আমি যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করি সমাজের চোখে আজ সে আমার স্বামী। ইসলাম মতে তিন কবুলে আমি তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলেও মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। যে মানুষটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে একজন অ’পরাধী তার নামে থানায় ২ টা মামলা রয়েছে। সে একজন ধ’র্ষক এবং খু’নি এটা ভাবতেই আমার মাথা ঘুরে উঠে সারা শরীর শিউরে উঠে। বিষয়টা এমন না যে লোকটা আমাকে জোড় করে বিয়ে করেছে! আমি ছোট বেলা থেকেই ফুপি আর ফুপার কাছে বড় হয়েছি। অনেক ছোটবেলায় আব্বু আম্মু মা’রা গেছে কিন্তু কিভাবে মা’রা গেছে তা আজও জানি না আমি। আমার কোনো চাচ্চু ছিলো না আর নানুবাড়ির কেউ দায়িত্ব নিতে চায়নি তাই ফুপিই আমাকে তার কাছে রেখেছে। ফুপি কখনোই আমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি কিন্তু যখন তারা আমার বিয়ে ঠিক করলো এমন একটা মানুষের সাথে তখন আমি নির্বাক হয়ে গেছিলাম। বিয়ের কথা শুনে ফুপিকে বলেছিলাম,
‘পৃথিবীতে এতো ছেলে থাকতে ওই লোকটার সাথেই কেনো আমার বিয়ে? একটা ধ’র্ষ’ক, মা’তাল, খু’নীর সাথেই কেনো আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়েছো তোমরা?’
ফুপি কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। হাতের কাজ রেখে কাঠকাঠ গলায় বললেন, ‘তোমাকে ছোটবেলা থেকে বড় করেছি আমরা। তোমার সব আবদার, ইচ্ছে সকল কিছু পূরণ করেছি। কখনোই তোমার ফুপা বা এই পরিবারের কেউ তোমাকে কষ্ট দেয়নি বরং আপন করে নিয়েছে। এখন যখন তোমার ফুপা চাচ্ছে তীব্রর সাথে তোমার বিয়েটা হোক তখন নিশ্চয় কোনো না কোনো কারণ আছে! আর তীব্র যে অপরাধী এটা এখনো প্রমাণ হয়নি প্রানেশা।’
এতগুলো কথার পিঠে আর কোনো কথা বলার মতো পেলাম না। শুধু কিছুক্ষণ ফুপির দিকে তাকিয়ে থেকে জায়গা ত্যাগ করলাম। আজ যদি তাদের মেয়ে হতাম তাহলে কি এমনটা করতে পারতো আমার সাথে? তাহলেও কি আমাকে এমন একটা জীবনের দিকে ঠেলে দিতে পারতো যেটার কোনো ভবিষ্যৎ ই নেই! আমি জানি যে এটা এখনো প্রমাণ হয়নি যে তীব্র অপরাধী কিন্তু এটা সত্য যে আসলেই তীব্র অপরাধী। টাকার জোড়ে পুলিশকে দমিয়ে রেখেছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও বিয়ের কোনো আমেজ ছিলো না। একদিনও তীব্রদের বাড়ি থেকে কেউ আসেনি আমাকে দেখতে কিংবা কথা বলতে। যখন যে অনুষ্ঠান হয়েছে তার জন্য শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস আর শপিং পাঠিয়েছে। আজ বিয়েতেই আমি তাদের বাড়ির সবাইকে দেখলাম। তেমন কোনো আয়োজনে বিয়ে না হলেও মোটামুটি আয়োজন হয়েছে। বিয়ের মুহুর্তে পুরোটা সময় আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম। ‘কবুল’ বলার সময় গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। কিন্তু বিয়েটা করা ছাড়া আমার কাছে কোনো উপায়ও ছিলো না। বিয়েটার সাথে সাথে আমাকে বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো কিছু দায়িত্বের মধ্যে। আমার ভাবনার মাঝে যখন গম্ভীর কন্ঠের ‘কবুল’ শুনলাম তখন রীতিমতো আমার শরীর হিম হয়ে আসলো। কন্ঠটা আমি এর আগেও শুনেছি। মাথা তুলে তাকাতেই বর বেশে সেই সুদর্শন তীব্রকে দেখে আমার মাথা ঘুরিয়ে আসলো। ঘৃ’ণায় গা রি রি করে উঠলো। মুহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক কালো রাত আর এক বি’ভৎস চেহারা। হাত শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলাম। শুনেছিলাম বিয়েতে তীব্র নিজেও রাজি না। হবেন কি করে! যে কুকর্ম করে রেখেছে তারপর আবার বিয়ে! বিয়ে শেষে বিদায়ও হলো। ফুপি কাদলেন। ছোট থেকে বড় করেছেন আমার প্রতি তার মায়ার শেষ নেই কিন্তু এ কান্নায় কেনো যেনো আমার মন গললো না। চুপচাপ তাদের কান্নাকাটি দেখে গাড়িতে বসলাম। অদ্ভুত ভাবে সব মেয়ে যেখানে স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ি যায় সেখানে আমি একাই শ্বশুরবাড়ি আসলাম। শ্বশুর আর ছোট ননদের সাথে। তীব্র বিদায়ের শেষ দিকেই উধাও হয়ে গেছে। ওই লোকটা না থাকায় আমার জন্য ভালো। এই একটা মানুষকে আমি এতো বেশি ঘৃ’ণা করি যতটা কেউ কাউকে করতে পারে না। অথচ ভাগ্যের লিখনে এই লোকটার সাথেই আমার কাটাতে হবে বছরের পর বছর। আদৌও কি বছরের পর বছর নাকি মাত্র! ভেবেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা মিললো। গাড়ি থেকে বাহিরের তাকিয়ে মনে মনে শত চিন্তার খাতা খুলে বসলাম। আমার ভবিষ্যৎও ছুটে চলেছে এই গাড়ির সাথে সাথে। আমার ভাগ্যে বুঝি এমনই ছিলো! তাকে কি জবাব দিবো আমি! সে যখন জানবে আমার স্বামীর জায়গা টা তীব্র নিয়েছে তখন কি সে আমাকে ঘৃণা করবে! চোখ দুটো ঝাপসা হলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল। গাড়ির বাইরে তাকিয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই।
ঘুম ভাঙে কারো ডাকাডাকির শব্দে। ধড়ফড় করে উঠতেই চোখে পড়লো কয়েক জোড়া মুখ। চোখ ডলে নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকালাম। সামনেই তিহা, আঙ্কেল আর আন্টি দাঁড়িয়ে আছে। তীব্রর বোন তিহা হাসিমুখে আমার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে বলে,
‘স্বাগতম মাই ডিয়ার ভাবি।’
আমি কিছু বললাম না। তিহার হাত ধরেই দরজায় দাঁড়ালাম। আন্টি গোমড়া মুখে আমাকে বরণ করে নিলেন। অদ্ভুত ভাবে তীব্রর মা আমাকে কোনোকালেই সহ্য করতে পারেন না। আমি এ বাড়িতে আগেও এসেছি ফুপি ফুপার সাথে। আর তিহা ছিলো আমার ফুপাতো বোন পলির বান্ধবী। পলিই মাঝে মাঝে এখানে আসার জন্য নিয়ে আসতো আমাকে। আসতে না চাইলে ঘ্যানঘ্যান করে নিয়ে আসতো। আন্টি আমাকে দেখলেই চোখ মুখ কুঁচকে রাখেন। তার চোখ মুখ অমাবস্যার রাতের মতো আঁধার হয়ে থাকে। আমি প্রথম প্রথম বুঝতাম না এমন করার কারণ। পরে ধীরে ধীরে বুঝলাম তিনি আমাকে পছন্দ করেন না। এবং তারপর থেকেই আমি আর আসতাম না। সব নিয়ম শেষে তিহা আমাকে তীব্রর রুমে বসিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ ফাজলামি করে রুম থেকে বের হয়। এ রুমে আমি খুব বেশি একটা কোনো কালেই আসিনি। যতবারই এসেছি পলির সাথে তিহার রুমেই থাকতাম। তীব্র ভীষণ রগচটা মানুষ তাকে দেখলেই ভয় পেতাম। তিনিও অনেকবার ফুপিদের বাড়িতে গেছিলেন। রাজনীতিতে আছেন তারা। তাই প্রায়শই কাজের জন্য যেতেন। আমি বরাবরই ভয় পেতাম। দেখতে তিনি মাশাল্লাহ। এজীবনে কতশত মেয়েকে পেছনে ঘুরিয়েছেন তা বোধহয় তিনি নিজেও জানেন না। কিন্তু তার থেকে গুণে গুণে শত হাত দুরে থাকতাম আমি। এতোটাই ভয় পেতাম। কিন্তু সময়ের তালে তালে এই ভয় পরিণত হলো ঘৃ’ণায়। যাকে দেখলেই ভয়ে, লজ্জায় রুমের দরজা আটকে বসে থাকতাম একসময় তাকে দেখেই ঘৃ’ণার দৃষ্টি দিয়ে বসে থাকতাম। সে বোধহয় বুঝতো আর সে জন্যই হয়তো গত ১ বছর আমি তাকে দেখিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আগে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। আমি পারবো না এই লোকটার জন্য বউ সেজে বসে থাকতে। যতটুকু করেছি বা পেরেছি তাই যথেষ্ট। চেঞ্জ করে এসে চুপচাপ ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। তার যখন মন চায় সে তখন আসুক আমার কিছু দেখারও নেই আর বলারও নেই।
_____
ভোর রাতের দিকে শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে চোখ ডলতে শুরু করলাম। অনুভব করলাম রুমে আমি ছাড়াও কেউ আছে। ড্রিম লাইটের আলোয় মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পড়ে তীব্রর মুখ৷ দুজনের মধ্যকার দূরত্ব চোখে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠলাম। বুকে ফু দিয়ে আশে পাশে তাকালাম। তীব্র কখন আসলো রুমে! আমিই বা এতোটা কাছে গেলাম কি করে! অবশ্য চরিত্রের যা অবস্থা তাতে এই লোকটা নিজেই এতো কাছে এসেছিলো বোধহয়। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফের তাকালাম তীব্রর দিকে। কি নিষ্পাপ মুখ! কে বলবে এই মানুষটাই এতটা ভ’য়ং’কর! ইচ্ছে করলো এখনই গলা টা টি’পে দেই কিন্তু নিজেকে শান্ত করলাম। একবার চারপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
‘এই বাড়ির, এই তীব্রর প্রত্যেকটা রহস্য আমি উপড়ে তুলবো। ঠিক যেভাবে কষ্ট দিয়ে দিয়ে তাকে মে’রে’ছেন আমিও ততটাই কষ্ট দিয়ে, ততটাই পু’ড়াবো আপনাকে মিষ্টার তাশজিদ শেখ তীব্র।’
বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালাম। শাড়িটা ঠিক করে ব্যালকনির দিকে এগোতেই পেছন থেকে পুরুষালী শান্ত কন্ঠ ভেসে আসে, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
আমি চমকে উঠলাম। ধীরে করে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিজেকে সামলে গম্ভীর কন্ঠে বললাম, ‘ব্যালকনিতে যাচ্ছি।’
‘কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। চুপচাপ শুয়ে থাকো। আযান হয়ে গেলে উঠে নামাজ পড়ে নিবে।’
তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললাম, ‘আপনার কথা মতো? আযান দিলে নামাজ পড়ে নিবো ততক্ষণ আমি ব্যালকনিতেই থাকবো।’
আবছা আলোয় খেয়াল করলাম তীব্র লাল চোখ। আমি পাত্তা দিলাম না। পেছন ফিরে যেতে যেতে বললাম, ‘শরীর তো নয় যেনো খা’ম্বা! শক্তের ঠেলায় আমার ঘুমই ভেঙে গেছে এখন নাকি আবার সজ্ঞানে একটা রে’পি’ষ্টের সাথে ঘুমাবো!’
পেছন থেকে তীব্রর কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। কথাটা তার গায়ে লেগেছে তা বেশ বুঝলাম। বাঁকা হেঁসে চুপচাপ ব্যালকনির এককোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। দুহাতে দু বাহু আঁকড়ে নিয়ে সামনে তাকালাম। রাস্তা ফাঁকা। মাঝে মাঝে সাই করে দু একটা গাড়ি অতিক্রম করে চলেছে রাস্তা। এই গাড়ি গুলোর মতোই আমার জীবনটাও অতিক্রম হচ্ছে। ভীষণ কান্না পেলো। আজ আব্বু আম্মুকে ভীষণ মিস করছি। তারা থাকলে আমার একাকিত্ব বাড়াতে হতো না। ফুপি হয়তো কখনো কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেনি কিন্তু কখনো আমার কাছে বসে মায়ের মতো মমতাও দেয়নি। বাবা-মা ছাড়া জীবন কত কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। চোখ বন্ধ করে যখন বাতাস অনুভব করছিলাম তখন মনে হলো কেউ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে গেলো,
‘তীব্রকে তুমি পু’ড়াতে পারবে না প্রাণ। তাকে পু’ড়াতে এসে তুমি ভীষণ বাজে ভাবে ফেঁসে গেছো। কবে কখন কিভাবে তুমি তীব্র প্রেমের নেশায় মত্ত হয়ে যাবে তা টেরও পাবে না।’
#তীব্র_প্রেমের_নেশা
#সূচনা_পর্ব
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ফিরে আসলাম নতুন গল্প নিয়ে। আশা করি সবাইকে প্রতিবারের মতোই পাশে পাবো।)