তিলেত্তমা পর্ব ৫

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৫

একটা খুবই অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে! আজকে আমাদের এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে এবং সবাইকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে আমি সাগুফতার থেকে ভালো রেজাল্ট করে বসে আছি! সবার কথা বাদ দিই, আমি নিজেই তো অবাক হয়ে বসে আছি খবর শুনে। বাবা কেজি পাঁচেক মিষ্টি এনে আশেপাশে বিলোচ্ছেন, মা জনে জনে ফোন করে খবর দিচ্ছেন- মেয়ে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। আত্নীয় স্বজনরা সকলেই জানে ছেলেবেলা থেকে রাত্রি-সিফু একসাথে বড় হয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবেই সিফুর রেজাল্টের খবরটাও জানতে চাচ্ছে সবাই-ই। মা’কে বিমর্ষ গলায় বলতে শোনা যাচ্ছে- ‘ ইংরেজী আর রসায়নে ছুটে গেছে সিফুটার, নিশ্চয়ই কোনো গোলমাল হয়েছে। বড়পা বোর্ডে যোগাযোগ করছে, re check এর এপ্লিকেশন নিয়ে!’

তবে আমরা যতটা অবাক হয়েছি, আমার স্কুলের স্যারেরা কিন্তু অতটা অবাক হননি। আমার সেই অংকের স্যার তো বাবাকে বলেই বসলেন- ‘এ মেয়ে ভালো করবে সে তো জানাই ছিলো। এবার মিষ্টি আনুন দেখি বেশি করে!’

কথা মিথ্যে নয়, ক্লাস টেন এর টেস্ট পরীক্ষায় আড়াইশো মেয়ের মধ্যে আমার পজিশন ছিলো এগারো! সেই মধ্যবিত্ত রেজাল্টের মেয়েটা রাতারাতি কী করে উচ্চবিত্ত হয়ে গেলো সেটা এক রহস্য বটে! কিন্তু, খুব ভালো করে ভেবে দেখলে এর কারণটা পরিষ্কার বোঝা যায়। পড়ালেখা করা ছাড়া আমার আসলে আর কোনো ‘অপশন’ ছিলোনা! উদাহরণ দিই- সিফুর কথাই যদি বলি, কত্তকিছু করবার ছিলো ওর! ছিলো বলছি কেনো, এখনো আছে! সুজনের সাথে একটা পাকাপাকি সম্পর্ক ছাড়াও ওর জীবনে এসেছিলো আরো অনেকে- আশিক, সোহাগ, হৃদয় কিংবা সেই শোভন! সাগুফতা না চাইতেই এরা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ওর দিকে, সাগুফতাও তাতে অসম্মতি প্রকাশ করেনি। একদিন সুজনের সাথে ঝগড়া হয়েছে তো আশিক এসে সিফুর মন ভালো করার জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন করে ফেলেছে! আজ ভালোবাসা দিবসে পুরোটা সুজনের সাথে ঘুরেছে তো কাল বন্ধু দিবসে বন্ধুদের নিয়ে ‘হ্যাং আউটে’ গেছে।

শুধু কি সিফু? একই ঘটনা তো আমার স্কুলের কত্ত মেয়ের সাথেই হয়ে গেলো এই ক’বছরে! হোসেন স্যারের অসম্ভব সুন্দর অঙ্ক বোঝানোর দক্ষতায় ক্লাস নাইন পেরোতে না পেরোতেই গণিত বিষয়টায় বেশ দখল চলে এসেছিলো আমার… সেই সুবাদে দু’চারজন বান্ধবীও জুটে গিয়েছিলো! এদের একজন তার বাসার টিচারের সাথে প্রেম জুড়ে দিলো, আরেকজন তাদের বাড়িওয়ালার বড় ছেলের গলায় ঝুলে গেলো! একজনের হলো পড়তে পড়তে প্রেমে পরা, আরেকজন সিঁড়ি বেয়ে আসতে যেতে দোতলার সুদর্শনের ঘাড়ে ঝুলে পরা! তৃতীয় যে বান্ধবী, সেও কিছুদিন পর খবর নিয়ে এলো- ‘ওরে! আমারো যে হয়ে গ্যাছে! বাপির বন্ধুর ছেলে…’

ব্যস! চারজনের দলে সেই রাত্রি একলা বাকি পরে রইলো। প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে ওরা ঘুরতে চলে যেতো, একেকদিন একেক জায়গায়। আমার তো কেউ নেই, কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছুটি করবার নেই। আমার জন্য পড়ে রইল কেবল কিছু বই। বেশ, তাই-ই সই!

একদিকে যেমন বেড়ে গেলো আমার গল্পের বই পড়ার হার, অন্যদিকে তেমন তরতর করে বাড়তে আরম্ভ করল অঙ্কের নাম্বার! দু’চারটা পরীক্ষাতে ভাল করার পরে টের পেলাম অনেকেই কেমন সমীহের নজরে দেখছে আমায়! ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর, পুতুল পুতুল মেয়েটা, দিশা- যার দিকে তাকালে প্রচণ্ড আফসোসে স্রষ্টাকে মনেমনে জিজ্ঞেস করতাম- ‘একই হাতে ওকে আর আমাকে গড়লে কেমন করে গো?’- একদিন গণিতের ক্লাস টেস্টের সময় সে নিজে যেচে আমার পাশে বসে বললো যেন ওকে দেখাই আমি, গতকাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে থাকার কারণে প্রিপারেশন নিতে পারেনি সে।

আচ্ছা, এই মেয়েটার কথা কি বলেছি আগে? বুকের ভেতর খুব গোপনে লালন করা কতগুলি কষ্টের ভেতর একটা কষ্টের সাথে এই মেয়েটা জড়িয়ে আছে!

সে প্রায় বছর ছয়েক আগের ঘটনা!ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর এ পড়তাম, তখন একেবারে বোকার হদ্দ ছিলাম আমি। নিজের মত চুপচাপ থাকতাম বলে কোনো বন্ধুবান্ধব ও জোটেনি, অথচ সেই বয়সেই বেশ কয়েকটা ‘ফ্রেন্ডগ্রুপ’ তৈরি করে ফেলেছিলো বাকি মেয়েরা! এরমধ্যে সবচেয়ে দাপুটে গ্রুপটা ছিলো দিশা-দের। দিশা, অন্তরা, রাওনাফ আরো দু’চারটে মেয়ে মিলে ডাঁকসাইটে ‘ক্যাপ্টেন গ্রুপ’ বানিয়েছিলো! প্রতিবছর এদের দলটা থেকেই কাউকে না কাউকে ক্লাস ক্যাপ্টেন বানানো হতো। এরা প্রত্যেকেই ভালো ছাত্রী হওয়াতে টিচারদের বেশ প্রিয় ছিলো। তারওপর এদের প্রত্যেকের বাবামায়েদের ই আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিলো, ক্লাস ওয়ান থেকেই টিচারদের বাসায় বাসায় যেয়ে কোচিং করতো এরা সকলে। এমনকি বাংলা, ধর্ম কিংবা সমাজের মত সহজ বিষয়গুলিও ওরা দলবেঁধে ক্লাস টিচারদের বাড়িতে যেয়ে আলাদাভাবে কোচিং করতো, আর তাই স্বাভাবিকভাবেই টিচারদের প্রিয়মুখ ও ছিলো এই মেয়েগুলি। তো যাইহোক, তখন আমার বয়স কম, এতশত তো বুঝতাম না! মা’কে যেয়ে বললাম- ‘ওদের সাথে আমিও বন্ধু হতে চাই, তুমি ওদের বলে দাও আমায় যাতে ওদের দলে নেয়!’ ওহ, বলে রাখি- আমরা কিন্তু অত বড়লোক নই! একটা ছোটখাটো সরকারি চাকরি করতেন বাবা। মা বললেন এভাবে বলেকয়ে নাকি বন্ধুত্ব হয়না, ওদের সাথে মিশতে মিশতেই একদিন ওরা আমার বন্ধু হয়ে যাবে। বেশ কথা! পরদিন বেশ ভেবেচিন্তে, বুকের ভেতর সাহসের বেলুন ফুলিয়ে ওদের দখলকৃত বেঞ্চগুলির একটার এককোণে যেয়ে বসলাম! ক্লাসের একদম সেরা জায়গায় সবচেয়ে ভালো তিনখানা বেঞ্চ বসিয়ে নিয়েছিলো ওরা নিজেদের জন্যে, রোজ সেখানেই বসতো। সবমিলিয়ে আটজনের দল ছিলো ওরা, আর তিনজন করে এক বেঞ্চে বসতে হতো আমাদের। তো তিন বেঞ্চে ওরা বসে যাবার পরও রোজ একজনের জায়গা খালি থেকে যেতো, ওখানে আর কেউ বসতো না। মনে মনে কতদিন যে নিজেকে ঐ জায়গাটাতে বসিয়েছি! ক্লাসের মাঝে ওরা যখন একে অন্যের কানেকানে ফিসফাস করে কিছু একটা বলে মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসতো কিংবা স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদের ভেতর চিরকুট চালাচালি করতো- খুব লোভ হতো আমার! ঐ ছোটছোট, অবান্তর কথাগুলি শোনার জন্য, ঐ হাতে হাতে চলে অবশেষে ছেঁড়া অবস্থায় মেঝেতে পরে থাকা চিরকুটগুলি পড়ার জন্য- আমার ছোট্ট মনটা ছটফট করতো! অবশেষে সেদিন সাহস করে সশরীরেই বসে গেলাম ঐ জায়গাটাতে… তৃতীয় সারির বেঞ্চটার কোণায়।

–‘তুমি এখানে বসেছ যে? জানোনা এটা আমাদের জায়গা?’- খানিক বাদেই অন্তরা এসে প্রশ্ন করলো।

–‘আমি… আমি! বসোনা এখানটায়, একজনের জায়গা তো ফাঁকাই পরে থাকবে…’- ঢোঁক গিলে নিয়ে থেমে থেমে বললাম আমি। মা বলে দিয়েছে- মিশতে হবে ওদের সাথে! তবেই না বন্ধু হবে ওরা আমার! উহু, ভয় পেলে চলবেনা!

–‘কীইইইহ!’- নাক টেনে একটা শব্দ করে অন্তরা। তারপর চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকায়, যেন অস্পৃশ্য কোনো জন্তুকে দেখছে। না না, তখনো সেই দৃষ্টিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার বয়েস হয়নি আমার! বহুদিন পর চোখ বুঁজে সেদিনের কথা ভাবতে গিয়ে টের পেয়েছি- বোধহয় হাঁটাচলার পথে একটা তেলাপোকা পরে থাকলেও এভাবেই তাকাতো অন্তরা!

বিড়বিড় করতে করতে একদম সামনের বেঞ্চটায় যেয়ে বসে অন্তরা, মাঝের বেঞ্চটা ফাঁকা রেখে। এক এক করে ওদের দলের বাকি মেয়েগুলি আসতে থাকে, সেই একই রকম দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে যার যার মত বসে যায় ওরা বাকি বেঞ্চ দুটোতে… টের পাই একে অন্যকে ফিসফাস করে কিছু বলছে ওরা আর বারবার ঘুরে তাকাচ্ছে আমার দিকে। তবু সাহসের শেষবিন্দুটুকু আঁকড়ে ধরে আমি বসে থাকি একা, তিনজনের বেঞ্চটার পুরোটা দখল করে!

একে একে আটজন ই চলে এসেছে ওরা, সামনের দুই বেঞ্চে গাদাগাদি করে আটজন বসেছে, তবু আমার পাশে কেউ বসেনি! নিরীহগোছের, গোবেচারা রোল ৫৬র এহেন অদ্ভুত আচরণে ক্লাসের বাকি মেয়েরাও কানাকানি শুরু করে দিয়েছে। নিজেকে ক্যামন বোকা বোকা লাগছে এখন আমার, আমার পাশে বসলে কি জাত চলে যায় অন্যদের? যে ই ক্লাসরুমে ঢুকছে সে-ই অবাক হয়ে এদিকে তাকাচ্ছে আর তারপর দৌড়ে যেয়ে নিজের বন্ধুদের সাথে ফিসফাস করছে… কী ভীষণ বিব্রতকর একটা অবস্থা! ‘মিছিমিছি’ আমায় গাল দিচ্ছিলো তখন ভীষণ, এখনও মনে আছে সেকথা!

ক্যাপ্টেন গ্রুপ বেশিক্ষণ এভাবে চিপকে থাকতে পারলো না, প্রথম ক্লাসেই ম্যাডাম এসে তিনজন করে বসতে বলে ওদের উঠিয়ে দিলেন। কেউই আমার পাশে বসতে চায়না, এ-ওকে সে-তাকে গুঁতোচ্ছে! অবশেষে ম্যাডামের ভয়ে নিতান্ত বাধ্য হয়ে দু’জন এলো আমার পাশে- দিশা আর অন্তরা! আমি কি খুশি হয়েছিলাম তখন? একটু আশার আলো দেখে? নাকি প্রচণ্ড লজ্জা আর অপমানে কুঁকড়ে ছিলাম? – নাহ! মনে নেই!

এটুকু মনে আছে, তখনো হাল ছাড়িনি। কী ভীষণ জেদি একটা জোঁকের মত লেগে ছিলাম ওদের বন্ধু হতে চেয়ে, এখন সেকথা ভাবলেও লজ্জায় গা গুলোয়! ক্লাসের গ্যাপ গুলোতে আমি যাতে শুনে না ফেলি, সেজন্যে মুখে হাত দিয়ে নিজেরদের মধ্যে কথা বলছিলো ওরা। কিন্তু মা যে বলে দিলো মিশতে হবে ওদের সাথে? এরকম করলে আমি মিশব কী করে? কথাই তো বলছেনা ওরা আমার সাথে! আচ্ছা, আমিই বলি নাহয়…

–‘তোমরা এত কী বলাবলি করো? আমি কাউকে বলবোনা, আমাকে বলোনা!’

দিশা আমার পাশে বসে ছিলো, আচমকা লাফ দিয়ে অন্তরার একেবারে কোলের কাছে ঘেঁষে গেলো ও- যেনো কালো একটা কিলবিলে জোঁক দেখেছে এইমাত্র!

ব্যস! ওদের কথা বলাবলিও বন্ধ হয়ে গেলো! এবারে নিজেদের মধ্যে চিরকুট চালাচালি করতে আরম্ভ করলো ওরা।

আমি বোধহয় ছ্যাঁচোড় ছিলাম ছোটকালে, নয়ত বিশ্ববোকা! নাহয় এরপরেও সরে না গিয়ে কীভাবে বলে বসলাম-

–‘ওটা ছিঁড়ে ফেলোনা! আমাকে দেখিও প্লিইজ!’

যেন শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে কাগজটা ছিঁড়ে ফেললো রাওনাফ! সামনে উবু হয়ে ওদের কানেকানে কি একটা বললো দিশা, আমি কেবল দেখলাম সকলের মুখে হাসি ফুটেছে! খাতার পেছনের পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে নিয়ে খসখস করে তাতে কিছু লিখলো দিশা, তারপর সবাইকে দেখালো। বাকিরাও কিছু কিছু লিখা যোগ করলো, তারপর দিশার হাতে ফেরত দিলো।

কী অবাক কাণ্ড! আমার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়েছে দিশা! মা তবে ঠিকই বলেছিলো… মিশতে হবে, তবেই বন্ধুত্ব হবে!

খুশিতে ডগমগ হয়ে কাগজটা লুফে নিলাম।

–‘থ্যাংকু!’- দু’পাটি দাঁত বের করে কাগজটার ভাঁজ খুলতেই লেখাগুলি চোখে পরলো-

‘ময়ূরের পুচ্ছ লাগালেই কাক কি ময়ূর হয়? সেই কাক ও ময়ূরের গল্পটা পড়োনি? বাংলা সহপাঠ বইতে আছে, ১৫ নং পৃষ্ঠায়- পড়ে নিও।’

নিচে একটা ছবি, তাড়াহুড়োয় পেন্সিল দিয়ে আঁকা। আটটা ডানাসহ পরী একসাথে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের পায়ের কাছে কিলবিল করছে একটা মোটাসোটা চীনেজোঁক…

এখনো মনে আছে টপটপ পানিতে ভিজে গিয়েছিলো কাগজটার একপ্রান্ত। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাথরুমে যেয়ে দরজা লাগিয়েছিলাম, মুঠোর ভেতর তখনো কাগজটা ধরে রাখা… চীনেজোঁক আর সারাদিনে বেরোয়নি সে বাথরুম ছেড়ে! ছুটির ঘন্টা বাজলে সবাই যখন হুড়মুড় করে নেমে গেছিলো, তারপর ফাঁকা হয়ে যাওয়া ক্লাসরুমটায় যেয়ে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে নেমেছিলো সে।

তারপর থেকে প্রতিদিন পেছনের বেঞ্চটায় বসে ক্লাস করে গেছে চীনেজোঁক, আর কোনো ডানাকাটা পরীর সাথে কখনো মিশতে যায়নি… মনের ভুলেও না!

সাগুফতার রেজাল্ট আর বদল হয়নি, recheck করেও একই ফলাফল এসেছে। অনেক ভেবেচিন্তে মামারা বলেছেন, বড়খালামনি ঐ স্কুলের টিচার বলে এতদিন সিফু হয়ত প্রাপ্যের চাইতে বেশি বেশি সুবিধা পেয়ে এসেছে, শেষমেশ বোর্ড এক্সামে যেয়ে রেজাল্টটা খারাপ হলো! তাই অনেক কথাবার্তার পরে ওকে ঢাকায় এনে আমার সাথে একই কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে।

ডায়েরিটা, কেবল আমার ডায়েরিটাই জানে- সিফু আসাতে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে! এমনিতে মা আমায় যেমনই আদর করুন, সিফু এলে মায়ের কী জানি হয়! সারাক্ষণ ওর সাথে আমার তুলনা দেন মা, আর মন ভার করে বসে থাকেন। ‘সিফুর পায়ের পাতাটা দেখ, কী সুন্দর, কী সুন্দর! তোর ত হয়েছে বাপের মত থ্যাবড়া পা!’

‘দেখতো সিফু কি সুন্দর সেজেগুজে বেরোয়, এই অকালকুষ্মাণ্ড নিয়ে আমার হয়েছে গেরো! কার ঘরে যে পার করবো এই মেয়ে আমি! ‘

কিংবা, ‘হ্যাঁ রে সিফু, ওই লকেটটা কী সুন্দর মানায় রে তোকে! রাত্রির জন্য বানিয়েছিলাম পুরো ছয় আনা স্বর্ণ দিয়ে, তা মেয়ের গায়ে সোনা ফুটলে তো! তুইই নিয়ে নে এটা, ধর!’- ব্যস আমার সাধের গোলাপি পাথর বসানো লকেটখানা হাতছাড়া।

আচ্ছা, মা যেমন বলে আমি কি আসলেও অমন হিংসুটে?

আমি বুঝি মা কেন এমন করেন! মায়েদের তিনবোনের মধ্যে আমার মা সবচেয়ে সুন্দরী ছিলেন! পাড়ায় খানবাড়ির তিন মেয়ের মধ্যে মেজোমেয়ে সোহেলীকে সকলে একডাকে চিনতো! ওদিকে বড়খালা ছিলেন এক্কেবারে উলটো, নানাভাইয়ের মত পুরুষালি চেহারার ধাঁচ পেয়েছিলেন। অথচ কপাল দেখো দুই বোনের? নানাভাইয়ের কারণেই কীনা মায়ের বিয়ে হলো আমার কালোকুলো বাবার সাথে আর বড়খালার বিয়ে হলো সুদর্শন বড়খালুর সাথে! বড়খালুদের অবস্থা বেশ গরিব ছিলো, কালো মেয়েটাকে তার হাতে গছিয়ে বিনিময়ে তার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নানাভাই। আর, ওদিকে আমার বাবা আমার মতই কালো-কুলো হলেও একখানা সরকারি চাকরি ছিলো তার… নানাভাইয়ের সুন্দরী মেয়েটাকে বিয়ে করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি বাবাকে তাই!

ছেলেবেলা থেকেই সবার কাছে একটু বাড়তি সমাদর পেয়ে পেয়ে বড় হয়েছেন আমার মা। এ তো জানা কথাই- ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী!’ তাই নিজের অসুন্দর মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের বড় চিন্তা হয়, সাগুফতাকে চোখের সামনে দেখলে মায়ের সে চিন্তার পালে হাওয়া লাগে। সাগুফতা নামক জ্বলজ্বলে তারাটার পাশে নিজের গর্ভের মেয়েটাকে বড় মলিন লাগে। মা তাই এখানে সেখানে যার কাছে যত প্রসাধনীর সন্ধান পান সব এনে হাজির করেন। আমার ড্রয়ার ভরে উঠতে শুরু করে ফেয়ার এণ্ড লাভলি, হরেক রকম আয়ুর্বেদিক সাবান আর ফেয়ারটোন পাউডারের কৌটো দিয়ে…

সাগুফতার এখানে আসবার খবর শুনে তাই আমার ভীষণ মন খারাপ হয়! ভীষণ!

কত কিছু বকবক করে গেলাম, আসল কথাটিই তো বলিনি! সেই শোভনের ঘটনার পরে কী হলো? বিদ্ধস্ত, অপমানিত মেয়েটার জন্য ধরণী সেদিন দ্বিধা হয়নি, বাড়ি ফিরে যাবার পর সকলের কাছে বেশ খানিকটা বকা শুনতে হয়েছিলো বরং, দেরি করে ফিরবার কারণে! যে বোনের প্রতিশোধের বলি হলো মেয়েটা, তাকে কিচ্ছুটি বলেনি সে! বলা ভালো, লজ্জায় বলতে পারেনি কিছুই। কেবল সারারাত কেঁদে কেঁদে অন্তরীক্ষের কাউকে বলেছিলো- ‘যদি আমি অপরাধ করে থাকি তো আমায় শাস্তি দিও! তা না হয় তো যে আমার সাথে এতবড় অবিচারটুকু করলো তাকে তুমি ছেড়োনা…’

বুকের ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ কেবল সান্ত্বনাবাক্য বলে যাচ্ছিলো তখন। পাশে শুয়ে শুয়ে সাগুফতা সহাস্যে সুজনকে গান শোনাচ্ছিলো-

‘কেউ কোনোদিন আমারে তো, কথা দিলো না…
কথা দিলো না।
বিনি সুতোর মালাখানি গাঁথা হইলো না…
গাঁথা হইলো না!’

স্কুলের ছুটি আরো কিছুদিন বাকি ছিলো, আমি পরদিনই ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ছোটমামার সাথে ঢাকায় রওনা করি। মামার কাজ ছিলো সেদিন ঢাকাতে, আমিও ঝুলে পড়ি ওর গলায়। সাগুফতা রয়ে যায় নানুবাড়িতেই, ওর ছুটির আমেজ তখনো ফুরোয়নি…

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here