তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -২০+২১

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (২০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

গত ২ মাস থেকে আমি নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছি৷ সেদিনের সেই ধাক্কাটা সহ্য করতে পারিনি। মেনে নিতে পারিনি আমাদের বিচ্ছেদ। সেন্স ফিরার পর থেকে আমি এই রুম থেকে বের হইনি। কতদিন বাহিরের আলো দেখিনা। পলি রুমে এসে যা পারে তা খাইয়ে রেখে যায়। আমি শুধু চুপচাপ বসে থাকি। এতোদিনে কতবার ভেবেছি তীব্র আসবে। সে তার প্রাণকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে তীব্র৷ সে হয়তো আমাকে ছাড়া আছে। আচ্ছা উনি কি ভালো আছে? তার প্রাণকে কষ্ট রেখে সে ভালো থাকতে পারে? এটাও কি সম্ভব! এর মধ্যে প্রায়দিনই এসে তিহা দেখা করে গেছে। ‘ও’ আসলেও আমি কিছু বলতাম না। তিহা আসতো, থাকতো আবার নিরাশ হয়ে চলে যেতো। আমার মুখ থেকে কখনো একটা শব্দও শুনতে পায়নি। আজকাল শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। যেখানে ভেতরটা ভালো নেই সেখানে শরীর ভালো থাকবে কি করে! মাঝে মাঝে তীব্রকে ভিষণ পা’ষাণ মনে হয়। আবার মনে হয় যে ছেলেটা আমার ঘৃ’ণা সহ্য করেও গত ৩ টা বছর ভালোবেসে গেছে সে এতোটা পা’ষাণ হতে পারে? সেদিন তো তীব্র তানহাকে বলেছিলো আমাকে ছাড়বে না তবে এই বিচ্ছেদ কেন? কেন এতো হাহাকারে ছেড়ে দিলো আমাকে? তীব্র কি তবে শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসা শিখিয়ে ছেড়ে দিলো! ভালোবাসে না আর আমাকে? এতো বড় শাস্তি দিতে পারলো! মানলাম আমি অন্যায় করেছি। সে অন্য ভাবে শাস্তি দিতো। বিচ্ছেদই কেনো হলো? আমাদের বিয়েটা কিসের ডিল ছিলো আমার জানা নেই। শুধু জানি ওই মানুষটার প্রেমের নেশায় প্রতিনিয়ত পু’ড়ে যাচ্ছি আমি। কতরাত ঘুমাই না আমি! এতোটা ভালো কিভাবে বাসলাম? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝেতে হাত দিয়ে উঠলাম। ধীর পায়ে এগিয়ে জানালার পাশে দাড়ালাম। এ জানালাটা সবসময় আমি বন্ধ করেই রাখি। আজ ভীষণ বাহিরের আলো দেখতে ইচ্ছে করলো। হালকা করে জানালা খুলতেই তীক্ষ্ণ আলো এসে চোখে বিধলো। চোখ মুখ খিঁচে রইলাম। পিটপিট করে তাকিয়ে আলো তে তাকালাম। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে বিছানার ওপর বসতেই দরজা খোলার আওয়াজ এলো। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম পলি এসেছে। আমি ওকে দেখেও বিছানার ওপর পা তুলে দু হাঁটু আঁকড়ে বসে রইলাম। পলি কাছে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘বাহিরে যাবে আপু? কতদিন তুমি বাহিরে যাও না। এভাবে ঘরবন্দী থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো!’

আমি যেভাবে ছিলাম সেভাবেই থাকলাম। কোনো কথারই উত্তর দিলাম না৷ পলি আমার সামনে বসে বললো,

‘আর কতদিন এভাবে থাকবে আপু? এবার তো স্বাভাবিক হও। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তীব্র ভাই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে জীবনটা এমন অন্ধকার করে ফেলবে! একটু নিজের কথা ভাবো।’

পলি নিজের মতো বলে গেলো। আমি খাটে হেলান দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলাম। তীব্র আমাকে ছেড়ে দিলেও আমি অনুভব করতে পারি তীব্র ভালো নেই। সে তার প্রাণকে ছাড়া বিন্দুমাত্রও ভালো নেই। ভালো থাকতেই পারে না। আমি অনুভব করেছি খুব কাছে থেকে। তীব্র প্রচন্ড ভালোবাসে আমাকে। আমি নিজের কষ্টটা প্রকাশ করতে পারলেও তীব্র চাপা স্বভাবের। ছেলেটা সহজে কাঁদেও না। আর কারো সামনে তো কখনোই কাঁদে না। পলি আমার গায়ে হাত দিতেই ছোট করে বললাম,

‘আমার ফোনটা দে তো পলি!’

পলি ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতগুলো দিনে কোনো প্রয়োজনেও কথা বলিনি। পলি নিজের অবাকতা কাটিয়ে আমার ফোনটা এনে হাতে দিলো। আমি ফোনের ওয়ালপেপারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সেখানে আমার আর তীব্রর একটা ছবি। তিহা তুলেছিলো ছবিটা। ট্রেনে বসে যখন তীব্রর বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম ঠিক তখনকার পিক এটা। আমি ছবির ওপর হাত বুলালাম। ফোন আনলক করে কললিস্টে ঢুকে তীব্রর নাম্বারে কল দিলাম। গত ২ মাসে আজই আমি উনাকে কল করছি। ২ বার কল হওয়ার পরও রিসিভ হলো না। বুঝলাম এ কল আর রিসিভ হওয়ার নয়। গ্যালারীতে ঢুকে সেদিনকার তোলা পিকগুলো একটা একটা করে দেখলাম। দুজনের খুনশুটির কথা ভেবেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। ঠোটের কোণে হাসি আর চোখের কোণে জলেের অনুভূতিটা কি সুন্দর! টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়ছে। আর আমি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে ছবিগুলো হাত দিয়ে বুলিয়ে দেখলাম। স্বযত্নে তীব্রর মুখটা হাত দিয়ে আগলে নিয়ে ফোনটা চেপে ধরলাম বুকে। চোখ বন্ধ করে রইলাম। চোখ নিজের কাাজ তখনও করছে। জলের ধারা বয়ে চলেছে আপনমনে। পলি হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দুহাতে আগলে নিয়ে ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,

‘এতো কেনো ভালোবাসো তীব্র ভাইয়াকে? তোমার এ ভালোবাসা যে মাটির সাথে পিষে যাচ্ছে। বুঝো না তুমি?’

‘আমি তো এতোশতো ভেবে ভালোবাসিনি পলি। ভালোবাসার জন্যই ভালোবেসেছি। ঘৃণার জায়গায় ভালোবাসার স্থান দেওয়া স্বত্বেও আজ আমি নিঃস্ব। তীব্র প্রেমের নেশায় জ্বলছি ক্ষণে ক্ষণে। আমার তীব্রকে ফিরতে বল না! আমার তো বিচ্ছেদ চাই না পলি!’

পলি আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। মুহুর্তেই ফোন ছেড়ে পলিকে আঁকড়ে ধরে উন্মাদের মতো কান্না করতে থাকলাম। এতোদিনের চেপে রাখা কান্না গুলো চিৎকারে পরিণত হয়ে বের হচ্ছে। শ্বাস আটকে যাচ্ছে কান্নার দমকে। মিনিট কয়েক বাদেই ছুটে আসে ফুপি, কাকি, ফারদিন ভাই। আমাকে কাঁদতে দেখে ফুপি আর কাকি কাছে আসলেও ফারদিন ভাই আসলেন না। ফুপি পলির থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা করলেন আমাকে। পলিকে সরিয়ে নিজে বসে বললেন,

‘এভাবে পাগলের মতো কাঁদিস না মা। কেঁদে যে লাভ নাই। তীব্র আসবে না।’

আমি ফুপির গাল আজলে নিয়ে বললাম, ‘ফুপি আমি তো তোমার থেকে কখনো কিছু চাইনি বলো! তুমি যখন যা দিয়েছো তাই নিয়েছি। কখনো নিজ মুখের কিছু চাইনি। আজ আমি তোমার থেকে কিছু চাইলে তুমি দেবে ফুপি! তীব্রকে বলো না সব ঠিক করে ফেলতে! আমি বাঁচতে পারবো না উনাকে ছাড়া। প্লিজ ফুপি এনে দাাও!’

ফুপি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলাম। একসময় কাঁদতে কাঁদতেই সেন্সলেস হয়ে ফুপির বুকে পড়ে রইলাম।
_______

সেন্স ফিরতেই সামনে ডক্টরকে চোখে পড়লো। ডক্টর হাসিমুখে বসে আছে। আমি পিটপিট করে তাকাতেই উনি বললেন, ‘এখন কেমন আছো প্রানেশা?’

আমি মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বললাম, ‘ভালো আঙ্কেল।’

ডক্টর আঙ্কেল নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললেন, ‘মিষ্টি খাওয়াচ্ছো কবে? ভাবী আমি কিন্তু মিষ্টি ছাড়া যাচ্ছি না।’

ফুপি হেঁসে বললেন, ‘মিষ্টি পেয়ে যাবেন ভাই।’

‘প্রানেশার হাজবেন্ড কই?’

ফুপি দৃষ্টি এদিক ওদিক করে বললেন, ‘সে তো কাজে ব্যস্ত। খবর পেলে ঠিকই চলে আসবে।’

তাদের কথার মানে বুঝলাম না। মূলত আমার মাথাটাই ফাঁকা লাগছে। পলি ততক্ষণে আমার পাশে এসে বসেছে। আমি চোখের ঈশারায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে পলি? কিসের মিষ্টি? হঠাৎ করে ডক্টর আঙ্কেল তীব্রকে খুঁজছে কেনো?’

পলি আমার গাল টেনে জড়িয়ে ধরে। হাসিমুখে বলে, ‘আমি খালামনি হচ্ছি আপু। তুমি মা হবে! ইশশ ভাবতেই আমার খুশিতে কান্না চলে আসছে। তোমার ছেলে বা মেয়ের ছোট ছোট হাত ধরে আমি ঘুরে বেড়াবো। দুষ্টুমি করবো। আহা!’

পলি হয়তো আরো অনেক কিছু বলেছে। তবে আমি এখনো একটা বাক্যেই আটকে আছি। আমি মা হবো! আপনমনে হাতটা পেটে চলে যায়। ডক্টর আঙ্কেল একটা প্রেসক্রিপশন এগিয়ে বললেন, ‘টেস্ট করে নিও। আর একদম সাবধানে চলাফেরা করবে। সবসময় নিজেকে খুশি রাখবে৷ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাবে। ফাস্ট ফুড একদম খাবে না।’

আমি মাথা নাড়ালাম। ডক্টর চলে যেতেই কাকী আর পলি আমাকে অভিনন্দন জানালো। মা হওয়ার অনুভূতিটা ঠিক কতটা প্রখর তা একটা মেয়ে ভালোভাবেই জানে। পেট থেকে তখনো হাতটা সরাই নি। বার বার মনে হচ্ছিলো আমি ঘুমিয়ে আছি। ডক্টর আঙ্কেল কে বিদায় দিয়ে ফুপি এগিয়ে আসে আমার রুমে। মুখটা থমথমে রেখেই বলে,

‘এখন এই বাচ্চার কি ফায়দা! তীব্র তো তোকে ছেড়েই দিয়েছে। এই বাচ্চাটা রেখে নিজের জীবন দুর্বিষহ করার কোনো মানেই হয় না।’

চমকে উঠলাম আমি। পলি আর কাকীও অবাক হলো। কাকী অবাক কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবী এসব কি বলছো? তীব্র প্রানেশাকে ছেড়ে দিচ্ছে বলে ‘ও’ ওর প্রথম সন্তানকে রাখবে না! মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেলো তোমার?’

‘যেটা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলিস না ছোট। এই বাচ্চার জন্য প্রানেশার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।’

আমার মাথা আরো একবার চক্কর দিলো। গুটিশুটি মে’রে বসে রইলাম। আমার প্রথম সন্তান কেনো! এটা যদি আমার ৫ তম সন্তান হতো আমি তবুও ওকে শেষ হতে দিতাম না। আমার বাবুকে আমি পৃথিবীর আলো দেখাবোই। শক্ত কন্ঠে ফুপিকে বললাম,

‘আমাকে নিয়ে, আমার বাবুকে নিয়ে তোমাদের বিন্দুমাত্র সমস্যা থাকলে আমি আমার বাবু নিয়ে চলে যাবো ফুপি। কিন্তু কোনো ভাবেই এবোরশন করবো না৷’

ফুপি বিস্ফোরিত নয়নে তাকায়। আমি নিজের কন্ঠস্বর শক্ত রেখেই পলিকে বললাম, ‘তিহাকে কল দিয়ে আসতে বলবি। আমার সন্তান তীব্রর অস্তিত্ব। যেখানে ওর বাবা, মা দুজনেই বেঁচে আছে সেখানে এবোরশন করানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। আমার বাবু তার বাবার বাড়িতেই বড় হবে। তীব্র কি করে আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ আনে এবার আমিও দেখে নিবো। বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না যে চাইলেই ডিল করে বিয়ে করলাম আর চাইলেই ডিল করে বিয়ে ভেঙে দিলাম। এখন সবাই যাও। আমি বিশ্রাম নিবো।’

পলি কিছু বললো না। চুপচাপ বের হয়ে গেলো। পেছন পেছন কাকীও গেলো। ফুপি কিছু বলতে নিলে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলাম। স্পষ্ট স্বরে বললাম,

‘তোমার প্রতি আমার ঋণের শেষ নেই ফুপি। ছোট বেলা থেকে আমাকে বড় করেছো। খাইয়েছো, পড়িয়েছো, বিয়ে দিয়েছো। এখন যখন আমার সন্তানের বিষয় তখন না হয় আমাকেই দেখতে দাও!’

ফুপি আর কিছু বললেন না। চুপচাপ বেড়িয়ে গেলেন। আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে হাসি মুখে নিজের পেটের দিকে তাকালাম। ধীর স্বরে বললাম, ‘তোর বাবা তোর কথা শুনলে কখনোই আমাদের দুরে সরিয়ে রাখবে না৷ কখনোই না৷ কোনোদিনও না৷ দেখিস তোর বাবা চলে আসবে!’

রাতের বেলা জানালা মেলে বাহিরের চাঁদ দেখছিলাম বসে বসে৷ বাহির থেকে চেচামেচির আওয়াজ পেলেও তা ইগনোর করলাম। নিজের মনে নিজের বাচ্চাটা আর তীব্রর কথা ভাবতে থাকলাম। তীব্র কখন আসবে! ‘ও’ কি জানে না ওর প্রাণ আর ছোট্ট মিষ্টি একটা পরী অপেক্ষা করে আছে! আমার ভাবনার মাঝেই হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলেন ফারদিন ভাই। উনাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। এই ২ মাসে উনি যথেষ্ট দূরত্ব রেখেছেন আমার থেকে। আজ এমন ভাবে ঢুকতে দেখে বেশ ভয় পেলাম। ফারদিন ভাই কোনো কথা না বলে আমাকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে বললো,

‘এই বাচ্চাটা আমি ম’রে গেলেও রাখতে দেবো না। চল! এবোরশন করাবো তোকে!’

আঁতকে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘ফারদিন ভাই ছাড়েন আমার হাত! আমি করাবো না এবোরশন। ছাড়েন বলতেছি!’

উনি না ছেড়ে দাঁত কটমট করে কিছু বলতে নিলে পলি ছুটে আসে। আমার বাহুতে হাত রেখে ব্যস্ত হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘তীব্র ভাইয়ের গু’লি লেগেছে আপু। অনেক র’ক্ত’ক্ষ’রণ হয়েছে৷ বাঁচবে না বোধহয়!’
#তীব্র_প্রেমের_নেশা (২১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

পলির কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তীব্রের গু’লি লেগেছে মানে! পুরো কথাটা বার বার মাথায় ঘুরপাক করতে থাকে। চোখ পিটপিট করে কয়েকবার পলির মুখের দিকে তাকিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম ফ্লোরে। ফারদিন ভাই হাত ছেড়ে দিয়েছে। পলি দ্রুত কাছে এগিয়ে এসে আগলে নিয়ে বলে,

‘আপু! ঠিক আছো তুমি? এই আপু!’

আমি ওভাবেই বসে রইলাম। তীব্রর কিছু হবে না তো! মাথায় তখন এই একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পলি বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই আপু! এভাবে চুপ করে আছো কেনো? তীব্র ভাইয়ের কাছে যাবে না? হসপিটালে আছে ভাইয়া। জীবন-মৃ’ত্যুর মাঝে লড়ছে!’

আমার দৃষ্টি দ্রুত হলো। চোখের পাতা কয়েকবার ঝাপ্টে কিছু বলার আগেই ফারদিন ভাই আমার হাত টেনে ধরে বললো, ‘তীব্র ম’রুক আর না ম’রুক তোর এই বাচ্চা ম’রবেই। ওঠ! তোকে এবোরশন করাতে হবে।’

‘ভাইয়া আপুকে ছাড়ো! ব্যাথা পাবে আপু। দেখো ভাইয়া বেশি বেশি করো না। প্রানেশা আপুকে ছাড়ো। আমরা তীব্র ভাইয়ার কাছে যাবো।’

ফারদিন ভাই পলিকে চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘আর একটা কথা বললে তোর গাল ফা’টিয়ে দেবো আমি। তুই সর!’

ফারদিন ভাই টানতে শুরু করলে শান্ত গলায় বললাম, ‘হাত ছাড়ুন!’

ফারদিন ভাই না ছেড়ে আরো শক্ত করে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘তোর এই বাচ্চা এবোরশন না করানো পর্যন্ত আমার হাত থেকে নিস্তার নাই।’

আমি আরো একবার শান্ত ভাবে বললাম হাত ছাড়ার কথা। কিন্তু ফারদিন ভাই না শুনে টানতে শুরু করলে আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘হাত ছাড়ুন!’

ফারদিন ভাই আর পলি ২ পা পিছিয়ে যায়। আমি কোনোমতে ফ্লোর থেকে উঠে আঙুল উচু করে ফারদিন ভাইয়ের দিকে তাক করে বললাম, ‘অনেক সহ্য করেছি আমি। আর না! কি পেয়েছেন আপনি আমাকে? আপনাদের বাড়িতে থাকতাম বলে আপনার সব অ’ত্যা’চা’র আমি সহ্য করে নিয়েছি বলে আমার বেবির কোনো ক্ষতি করতে চাইলেও আমি সহ্য করে নিবো! কান খুলে শুনে রাখেন এটা তাশজিদ শেখ তীব্রর সন্তান। তাকে যেমন কোনোদিন আপনি হা’রাতে পারেননি তেমনই তার সন্তানেরও টিকি টাও নড়াতে পারবেন না।’

ফারদিন ভাই অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। আমি শাড়ির কুঁচি ধরে কোনোরকমে রুম থেকে বের হলাম। পেছন পেছন পলিও আসলো। গেইট দিয়ে বাইরে বের হতেই পলি ছুটে এসে হাত ধরে। আমার তখনো মাথা কাজ করছে না। মাথায় বার বার ‘তীব্রর কিছু হয়ে গেলে’ আসতেই আমার পাগল পাগল লাগছে। চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। পলি একটা সিএনজি ডাকলে দুজনে সেইটা করেই হসপিটাল পৌঁছালাম। ছুটে রিসিপশন থেকে তীব্রর খোঁজ নিয়ে ছুটলাম অপারেশন থিয়েটারের সামনে। সেখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আজাদ আঙ্কেল। তিহা আর আন্টি কান্না করছে। আমি ধীর পায়ে আসলাম তিহার কাছে। তিহা আমাকে দেখেই চমকে তাকালো। পলি এসে আমাকে ধরলো। আমি তিহার কাছে গিয়ে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

‘তীব্র কোথায় তিহা?’

তিহা আমার প্রশ্নে মুখ অন্যদিকে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। আমি তিহার মুখ সোজা করে আবারও একই প্রশ্ন করলাম। তিহার উত্তর না পেয়ে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি তিহা!’

তিহা কাঁপা কাঁপা হাতে ওটির দিকে ঈশারা করলো। আমি তিহাকে ছেড়ে ওটির দিকে এগোতে নিলে হাতে টান পড়ে। ব্যস্ত চোখে পেছনে তাকাতেই দেখি আন্টি হাত টেনে ধরে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ পিটপিট করে তাকাতেই উনি বললেন,

‘তুমি এক্ষুণি এখান থেকে যাও!’

আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘আমি তীব্রর কাছে যাবো। হাত ছাড়ুন আন্টি!’

আন্টি ছাড়লেন না। বরং টান দিয়ে দুরে সরিয়ে রাগ ঢেলে বললেন, ‘আমার ছেলের জীবনটা খে’য়ে এখন আসছো দরদ দেখাইতে! এক্ষুণি এখান থেকে বের হও তুমি।’

আজাদ আঙ্কেল দৌড়ে আসলেন। আন্টিকে আগলে নিয়ে বললেন, ‘তাফিয়া! পাগল হয়েছো নাকি? কি বলছো এসব!’

আন্টি ঝটকা মে’রে দুরে সরে গেলেন। পাগলের মতো কান্না করতে করতে চিৎকার করে বললো, ‘তোমার জন্য সব হয়েছে। তোমাদের জন্য! কতবার বলেছি এই মেয়েটা অ’পয়া। ওকে বাড়ির বউ করো না। নিজের বাবা-মা’কে খে’য়েছে ছোট বেলাতেই। এখন আমাদের জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলবে। করেছেও তো তাই। এই মেয়েকে দু কথা শুনিয়েছিলাম বলে আমার ছেলে আমার সাথে কতদিন ঠিক করে কথা বলে না! তোমরা বাবা-মেয়েও তো আমাকে কথা শোনাতে ছাড়োনি! এই মেয়ের জন্য আমার বাপের বাড়িতেও সম্পর্ক খারাপ হলো। এখন! এখন এই মেয়ের জন্যই তো আমার ছেলের এই অবস্থা!’

আন্টি কান্না করছে। আমি অবাক চোখেই তাকিয়ে আছি। চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানেই ফ্লোরে বসে পড়লাম। তিহা আন্টিকে সামলে বললো, ‘এটা হসপিটাল আম্মু। চেচামেচি করো না। তারপর ওটির সামনে এসব চেচামেচি করলে নার্সরা রেগে যাবে।’

আন্টি চুপ করে বসে রইলেন। পলি আমাকে তুলে বেঞ্চে বসিয়ে দিলো। তারপর আন্টির সামনে গিয়ে বললো,

‘ঠিকই বলেছো আন্টি। মেয়েটা আসলেই অ’পয়া জানো তো! নয়তো কি কেবল ৬ মাস বয়সে বাবা-মায়ের খু’নের সাক্ষী হয়! এরপর ফুপির কাছে বড় হলো। নিজের সব আহ্লাদ, সব স্বপ্ন ত্যাগ করে সবার বলা পুতুলের মতো চলতে পারতো! ফুফাতো ভাইয়ের কাছে দিনের পর দিন অমানবিক অ’ত্যা’চা’র সহ্য করতে পারতো! নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডের বেই’মানি সহ্য করতে পারতো! আপনার ছেলেকে এতো ভালোবাসার পরও, আপনার ছেলে ছেড়ে যাওয়ায় গত ২ মাস নিজেকে একটা ঘরবন্দী করে রাখতে পারতো! রোবটের মতো থাকতে পারতো! আজ যখন জানলো মেয়েটা মা হবে তখন জানলো তীব্র ভাইয়ের এই অবস্থা। নিজের দিক না ভেবেই এভাবে পাগলের মতো ছুটে আসতে পারতো যদি না মেয়েটা অ’পয়া হতো! অ’পয়া বলেই তো সারাজীবনই মেয়েটাকে কষ্টের পাহাড়ে ডুবতে হলো। তাই না আন্টি?’

আমি চুপ করে বসে রইলাম। অনুভব করলাম সেখানকার সবার অবাক দৃষ্টি। তিহা ছুটে এসে আমার সামনে বসে অবাক হয়ে বললো, ‘ভাবী তুমি সত্যিই…’

আমি কোনো জবাব দিলাম না। পলিই এগিয়ে এসে বললো, ‘আজই ডক্টর জানিয়েছে। কাল সব টেস্ট করতে হবে।’

এমন অবস্থায় এই সুসংবাদটাও যেনো সবার কাছেই শুধুই একটা সংবাদ। আমার দৃষ্টি তখন ওটির দিকে। আন্টি চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, ‘এই মেয়ের মতো ওর সন্তানটাও অ’পয়া।’

এবার আজাদ আঙ্কেল রেগে গেলেন। ঠা’স করে থা’প্পড় বসালেন আন্টির গালে। থা’প্পড়ের শব্দে চমকে উঠলাম। আন্টি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। আঙ্কেল রেগে গিয়ে বললেন,

‘তোমার মতো নি’কৃষ্ট মেয়ে মানুষ আমি আসলেই দেখিনি। একটা মেয়ের সাথে এতোটা খারাপ ব্যবহার কোনো মা করতে পারে! আজ প্রানেশার জায়গায় তোমার মেয়ে থাকলে ওকেও এভাবেই বলতে! ভুলে যেও না প্রানেশার গর্ভে কিন্তু তোমার ছেলেরই অংশ। যদি সেই সন্তান অ’পয়া হয় তাহলে তোমার ছেলে নিজেও অ’পয়া। প্রানেশাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবে না।’

আন্টি ধপ করে বসে পড়লেন। কে কি করছে আমার এদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার শুধু তীব্রর ব্যাপারে জানা লাগবে। আমি তিহার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ডক্টর কখন বের হবে তিহা?’

তিহা আমার গালে হাত রেখে বললো, ‘একটু পরই হয়তো। চিন্তা করো না ভাবী। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমি মাথা নাড়ালাম। ডক্টর বের হলেন তারও প্রায় আধাঘন্টা পর। আমি ছুটে গেলাম উনার কাছে। ব্যস্ত গলায় বললাম, ‘আম-আমার হাজবেন্ড! কেমন আছে ডক্টর? উনি ঠিক আছে তো? সুস্থ হয়ে যাবে তো? কোথায় উনি?’

ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত থেকে গ্লাভস খুলে মাথায় হাত রাখলেন। আমি তখনো চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ডক্টর ধীর কন্ঠে বললেন, ‘আমরা ৪৮ ঘন্টার আগে আর কিছু বলতে পারবো না মা। যদি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সেন্স না আসে তাহলে যা কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। এমনকি মা’রাও যেতে পারে।’

আমি থমকে গেলাম। আন্টি, তিহা শব্দ করে কাঁদতে থাকলেন। ডক্টরের কথা শুনে আমি একবার ওটির দিকে তাকালাম। সবকিছু ছাপিয়ে ওটির দিকে ছুট লাগালাম। পিছন পিছন পলি আটকানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। ওটির ভেতরে ঢুকতে নিলে দুজন নার্স আটকে দিলেন। আমি বার বার একটাই কথা বলছিলাম, ‘তীব্রর কাছে যাবো আমি৷ ছাড়ুন আমাকে!’

কেউ কোনো কথা শুনলো না। আমার উন্মাদনা বাড়লো৷ পাগলের মতো শুরু করলাম। পলি ততক্ষণে আমাকে আটকাতে আটকাতেই কেঁদে ফেলেছে। তিহা, আঙ্কেল সবাই আটকানোর চেষ্টা করছে। এতো চাপ নিতে না পেরে ওখানেই সেন্স হারালাম।
_______

সেন্স ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম হসপিটালের কেবিনে। আমি চোখ মেলে আশে পাশে তাকাতেই নজরে পড়লো হাতের স্যালাইন। পুরো রুম ফাঁকা। সাথে আমার মস্তিষ্কের চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। কি হয়েছে কাল তা মাথায় আসতেই প্রথমে হাত গেলো পেটে। এরপর চট করে উঠে স্যালাইনের সূচ টেনে বের করলাম। খোলা চুলে কোনোরকমে শাড়িটা ঠিক করেই কেবিনের বাহিরে আসলাম। পড়নে সুতির একটা শাড়ি। আমি বাহিরে এসে নজরে পড়লো না কাউকে। আমি হসপিটালের কোন তালায় আছি বা কোন কেবিনে আছি এসবের কিছুই জানা নেই৷ আশে পাশের একটা কেবিনে ঢুকেই নার্সকে চেপে ধরলাম। নার্স আমাকে দেখে ভয় পেয়ে বললো,

‘আরেহ ম্যাম কি করছেন! আপনার হাতে এতো র’ক্ত কেনো?’

আমি কোনো প্রকার জবাব দিলাম না। শুধু কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটি কোনদিকে?’

‘আরেহ ম্যাম ওটিতে যাবেন পরে। আগে আপনার হাতটা তো ব্যান্ডেড করুন!’

‘আপনি বলুন ওটি কোনদিকে! আমি করে নিবো ব্যান্ডেড।’

নার্স কিছুক্ষণ আমার হাতে ব্যান্ডেড করতে চেয়েও ব্যর্থ হলেন। শেষে হার মেনে বললেন, ‘২ তালায় ওটি।’

‘এটা কয় তালা?’

‘৩ তালা।’

আমি আর কিছু না বলেই বের হয়ে আসলাম। ছুট লাগালাম নিচে। শাড়িটা ভালো মতো ধরে ২ তালায় আসতেই এক ভদ্র মহিলার কন্ঠ কানে এলো,

‘আজ তো ওপারেশনের পর একটা ছেলে মা’রা গেছে। আহারে ছেলেটার বয়সই আর কত হবে! বাঁচতে পারলো না।’

থেমে গেলো পা দুটো। অজান্তেই শরীরের ভার ছেড়ে দিলাম। আজ তো তীব্রর অপারেশন ছিলো! তাহলে কি! মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলাম। মহিলার কথা শুনে আর এগোনোর সাহস বা শক্তি কোনোটাই পেলাম না। চারদিকে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ আর প্রিয়জন হারানোর হাহাকার শোনা যাচ্ছে। এ হাহাকার আমার তীব্রর জন্য নয় তো! এই হাহাকার গুলো আমার আপন মানুষদের নয় তো!

চলবে..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here