#তাহারেই_পড়ে_মনে
পর্ব সাত
‘প্রিন্স ভাই, আমি পাঁচ বছর বলেছিলাম, তুমি পাঁচমাসও পারোনি! ভেবেছো এইযে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে তুমি হনহন করে হেঁটে যাও আমার বাসার সামনে দিয়ে, কখনো বাইক নিয়ে একছুটে এমাথা থেকে ওমাথা – আমি টের পাইনা? একদম প্রথমদিনই তোমাকে দেখে ফেলেছি আমি। রাস্তার হালকা ঠান্ডা আলোতে তোমাকে চিনে নিতে আমার তো ভুল হয়না। তোমার উদাস হয়ে চলার গতি ঠিক আমার সামনে এসেই স্লথ হয়ে যায়, তোমার বাইকের ব্রেক ঠিক আমার গেইটের সামনে এসেই পড়ে যায়, আমি তো সব দেখি। তুমি কি ভাবো, আমি এমনি এমনি সন্ধ্যেকাটা রাতে ছাদে উঠে ভুতের মতো হেঁটে বেড়াই? এই নিহারভেজা রাতে ঘরের ভেতর আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, সেও কী অকারণ?
ওইযে ঠান্ডা হাওয়ার কাঁপন ঠেলে কয়েকপাক ঘোরো তুমি একই রাস্তা দিয়ে, তা আমার চোখে পড়েনা তাই তুমি ভাবো, বুদ্ধুরাম? আমার এলোচুলের ঘ্রাণ তোমাকে মাতাল করে দেয় না বা তোমার মুগ্ধ চোখের পলক পড়তে আমি দেখি না কিন্তু আমি জানি তুমি আছো আর তুমি জানো আমি আছি!’
এরকম হাজারটা চিঠি মনে মনে লিখে চলে মিষ্টি। মনের ভিতর যে গণ্ডি কেটে রেখেছে ও তার ভেতর গুপ্তদরজা খুঁজে নিয়ে কোথা দিয়ে কোথায় ঢুকে পড়ে প্রিন্সের ভাবনা আর ওর হৃদয়, অলিন্দ, দেহ ফালাফালা করে রেখে যায়। কখনো কখনো অসহ্য লাগে। মনে হয় ‘যা হয় হোক’ – আবার নিজেকে শাসন করে। এই সম্পর্কটা ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আর হৃদয়ে প্রিন্সের জন্য আলোড়নটাও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো মনের জোর ওর নেই – তাই কিছু সময় ওর খুবই দরকার। এমনিতেই সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে ও যথেষ্ট সন্দিহান, ও ভালোভাবেই জানে দুই পরিবারের কেউই এই সম্পর্ক সহজে মেনে নেবে না। তাই হুইমজিকেল না হয়ে ও বরং নিজেকে একটু ঘেঁটে দেখতে চায়, আসলেই ও মন থেকে প্রিন্সকে চায় কিনা নাকি শুধু বয়সের আবেগ – যেটা সময়ের সাথে সাথেই মিলিয়ে যায়, কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে। আবার প্রিন্সকেও পরখ করে নেওয়া হবে, আসলেই ওর অনুভূতি মিষ্টির জন্য কতটা খাঁটি – সহজে চাওয়া পাওয়াতে পরিণত হলে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো উবে যাবেনা তো? মনের এই দ্বৈরথে মিষ্টি মাঝেমাঝেই ক্লান্ত হয়ে যায়।
অন্যদিকে প্রিন্সের অবস্থা দেবদাসের চাইতে কোনো অংশে কম না। ও আসলে জানেই না ও কী করছে! মিষ্টি যতটা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে ও ঠিক ততটাই অন্ধ আবেগে মিষ্টির কথা শুনে চলেছে। কখনো কখনো ওর মিষ্টিকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে রাগে, আক্রোশে আবার কখনো মিষ্টির পা ধরে বসে থাকতে মনে চায় তাতে যদি মিষ্টির এই ‘ফাউল ডিসিশন’ বদল হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই ও মিষ্টির কথার অবাধ্য হতে পারে না – মনের অজান্তেই ও জানে মিষ্টির সব কথা ওর শুনতেই হবে। কেন, কী কার্যকারণ না জেনেই ও তাই মিষ্টির সামনে যায়না, মিষ্টিকে বিরক্ত করে না। কিন্তু তাই বলে পাঁচবছর মিষ্টিকে না দেখে থাকতে হবে এমন আজব কথা কে কোনদিন শুনেছে- এমন ভয়ংকর পরিকল্পনা মেনে নেওয়াও ওর জন্য দুঃসাধ্য। তাই ও দুঃসাহসি হয় – অবাধ্য হয় মিষ্টির। প্রায়ই রাত নেমে আঁধার ঘনিয়ে আসলে ও মিষ্টির বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ায় – যেন কেউ দেখে চিনতে না পারে, মিষ্টিও যেন এতটুকু টের না পায়! মিষ্টির দেখা পাবেই সেই আশা ছিলো ক্ষীণ তবুও কেন ওইভাবে এসে দাঁড়িয়েছিলো ডেইজি হাউসের গেইটে ও জানে না – কিন্তু মিষ্টিকে দেখতে পেয়ে উত্তেজনায় শরীর ওর শিথিল হয়ে আসে। অন্ধকারে মিষ্টির স্নিগ্ধ মুখ ও দেখতে পায় না কিন্তু ছাদের উপর ওর অবয়ব দেখেই মন ভরে যায় এক অন্যরকম প্রশান্তিতে। আবার মাঝেমাঝে ভয় হয়, ও মানবী না হয়ে কোনো অশরীরী নয়তো – কীভাবে টের পায় প্রিন্সের পায়ের আওয়াজ! কেন ঠিক ওই সময়টাতেই খোলা ছাদের অসমাপ্ত পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় মিষ্টিকে? ওর খোলা চুলের ঘ্রাণ যে অতখানি দূর থেকেও মাতাল করে দেয় প্রিন্সকে, ওই কঠোরহৃদয় মেয়ে কি জানে তা? ও হাতদুটো শক্ত করে মুঠোবন্দি করে বিড়বিড় করে ‘চুল খুলে রাখতে নেই, মেয়ে।’
*****
স্বপ্ন পূরণ করতে যতটুকু পরিশ্রম লাগে তার সবটাই করেছে মিষ্টি, টালমাটাল আবেগে নিজের পা হড়কাতে দেয়নি কিছুতেই আর স্বপ্নটা তাই সত্যি হয়ে হাতের মুঠোয় বন্দী হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত ছাত্রী এখন ও। হলে সিট পায়নি, আজিমপুর সরকারি কলোনির এক বাসায় সাবলেট থাকছে। বাবা এসেছিলো, মাও মিঠিকে নিয়ে এসেছিলো – সবকিছু গুছিয়ে দিতে। ছোট্ট মিঠিকে ছাড়তেই ওর বুকভাঙা কষ্ট হলো – কী সুন্দর ফোকলা গালে হেসে বলে ওঠে ‘মিততি’!’ ছোট্ট আঙ্গুলগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ‘তাতা’ দিতে দিতে চলে গেলো মায়ের কোলে চড়ে। বয়সের তুলনায় মিষ্টি তো বড্ড বেশি পরিণত, তাই সামলে নিলো নিজেকে ভালোমতোই।
কিন্তু প্রিন্সযে নিজেকে সামলে রাখবে এই কথা কেউ কি গ্যারান্টি দিয়ে রেখেছে? তাই প্রথমদিনের ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরিতে ঢোকার আগমূহুর্তেই ও দেখলো মুখ কাচুমাচু করে একদম ওর মুখোমুখি প্রিন্স! মিষ্টি একটু অবাক হলো কিন্তু হতচকিত হলো না। বরং মন থেকে একটা বিরাট ভার নেমে গেলো যেনো – কখনো কখনো সাজানো গোছানো জীবন বড্ড একঘেয়ে লাগে – একটু এলোমেলো ঝড় মন্দ হয়না!
‘দেখ মিষ্টি, নতুন কোনো কাহিনি হবে না, আমি এতোদিন তোরে একটুও বিরক্ত করিনি। আর তুই আমাকে লাট্টু বানায়ে যেমন ইচ্ছে ঘোরাচ্ছিস! আসলে তোর কোনো ফিলিংসই নেই আমার জন্য – সবাই ঠিকই বলে!’
‘সবাই আর কি বলে?’ আনন্দে মিষ্টির মুখেও চওড়া হাসি।
‘বলে, আমাকে সাদাসিধা পেয়ে তুই এইরকম অদ্ভুত শর্ত দিয়ে রেখেছিস, নইলে এইভাবে কেউ প্রেম করে?’
‘কিভাবে প্রেম করে, প্রিন্সভাই?’ কৌতুক আর আহ্লাদে মেশানো মিষ্টির গলা।
‘ওইতো, সবাই বলেতো, এতো কাহিনি করার কি দরকার, দুম করে বিয়ে করে নিলেই তো হয়। মিয়া- বিবি রাজি… ‘ এইটুকু বলেই ওর খেয়াল হলো মিষ্টি ফাজলামো করছে ওর সাথে। ‘তুই অনেক শয়তান একটা মেয়ে মিষ্টি। তোর কপালে অনেক কষ্ট আছে, দেখিস।’
‘তা তো আমি জানিই, আমার কপালে অনেক কষ্ট আছে।’ ফিসফিস করে বলে মিষ্টি, সেইকথা প্রিন্সের কানপর্যন্ত পৌঁছায় না।
‘তুই, এতো সারাদিন পড়ে কি করলি বলতো? কি বলছে সব কি ফলিত, টলিততে চান্স পেয়েছিস? এতো পড়ে আমাকে এতো ঘুরিয়ে ফলমূল দিয়ে কী করবি?’
‘ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, প্রিন্সভাই- এপ্লাইড ফিজিক্স’ হাই তুলতে তুলতে বলে মিষ্টি। এ কোথায় মরেছে ও, যে কীনা ওর সাবজেক্টের নাম বলতেই তিনটা দাঁত ভাঙবে!
‘চুপ, একদম চুপ। মুখ খুললে যা বেরোয় তা বলার একেবারেই দরকার নেই । কথা বলার একদম দরকার নেই। চুপ করে বসো এখানে।’ বলেই ঘাসের উপর বসে পড়ে মিষ্টি।
প্রিন্সও মুখ গোঁজ করে পাশে বসে। একটু পরেই আবার কথা বলে ও ‘আমি ভেবেছিলাম তুই অনেক রাগ করবি। ওরা যা বলে সব ভুল, তাইনা মিষ্টি? সবাই বলে, তুই এতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রি। আমিতো তোর তুলনায় একেবারেই অশিক্ষিত। তুই কখনোই আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসিস না! তোর হাতটা ধরি, মিষ্টি!’
খুব করুণ শোনায় প্রিন্সের কথাগুলো। এইখানেই মিষ্টির ভয়- এই কম্পারিজনের সামনেই একদিন দাঁড়াতে হবে ও জানে, সম্পর্কের মাঝে টাকা আর যোগ্যতাই দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। যোগ্যতা বা টাকা কি ভালোবাসার মাপকাঠি হয়? ভালোবাসা তো এমনি এমনিই হয়!
মিষ্টি প্রিন্সের হাতে হাত রেখে রাগ করেই বলে ‘ আর কি বলে তোমার সবাই? বলে না দুম করে একটা চুমু খেয়ে নিতে? তাহলে দাওনা…।’ মিষ্টি গাল বাড়িয়ে দেয় প্রিন্সের দিকে।
‘তুই অনেক শয়তান, মিষ্টি। আমার ভুলই হয়েছে তোর কাছে আসা। আমি আর কখনো আসব না। আমার মুখ তোকে আর দেখাবই না। যদি তোর সামনে আসি তো তোর পা আর আমার মুখ!’ ক্ষেপে উঠে দাঁড়ায় প্রিন্স।
মিষ্টি হাসতে হাসতে বলে ‘তুমি শুধু চুমুতেই আটকে গেলে? আমার প্ল্যানিং তো অনেক দূর – প্রিন্সভাই। আমিতো বাচ্চাকাচ্চার নামও ঠিক করেছি। আমার ছেলের রাখবো ‘শাহেনশাহ।’ প্রিন্সের ছেলে শাহেনশাহ! ভালো হবে না, বলো।’ হাসতে হাসতে পারলে মাটিতেই শুয়ে পড়ে মিষ্টি!
‘তুই মরে যা, মিষ্টি।’ বলেই দ্রুতবেগে হাঁটা দেয় প্রিন্স!
চলবে…
(কখনো কখনো অল্পই ভালো 🥰)