানে কথাটা গেলো।অধরা এসে বললো একটু সরে দাঁড়াতে।তোষক সরিয়ে ফোম বসাবে বিছানায়।সারথির বেশ মনে আছে ঘন্টা খানেক আগে সে শক্ত বিছানা নিয়ে আফসোস করছিল।কথাটা অধরা শুনেই কি এই ব্যবস্থা করেছে?
অধরার কানের কাছে তখন আনাফ ফিসফিস করে বলে দিয়েছে সারথি যদি জানতে চায় হঠাৎ ফোম কেন বদলাচ্ছে তাহলে বলতে যে আগে থেকেই বদলানোর কথা ছিল।
আনাফ খুব ভাল করে জানে সারথির মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।এবং সে অধরাকে পাকড়াও করবে এই ব্যাপারে।এত সাবধান থাকার পরেও আনাফের মনে হয় একদিন সে ধরা খাবেই।সারথি চোখে দেখেনা তো কি হয়েছে তার অনুভব করার ক্ষমতা প্রখর।
সারথি অধরার কাছে আর কিছু জানতে চায়নি।এই রুমটার আয়নায় ফ্রেম লাগানো নেই।হয়ত পরে লাগানো হবে এই ভেবে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা আছে।সারথি আয়নাটা ছুঁতেই বুঝতে পারলো এটাতে হাত কাটা যেতে পারে তার অসাবধানতায়।মাথায় একটা বুদ্ধিও আসলো তার।মুখে হাসি ফুটিয়ে আয়নায় হাত বুলিয়ে দেখতে দেখতে বিনাকারণেই চিৎকার করে বললো সে হাতে ব্যাথা পেয়েছে।আনাফ তখন দূর থেকে ওকেই দেখছিল।অধরা ছিল তার রুমে।সে শুনতে পায়নি।
আনাফ এক দৌড়ে এসে সারথির হাত ধরে বললো,’কোথায় ব্যাথা পেলেন?’
সারথি হাসলো।হাসতে হাসতে বললো,’ঘুঘুকে ফাঁদে ফেলতে পেরেছি হাহাহাহা’
সারথিকে খিলখিল করে হাসতে দেখে আনাফ যে ডোজ খেলো সেটা ভুলে সারথির চমৎকার হাসিটাই দেখে যাচ্ছে।আর কত মুগ্ধ হবে একটা মানুষের প্রতি।সারথি হাসির কারণে কিছু বলতেই পারছেনা।শুধু হেসেই যাচ্ছে।আনাফ ওর হাত ছেড়ে কপাল কুঁচকে বললো,’তাহলে এই ছিল পরিকল্পনা?’
‘ধরা খেলেন।এটা আপনারই বাসা।এত লুকোচুরির কি আছে বুঝলাম না’
‘আমি বাসায় থাকলে আপনি তো ভাববেন খারাপ কিছু করে বসবো’
‘বলতেও পারি,যদি আশেপাশে ঘুরঘুর করেন তবে।’
‘আপনি সত্যি হাতে ব্যাথা পাননি?’
‘আমি ব্যাথা পেলে চেঁচাইনা’
‘ধরা খেয়ে ভালই হলে।অন্তত এটা জানতে পারলাম আমি এই বাসায় থাকলে একটা মানুষের অসহজবোধ হবেনা’
সারথি আর কিছু না বলে চুপচাপ বিছানা খুঁজে বসে পড়ে।আনাফ ওর দিকে ফিরে আবার বললো ফারাজের নাম্বার আছে কিনা ওর কাছে।
———-
‘ভাই আপনি যে ফারাজকে নিয়ে বললেন তার সবটাই তো মিথ্যে।আমি গিয়ে পরোক করে এসেছি’
‘তুমি যাহা দেখিয়াছো তাহার সবখানাই ভুল,বেঠিক!
আর আমি যাহা বলিয়াছি তাহার সবখানাই সঠিক’
‘আরে কবিতা শুরু করলেন কেন?আমি সত্যি বলছি।নিজের চোখে দেখে আসলাম।ওদের তো প্রেমিক প্রেমিকা মনে হলো না একবারও’
‘প্রেমিক প্রেমিকা অচেনা এক ছেলের সামনে নিজেরদের প্রেম দেখাবে?এত বড় দামড়া ছেলে হয়ে এই টুকু বুঝোনা মিয়া!! আসছো নিজের বোনরে বিয়া করাইতে।যাও তো ভাগো’
‘আহা রাগ করছেন কেনো।আমি তো যা দেখলাম তাই বলছি’
‘বয়স অনুযায়ী দেখার ভুল।দেখি এই কাপটা দেখে বলো কি দেখতেছো?
‘কি দেখবো!খালি একটা কাপ।আর কি?’
‘উহু!! কাপটায় লিবিস্টিক লেগে আছে।মানে হলো,এই কাপের চা একটা মেয়ে খেয়ে গেছে।তাহলে বুঝো তুমি কি দেখলা আর আমি কি দেখলাম?’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৯
#আফনান_লারা
________
লোকটার কথায় দম আছে কিন্তু কেনো যে বারবার মনে হচ্ছে তিনি ফারাজের ব্যাপারে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।প্রতিবেশী হয়ে এতকিছু বলার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?ওনার কি ফারাজের সাথে কোনো শত্রুতা আছে?
দোকানদার শাহেদকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে বলেন,’মামা তুমি আরও এক কাপ চা নাও।আমার কাছে ফারাজের ব্যাপারে আরও কথা আছে’
‘দেখুন একটা কথা বলি আপনাকে,আমরা খুব সাদাসিধা পরিবারের মানুষ।আমার বোন ও খুব সাদা মনের। তাই আমি ভেবেছি “হাবিজাবি” বাড়ির মানুষরাও তেমন।এদের বাড়ির ছেলে ফারাজকে নিয়ে আমায় খবর দিয়েছিল আমার এক বন্ধু।সে ফারাজের ক্লাসমেট ছিল। তার থেকে ফারাজকে নিয়ে যা যা শুনেছি আর আপনার থেকে যা যা শুনছি তার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত দেখছি।তাই আমি নিজে একবার ফারাজের সাথে কথা বলে দেখবো।তাছাছা আমার পরিবারের লোকজনও যাচাই বাছাই করবেন।তাড়াহুড়ার কিছু নেই।
আর একটা কথা,আপনার চায়ের পানি কষে না।পানি কষাবেন ভাল করে তাহলে চা স্বাদ হয়।আজ আসি’
শাহেদ চলে গেছে।দোকানদার রাগ করে ব্যবহার করা পুরোনো চাপাতার বালতি নিয়ে পেঁপে গাছের তলায় এসে ঢাললেন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন,’সোনালী আমার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে মানিককে বিয়ে করেছিল।আমি এর শোধ তুলবোই।একদিন না একদিন ঠিক তুলবো’
——–
পূর্ণতা নিজেও বের হয়েছে সারথিকে খোঁজার জন্য।
ফারাজের মাথা ঘুরছে সারথির কোনো খোঁজ না পেয়ে।আশেপাশে যাকেই দেখছে তার কাছেই সারথিকে নিয়ে জিজ্ঞেস করছে তাও কোনো তথ্য পায়নি।মাথা কাজ করছেনা।সারথি না বলে কোন সময় যে বেরিয়ে গেলো।
দিশেহারা হয়ে একটা দোকানের পাশে রাখা টুলে বসে পড়ে ফারাজ।এখন কোথায় খুঁজবে।কি দিয়ে শুরু করবে তাই ভাবছিল।
সেসময় পূর্ণতা এসে সামনে দাঁড়ায়।ওর ও একই অবস্থা।কপালভর্তি ঘাম,হাঁপিয়ে যাচ্ছে শুধু।ফারাজ ওকে দেখে কোনো কথা বলেনি।মাথা নিচু করে বসে আছে শুধু।পূর্ণতা এক বোতল পানি কিনে ছিপি খুুলে ওর দিকে ধরে বললো,’হয়ত আমি জানি আপু কোথায় আছেন’
‘কোথায়?’
‘আনাফ ভাইয়ার কাছে,ঐ যে ঐদিন আপুকে দিতে আসলোনা?’
‘আনাফ ভাই এসেছে সারথিকে বাঁচিয়েছে বলে পরে দিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিল।তার মানে কি প্রতিবার ওর সাথে সারথির দেখা হবে?এটার কোনো লজিক আছে?’
‘যেহেতু কোথাও খোঁজ পাচ্ছেন না,একবার আনাফ ভাইয়ার কাছে গিয়ে দেখা করলেই হয়ত সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
কথাটা ফেলে দেয়ার মতন ছিল না,কিন্তু সমস্যা হলো কোথায় গেলে আনাফকে পাবে।
এই কথা শুনে পূর্ণতাও ভাবতে বসেছে।অনেকক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়লো সেদিন সারথি আপুর যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেখানে সদর হসপিটালে আনাফ ডাক্তার হিসেবে এসেছিল,এ কথা আনাফ নিজেই বলেছে।তার মানে ওখানে গেলে ওর নাম্বার পাওয়া যেতে পারে।এই কথা ফারাজ শুনতেই বোতল রেখে দিলো এক দৌড়।পূর্ণতাও ছুটেছে ওর সাথে সাথে।হাসপাতাল টা বেশি দূরেনা বলে ওরা দুজনেই ক্ষিপ্রগতিতে ছুটছে।পাঁচ মিনিট দৌড়ানোর পর তারা হাসপাতালের সামনে এসে হাজির হয়।ভেতরে গিয়ে যেখানে সিজনালি ডাক্তার বসেন সেই চেম্বারে গিয়ে নার্সকে তারা তারিখ বলে সেইদিনের ডাক্তারের নাম ও নাম্বারের তালিকা চাইলো।নার্স দিতে চাইছেনা।দিতে পারা খুব সহজ কিন্তু নার্সটি বারবার ঘুরাচ্ছিল।যেন তার এক্সের ফোন নাম্বার চাইছে পূর্ণতা।
শেষে একশো টাকার একটা কচকচে নোট খামে পুরে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে ফারাজ।ওমনি নার্সটা একটা ফাইল খুলে নাম- নাম্বার সব ফারাজের হাতে তুলে দিলো।পূর্ণা আর ফারাজ দুজন মিলে নাম চেক করতে করতে সবার শেষে আনাফের নাম পায়।দুজনেই এখন মহাখুশি।এবার ফোন বের করে কল ও করেছে।
আনাফ সেসময় শাওয়ারে ছিল।তার ফোনের সাউন্ড এত বেশি ছিল যে সারথি সহ অধরাও শুনেছে।অধরা তখন টেবিলে উঠে ফ্যান পরিষ্কার করছিল।তাই সে কলটাকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি।সারথি আওয়াজ শুনে দেয়াল ধরে ধরে রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে আনাফের রুমের কাছে এসে থামলো।তারপর দরজায় হাত রাখতেই সেটা খুলে গেছে।এবার আরও সামনে গিয়ে ফোন যেখানে সেখানে এসে হাতে নিয়েছে সে।এই নিয়ে ৩য় কল ছিল।সারথি আসতে আসতে দুবার কাটা গিয়েছিল।সারথি মুখের কাছে নিয়ে ফোন রিসিভ করার চেষ্টা করছে। ফোনটা অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর শেষে রিসিভ হয়েছে।
ওপাশ থেকে ফারাজ বলে উঠলো,’আনাফ ভাই আমি ফারাজ।’
এটা শুনে সারথির মুখের কথা আটকে গেছে।কি বলবে জবাবে তা ভাবছে।সেসময় আনাফ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছিল।সারথিকে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে জানতে চাইলো কি হয়েছে।
সারথি কিছু না বলে ফোন রেখে চলে যাচ্ছে।আনাফ তখন ফোন তুলে কানে ধরার পর ফারাজ আবার বললো,’ভাইয়া শুনতে পাচ্ছেন?আমি ফারাজ বলছি’
‘ফারাজ মানে সারথির ভাই ?হাই কেমন আছো?’
‘ভাল নেই ভাই।সারথি কাল থেকে বাসায় নেই।কোথায় গেছে জানিনা।আপনি বলতে পারবেন সে কোথায়?’
‘সে আমার কাছে আছে’
‘সুস্থ আছে তো?’
‘হ্যাঁ,তুমি এক কাজ করো।আমি ঠিকানা দিচ্ছি, তুমি চলে আসো।তোমায় দেখলে হয়ত ওর মন ভাল হবে’
‘হ্যাঁ।এখনই দিন।আমি আসতেছি”
আনাফ ঠিকানা মেসেজ করে পাড়িয়ে দিয়েছে।সারথি রুমের বাইরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সব শুনছিল। আনাফ ফোন রেখে রুম ছেড়ে বের হতেই দেখে সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে।আনাফ তখন ওর সাথে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু কেমন করে যেন সারথি ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়,সে চলে গেছে ওখান থেকে। ফারাজকে ঠিকানা দেয়া নিয়ে কি সারথি রেগে আছে নাকি অন্য কারণ?
‘আমার মতে ফারাজকে জানিয়ে ভুল করিনি। তাহলে সারথি এড়িয়ে চললো কেন?’
আনাফ গেলো অধরার কাছে।অধরা চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ফ্যান মুছতেছিল।ওকে বলে কয়ে নিচে নামিয়ে আনাফ তাকে সারথির কাছে পাঠালো।শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে।সারথির মন খারাপ কেন সেই কারণ জানার জন্য।
অধরা আনাফের শেখানো মতন সারথির কাছে এসে টুকুস করে বসে পড়ে।সারথি তখনও চুপ করে ছিল।অধরা হাত নিয়ে সারথির কানের পাশের চুল সরিয়ে বললো,’তোমার কানের দুল অনেক সুন্দর’
কথাটা শুনে সারথি চট করে কান থেকে দুল খুলে বললো,’তুমি নিয়ে যাও’
‘এমা!সুন্দর বললে বুঝি সেটা দিয়ে দিবে?’
‘আমি এমনই।আমার কোনো জিনিস কারোর পছন্দ হলে সাথে সাথে দিয়ে দিই।নাহলে পরে ঐ জিনিসটা যতবার পরি আমার মন খারাপ হয়’
‘এটা আবার কেমন কথা?না না এটা আমি নিতে পারবোনা।সুন্দর বলেছি কারণ এটা তোমার কানেই সুন্দর লাগছে’
সারথি আবারও চুপ। অধরা এবার ওর হাত ধরে হাতের আঙ্গুল গুলো দেখতে দেখতে বললো,’তোমার কি মন খারাপ আপু?’
‘হুম’
‘কেনো?’
‘কাল থেকে আমি বাসাতে নেই।অথচ আমার খোঁজ এখন নিলো আমার ভাই’
‘হয়ত মনে ছিল না,বা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল।আনাফ ভাইয়াও তো আমার কথা ভুলে যায় কাজের চাপে।মাসে একবার কল দেয় জানো?’
‘ফারাজ আমাকে দিনে দুইবার করে কল দিতো।সেখানে গোটা একদিন সে কলই দেয়নি এই বিষয়টা আমি হজম করতে পারছিনা’
‘আরে ভাই বোনের মধ্যে এগুলো ধরে বসে থাকলে হয়?তুমি বরং তোমার ভাইয়ার সাথে রাগ দেখিয়ে রাগটা কমিয়ে নিও।’
সারথি আবারও চুপ হয়ে গেছে।দূর থেকে আনাফ ইশারা করে অধরাকে শিখিয়ে দিচ্ছে আরও কিছু বলার জন্য।
সেটা দেখে অধরা আবার বললো,’তোমার ভাইয়ের সাথে আমায় বিয়ে দিবা?’
এটা শুনে সারথির মুখে হাসি ফুটলো। ওর হাসি দেখে অধরা বলে,’আমি কিন্তু পানি গরম করতে পারি,আবার সেই পানি ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডাও করতে পারি।মাল্টিটেলেন্টেড।’
সারথি এবার খিলখিল করে হাসছে।আনাফ ও হাসলো ওর হাসি দেখে।গোসল করে বের হবার পর থেকে একবারও মাথা মুছেনি সে। ঠাণ্ডা লেগে গেছে ওর তাই হাঁচি দিয়ে ফেললো হঠাৎ করে। সারথি আবারও ধরে ফেলেছে আনাফ আশেপাশেই আছে।এবার নিজের উপরই নিজের বিরক্ত লাগলো।সে অন্ধ বলে আনাফ ওর কাছাকাছি থাকে আর সে বুঝতেও পারোনা।বুুঝতে পারলে বের করে দিতো ওনাকে।আশেপাশে এমন থাকতে দিতোনা।
————-
ফারাজ একাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু পূর্ণতা ওর পিছু ছাড়বেইনা।সেও যাবে বলে জেদ ধরে বসে আছে।
শেষে বাধ্য হয়ে ওকে নিয়েই চললো ফারাজ।আনাফ যে ঠিকানা দিছে সেটা তেমন একটা দূরেনা, বাস ধরেছে দুজনে।একেবারে পেছনের দুই সিট।পূর্ণতা জানালার পাশের সিটটায় বসে জানালা খুলে দিলো ওমনি ফারাজ বললো,’অতি বাতাসে আমার হাঁপানি শুরু হয়।জানালা বন্ধ করেন’
‘কি গরম সেটা দেখছেন?জানালা বন্ধ করলে বাঁচবো কি ভাবে?’
‘তো মরে যান’
‘আজব কথাবার্তা!আমি জানালা বন্ধ করবোনা’
ফারাজ ঝুঁকে জানালা বন্ধ করে দিয়েছে পূর্ণতার কথা না শুনে।এদিকে পূর্ণতা গরমে হাত দিয়ে বাতাস করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।তাও লাভ হচ্ছেনা।মনে হয় মাথার উপর লাভা ভাসছে।ফারাজের অবাধ্য হয়ে আবার জানালা খুলে দিয়েছে পূর্ণতা।এমন করে একবার বন্ধ একবার খোলা করতে করতে শেষে পূর্ণতা জিতে গেলো।কারণ সে জানালা ধরে লেপটে বসে আছে।
এতক্ষণে বাতাসে ফারাজের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করছিল।পূর্ণতা জিতে গেছে ভেবে দাঁত কেলিয়ে জানালা দিয়ে যানজট মনযোগ সহকারে দেখছিল।যানজট দেখা মজার কিছু না কিন্তু পূর্ণতার কাছে বেশ মজা লাগছিল।
হঠাৎ হাঁটুর উপর ফারাজের হাত পড়তেই চমকে সে পাশে চেয়ে দেখলো ফারাজ বারবার শ্বাস নিচ্ছে আর কি যেন বলার চেষ্টা করছে। পূর্ণতা ভয় পেয়ে গেছে।ভয়ের চোটে সবার আগে জানালা আটকে ফেললো।তারপর ফারাজের হাতটা ধরে বললো,’কি হয়েছে?কি করতাম?আপনি ঠিক আছেন?’
ফারাজ ইশারা দিয়ে ব্যাগ দেখাচ্ছিল,এই ব্যাগটা আসার পথে বাড়ি ফিরে আবার নিয়ে এসেছিল যদি পথে কাজে লাগে।তার ব্যাগে ইনহেলার আছে।পূর্ণতা ব্যাগ হাতিয়ে ওকে ইনহেলারটা দিলো তখনই।
দশ /পনেরো মিনিট পর ফারাজ স্বাভাবিক হয়।হয়েই পূর্ণতার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালো।পূর্ণতা চোরের মতন চেয়ে থেকে বললো,’গরমে গলে গেলেও আর জানালা খুলবোনা।মাফ করে দেন’
‘আপনার সাথে এক বাসে ওঠাই আমার অপরাধ। আর একটুর জন্য মরে যেতাম আমি।আমি যে বললাম বাতাসে আমার কষ্ট হয়,আমি কি মিথ্যা বলেছি?’
ফারাজের ফোন বাজছে এবার।চেয়ে দেখলো দাদাজান কল করেছেন।ফারাজ পূর্ণতাকে চুপ থাকতে বলে রিসিভ করলো।
‘তুমি কোথায় ফারাজ?’
‘আমি ফার্মগেট।জ্যামে বসে আছি।সারথির খোঁজ পেয়েছি’
‘ফার্মগেট??আমার বন্ধু আজিজ তোমার সাথে দেখা করবে।যেখানে নামবে সেই জায়গার নাম বলো’
ফারাজ ভয়ে ভয়ে বলে দিলো।দাদাজান অমনি কল কেটে দিছেন।তার বন্ধু আজিজকে ফারাজ চেনে।মানুষকে প্রশ্ন করতে করতে মেরে ফেলবে তারপর সেখান থেকে উঠিয়ে আবার প্রশ্ন করবে।
পূর্ণতা বললো,’কি বলেছে দাদাজান?’
‘ঝামেলায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আমাদের।এক কাজ করতে হবে’
‘কি কাজ?’
‘চলেন পালাই’
‘কেনো?’
‘একটা পাগলের থেকে বাঁচতে হবে।নাহলে এই দিনে আর বাড়ি ফেরা হবেনা।প্রশ্নে প্রশ্নে বিয়েসাদি করিয়ে বাচ্চাও পয়দা করিয়ে দিবেন।আর আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা বলেই আপনাকে নিয়ে পালাচ্ছি।কারণ আজিজ দাদু আমাদের একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিবেন।
এই ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রতিটি প্রবীণ ব্যাক্তি একই ধরনের।’
চলবে♥