তালা চাবি পর্ব -০৩

#তালা_চাবি
#পর্ব (৩)

সিঁথি এসএসসির পর পুলিশের চাকরির জন্য ফরম পূরণ করেছিল। সকল যোগ্যতায় পাশ হওয়ায় ট্রেনিংয়ে ডাকও পড়ে। কিন্তু বাঁধা হয় তার বাবা। কিছুতেই মেয়েকে বাড়ির বাইরে যেতে দিবেন না। চাকরি-বাকরির চিন্তা করাও ঘোর অন্যায় হবে বলে জানিয়ে দিলেন। সে মানানোর জন্য অনেক কান্না-কাটি করেছিল, না খেয়ে থেকেছিল, দুয়ার বন্ধ করে কথা বলা বন্ধ করেও বাবার আদেশ বদলাতে সফল হয়নি। অতঃপর আরশাদের শরণাপন্ন হয়। সব শুনে উপদেষ্টার মতো বলেছিল,
” এখন পুলিশে ঢুকলে তো সাধারণ পদে জয়েন করতে হবে। সেখানে অনেক খাটুনি! খুব ঝামেলা! তুই বরং পড়ালেখাটা মন দিয়ে কর। অনার্স পাশের পর নতুন করে আবেদন করিস তখন এসআই হতে পারবি। আর বিসিএস এ টিকে গেলে তো আরও ভালো পদে ঢুকতে পারবি। ততদিনে তোর বাবার মতও বদলে যাবে। ”
” যদি না বদলায়? ”

প্রশ্নকর্ত্রীর বাক্যভাবে শঙ্কা, অনিশ্চয়তা। আরশাদ অল্পক্ষণ নীরব ভেবে বলল,
” অভিভাবক বদলে ফেলবি। ”
” কিভাবে? ”
” বিয়ে করে। ”

প্রত্যুত্তর করেই বেশ হেসেছিল সে। বুঝতে পারেনি তার এই মজার ছলে দেওয়া সমাধানটি একদিন বাস্তবে ঘটবে। সেই দিনটি তবে আজ চোখের সামনে এসেছে ঘূর্ণিঝড়ের রূপে!

” মনে পড়ল? ”

সিঁথির কণ্ঠস্বরে সংকটাপন্ন ভাবনা – চিন্তায় ফাটল ধরল। এক মূহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে বৃষ্টির পানির মতো শীতল কণ্ঠে বলল,
” যাস না সিঁথি। ”

এমন আকুতিভরা বাক্যভাবে ভেতরটা নরম হয়ে এলো তার। এক ঝলক বিপরীত মানুষটির মুখটায় চেয়ে পেছন ঘুরে গেল ঝটিতে। চোখ বন্ধ করে কঠিন স্বরে বলল,
” যাব। তুই তো জানিসই এটা আমার কত বছরের লালিত স্বপ্ন! ”

আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” না, জানি না। ”

বলতে বলতে হস্ত বাঁধনে বেঁধে নিল সিঁথিকে। গভীর আলিঙ্গনে ডুবে যেতেই শুনল,
” মিথ্যা বলছিস? ”
” হ্যাঁ, বলছি। ”
” ছাড়। ”
” না। ”
” ব্যথা পাচ্ছি। দম নিতে পারছি না। ”
” ছেড়ে দিলে আমাকেও এই যন্ত্রণাটাই দিবি। ”
” আমি কারণে দেব, তুই অকারণে দিচ্ছিস। ”
” উহু, আমিও কারণেই দিচ্ছি। ”
” কী কারণ? ”

সিঁথির কণ্ঠ থেকে প্রশ্নটা প্রকাশ পেতেই হাতের বাঁধন নরম করল আরশাদ। নববধূকে নিজের দিকে ঘুরাল। সুশ্রী মুখটায় চেয়ে থেকে সুধাল,
” তুই জানিস না? ”

সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,
” না, জানি না। ”
” মিথ্যা বলছিস? ”
” হ্যাঁ, বলছি। ”
” আমি কষ্ট পাচ্ছি। অসহায় বোধ করছি। ”
” তাকালে আমাকেও এই যন্ত্রণাটাই দিবি। ”
” আমি অনিচ্ছায় দিব, তুই ইচ্ছাতে দিচ্ছিস। ”
” আমিও অনিচ্ছায় দিচ্ছি। ”
” কীভাবে? ”

আরশাদের কণ্ঠ থেকে প্রশ্নটা প্রকাশ পেতেই নত মুখটা উঁচু হলো। চোখের কোণে বৃষ্টির ফোঁটা জমিয়ে বলল,
” মাফ করে দিস। ”

সিঁথি প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে দক্ষিণা বাতাসের মতো খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

__________
ট্রেন আসবে বেলা এগারেটায়। সিঁথি আগেই টিকেট কেটে রেখেছিল, গোছগাছও সম্পন্ন। এবার নিজের তৈরি হওয়া বাকি। শাশুড়ি মায়ের শাড়িটা খুলতে গিয়েও কেমন মায়ায় জড়িয়ে পড়ল! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিনিট কয়েক দেখল নিজেকে। এমন আদুরে নারী সৌন্দর্যের দর্শন পাচ্ছে এই প্রথম। কিছুতেই যেন দৃষ্টি সরাতে পারছে না, মন মানাতে পারছে না। গাঢ় আবেগে জড়িয়ে যাচ্ছে আরও।

” কোথাও যাচ্ছিস? ”

হঠাৎ বাবার কণ্ঠ পেয়ে চমকে কেঁপে ওঠল। ভয়ে তটস্থ হলো মুহূর্তেই। শাড়িখানা সামলাতে গিয়ে খামচে ধরল। পেছন মুখো হয়েই কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
” হ্যাঁ। সারদায় ট্রেনিং নিতে যাচ্ছি। ”
” পুলিশ হওয়ার ভূতটা মাথা থেকে যায়নি এখনও? ”

বোমার মতো কণ্ঠটা বিস্ফারিত হতেই সিঁথি ঘুরে দাঁড়াল বাবার দিকে। কোনোরূপ বাক্য ব্যয় না করে নীরব চেয়ে থাকল। সেই চাহনিতে ভীষণ কাতরতা, আকুতি-মিনতি। যার বিন্দুমাত্র মূল্য দিলেন না বাবা। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ভারী ব্যাগপত্র বিছানা থেকে নিচে ফেলে দিলেন আচমকা। চিৎকার করে বললেন,
” আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও এতদূর এগিয়ে গেছিস! তোর সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। ”

ভারী পদক্ষেপে মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে আবার বললেন,
” কোথাও যাবি না তুই। আমার নিষেধ তোকে শুনতে হবে। মানতে হবে। চুপচাপ বসে থাক এখানে। আমার অনুমতি ছাড়া একপাও বাইরে যাবি না। ”

বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে আদেশ প্রতিষ্ঠিত করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সেই সময় সিঁথি বলল,
” যাব। আমার অনুমতি দেওয়ার মানুষ বদলে গেছে, বাবা। ”

বাবা থামলেন। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় ফেরাতেই সে ধীরভঙ্গিতে পুনরায় বলল,
” আমি আর আরশাদ বিয়ে করেছি। এখন থেকে সে আমার অভিভাবক। সবার আগে তার আদেশ ও অনুমতি পালন করতে হবে। ”
” আরশাদ অনুমতি দিয়েছে? ”

উত্তরে সে মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। তিনি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে চলে গেলেন। সিঁথি ঠিক বুঝে গেল, বাবা আরশাদের কাছেই গেছে। নিশ্চয় খুব রাগ দেখাবে, বকবে। অনেকগুলো কথা শুনাবে। পরিশেষে সুন্দর করে বুঝাবে, তার বিয়ে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সকল সমস্যা তো সিঁথির পুলিশে চাকরি করা নিয়ে। যে চাকরিতে ছেলেকে জোর করে পাঠিয়ে হারিয়েছেন, সেই চাকরি মেয়েকে করতে দিবেন না। কিছুতেই না। আরশাদ কি তার ইচ্ছা মেনে নিবে? সিঁথিকে আটকে দিবে? অবশ্যই না। এই এতদূর আসার পথটাতে একমাত্র সঙ্গী তো সেই ছিল। বাবার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস, উপকরণ সেই যুগিয়ে দিয়েছে। ব্যবহার করার পদ্ধতি বলে দিয়েছে। এই শেষ সীমানায় এসে আটকে দিবে? অসম্ভব! আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় মাথাটা যখন ধরে এলো তখনই আরশাদের আকুতিভরা বদনখানা উঁকি মারল অন্তর আরশিতে। মুহূর্তেই সিঁথির সকল সাহস, আস্থা, ভরসা কাচের মতো ভেঙে গেল। ভয়ে শুকিয়ে এলো মুখটা। মনে পড়ল, তার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব দিতে গিয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সকল কাগজ-পত্র আরশাদের কাছেই জমা রেখেছে। সিঁথি শুষ্ক ঠোঁটে ম্লান হাসল। শাড়ির খুলে সেলোয়ার-কামিজ পরতে পরতে স্বগোতক্তি করল, ‘ তোর কাছে কোনটা অধিক সম্মানীয়, তোর চাওয়া নাকি আমার স্বপ্ন? আজ প্রমাণ হয়ে যাক তাহলে! ‘

[অনেক দিন পর লিখেছি। একটু সাড়া দিয়েন। ভুল-ত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিবেন প্লিজ। অপেক্ষা করানোর জন্য সকলকে খুব ভালোবাসা। ]

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here