#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই যেনো মাথার ওপর ঘুরছে। তীব্র কি তবে আমাকে ঠ’কালো? আমার একটা ভুলের শাস্তি বুঝি এতোটা গভীর! চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে নিলাম। শব্দ করে কেঁদে উঠলাম৷ সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরে বোবা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। চোখের কাজল লেপ্টে গিয়ে চোখের নিচে দাগ হয়ে গেছে কালো কালো। সেই মুহুর্তেই বাহির থেকে ডাক ভেসে আসে তিহার। আমি দ্রুত কান্না আটকানোর চেষ্টা করলাম৷ তিহা দরজার অপর পাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বললো,
‘ভাবী তুমি কি রুমে আছো?’
আমি কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম, ‘হ্যাঁ তিহা৷’
‘আরেহ ভাবী তুমি রুমে কি করো! কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে! জলদি বাহিরে আসো। ছোট মামি তোমাকে খুঁজছে।’
আমি নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। পরপর কয়েকবার ঢোক গিললেও কথা বলার সময় অস্পষ্ট হয়ে আসছিলো স্বর। মুখ চেপে ধরলাম। এ অবস্থায় আমার বাহিরে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। তিহা ফের ডাকলো। আমি কোনো রকমে শ্বাস আটকে বললাম,
‘তিহা আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু ভালো লাগলে আসি! তুমি নিচে যাও বরং।’
তিহা তড়িঘড়ি করে বলে, ‘ভাবী খুব বেশি খারাপ লাগছে? দরজা খোলো!’
‘নাহ খুব বেশি খারাপ লাগছে না। তুমি যাও!’
তিহা কিছু বলতে নিয়েও চুপ হয়ে যায়। তারপর ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। আমি এলোমেলো পায়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটলাম। চুলের খোঁপা থেকে রজনীগন্ধার গাজরা খুলে ফেলে দিলাম। হাতে পড়ে থাকা চুড়ি গুলোও খুলে ফ্লোরেই ফেললাম। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম অনেকটা সময় নিয়ে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই আমার হাসি পেলো। হুট করেই হেঁসে দিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ালাম,
‘খুব এসেছিলে প্রানেশা তীব্রকে পু’ড়াতে! অকারণে তাকে ভুল বুঝে তাকে শাা’স্তি দিতে উঠে পড়ে লেগেছিলে! যে মানুষটাকে ঘৃ’ণার সর্বোচ্চতে রেখে ‘কবুল’ বলেছিলে আজ তুমি তাকে ভালোবেসে পু’ড়ছো! তীব্রর এই ঝলসানো প্রেমে তুমি আরো পু’ড়বে। তীব্রকে ভালোবেসেই, তার দেওয়া বিরহ নিয়েই তুমি শেষ হবে। ইশশ কেনো যে ঘৃ’ণার জায়গায় ভালোবাসার ঠায় দিলে!’
চোখ বন্ধ করতেই দু ফোঁটা জল গড়ালো চোখের কোণ বেয়ে। চুপচাপ রুমে এসে কাবাড থেকে নরমাল শাড়ি বের করে পড়ে নিলাম। এতো কাজ করা শাড়ি পড়ে ঘুমানো টা কষ্টকর। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম ব্ল্যাঙ্কেট মুড়িয়ে। চোখ বন্ধ করে থাকলেও চোখের পানি পড়া তখমও বন্ধ হয়নি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চোখ মুছে নিলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম হয়তো ছোট মামি বা তিহা, মিলি এসেছে কিন্তু ঝাপসা চোখে তীব্রকে দেখে সরে আসলাম। এলোমেলো পায়ে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। তীব্র ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলে,
‘তোমার শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে?’
আমি জবাব দিলাম না। ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে পুরো মাথাসহ ঢেকে নিলাম। মুখ চেপে ডুকরে উঠলাম। তীব্র আমার এমন আচরণে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। চুপ হয়ে গেলো। আমি যতটা সম্ভব শব্দ না করে কান্নার চেষ্টা করে গেলাম ক্রমাগত। পুরো রাতটাই কেটে গেলো নিঃশব্দ কান্নায়। পাশে থাকা তীব্র টের পেয়েছে কি না জানা নেই তবে সে একটা শব্দও করেনি আমার সাথে।
সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়ে আবার শুয়েছিলাম বলে উঠতে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেলো। ঘুমের জন্য মাথাটা ভার হয়ে আছে প্রচন্ড রকমের। পাশে তীব্র নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতেই আয়নায় নিজের দিকে চোখ পড়ে। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠলাম। বাড়ির বাকিরা প্রশ্ন না করলেও তিহা, মিলি আর ছোট মামি কিছুতেই ছাড় দেবে না। জলদি করে ফ্রেশ হয়ে চোখ ভালো করে ডললাম। কিন্তু চোখের ফোলা তো কমবে না। শেষে ওভাবেই বের হলাম৷ হাত খোঁপা করে মাথায় আঁচল টেনে নিতেই চোখ পড়লো মেঝেতে। কাল যেখানে ফুলের গাজরা, চুড়ি ফেলেছিলাম সেগুলো ওখানে নেই। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে স্বযত্নে চুড়ি আর গাজরা রাখা। ওগুলো ওখানে কে রাখলো? তীব্র! উনি এগুলো ফ্লোর থেকে উঠালে নিশ্চয় টের পেয়েছে কিছু। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নামলাম। আশে পাশে তীব্রকে কোথাও নজরে পড়লো না। মানুষটা কিছুদিন পরই আমাকে ছেড়ে দেবে অথচ আমার বেহায়া মন তার সান্নিধ্য পেতে ব্যস্ত। তিহা আর মিলি আমাকে দেখে দৌড়ে আসে। কাছে এসে বলে,
‘ভাবী শরীর কেমন তোমার? কাল তো আর আসলেই না তুমি!’
আমি উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দৃষ্টি এদিক ওদিক করতে থাকলাম। মিলি আমার হাত জড়িয়ে বলে, ‘ভাবী কতকিছু যে মিস করলেন আপনি! আহারে।’
এবারও জবাব দিলাম না। তিহা আমার নীরবতার কারণ বুঝতে না পেরে থুতনীতে হাত দিয়ে মুখ উচু করে। সাথে সাথে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নিলাম। বড় করে শ্বাস নিলাম। তিহা বললো,
‘চোখ মুখের এমন দশা কেনো ভাবী? তোমার কি সত্যি শরীর খারাপ ছিলো কাল?’
আমি ফাঁকা ঢোক গিললাম। উত্তর দেওয়ার আগেই ডাক পড়লো আন্টির। আমি তিহা আর মিলিকে পাশ কাটিয়ে আন্টির কাছে আসলাম। আন্টি আমাকে শুধু একটা লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন যেনো বড় মামা, ছোট মামা, আঙ্কেল, কাউকে না কাউকে এটা দিয়ে দেই। আমি মাথা নাড়িয়ে লিস্ট নিয়ে চুপচাপ চলে আসলাম৷ মিলিকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘বড় মামা, ছোট মামা বা আঙ্কেল কে কোথাও দেখেছো?’
‘আব্বু রুমে, কাক্কু আর আঙ্কেল বাহিরে। গার্ডেনে।’
বড় মামাকে ভয় লাগে আমার৷ আমার জন্য তার আদরের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে তাই সে আমাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। তাই তার কাছে না গিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হলাম গার্ডেনের উদ্দেশ্যের। এসে দেখি আঙ্কেল আর ছোট মামা বসে খোশ গল্পতে মেতেছেন। আমি মাথা নিচু করে এসে আঙ্কেলের দিকে লিস্টটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘আঙ্কেল! আন্টি বলেছে এগুলো আনতে।’
আঙ্কেল আমার থেকে লিস্টটা নিলেও ছোট মামা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কিসের আঙ্কেল আন্টি? কে আঙ্কেল আর কে আন্টি?’
আমি উনার হঠাৎ এমন প্রশ্নে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম। আঙ্কেল হেঁসে বললেন, ‘আরেহ আর বলো না! প্রানেশা মা আমাকে আর তোমার আপাকে আঙ্কেল-আন্টিই বলে। আগেকার অভ্যাস কি না!’
‘আগেকার অভ্যাস তো ঠিক আছে কিন্তু এ কথা আব্বাজান জানে?’
আঙ্কেল দুপাশে মাথা নাড়ালেন। ছোট মামা আমার পাশে দাড়িয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমার আব্বাজান কতটা কড়া এটাতো তুমি ভালো করেই জানো আম্মু! তাই এখন থেকেই আঙ্কেল-আন্টি ডাকা বন্ধ করো নয়তো ভুল করেও একথা আব্বাজানের কানে গেলে আস্ত রাখবে না কিন্তু। আর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে কতদিনই বা আঙ্কেল-আন্টি ডাকবে শুনি! এটা তো আর কয়েকদিনের ব্যাপার না যে আজ আছো কাল নেই তাই এখন থেকেই বাবা-মা ডাকতে শিখো।’
আমি ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়ালাম। তারপর উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পাশের বড় পুকুরটার দিকে এগোলাম। ছোট মামা তো জানে না যে আসলেই এটা কয়েকদিনের ব্যাপার শুধু এরপর আমাদের বি’চ্ছেদ। আসলেও আমি আজ আছি তো কাল নেই। শুধু শুধু আব্বু-আম্মু ডেকে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ! মাথার আঁচল টা ভালো ভাবে টেনে নিয়ে পুকুরপাড়ের সিড়িতে বসলাম। পা পানিতে ডুবিয়ে স্বচ্ছ পানিকে ঘোলাটে হতে দেখলাম। ধীরে ধীরে আবার পানি ঠিক হয়ে গেলো। পানিতে অস্পষ্ট নিজেকে দেখে হাসলাম। বড় করে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। অনুভব করলাম আমার পাশে কেউ আছে। চট করে চোখ মেলতেই তীব্রর গম্ভীর মুখটা চোখে পড়ে। কিয়ৎক্ষণ তার মুখপানে তাকিয়ে আমি দৃষ্টি সরালাম। দুজনের মধ্যকার নীরবতা মিটিয়ে উনি নিজেই বললেন,
‘কিছু হয়েছে?’
আমি জবাব দিলাম না। প্রয়োজনই মনে করলাম না। যদি দূরত্বটাই হয় আমাদের পরিণতি তবে সে দূরত্ব এই মুহুর্ত থেকেই হোক। পাশাপাশি বসেও দুজনের মধ্যকার দূরত্ব যেনো আকাশ সমান। দুজনই টের পেলাম সে দূরত্ব। আমি উনার প্রশ্নের উত্তর না দিলেও নিজে থেকে প্রশ্ন করলাম,
‘আমরা বাড়ি কবে ফিরবো?’
তীব্র কোনোরকম প্রশ্ন ছাড়াই উত্তর দিলো, ‘আজ গায়ে হলুদ শেষ হলে কাল বিয়ে। এরপর নানাভাই যাওয়ার অনুমতি দিলে ২ দিন পরই চলে যাবো। আর না দিলে কিছুদিন থাকতে হবে।’
এরপর আবারও দুজনের মধ্যকার নীরবতা। এতো এতো কথা বলার থাকলেও সবটাই গলায় দলাা পাকিয়ে রয়েছে। আমাদের এখানে থাকাটাই একসাথে থাকার শেষ সময় এরপর দুজনের দূরত্ব বাড়বে, বাড়বে সম্পর্কের জটিলতা। একটা সময় সবশেষে এসে দাঁড়াবে বি’চ্ছেদ। এই মানুষটার চোখের দিকে তাকালে আমি অনুভূতির গভীরতা মাপতে পারতাম না আজ মনে হচ্ছে ওগুলো অনুভূতি নয় শুধুই রহস্যের বোনা জ্বাল ছিলো। যেখানে আমি ফেঁসে গিয়ে দম আটকে ফেলেছি। এখন সময় শুধু কখন সেই দমটা বের হয়! ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত ভাবে হাসি ফুটে উঠলো। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘জিনিয়ার কোনো খোঁজ পেয়েছেন?’
‘তুমি কি করবে?’
‘অনেকদিন বেষ্টির মুখ দেখি না। তাই ভাবছি দেখা করবো।’
তীব্রর মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। রহস্যময় ভাবে হেঁসে বলে, ‘নো প্রবলেম বেইব আমি তোমাকে তোমার বেষ্টির সাথে খুব শীঘ্রই দেখা করাবো কিন্তু কথা হচ্ছে যে বিষয়গুলো তুমি নিতে পারবে তো?’
আমি হাসলাম। ঠোঁট প্রসারিত রেখেই বললাম, ‘এতো বড় ধা’ক্কা সহ্য করে নিলাম আর এটুকু পারবো না? শুধু নিজের প্রতি ঘৃ’ণা গুলো হয়তো বা আকাশ ছুঁবে তবে আমি সহ্য করে নিবো।’
তীব্র মুহুর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলো। পাশ থেকে উঠতে উঠতে বললো, ‘বাড়ির ভেতরে যাও। আম্মু আবার তোমাকে খুঁজে না পেলে চেচামেচি শুরু করবে তখন বিয়ে বাড়িকে আর বিয়ে বাড়ি মনে হবে না।’
আমি ছোট করে ‘আচ্ছা’ বললাম। উনি এগোতেই আমি নিজেও উঠে পড়লাম। অন্যমনষ্ক ভাবে উঠতে গিয়ে শাড়িতে পা বেঁধে উল্টে পড়লাম পুকুরে। মুহুর্তেই আর্তনাদ করে উঠলাম৷ উল্টো হয়ে পড়ার কারণে বেশ খানিকটা পানি অলরেডি পেটে চলে গেছে। পুকুরের নিচটা পিচ্ছিল হওয়ায় বেশ খানিকটা পানিতে চলে এসেছি। নাক মুখ দিয়ে হুর হুর করে পানি ঢুকতে থাকে।
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)