তালা চাবি পর্ব -০২

#তালা_চাবি
#পর্ব_২

আরশাদ মরিয়া হয়ে তালার চাবি খুঁজল অনেক্ষণ যাবত। তন্মধ্যে সিঁথিকে অনুনয়-বিনয়ও করল। কোনোটাই কাজে লাগল না। হতাশা ও নিরাশায় পড়ে কাবু হলো। পরাজয় স্বীকার করে ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে বসে থাকল সিঁথির কাছেই। করুণ চোখে একভাবে চেয়ে থাকল অল্পক্ষণ। সে চোখ বুঝে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। কপালে হাত দিয়ে অসহায় সুরে বলল,
” তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে আমার তো ভয় করছে, সিঁথি! ”

সে চোখ বুঝা অবস্থায় কপাল কুঁচকে ফেলল। বিরক্ত স্বরে বলল,
” কানের কাছে সারাক্ষণ সিঁথি সিঁথি করিস না তো। অসহ্য লাগে। ”
” নিজের নাম অসহ্য লাগে? ”
” না, তোর অতিরিক্ত উচ্চারণে অসহ্য লাগে। ”

কথাটা বলেই আরশাদের দিকে কাত হলো। হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
” তোকেও অসহ্য লাগছে। চোখের সামনে থেকে সর। ”

সে সত্যি সত্যি সরে গেলো। পানি খাওয়ার জগে পানিভর্তি করে তবেই ফিরে এলো। সিঁথিকে টান দিয়ে আড়াআড়ি করে শুয়িয়ে মাথায় পানি দিতে শুরু করল। এক জগের পানি শেষ করে আরেক জগের পানি ঢালতে নিলে রোগী রেগে গেল অকস্মাৎ। ধাক্কা দেওয়ায় আরশাদের হাত থেকে ছুটে গেল। সে ধমকে ওঠল,
” থাপ্পড় দেব কিন্তু! ”
” বৃষ্টির অযুহাতে চুমু দিয়ে কষ্ট দিবি, জ্বরের অযুহাতে থাপ্পড় দিয়ে কষ্ট দিবি। এজন্যই তো তোর সাথে মিশি আমি। কষ্ট পেতে আমার এত ভালো লাগে! ইচ্ছে করে এই পৃথিবীর সকল কষ্ট এক লোহমায় খেয়ে ফেলি। ”

আরশাদ আহত হয়ে বলল,
” কী আবোল-তাবোল বলছিস, সিঁথি! ”

সিঁথি চোখ মেলল। মাথাটা একটু তুলে বলল,
” পাগলদের আবোল-তাবোলের মধ্যেও অর্থ থাকে। তোর মতো সুস্থ মানুষেরা সেই অর্থ ধরতে পারে না। ”
” তুই পাগল? ”
” নাহলে আবোল-তাবোল বলতাম? ”

আরশাদ উত্তরে কী বলবে খুঁজে পেল না। ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগল। সিঁথি গড়িয়ে গিয়ে মাথা রাখল বালিশে। হাত-পা ভাঁজে ভাঁজে সংকুচিত করে শরীরটাকে একটুখানি করে বিড়বিড় করল,
” এমনিতে শীতে মরছি। তারমধ্যে এক টাংকি ঠাণ্ডা পানি ঢেলেছে মাথায়! ”

আরশাদ শুনে ফেলল। প্রতিবাদ করে বলল,
” এক টাংকি না, এক জগ ঢেলেছি। ”

সেই প্রতিবাদে সিঁথির রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছাল। মাথার নিচ থেকে বালিশ ঢিল মারল প্রতিবাদির শরীরে। আঘাত না পেলেও ভয় পেল বোধ হয়। বিছানা থেকে নেমে দূর থেকে বলল,
” সবকিছুতেই রেগে যাচ্ছিস! কী করব, কী বলব কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ”
” আলো নেভা। ওটার যন্ত্রণায় অন্ধ হয়ে যাব মনে হচ্ছে। ”

আরশাদ আলো নিভিয়ে দিল। সেই সাথে সিঁথির রাগটাও পড়ে গেল বুঝি! বেশ ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
” আমি মরে গেলে বাবা-মাকে দেখিস। ওদের তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই! ”

আরশাদের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠল যেন। সাপের দংশনের মতো ঠেকল। যার বিষ ছড়িয়ে পড়ল শিরা-উপশিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, স্নায়ু-স্নায়ুতে। মনখারাপের তীব্র ভাবে ছুটে এলো বিছানার কাছটায়। স্ত্রীর পাশে বসে বলল,
” জ্বরে কেউ মরে না, সিঁথি। ”
” মরে না? ”
” না। ”
” তোর হাব-ভাবে তো মনে হচ্ছে আমি মৃত্যুযাত্রী। ”

সিঁথির বিদ্রুপাত্মক কথাটাকে গায়ে মাখল না। প্রত্যুত্তর করল,
” মরে না গেলেও অন্য ক্ষতি হবে। ”
” কী ক্ষতি? ”

সে উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না তার পূর্বেই সিঁথি বলল,
” আমার খুব কান্না পাচ্ছে! ”

আরশাদ এতক্ষণে টের পেল, তার নববধূ উরুতে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷ কোমল হাতের শক্ত খামচিতে শার্টের এক অংশ দখল করেছে৷ তার ভারি মায়া হলো। স্নেহ এসে ভর করল হাতের পাঁচ আঙুলে, স্পর্শে। চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই মনে পড়ল সাত বছর আগের একটি ঘটনা৷ তখন সে এসএসসি পরীক্ষার্থী, সিঁথি মাত্র দশম শ্রেণিতে ওঠেছে। দুজনে একই এলাকা, পাশাপাশি প্রতিবেশি হওয়ায় বন্ধুভাব গড়ে উঠলেও পড়ালেখায় আরশাদ এক বছরের বড় ছিল। দীর্ঘ বছর ধরে একই বিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে দুজনের ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রবল। পরীক্ষা দিয়ে একজন বেরিয়ে যাবে আরেকজন একা একা থাকবে এটা একদমই মানতে পারছিল না সিঁথি। বিদায় অনুষ্ঠানের দিনে সে কী কান্না! নাভিশ্বাস তুলতে তুলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল একদম। আরশাদ এত ভয় পেল যে পরীক্ষায় অংশ নিল না। তার পরবর্তী বছরে সিঁথির সাথে একই হলে, একই কক্ষে পরীক্ষা দিল। এরপর থেকে দুজন এক কলেজ, এক ভার্সিটির, এক ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্স শেষ করেছে। চলতে-ফিরতে কত ঝগড়া হয়েছে, মান হয়েছে, অভিমান হয়েছে, কথা বন্ধ রেখেছে তবুও সেরকম করে আর কখনও কাঁদেনি। তাহলে আজ কেন কাঁদছে? প্রশ্নটা উদয় হতেই শুনতে পেল,
” আমার খুব ভয় করছে! ”
” চল, বাসায় দিয়ে আসি। ”

মুহূর্তেই কান্না থেমে গেল সিঁথির। শার্ট ছেড়ে পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে বলল,
” কেন? তুই ভয় তাড়াতে পারিস না? ”

বলতে বলতে আরশাদের কাছ থেকে সরে গেল। বালিশ ছাড়া বিছানার মাঝ বরাবর শক্ত হয়ে শুয়ে থাকল। আরশাদ একটু কাছ ঘেষে অসহায় সুরে বলল,
” আমি কাছে থেকেও ভয় তাড়াতে পারছি না। এর থেকে তো ভালো উপায় মাথায় আসছে না। ”
” কোথায় কাছে আছিস? ”

আরশাদ আরেকটু কাছ ঘেষে বসে বলল,
” এই তো। রুম অন্ধকার তো তাই দেখতে পাচ্ছিস না৷ সিঁথি, আলোটা জ্বালিয়ে দিই? ”
” আমার মাথা জ্বালিয়ে দে। ”

তার কণ্ঠে অগ্নি ঝরা রাগ, সীমা অতিক্রম করা বিরক্ত। সিঁথির একটা হাত টেনে নিজের শরীরে রেখে সুধাল,
” এবার বিশ্বাস হয়েছে? ”

সে উত্তর দেওয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করে বসল,
” তোরও কি জ্বর হয়েছে? ”

মুহূর্তে কোমল, উষ্ণ হাতখানি চঞল হয়ে ঘুরতে লাগল আরশাদের পেটে, বুকে, গলায়। নিজের পাশে শুয়িয়ে বলল,
” ঠিক হয়েছে। আমাকে কষ্ট দেওয়ার ফল এটা। ”

সিঁথি জ্বরের কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু কাঁপুনি উঠে গেল শরীরে। মাথার ভেতরটায় যন্ত্রণা টের পেল। চোখের পলক হয়ে ওঠল ভারি। মুখের ভেতরটাও তেতো ঠেকল। সত্যিই কি তারও জ্বর হয়েছে? টানা এক ঘণ্টায় বৃষ্টিতে ভেজার পর জ্বর আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তবুও তার লজ্জা হতে লাগল। খানিকটা ঠাঁট বজায় রেখে বলল,
” কিসের জ্বর? তোর হাত তো এমনিতেই গরম তাই যা স্পর্শ করছিস সব গরম মনে হচ্ছে। ”
” আসলেই? ”
” হ্যাঁ। ”

সিঁথি আরশাদের দিকে চেপে এলো আরও। পরীক্ষা করার অযুহাতে ঘনিষ্ঠতা গাঢ় করল। হাতের স্পর্শে তাপমাত্রা মাপার বদলে ঠোঁট দিয়ে মাপতে শুরু করল।

_____________
আরশাদের ঘুম ভাঙতে দেখল, বিছানা এলোমেলো, শার্ট মেঝেতে, কপালে এক টুকরো জলপট্টি। জ্বর নেই। মন ও শরীর হালকা, সতেজ, চনমনে। রাতের ব্যাপারটা আবছা মনে পড়লেও স্বপ্ন নাকি বাস্তব নিশ্চিত হতে পারছিল না। দরজাতে তালা নেই, আধখোলা। সিঁথি আশপাশে না থাকলেও স্নানাগার থেকে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। সে কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনায় না গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক মিনিট বাদে দরজা মেলে বেরিয়ে এলো সিঁথি। কালকের শাড়ি বদলেছে, ভেজা চুলে তোয়ালে জড়ানো। চোখ-মুখ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, স্নিগ্ধ।

” আন্টির সবগুলো শাড়িই সুন্দর। কোনটা রেখে কোনটা পরব বুঝতে পারছিলাম না। ”

সিঁথির কথাগুলো আরশাদের কানে ঢুকল বলে মনে হয় না। সে চুপচাপ নিষ্পলকে চেয়ে আছে শুধু।

” না বলে ব্যবহার করছি, রাগ করবে না তো? ”
” আমি কি গোসল করব? ”

সিঁথি আয়নায় নিজেকে দেখছিল। একটু অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে তাকাল আরশাদের দিকে। পর মুহূর্তেই বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” তুই গোসল করবি কি করবি না, সেটা তোর ইচ্ছা। আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? ”
” তুই গোসল করে এলি যে তাই। ”
” আমার গোসলের সাথে তোর গোসলের কী সম্পর্ক? ”

আরশাদ বোকা বনে গেল যেন! স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্য তাহলে তাকেই করতে হবে? সে দূর থেকে সিঁথিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ছোটবেলার বন্ধুত্ব হওয়ার ফলে মেলামেশায় তাদের অগাদ প্রশ্রয় ছিল। হাত ধরা, জড়িয়ে ধরা ঘটনাগুলোও স্বাভাবিক ছিল। তবুও সেই স্পর্শ আর কাল রাতের স্পর্শ কি এক? যদি সত্যিই তেমন হয়ে থাকে মেয়েটার মধ্যে একটু হলেও তো পরিবর্তন বুঝা যাবে। লাজুক লাজুক একটা ভাব আসা অবশ্যম্ভাবী। মিনিট কয়েক পেরিয়ে গেলেও সিঁথির মধ্যে তেমন কিছুই নজরে পড়ল না। উপরন্তু চোখে চোখ পড়লেই বিরক্তে ভ্রূ দলা পাকিয়ে ফেলল। ধপ করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সিঁথির মাথায় জড়ানো তোয়ালেটা টেনে নিয়ে গোসলখানায় ঢুকল। গোসল শেষে বেরিয়ে দেখল, সিঁথি বিছানা গোছাচ্ছে। মনে মনে ভাবল, রাতের ঘটনাটা স্বপ্ন হলেও বিয়েটা তো বাস্তবেই হয়েছে। আইনুযায়ী এই মেয়ে এখন তার বউ। রয়েছেও তার কক্ষেই। একটুখানি দুষ্টুমি করা যেতেই পারে। সে ভাবনামতো সিঁথিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আপ্লুত স্বরে বলল,
” বিয়ে হয়েছে, বাসর হয়েছে, এবার হানিমুনের প্লেন করার সময়। কোথায় যাবি বল তো? ”

সে সঙ্গে সঙ্গেই জানাল,
” রাজশাহী, সারদায়। ”
” সেখানে কেন? ”
” ট্রেনিং করতে। ”

সিঁথিকে ছেড়ে নিজের দিকে ঘুরাল। মনে পড়ল, সিঁথির পুলিশ হওয়ার স্বপ্নের কথা।

” এমন একটা ভাব করছিস, যেন নামটা প্রথম শুনলি। এ ব্যাপারে কিছুই জানিস না। ”

আরশাদের মুখের ভাব বদলে গেল। কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” তাহলে বিয়ে করলি কেন? ”
” অভিভাবক বদলানোর জন্য। বুদ্ধিটা তো তোরই ছিল, ভুলে গেলি? ”

চলবে

[ এটা কয়েক পর্বের ছোট ধারাবাহিক হবে। তাই বেশি চরিত্র ও বিস্তারিত দেখানো হবে না। অল্পে অল্পে সমাপ্তি ঘটবে। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here