তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -১৯

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটেছে। আমরা এই কয়েকদিনই একটা রিসোর্টেই ছিলাম৷ যেনো সত্যি সত্যি হানিমুনে এসেছি। তিহা, মিলি, মুন্না, বিপ্লব এসে আমাদের সাথে ঘুরে গেছে। কাল সবাই ঢাকা ফিরবে। আমরাও ফিরবো। এই কয়েকদিনে সবকিছুই স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক হতে পারছি না আমি। সেদিন জিনিয়াকে দেখার পর থেকেই অজানা আশঙ্কায় আমার অস্থিরতা বাড়ে। সেদিন রাতে উল্টো পাল্টা স্বপ্নও দেখেছি৷ তীব্র একদম স্বাভাবিক। আমাকে জ্বালাচ্ছে, লজ্জা দিচ্ছে, ঠাট্টা করছে সবই চলছে শুধু আমিই নিজেকে একদম স্বাভাবিক করতে পারছি না। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বড় বড় শ্বাস নিয়ে সামনে তাকালাম৷ তীব্র ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ হলে আমি তা মেনে নিবো কিভাবে! দুপা এগিয়ে তার কাছ ঘেষে বসলাম। তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন৷ তারপর ল্যাপটপ রেখে আমাকে দুহাতে আগলে নিয়ে বললেন,

‘আজ রাতে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’

আমি খানিকটা অবাকই হলাম। অবাকের রেশ ধরেই বললাম, ‘কি সারপ্রাইজ?’

‘সেইটা বললে কি সারপ্রাইজ আর সারপ্রাইজ থাকবে!’

আমি মাথা নাড়িয়ে হাসলাম। তীব্র আমাকে ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো, ‘চলো রেডি হও! একবারে দুজনে ঘুরেফিরে তোমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে আজ রাতেই ঢাকা রওনা দিবো।’

‘রাতেই!’

তীব্র ছোট্ট করে ‘হুম’ বললেন। উনার থেকে সারপ্রাইজ পাবো শুনে মনে হলো হয়তো বা উনি হিরোদের মতো প্রপোজ ট্রপোজ করবে। হিহিহি! মনে লাড্ডু ফুটতে শুরু করলো৷ লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেলাম। মাথা থেকে বের হয়ে গেলো জিনিয়া আর ভয়। তীব্র আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বাহিরে বের হয়ে গেলেন৷ আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে শুভ্র রঙের শাড়ি৷ পাড়টা টকটকে লাল। হালকা করে কিছু কাজ করা। শাড়িটা দেখেই আমার চোখ চকচক করে উঠলো। আমি চটপট রেডি হয়ে নিলাম। শাড়ি পড়ে তার সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি, চুড়ি পড়লাম৷ তীব্র আলতা আনিয়েছে দেখে চট করে তাও পড়ে নিলাম। কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো খোলা রাখলাম৷ বাহিরে কেবল সন্ধ্যা হয়েছে। আমি ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলাম৷ নিজেই নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। তীব্র কি আমাকে দেখার পর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে! লজ্জায় নিজেই নিজের হাতে মুখ ঢেকে নিলাম৷ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আমি নিজেই দরজা খুলে দিলাম৷ তীব্রকে দেখে আমার হার্ট বিট-ই যেনো মিস হয়ে গেলো৷ নিঃশ্বাস থেমে গেলো৷ নিঃসন্দেহে মানুষটা সুদর্শন। তার চোখ, তার চাপদাড়ি, ঠোঁট, নাক, কপাল, চুল সবকিছুতেই যেনো সৌন্দর্য ঢেলে দেওয়া। এর আগে কতবার দেখেছি তাকে কই তখন তো মুগ্ধতা আসতো না! সবসময় ঘৃ’ণায় আসতো। আর এখন তার দিকে তাকালেও সুখ সুখ লাগে। আমার ধ্যান ভাঙে তীব্রর ডাকে। তীব্র ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলে,

‘এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো আমার নজর লেগে যাবে। তখন অন্য কোনো মেয়ে আর তাকাবে না। বিয়েও করবে না।’

আমি কপালে ভাজ ফেলে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালাম। তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম, ‘বউ থাকতেও বিয়ে করার শখ কেনো?’

তীব্র রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘এই বউ কয়দিন আছে তার তো কোনো ঠিক নাই৷ ডিভোর্স হয়ে গেলে তো তখন আমার বউ লাগবে নাকি!’

আমি থমকালাম। চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকালাম। তীব্র নিজের ঘড়ি পড়ে চুল ঠিক করে আমার দিকে তাকায়। আমাকে এমনভাবে থাকতে দেখে বলে, ‘আবার কি হলো? মজা করছি তো! এক বউ-ই সামলাতে পারি না আবার বিয়ে করলে আমার হা’ড় মাং’স কিছু থাকবে?’

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। তীব্র কাছে এগিয়ে এসে এক হাত গালে রেখে মুখটা কাছে আনলেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘এমন সুন্দরী বউ থাকতে কোনো পুরুষ কি আবার বিয়ে করে! আর অন্য কেউ করলেও তো আমি করবো না। আমার একটাই প্রাণ। একটাই বউ। এই বউয়ের রুপে, ভালোবাসায় বারংবার ম’রবো।’

আমি লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে ফিরলাম। উনি বুকে হাত দিয়ে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে কিছু বলতেই আমি উনাকে ধাক্কা দিয়ে সরে আসলাম। বে’হায়া লোক! যা মুখে আসে তাই বলে। তীব্র শব্দ করে হেঁসে বলে, ‘এবার তো চলুন ম্যাম!’

আমি হেঁসে হাঁটা লাগালাম। তীব্র এক হাতে আমার হাত শক্ত করে ধরে সমুদ্রের কাছে আসলেন। কত কত কাপল এখনও সমুদ্রবিলাস করছে। নিয়নের আলোতে কি ভীষণ সুন্দর লাগছে সবটা। শীতের রাত হওয়ায় সবাই টুকটাক কিছু না কিছু গায়ে জড়িয়েছে। আমিও শাল নিয়েছি শুধু। তীব্র পাঞ্জাবির ওপরেই জ্যাকেট পড়েছে। তীব্র হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘সুন্দর না?’

‘ভীষণ! এটাই আপনার সারপ্রাইজ?’

‘জ্বি নাহ। সময় হোক। ঠিকই পেয়ে যাবেন আপনি আপনার সারপ্রাইজ ম্যাম।’

আমি ঠোঁট এলিয়ে হাসলাম। দুজনে অনেকটা সময় কাটালাম সমুদ্রের ধারে। একে অপরের সাথে কাটানো কিছু মুহুর্ত ফ্রেমবন্দীও করলাম। তীব্র সুন্দর করে ক্যান্ডেলাইট ডিনারের ব্যবস্থা করেছে। তীব্রর সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহুর্তই যেনো স্বপ্নের মতো। সুখের! দুজনে ডিনার করলাম, ঘুরলাম। প্রেমিক প্রেমিকার মতো শত শত খুনশুটিতেই কেটে গেলো প্রায় অনেকটা সময়। রাত প্রায় তখন ১১ টা। ঘুমে আমার চোখ বুজে আসছে। হাই তুলতে তুলতে তীব্রর বাহু আকড়ে ধরে কাধে মাথা রাখলাম। বললাম,

‘আপনার সারপ্রাইজ দেওয়ার সময়টা কখন হবে? ঘুম পাচ্ছে তো আমার।’

তীব্র অদ্ভুত ভাবে হাসে৷ আমাকে সোজা করে কপালে গভীর ভাবে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়। আমি ড্যাবড্যাব করে উনার দিকে তাকাতেই উনি হাসলেন। উনার এই হাসিতে আমি কিছু একটার আভাস পেলাম। বুঝলাম না কি হচ্ছে! তীব্র আমার হাত ধরে তুলে বললেন,

‘আচ্ছা প্রাণ যদি আজকের এই সময়টাই হয় তোমার আমার শেষ মুহুর্ত! তবে তোমার অনুভূতি কেমন হবে?’

আমি চমকে উঠলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তীব্রর দিকে। এক হাতে তীব্রর জ্যাকেট চেপে ধরলাম। তীব্র একপলক সেদিকে তাকিয়ে আমার কপালে পর পর তিনটে চুমু দিলেন। এরপর হেঁসে হাত থেকে জ্যাকেট ছাড়িয়ে নিয়ে হাতে হাতে রেখে হাঁটা শুরু করলেন। রিসোর্ট থেকে অনেকটা দুর এসে একটা ছোট বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। আমি আশে পাশে তাকিয়ে বললাম,

‘এটা কোন জায়গা তীব্র?’

‘তোমার সারপ্রাইজ এখানেই।’

উনার কন্ঠটা অদ্ভুত শোনালো। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালাম৷ তীব্র দুপা এগিয়ে কলিং বেল এ চাপতেই দরজা খুলে দিলো একজন লোক। তীব্রকে দেখে দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন,

‘সবাই ভেতরেই আছে বস।’

আমি নির্বাক। কারা ভেতরে আছে! তীব্র হাত চেপে ধরে ভেতরে ঢুকলেন। লিভিং রুমের সোফায় বসা কয়েকজন মানুষকে দেখে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। অবাক হওয়ার মাত্রাটাও যেনো ছাড়িয়ে গেছে আমার। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে নিজেই নিজেকে সামলে নিলাম। জুঁই ততক্ষণে কান্না করে আমাকে ডাকছে আর বলছে,

‘ও মামুনি, মামুনি! দেতো না এরা আমাতে ধলে লেখেতে। তুমি এই পতা লোকগুলোতে মারু দিয়ে দাও।’

আমি যেনো নিজেকে ফিরে পেলাম। একছুটে লোকটার কোল থেকে জুঁইকে টেনে নিলাম। পিচ্চিটা আমাকে এতোটাই ভালোবাসে যে আমার কোলে আসতেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। গলা জড়িয়ে থাকে শক্ত করে। আমি শুধু সোফায় বসা জিনিয়া আর আন্টির দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনেই মাথা নত করে বসে আছে। আমি চোখ ফিরিয়ে তীব্রর দিকে তাকাতেই তীব্র এগিয়ে আসে। প্রথমে জুঁইকে কোলে রাখা লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘জুঁই এতো ভয় পেলো কিভাবে? তোমাদের কি বলেছিলাম আমি!’

সামনে থাকা লোকটা তীব্রর কন্ঠে কেঁপে ওঠে। কাঁপা গলায় বলে, ‘সরি বস৷ বাচ্চাটা অনেক কান্না করছিলো বলে ধমকে দিয়েছিলাম।’

তীব্র দাঁতে দাঁত চেপে থেকেও কিছু বললো না। আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো, ‘তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড তোমার সামনে স্বশরীরে বসে আছে। তাকে যে আমি রে’প বা মা’র্ডার কোনোটাই যে করিনি তা নিশ্চয় তোমার বিশ্বাস হচ্ছে!’

আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালাম তীব্রর দিকে। আমি তো কবেই মেনে নিয়েছিলাম যে তীব্র দো’ষী না। আজ আবার নতুন করে তীব্র কি বলছে! তীব্র জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘নিজে নিজে সত্যিটা বলবা নাকি আমি কিছু করবো?’

জিনিয়া হকচকিয়ে দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। আমি আশায় রইলাম জিনিয়ার মুখ থেকে শোনার জন্য। সে কেনো এমন করলো! আমার কাছে তীব্রকে ছোট করে কি পেলো সে! এতোগুলো দিন আমাকে দিয়ে তীব্রকে ঘৃ’ণা করিয়ে তার কি লাভ হলো! জিনিয়া কিছু বলছে না দেখে তীব্র এমন এক ধমক দিলেন যে সেখানে থাকা আমরা প্রত্যেকটা মানুষই কেঁপে উঠলাম। জিনিয়া আর জুঁই কেঁদে ফেলেছে। জুঁই বাচ্চা মেয়ে হওয়ায় এতো বড় ধমকে ভীষণ ভয় পেয়েছে। আর জিনিয়া ভয় পেয়েছে নিজের কর্মফলের কথা ভেবে। তীব্র আগের চেয়ে দ্বিগুণ গম্ভীর স্বরে আন্টিকে বললেন,

‘জুঁই কে নিয়ে ভেতরে যান!’

আন্টি দেড়ি করলেন না। কোল থেকে জুঁই কে নিয়ে ছুটে গেলেন রুমের মধ্যে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আন্টি একবারও তাকালেন না আমার মুখের দিকে। জিনিয়া ততক্ষণে শব্দ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। তীব্র নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখলেন। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন,

‘তোমার এই নাটকীয় কান্না শেষ করে বলা শুরু করবে নাকি আমাকে কিছু করতে হবে!’

জিনিয়া চমকে উঠলো। কোনো রকমে কান্না থামানোর চেষ্টা করতেই একজন লোক এসে ওকে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিলো। ঢকঢক করে পানি শেষ করে কিছুক্ষণ দম নিয়ে বলা শুরু করলো,

‘কলেজ লাইফের প্রথম থেকেই আমার ভীষণ ভালো লাগতো তীব্রকে। ওকে যেখানেই দেখতাম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। একসময় ভীষঙ ম’রিয়া হয়ে উঠলাম উনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। এইচএসসি শেষ করে নিজে থেকেই প্রপোজ করে ফেললাম তীব্রকে। তোকে এসবের কিছুই জানাইনি আমি। তীব্র তার গম্ভীর স্বভাব সূলভ বজায় রেখেই আমাকে রিজেক্ট করে দিলেন। আমি হাল ছাড়লাম না। তার পেছনে ছ্যা’ছড়ার মতো পড়ে ছিলাম। উনি বিরক্ত হয়ে একদিন আমাকে অ’পমান করলেন। এরপর তারই এক লোকের কাছে জানতে পারলাম তীব্র তোকে পছন্দ করে ২ বছর হলো। আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। আমাকে রেখে তোকে পছন্দ করেছে তীব্র এটা আমি মেনে নিতে পারলাম না। তোর প্রতি তৈরী হলো ঈ’র্ষা। সেখান থেকেই বার বার তোর ক্ষ’তির কথা চিন্তা করছিলাম। তখন দেখা পাই ফারদিন ভাই আর তোর ফুপা পলক আঙ্কেলের। তারা দুজনেই প্রথম থেকে তীব্রর শ’ত্রু ছিলেন। কোথাও থেকে ইনফরমেশন পেয়েছিলো তীব্রর দুর্বলতা তুই। প্রথম থেকেই তারা এখবর জানতো। তাই আমাকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করলো। তীব্ররও মানসম্মান শেষ হবে আর তোর মনেও তীব্রর প্রতি জন্মাবে এক আকাশ ঘৃ’ণা। সেদিন রাতে প্ল্যান অনুযায়ী আমি তীব্রকে কল করে বলে আমাকে সাহায্য করতে। যখন তীব্র এসেছিলো ততক্ষণে আমি তোকেও বলেছিলাম চলে আসতে। তীব্র আসতেই আমি আমার অভিনয় শুরু করি। কিন্তু ভুলবশত সেদিন আপু আর দুলাভাই চলে আসে। সবটা দেখে নিয়েছিলো। তাই ব্যাপারটা যাতে লিক না হয় তাই পলক আঙ্কেল আর ফারদিন ভাই আমার চোখের সামনেই আমার দুলাভাইকে মে’রে ফেললেন। আপুকে আ’ঘাত করলেও আপু বেঁচে যায়। কোমায় চলে যায়। তুই যখন আসলি তখন আমি মিথ্যে মিথ্যেই তোকে ওসব বলেছিলাম। আর ম’রে যাওয়ার নাটকও করে ছিলাম। সে সময় তীব্র নিজেও বুঝতে পারেনি আমি বেঁচে আছি। সে ভেবেছিলো বোধহয় আমি সত্যি আ’ঘাত পেয়েছি। আ’ঘাত পেয়েওছিলাম তবে তা সামান্য ছিলো। এরপর তুই তীব্রকে ঘৃ’ণা করতে শুরু করলি। তীব্র অন্ধকারে হাতড়ে ম’রতে ম’রতে ডিপ্রেশড হয়ে গেলো। ফারদিন ভাই তখন টপে আছেন। তীব্র তোর চোখে তার জন্য ঘৃ’ণা সহ্য করতে না পেরে কতদিনের জন্য শহরই ছেড়ে দিলেন। এরমধ্যে তিনি খবর পান আজাদ আঙ্কেল অসুস্থ। রাজনীতি, নিজেদের ব্যবসা সবকিছুই শেষ হতে বসেছে। তীব্র নিজেকে শক্ত করে আবার কাজে লেগে পড়ে। তারপর কি থেকে কি হয়ে গেলো তীব্র আর তোর বিয়ে হয়ে গেলো।’

আমি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে তীব্র আগলে নিলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ফুপা আর ফারদিন ভাই এতো নীচ! তীব্র আমাকে বসিয়ে দিলেন সোফায়। জিনিয়া শব্দ করে কেঁদে বললো,

‘আমাকে মাফ করে দে প্রানেশা। আমি বুঝতে পারিনি তখন। ভালোবাসায়, প্রতি’হিং’সায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম। এখন নিজের করা সমস্ত ভুল আমি টের পাই। আমাকে মাফ করে দে!’

জিনিয়াকে কিছু বলার ইচ্ছেটাও যেনো হারিয়ে গেলো আমার। শুধু চুপচাপ বসেই রইলাম। তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বললেন, ‘আমি জানি তুমি সত্যটা জানতে না কিন্তু তবুও যা করেছো তাতে তুমি আমার মনে বড় করে দাগ কেটে দিয়েছো। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি। আজও বাসি। ভবিষ্যতেও বাসবো।’

আমি চোখ মুখ খিঁচে রইলাম। নিজের অবস্থানটা শক্ত করলাম। পুরো লিভিং রুমে কয়কেটা মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ আর কান্না ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই। জিনিয়াকে কি বলবো! আমি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা জল হাত দিয়ে মুছে চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নিলাম। শ্বাড আটকে জিনিয়াকে বললাম,

‘তোকে আমি স্কুল লাইফ থেকে বেষ্ট ফ্রেন্ড হিসেবে জেনে এসেছি। তোকে আপন করে আত্মার সাথে মিশিয়ে রেখেছিলাম। আমি সে সময় তীব্রকে ভালোবাসিনি। ভয়ে উনার থেকে দুরে থাকতাম। তুই যদি একটা বার আমার সাথে কথা বলতি! প্রতি’হিং’সা থেকে প্রতিশোধ না নিয়ে যদি আমাকে বলতি সব! আজ তুই, আমি, তীব্র হয়তো এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। জানিস তীব্র আমাকে বলেছিলো আমি সব সত্য জানার পর নিজেকে ঘৃ’ণা করবো। বিশ্বাস কর! আজ আমি নিজেকে এতো বেশি ঘৃ’ণা করতে শুরু করেছি যা আমার ভেতরটা পু’ড়াচ্ছে। নিজের প্রতি এতো অভিযোগ, এতো রাগ আমার কখনো হয়নি৷ একটা নির্দোষ মানুষকে কারণে, অকারণে হাজারবার অপমান করে এসেছি। তার অনুভূতি, তার ছোঁয়া আমি ঘৃ’ণা করেছি। তার ভালোবাসার অ’পমান করেছি। তোকে না হয় মাফ করে দিবো আমার এতগুলো ভুলের ক্ষমা কি আদৌও হবে! নিজের অজান্তে করা ভুলের মাশুল আমাকে গুণতে হবে না তো!’

মুখে হাত চেপে জোড়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। তীব্র বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। জিনিয়া নীরব দর্শক। মনে ভয় জমেছে। সন্ধ্যে থেকে এতো এতো মুহুর্ত আমার জীবনে শুধুই স্মৃতি হবে না তো! কানের কাছে বার বার বাজছে তীব্রর বলা, ‘আচ্ছা প্রাণ যদি আজকের এই সময়টাই হয় তোমার আমার শেষ মুহুর্ত! তবে তোমার অনুভূতি কেমন হবে?’ আমার শরীরে লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। মুহুর্তেই কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো। অনেকটা সময় কাটলো ওভাবেই। ঘড়ির কাটায় তখন ১২ টা। ঘড়ির শব্দেই আমি চোখ মুছে নিলাম। জিনিয়াকে বলার মতো কোনো ভাষা আমার নেই। যাকে বোনের মতো ভালোবাসলাম সে ঠ’কিয়েছে আমাকে৷ নিজের ফুপা, ফারদিন ভাই তাদের কথা না-ই বা বললাম। পৃথিবীতে বার বার কেনো যেনো আমাকে শূণ্য থাকতে হয়। লিভিং রুম থেকে দুপা এগোতেই তীব্র ফিরে আসলেন। তার দিকে মাথা তুলে তাকানোর মতো সাহস পেলাম না। তীব্র শীতল কন্ঠে বললেন,

‘বাড়ি ফিরবো। আসো!’

আমি জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করেই হাঁটতে লাগলাম। তীব্র পিছু ফিরে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চালাকি করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করো না জিনিয়া। আমি যদি বুঝতে পারি! কসম তোমাকে এই বালুর চরেই পু’তে দেবো।’

হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন৷ জিনিয়া কয়েক দফা কেঁপে উঠলো। আমি হাসলাম। বিড়বিড় করে আওড়ালাম, ‘তীব্রর মতো পুরুষের সাথে লড়তে আসাটা ঠিক হয়নি তোদের জিনিয়া। এ যে এক নেশাদ্রব্য! যত গভীরে যাবি তত তলিয়ে যাবি৷ এই যে এই মানুষের প্রেমে পু’ড়ে যাচ্ছি আমি৷ তাকে না পেলে আমার ভেতর পু’ড়ে ছাই হয়ে যাবো।’

বেড়িয়ে আসলাম৷ তীব্র আর আমি গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে দুজন একটা কথাও বললাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে কাঁদতে থাকলাম। ভেতরটা হাহাকার শুরু করেছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
_______

ঘুম ভাঙে তীব্রর ডাকে। কাঁন্না করা চোখ মুখ জ্বলছিলো৷ আর চোখ জ্বালা করার জন্য ঘুম হয়েছে এমন৷ চোখ টেনে তুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে। ক’টা বাজে তা অনুমান করতে পারলাম না। চলে এসেছি বাড়িতে! গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই বেশ অবাক হলাম। অবাকের রেশ ধরোই তীব্রকে বললাম,

‘ফুপিদের বাড়ি কেনো তীব্র? আমরা তো আপনার বাড়ি যাবো!’

তীব্র আমাকে জবাব না দিয়ে হাত ধরলেন। ততক্ষণে বাড়ির সবাই বাহিরে চলে এসেছে৷ তীব্র বললো, ‘তোমার আমার বিয়েটা ছিলো একটা ডিল। তোমার আমার বিচ্ছেদই নিয়তি। এ বিচ্ছেদ হওয়ারই ছিলো প্রাণ।’

আমি উনার কথা শুনে ব্যস্ত গলায় কিছু বলতে নিলেই ছুটে আসে ফারদিন ভাই। আমার হাত শক্ত করে ধরে বলে, ‘ভেতরে চল।’

আমি যাবো না বলে চেঁচানো শুরু করলাম। তীব্র মুখ ফিরিয়ে চলে গেলো। গাড়ি স্টার্ট দিতেই উন্মাদের মতো তীব্রকে ডাকতে থাকলাম। তীব্রর গাড়ি গেইট থেকে বের হতেই আমি ফারদিন ভাইয়ের হাতে কামড় দিয়ে ছুট লাগালাম। শাড়ির আঁচল গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। বাড়ির এতগুলো মানুষ কিছুই বললো না। সবাই নীরব দর্শক। তীব্রর গাড়ির পিছে ছুটতে ছুটতে বার বার তীব্রকে দাঁড়াতে বলেও লাভ হলো না। শাড়িতে পা বেঁধে উল্টে পড়লাম। মাথা ঝিমিয়ে আসলো। নিভু নিভু স্বরে আওড়ালাম,

‘আমাকে ছেড়ে যাবেন না তীব্র। আমার ভুলের এতো বড় শাস্তি দিবেন না। আমি বাঁ’চতে পারবো না তীব্র।’

মুহুর্তেই লুটে পড়লাম মাটিতে। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলাম রাস্তার মাঝে। ততক্ষণে তীব্রর গাড়ি দৃষ্টির বাহিরে।

চলবে..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here