#তি_আমো(রিপোস্ট)
পর্ব – ২
Writer: Sidratul muntaz
স্টেজে কেক কাটা হচ্ছে। সাথে চলছে ফটোস্যাশন। কিছুক্ষণ আগের দূর্ঘটনা ভুলে সবাই আবার হাসি-আনন্দে মেতে উঠেছে। এতে আমিও কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি। কিন্তু আমি এখনও মোহনা আন্টি মানে ঈশানের মায়ের পাশে বসে আছি। অন্যপাশে বসেছে ঈশান। মোহনা আন্টি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন,
” নিহা খুব সাহসী একটা মেয়ে। আমি ওকে কেন এতো পছন্দ করি, জানো?”
আমি আঁড়চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তার কাঁধেই আমার কানের দুল। তাই আমার মনোযোগও সেখানে। মোহনা আন্টি আমার উত্তর না পেয়েও কথা বলে যেতে লাগলেন। ঈশান মাথা নিচু করে বসে আছে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু হাসছে। কেক কাটা শেষ হওয়ার পর মিউজিক শুরু হলো। নিহা আর সাফিন ভাইয়া এখন ড্যান্স করবে। মোহনা আন্টি হাত তালি দিতে দিতে বললেন,
” অপূর্ব! তারিন, তুমিও যাও না। ওদের সাথে ড্যান্স করো।”
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,” আমি ওখানে গিয়ে কি করবো আন্টি? ওরা তো কাপল। আর আমি সিংগেল মানুষ! ”
” প্রবলেম কি? ঈশানের সাথে যাও!”
এই কথা শোনার পর যতটা না আমি অবাক হলাম তার চেয়েও বেশি যেন অবাক হলো ঈশান। সে মুখে হাত দিয়ে কেশে ফেলল। তার অবস্থা দেখে আমি হেসে ফেললাম। ঈশান বিব্রত ভঙ্গিতে বলল,
” কি যে বলো মম! আমরা কেন ড্যান্স করবো? আমরা কি কাপল?”
মোহনা আন্টি অতি স্বাভাবিক চালে বললেন,” ড্যান্স করার জন্য কাপল হতে হবে কেন? এতো মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে তোর ড্যান্স করতে ইচ্ছে করছে না?”
আমার খুবই লজ্জা লাগছে। আমি চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। মোহনা আন্টি আমার হাত টেনে ধরে বললেন,” যাচ্ছো কই? এদিকে বসো। থাক ডান্স করতে হবে না।”
ঈশান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাথে আমিও। একটু পরেই নিহা দৌড়ে এলো। আমাকে হাত ধরে স্টেজে নিয়ে গেল ছবি তোলার জন্য। ক্যামেরাম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল,” ভাইয়া, এটা হচ্ছে আমার বেস্টফ্রেন্ড। আমার জান। আমাদের চমৎকার কিছু ছবি তুলবেন।”
আমি আর নিহা প্রায় একই রকম লেগেঙ্গা পরেছি। শুধু রংটা ভিন্ন। দু’জনের চুলের স্টাইলও এক। এ সব কিছু নিহার পাগলামি। সে কখনও কোনো জিনিস একা কিনবে না। আমার জন্যেও কিনবে। এই নিয়ে অবশ্য ভার্সিটিতে সবাই অনেক মজা করে। কেউ তো বলে, নিহা বিয়ের সময় বরও খুঁজবে ডুপ্লিকেট। যেন নিজের সাথে আমার বিয়েটাও দিতে পারে।
ছবি তুলতে তুলতে আমার হঠাৎ মনে পড়ল, মেকাপরুমে আমার ব্যাগটা আছে। ব্যাগের ভেতর মোবাইল আছে। নিশ্চয়ই মা ফোন করতে করতে অস্থির হয়ে যাবেন৷ আমি নিহাকে বলে দ্রুত মেকাপ রুমে ছুটে গেলাম ফোন আনার জন্য।
আমার ব্যাগের উপর একটা ছোট চিরকুট। চিরকুটের সাথে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো একটা কালো পায়েল। চিরকুটে লেখা,” পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পায়ের মালকিন, এটা তোমার জন্য।” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এসব কে দিল আমাকে? ঈশান?
ফোন বাজছে। মা ইতোমধ্যে অনেক বার কল দিয়ে ফেলেছেন। স্ক্রিনে মিসডকল ভেসে আছে। আমি চিরকুট ফেলে দ্রুত ফোন রিসিভ করলাম। মা উদগ্রীব হয়ে বলল,” তারু, কোথায় তুই? দ্রুত বাড়ি আয়। তারিফ ফিরে আসছে।”
ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। আজ ভাইয়ার অফিসের কাজে শহরের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। সেই ভরসাতেই আমি এখানে এসেছি৷ ভাইয়া তো আর জানবে না। জানলে আর আমাকে আসতে দিতো না। আমার ভাইয়া খুবই কনজার্ভেটিভ। সে আমাকে একা ভার্সিটিতেও যেতে দেয় না। আর রাতে পার্টিতে যেতে দেবে এই কল্পনাও তো বিলাসিতা! আমি অবাক হয়ে বললাম,” ভাইয়া আসছে মানে? আজরাতে তো ভাইয়ার ফেরার কথা ছিল না। ভাইয়া না মহেশখালী যাবে?”
” যাওয়ার কথা ছিল। এখন কি কারণে যাচ্ছে না আমি কি জানি? একটু আগেই ফোন দিয়ে বলল বাসায় আসছে। এসে যদি তোকে না দেখে তাহলে কেলেংকারী হয়ে যাবে, মা! তুই দ্রুত আয়।”
বাঘ আসার খবর শুনলেও আমি এতো ভয় পেতাম না, যতটা ভাইয়া আসার খবর শুনে পেলাম। খুব দ্রুত মোবাইল আর চিরকুট ব্যাগে ভরে গুছিয়ে নিলাম। ঈশানের থেকে আমার কানের দুলটাও নেওয়া হয়নি। এখন এসব নিয়ে ভাবার সময়ও নেই। আমি লেহেঙ্গা বদলে নিলাম। ভাইয়া ফেরার আগেই আমাকে বাড়ি পৌঁছাতে হবে।
নিহা মনখারাপ করে বলল,” তোর ভাইটা আর শুধরালো না। ভেবেছিলাম আজ একটু তোর সাথে চিল করবো.. সেটাও হচ্ছে না। ধ্যাত! আমি সবসময় কি দোআ করি জানিস? তোর ভাইয়ের বউটা যেন অনেক দজ্জাল হয়। তোকে যেমন সারাদিন ঘরে আটকে রাখে তেমনি বউ এসে তোর ভাইকেও সারাদিন ঘরে আটকে রাখবে।”
আমি হেসে বললাম,” আমার ভাই এমন মানুষ না যে বউয়ের কথায় উঠবে আর বসবে। তুই এখনও ভাইয়াকে চিনতে পারিসনি।”
” পুরুষ মানুষ মাত্রই বউয়ের কথায় উঠবে-বসবে। পুরো দুনিয়ার কাছে তারা বাঘ হলেও বউয়ের কাছে বেড়াল। এটাই পুরুষ মানুষের ধর্ম। যাহোক, তোকে তো এখন যেতেই হবে। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তোকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। তুই তৈরি হয়ে নে।”
” আমি তৈরীই আছি।”
” সব নিয়েছিস?”
” হুম।”
” আচ্ছা চল।”
আমি নিহার সাথে বের হতে নিবো তখন মোহনা আন্টি আমাদের আটকালেন। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন,” তারিন কোথায় যাচ্ছো?”
নিহা জবাব দিল,” আসলে আন্টি, ওর বাসায় একটা প্রবলেম হয়েছে। তাই ওকে চলে যেতে হবে।”
” কার সাথে যাবে ও?”
” ড্রাইভার ওকে পৌঁছে দিবে।”
মোহনা আন্টি অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,” ওকে ড্রাইভারের সাথে একা পাঠাবে নাকি? তাও এই রাতের বেলা?”
নিহা সহাস্যে বলল,” আপনি চিন্তা করবেন না।ও বাসায় পৌঁছে আমাকে ফোন দিবে তো! তারিন তুই ফোন করিস হ্যা?
আমি সম্মতি জানাতে মাথা নাড়লাম। কিন্তু আন্টি কড়া গলায় বললেন,
” আরে, আগে তো বাসায় সেইফলি পৌঁছাতে হবে নাকি? তারপরই না ফোন! রাস্তার মাঝে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে? রিস্ক নেওয়ার কি দরকার? তার চেয়ে ভালো হয় ওর বাসা থেকে কাউকে ফোন কর। ওকে এসে নিয়ে যাক।”
আমি আর নিহা চোখাচোখি করলাম। বাসায় ফোন করা যাবেনা। আমাকে নিতে আসার মতো কেউ নেই। আন্টি আমাদের নিশ্চুপ দেখে আরেকবার বললেন,
” আচ্ছা নাহলে আমরা যাওয়ার সময় তারিনকে ড্রপ করে দিবো। এটাই ভালো হবে। কি বলো নিহা? তারিন?”
আমি এবার একটু অবাকই হলাম। মোহনা আন্টি হঠাৎ আমাকে নিয়ে এতো ভাবছেন কেন? নিহাকে দেখে মনে হচ্ছে সেও বিস্মিত। নিহা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“না আন্টি, সেটা তো সম্ভব না। ওকে জলদি বাসায় যেতে হবে। আর আপনাদের যেতে তো এখনও অনেক দেরি। ”
আন্টি ভ্রু কুচকে চিন্তা করতে করতে বললেন,
” মেয়েটাকে তো এভাবে একা ছাড়া যায়না। আচ্ছা এক কাজ করি! ঈশানকে ওর সাথে পাঠিয়ে দেই।”
কথাটা শুনে আমি নিহার কাঁধ খামচে ধরলাম। নিহা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
” ঈশান ভাইয়া কি যেতে রাজি হবে?”
আন্টি চোখ বড় করে বললেন,” কেন রাজি হবে না? নিশ্চয়ই হবে! দাঁড়াও আমি বলছি।”
মোহনা আন্টি চলে গেলেন ঈশানকে ডাকতে। আমি নিহাকে সাইডে এনে ফিসফিসিয়ে বললাম,” নিহু! আমি কিন্তু ওই ছেলেটার সাথে যাবো না।”
” ওই ছেলে মানে? ঈশান ভাইয়া বল। তোর থেকে বয়সে কত বড় জানিস?”
আমি চুপ রইলাম। একবার ইচ্ছে করল নিহাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বলি। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমারই দেরি। এখন সবচেয়ে জরুরী হলো নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি পৌঁছানো৷
নিহা আবার বলল,” আন্টি তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করছে তারু! এইজন্যই তো নিজের ছেলেকে পাঠাচ্ছেন। তাহলে বোঝ কতটা কনসার্নড তোর প্রতি? এখন যদি তুই না করে দিস তাহলে মাইন্ড করবে না? তাছাড়া ঈশান ভাইয়ার সাথে গেলেই সেফটি বেশি। আন্টি ভালোর জন্যই বলছে। রাজি হয়ে যা।
ঈশান গম্ভীর মুখে আমাদের কাছে এলো। আমি মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকালাম। ঈশান নিহাকেই জিজ্ঞেস করল,” কখন যেতে হবে?”
নিহা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,” এখনি। ”
ঈশান আমার দিকে তাকিয়ে আন্তরিকভাবে বলল,” তুমি তৈরী?”
আমি ঈশানের কথার জবাব না দিয়ে নিহার দিকে তাকিয়ে বললাম,” বাই।”
” সাবধান যাস। পৌঁছে ফোন করিস।”
সারারাস্তা আমায় একটা অপরিচিত ছেলের সাথে থাকতে হবে ভাবতেই আমার হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে। আর এই সবই হচ্ছে আমার প্রতি মোহনা আন্টির অতিরিক্ত যত্নশীলতার কারণে। অতিরিক্ত কোনোকিছুই আসলে ভালো না। যত্নশীলতাও না। ভদ্রমহিলার মনে কি চলছে আল্লাহ মালুম!
ঈশান আমার সাথে পেছনে বসেছে। সামনে ড্রাইভার। আমি একদম জানালার সাথে সেঁটে আছি। ভুল করেও যেন তার সাথে আমার গায়ের স্পর্শ লেগে না যায়। ঈশান অযথাই শিষ বাজাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বললাম,” আপনার কাঁধে কিছু একটা লেগে আছে, দেখুন!”
ঈশান অবাক হয়ে তাকালো। আমি তার দিকেই চেয়ে কথা বলেছি তবুও সে প্রশ্ন করল,” আমাকে কিছু বললে?”
” হ্যাঁ। আপনার কাঁধের পেছনে একটা জিনিস লেগে আছে।”
ঈশান কাঁধের পেছনে হাত রাখল। তার চুল থেকে বেরিয়ে এলো আমার কানের দুল। ঈশানের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চোর ধরা খেলে চেহারা যেমন হয়, ঠিক তেমন। আমি হাসলাম। ঈশান আমার দিকে চেয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,” এটা কোথ-থেকে এলো?”
” এই প্রশ্ন তো আমার করা উচিৎ। এটা আমার কানের দুল। আপনার কাছে কিভাবে গেল?”
ঈশান নিজস্ব কায়দায় ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,” এটা যে তোমারই কানের দুল, এর কি কোনো প্রমাণ আছে?”
” আছে। ” আমি চুল সরিয়ে দ্বিতীয় কানের দুলটা দেখালাম। ঈশান বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল। সাত-পাঁচ ভেবে বলার চেষ্টা করল,” তাহলে হয়তো কোথাও পড়ে গেছিল।”
” তাই? কোথাও পড়ে গেছিল আর সেটা আপনি পেয়ে নিজের চুলে লাগিয়ে রেখেছেন? অদ্ভুত! ”
” না। সেরকম নয়।”
” তাহলে নিশ্চয়ই আপনি মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়েছিলেন। যে কারণে এটা আপনার চুলে লেগে গেছে। তাই না?”
ঈশান গাঢ় করে হেসে বলল,” তুমি কি প্রমাণ করতে চাইছো তারিন?”
” আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না৷ দুলটা দিন।”
ঈশান আমাকে দুল দিয়ে দিল। আমি কানে পরতে পরতে বললাম,” এবার বলুন, আমার ব্যাগে চিরকুট কি আপনি রেখেছেন?”
ঈশান মাথা নাড়ল। তার মুখে এখনও মৃদু হাসি। বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই। আমি অবাক হয়ে বললাম,” মেকাপরুমে কারেন্ট চলে যাওয়ার পর আপনিই কি এসেছিলেন? ”
ঈশান এবারও একইভাবে মাথা নাড়ল। আমি রাগে কটমট করে বললাম,” এসব আপনি কেন করলেন?”
ঈশান আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ” তি আমো।”
” তি আমো মানে কি?”
” খুঁজে বের করো!” ঈশানের চোখে রহস্য। আমি রেগে-মেগে বললাম,” গাড়ি থামান৷ আমি নামব।”
#তি_আমো(রিপোস্ট)
পর্ব ৩
লিখা- Sidratul Muntaz
আমার নির্দেশ ড্রাইভার শুনলেন। অবিলম্বে গাড়ি থামানো হলো। ঈশান ব্যস্ত সুরে বলল,
” ওকে চলো নামি।”
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম,” ওয়েট! চলো নামি মানে? আপনি কেনো নামবেন আমার সাথে?”
” আমি কেনো নামবো না? এতোটা রাস্তা তুমি একা যাবে নাকি? কত অন্ধকার দেখেছ! যদি কিছু হয়ে যায়?”
” কিছুই হবে না। কারণ সবাই আপনার মতো না। ”
” আমার মতো না মানে?”
” মানে আপনার মতো সবাই অন্ধকারে সুযোগ নেবে না। ”
” তুমি কি মানুষকে ইনসাল্ট করার ট্রেনিং নিয়েছো?”
” সব মানুষকে আমি ইনসাল্ট করি না। শুধু আপনার মতো অসভ্য যারা, তাদের করতে হয়।”
ঈশান হা করে তাকিয়ে আছে। আমি তার থোতা মুখ ভোতা করে দিয়েছি। ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। প্রায় চলেই এসেছি। জায়গাটা আমাদের এলাকার বাজার। আর দশমিনিট হাঁটলেই আমাদের গলি। আমি দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। পেছনে একবারের জন্যেও তাকালাম না।
যত কদম এগোচ্ছি তত আমার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ছে। ভাইয়া কি বাড়িতে চলে এসেছে? যেন না আসে। আমি সূরা পাঠ করতে লাগলাম। বাড়ির সামনে গিয়ে বুঝলাম ভাইয়া এখনও আসেনি। এলে তো বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল থাকতো। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সদর দরজায় পা রাখব, ঠিক তখনি ঘটল আরেক বিপত্তি। বুড়িটা দরজার সামনেই দাড়িয়ে আছে। কোমরে এক হাত রেখে শকুনি দৃষ্টি নিয়ে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। ভয়ে আমার আত্মাটা এতোটুকু হয়ে গেল। এটাই যে বিপদের আভাস! এই সময় তো বুড়ির শুয়ে পড়ার কথা ছিল৷ অথচ বুড়ি এখনও জেগে আছে। বুঝলাম, আজ এই কুচুটে বুড়ির হাত থেকে আমার নিস্তার নেই। শুকনো একটা ঢোক গিলে চেহারা স্বাভাবিক করে ভিতরে ঢুকে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু বাঁধ সাধলো বুড়িটা। দরজায় হাত ঠেঁকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
“খাড়া! আগে ক কই গেছিলি?”
আমি কপালের ঘাম আলতো করে মুছে বুড়ির দিকে শক্তচোখে তাকালাম। হাত পা অল্প অল্প কাঁপছে। তবুও অসীম সাহস দেখিয়ে বলে উঠলাম,
“কোথায় আবার? কোচিং এ ছিলাম। আজকে স্পেশাল ক্লাস ছিল আমাদের। পুরো তিনঘণ্টার ক্লাস। ভাইয়াকে বলে গিয়েছিলাম তো! ভাইয়া সব জানে। ”
” সত্য কইতাছোস? তোর চেহারার এই অবস্থা কেন? চোখের কোণায় কালি লাইগা আছে। সাইজা-গুইছা তুই কোচিং যাওন শুরু করলি কবে থেকা?”
আমি একহাতে চোখের কাজল মোছার চেষ্টা করলাম। যদিও লাভ নেই। বুড়ির নজরে পড়ে গেছে আমার সাজ। মুখ ধোঁয়ার পরেও ভারী মেকাপের রেশ লেগে আছে চেহারায়। আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,
” আরে কোথায় সেজেছি? দেখো, এখন এতো প্রশ্ন ভালো লাগছে না। কতটা পথ রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে হেঁটে আসতে হয়েছে জানো? খুব ক্লান্ত আমি। সরো তো, ভেতরে ঢুকতে দাও।”
“এতোরাইতে বেলা কোচিং থাকে? আমারে শিখাস? এই চুল কতলা না এমনে এমনে পাকে নাই। সত্য কইরা ক কই গেছিলি?”
আবার এক প্রশ্ন! আমি ভয় ভয় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। মা ছুটে আসল তখন। বুড়িকে সামলানোর উদ্দেশ্যে বলল,
” মা, আপনার জন্য চা বানিয়েছি। ভেতরে চলুন।ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে চা। এই তারু তুইও ভেতরে আয়।”
আমি স্বস্তির হাসি দিয়ে আরেকবার ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলাম। বুড়ি হাত উঠিয়ে উচ্চারণ করল,
” ওই খাড়া। একদম নড়বি না জায়গারতে।”
তারপর বুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,” তোমার কৌশল আমি বুঝি আয়শা। এমন কইরা মাইয়াডারে বাঁচাইতে চাইতাছ। কিন্তু তা হইবো না। আমি জানি, তুমি সব জানো। মাইয়াডারে নষ্ট করতাছো লাই দিয়া দিয়া। আগে আমি ওর ব্যাগ খোলামু। ব্যাগো আসলেই বই-খাতা আছে কিনা দেহন দরকার। ওই তারু ব্যাগডা দে।”
আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল। ব্যাগে বই-খাতার অস্তিত্বও নেই। আছে ভারী লেহেঙ্গা আর সাজগোজের জিনিস। এসব যদি বুড়ির হাতে পড়ে তাহলে আমি আর আস্তো থাকব না। অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। মা আমাকে শান্ত থাকার ইশারা করে বুড়িকে বলল,
” আহা! থাক না মা! মেয়েটা বাহিরে থেকে এসেছে, খুব হয়রান। আগে তো ভেতরে আসুক। তারপর কথা বলেন। ”
” না। কোনো ভেতরে আসাআসি নাই। আগে ওর ব্যাগ দেখমু তারপর চিন্তা করমু ভেতরে আইতে দেওন যায় নাকি। তারু ব্যাগ দে কইলাম।”
আমি ব্যাগটা আকড়ে ধরে বললাম,
“না। আমি ব্যাগ কেনো দিবো? আমার ব্যাগে অনেক ইম্পোর্টেন্ট জিনিস আছে। তুমি এখন সব এলোমেলো করলে আমাকে আবার গুছাতে হবে। কোনো দরকার নেই।”
বুড়ি উচ্চস্বরে ধমক দিল,” চুপপ! আমারে শিখাও? লেখাপড়া খালি তোমরাই করসো? আমগোর পোলাপান করে পড়ালেখা করে নাই? অযুহাত দেখাও? অযুহাত? তোমার অযুহাত দেহানি আমি বাইর করতাসি। বেশি বাড়সো না? ঠেং কাইট্টা ঘরে বসায় রাখমু। লেখাপড়া সব বন্ধ। তারপর অযুহাত বাইর হইবো তোমার।”
বুড়ির ধমকে ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। বুড়ি মাথা নিচু করে ব্যাগটা তুলতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে কেউ উচ্চারণ করল,
“এনি প্রবলেম?”
আমি তুমুল গতিতে পেছনে তাকালাম। আর তাকিয়েই আমার চোখ ছানাবড়া। ঈশান পকেটে হাত গুজে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। হায় আল্লাহ! উনি আবার এখানে কি করতে আসল? আজ তো আমার সর্বনাশ নিশ্চিত! কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিলাম? শেষ রক্ষাটাও বোধ হয় হলো না আর।
বুড়ির কথার আওয়াজে চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালাম আমি। আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বুড়ি ধমকের স্বরে বলল,
” তুমি কেডা?”
ঈশান এক হাত পকেটে গুজেই অন্যহাতের আঙুল দিয়ে ভ্রু চুলকে বলতে যাচ্ছিল, “আমি….”
তার কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে আমি ফট করে বলে উঠলাম,” আমার স্যার! কোচিং এর স্যার।”
আমার কথা শুনে মা আর বুড়ি দুজনেই ভ্রু কুচকালো। পেছনে ঈশানের মুখের অবস্থা কি হয়েছে সেটা দেখতে পারলাম না। বুড়ি সন্দেহী দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করল,” মাষ্টর? এতো জুয়ান মাষ্টর ক্যান?”
আমি বললাম,” কোচিং এর মাস্টার জোয়ানই হয় দাদী। উনিই আমাদের কোচিং এ ক্লাস নেন। আসলে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল কি-না! আমি একা বাসায় ফিরছিলাম..আর স্যারের বাসাও এদিকেই। তাই আমাকে একটু এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। এই আর কি! ”
কথাটা শুনে বুড়ি চোখ বড় করে তাকালেও মাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশ্বাস করেছে। তাই মা একটা সন্তোষজনক হাসি দিল। কিন্তু বুড়িটা যে নাছোড়বান্দা! আমাকে অবিশ্বাস করবেই। তাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ঈশানের দিকে তাকাল। প্রশ্ন করল,
“তোমার বাসা কোন জায়গায়?”
ঈশান গলা খাকারি দিয়ে বলল,” জ্বী, এইতো সামনে। এই গলির পরের গলিতেই। ”
ঈশানের উত্তর শুনে আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। বুড়িটা এবার হতাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” ওহ! আইচ্ছা তাইলে ভেতরে আয়ো। এক কাপ চা খাইয়া যাও। আয়শা, ভেতরে আনো ওগো। ”
ব্যাগটা মায়ের হাতে দিয়ে শাড়িটা হালকা উঁচু করে ঘরে চলে গেল বুড়ি। আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম তখন। মা একটা অমায়িক হাসি দিয়ে ঈশানকে বলল,
“বাবা, ভেতরে আসো না। এক কাপ চা খেয়ে যাও।”
ঈশান অতি উৎসাহী কণ্ঠে বলল, ” জ্বী নিশ্চয়ই!”
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঁচু গলায় উচ্চারণ করলাম,” কোনো দরকার নেই। উনার তাড়া আছে উনাকে যেতে দাও, মা। এই আপনি যান তো!”
মা অবাক হয়ে বলল,”তারু এসব কি? স্যারের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? ”
” স্যার মানে? কিসের স্যার?”
” তুই কি তাহলে দাদীকে মিথ্যা বললি?”
আমি জীভ কাটলাম। মা দেখি সত্যিই বিশ্বাস করে নিয়েছে যে ঈশান আমার স্যার! অবশ্য এটা ভালোই হলো৷ মায়ের এই বিশ্বাস ভাঙানোর প্রয়োজন নেই। কারণ পার্টিতে আজ যা হয়েছে তার কোনো কিছুই আমি মাকে বলতে পারব না। তাহলে পরবর্তীতে মাও আমাকে নিয়ে কনজার্ভেটিভ হয়ে যাবে। ভাইয়া আর দাদীর মতো কোথাও বের হতে দিবে না।
আমি হাসার ভাণ ধরে বললাম, ” আসলে স্যারের একটা জরুরি কাজ আছে। সেজন্য বলছিলাম উনি চলে যাক।”
ঈশান পেছন থেকে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,” কোনো সমস্যা নেই। ”
আমি পেছন ফিরে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালাম। বিরবির করে বললাম,” নির্লজ্জ!”
মা বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন,” ভেতরে এসো, বাবা।”
ঈশান মায়ের সাথে ভেতরে গেল। যাওয়ার সময় সে একবার ঘুরে আমাকে চোখও মারল। ফিসফিসিয়ে বলল,” থ্যাংকস।”
আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কি থেকে কি হয়ে গেল! আমার সাথে এতো অসম্মানজনক একটা কাজ করার পরেও এই লোককে এখন বাড়িতে নিয়ে আমায় সম্মান দেখাতে হবে? আমি ঈশানকে গালি দিতে দিতে ভেতরে ঢুকলাম।
ঘরে গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুও পেলাম না। এরই মাঝে মা রান্নাঘর থেকে ডাকল। আমি অনীহা নিয়ে ছুটে গেলাম।
” কি হয়েছে, বলো?”
” তোর স্যারকে জিজ্ঞেস করে আয়, চায়ে কয় চামচ চিনি খাবে।”
” আমি এসব জিজ্ঞেস করতে পারব না। তোমার দরকার লাগলে তুমি জিজ্ঞেস করো।”
মা কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল,” তুই খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস তারু। এক চড় মারবো।”
আমি মুখ ফুলিয়ে বসার ঘরের দিকে গেলাম। ঈশান সোফায় বসে আছে; পায়ের উপর পা তুলে। তাকে দেখলে মনে হবে, এই দুনিয়ায় তার চেয়ে সুখী মানুষ কেউ নেই! আমাকে দেখেই হাসল সে। বলতে কি? এই বেটার হাসি আসলেই সুন্দর। এমন কুৎসিৎ মনের একটা মানুষের হাসি এতো সুন্দর কেন হবে? এটা তো ভারী অন্যায়! আল্লাহ কেন বেছে বেছে এই জঘন্য মানুষটিকেই ওমন সুন্দর গেজ দাঁত দিল? তার ওই গেজ দাঁতটা আমার হলেও তো পারতো। ঈশানের প্রশ্নে চমকে উঠলাম,” এমন হা করে তাকিয়ে আছো কেন? বেশি সুন্দর আমি?”
রাগে গা চিড়বিড় করে উঠল। নিজেকে দমাতে দাঁতে দাঁত পিষে বললাম,” মা জিজ্ঞেস করেছে, আপনি চায়ে কয় চামচ চিনি খাবেন?”
” চিনি লাগবে না। তুমি হাতে করে নিয়ে এলেই তো চা মিষ্টি হয়ে যাবে।”
” আচ্ছা তাই নাকি? ঠিকাছে!”
ঈশান গা জ্বালানো হাসি দিল। আমার শরীর যদি আগুন হয় তাহলে ঈশানের হাসি হবে ঘি। যতবার সে হাসছে আমার শরীর তত বেশি দাউদাউ করে জ্বলছ। ঠিক করলাম আজ বেটাকে জন্মের চা খাওয়াব। সে যেন জীবনে আর কখনও কারো বাড়িতে চা খাওয়ার সাহস না পায়।
মাকে আগে রান্নাঘর থেকে বিদায় করতে হবে। আমি বললাম,” স্যারের চা টা আমি বানাই মা। তুমি যাও।”
” আমি কোথায় যাব?”
” বুড়িটার কিছু লাগবে কি-না দেখো।”
মা চোখ গরম করে বলল,” তোকে আমি আগেও বলেছি তারু। দাদীকে বুড়ি ডাকবি না।”
” আচ্ছা স্যরি।”
মা চলে গেল। আমি এবার ঈশানের জন্য স্পেশাল চা তৈরী করলাম। এক কাপ চায়ে দিলাম পাঁচ চামচ লিকার।চায়ের রঙের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তবুও কৌতুহলবশত একটু মুখে দিলাম। প্রায় বমি চলে এলো। এতো তিক্ত! আমি সুন্দর করে ট্রে-তে চা সাজিয়ে নিয়ে গেলাম।
বসার ঘরে গিয়ে দেখলাম ঈশান একা নয়। ভাইয়াও তার সাথে বসে আছে। দু’জন হাসি-খুশি গল্প করছে। মা তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে। আমি চা নিয়ে যেতেই মা বলল,” আরেক কাপ নিয়ে আয়। তোর ভাইয়াকেও দে।”
আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চা টেবিলে রাখলাম। ভাইয়াকে দেখে ভয় লাগছে। ঈশান যদি চা খেয়ে উল্টা-পাল্টা কিছু বলে তাহলে তো ভাইয়া আমাকেই ঝারবে! ঈশান বলল,” ভাইয়া, চা টা আপনি খান। আমি পরে খাবো।”
আমি সাথে সাথে বললাম,” না, না, ভাইয়া কেন খাবে? আপনার জন্য এনেছি। তাই অবশ্যই এটা আপনি খাবেন।”
তারিফ ভাইয়াও তাই বলল,” হ্যাঁ সেটাই তো। আপনি শিক্ষক মানুষ। আপনার চা আমি কিভাবে খাই?”
ঈশান অমায়িক সুরে বলল,” আমি আপনার বোনের শিক্ষক। কিন্তু আপনার তো শিক্ষক না। আপনি হলেন তারিনের গার্ডিয়ান। আর আমার বড়ভাইয়ের মতো। আপনাকে সামনে রেখে আমি কিভাবে খাই?”
চূড়ান্ত বিরক্ত লাগছিল আমার। এক কাপ চা নিয়ে আর কত রঙ-তামাশা হবে? শেষমেষ ভাইয়া টেবিলেই থাকা অন্য আরেকটা খালি কাপে অর্ধেক চা ঢেলে নিল। বাকি অর্ধেক ঈশানকে দিল। তবে ঈশানের আগেই চায়ে চুমুক দিল ভাইয়া। আমার আত্মা তখন চড়ুইপাখির মতো এতটুকু হয়ে গেছে। ভাইয়া সাথে সাথে চা মুখ থেকে ছিটকে ফেলে দিয়ে হুংকার ছাড়ল,” চা টা পর্যন্ত বানানো শিখলি না? এটা কি চা না নিমপাতার রস?”
আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। মাথা নিচু করে বললাম,” স..স্যরি ভাইয়া।”
” যা। আবার ভালো করে দুই কাপ চা বানিয়ে আন।”
মা তড়িঘড়ি করে বলল,” আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”
ভাইয়া সাথে সাথে নিষেধ করল,” না। তুমি কেন যাবে? শ্বশুরবাড়িতেও কি তুমি গিয়ে চা বানিয়ে দেবে? ওর শেখার দরকার আছে। তারু, যা।”
আমি দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। এবার ঠিক মতোই চা বানালাম।
চলবে
চলবে
সবাই কমেন্ট করুন প্লিজ।