স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নিরপত্তায় ঘেরা সম্পূর্ণ স্কুল এড়িয়া। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিমন্ত্রিত হয়েছে এখানে। সাংবাদিক, টেলিমিডিয়ার লোক ছুটে এসেছে অনুষ্ঠানস্থলে। ঢাকা শহরের সনামধন্য এক স্কুল মাঠের মাঝে বড় করে স্টেজ সাজানো এবং সামনে বিশাল প্যান্ডেল টানানো হয়েছে আগত অতিথীদের বসার জন্য। হোয়াইট, গোল্ডেন কাজের শেরওয়ানি, নাগরা, বরটুপি পড়ে বসে আছে সারিবদ্ধভাবে বরেরা। বর না বলে বরেরা কেন বললাম? একটু পরেই বুঝবেন। বিয়ের কনে সাজানোর ব্যবস্থা ভেতরের ক্লাসরুম গুলোতে করা হয়েছে। আজ শুক্রবার! বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যে যথার্থ একটা বার বলা হয় শুক্রবারকে। কিন্তু এই শুক্রবারও আবার কারো কারো জন্যে শনির দশা নিয়ে আসে। প্রণয়,পরিণয় মধুর শব্দ। তারচেয়েও মধুর সেই সময়কাল। তবে ইমার জন্য এই দু’টি শব্দই সর্বাধিক অপছন্দের। একধরনের তিক্ততা চলে আসে যখনই শব্দদুটি তার কর্ণকুহরে বাজে। অথচ আজ কেবল কর্ণে নয় সর্বাঙ্গই তার পরিণয়ের সাজে সজ্জিত।
নিতান্ত অনিচ্ছা আর অনীহা মনে বধূবেশে বিয়ের আসরে বসে আছে ইমা। এটা কোনো সাধারণ বিয়ের আসর নয়। গণবিয়ের আসর! আট জোড়া এতিম ছেলে মেয়েকে নিয়ে আয়োজিত হয়েছে এই গণবিয়ের আসর। আয়োজন করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী একজন বিত্তবান। বরদের প্রত্যেককে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন তিনি।
যথারীতি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আরম্ভ হলো। কনেদের এনে বসানো হয়েছে স্টেজে। লাল জামদানি, জরিওয়ালা ওড়নার অবগুন্ঠনে কনেগণকে বেশ লাগছে দেখতে। একে একে তিনজোড়ার বিয়ে পড়িয়ে কাজী উপস্থিত হলেন চতুর্থ জোড়ার বধূর নিকটে। ভয়ে আড়ষ্ট ইমা। বুকটা তার দুরুদুরু কাঁপছে। ঘোমটার কোনা দিয়ে বার বার চোখ পড়ছে অদূরে দাঁড়ানো পুলিশের উপর। পুরো পৃথিবীতে এই একটা পেশার জীবকেই তার ভয়। এতো ভয় ইমা বাঘ,সিংহ কিংবা ইংলিশ মুভির ঐ দানবীয় এনাকোন্ডা সামনে এলেও হয়তো পাবে না। এটা অবশ্য তার নিজস্ব ধারণা। বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারে। কাজী মোতালেব তরফদারের কথায় চমকে ওঠে ইমা, সাথে মনে জমে একরাশ বিরক্তি।
কাজী নিয়ম মতো সব বলে শেষে বলতে লাগলো,
” বলেন মা, কবুল! বলেন কবুল।”
ইমা দু’হাত কোচের মধ্যে নিয়ে মোচড়াচ্ছে আর মনে মনে প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলছে,
” আবে হালায় কয় কী? কবুল কমু ক্যালা? বিয়া কী আমার নাকি? আমি তো উইড়া আইয়া মাইনক্যা চিপাই পইড়ালছি। হে মাবুদ রক্ষা কর। উপকার করলে এমতে পুরুছকার দিবা জানলে করতামই না। আরে রে ইমা রাণী, আব তো ফাইছ্যা গেছস। জবর ফাছা ফাসছস।”
চারনাম্বার কনের কবুল বলতে বিলম্ব হওয়ায় উপস্থিত সবাই বিরক্ত হয়।
কাজী মোতালেব অবশ্য বিরক্ত হন না। তিনি বিয়ের আসরে এমনও মেয়ে পেয়েছেন, যে কিনা কবুল বলতে পাক্কা দুই ঘন্টা লাগিয়েছিল। ক-ক-ক বলেই অজ্ঞান, পরেবার দেখা গেল ক সাথে ব ও বললো কিন্তু আবার অজ্ঞান। ক, ব এবং এর সাথে উ-কা আর ল মিলিয়ে বলতেই দুইঘন্টা লেগেছিল। মেয়ের নিরবতা দেখে দুই পক্ষ ঘাবড়ালেও কাজী মোতালেব ঘাবড়ায় না। তার পেশায় এমন। ধৈর্য ধরে কবুল বলানো এবং শোনা। তিনি পবিত্র পেশায় আছেন। পবিত্র পেশায় তাড়াহুড়ো গুনাহের কাজ। কাজী মোতালেব নাকের ডগায় দন্ডায়মান চশমাকে উপেক্ষা করে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন,
” আম্মা বলেন কবুল?” এটাও কাজী মোতালেবের অভ্যাস মা থেকে ক্রমশ আম্মাতে চলে যান তিনি। আবেগটাও বাড়িয়ে বলেন। চারনম্বর কনের মতিগতি সুবিধার ঠেকছে না কাজীর নিকট। মেয়ের কী অমত আছে বিয়েতে? হতেও পারে। এধরনের কনের সাথেও তিনি পরিচিত। একবার এক বিয়ের আসরে ছেড়ে কনে দৌড়ে কোথায় যেন পালিয়ে গিয়েছিল। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা এমন করে পাঁচ ঘন্টা পেরিয়ে গেল তবুও কন্যা এলো না৷ মোতালেব একবার চেয়েছিল চলে যাবে কিন্তু যায় নি।ধৈর্য্য ধরে বসে ছিলেন পাঁচ ঘন্টা। মেয়ের আবা অবশ্য ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল মোতালেব নেয় নি। তার মন সায় দেয় নি মেয়ে পালানো পিতার কষ্ট বুঝে। মোতালেব অতীত স্মৃতিচারণে ক্ষান্ত দিয়ে চারনম্বর কনের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। চারনম্বর কনের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। অন্য সব কনের ঘোমটা এতোটাও নামানো না কিন্তু এর টা হাঁটু পর্যন্ত নামানো। সম্ভবত পরহেজগার টাইপ কন্যা সে। মোতালেব মৃদু হাসল। মঞ্চের অদূরে বসা মঈন খানের দিকে একনজর তাকায় সে। বেশ বিরক্ত তার চোখে মুখে।
বিয়ের আয়োজক অর্থাৎ ধনকুবের মঈন খান বিয়ের কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিচ্ছেন। মঈন খান এলাকার তথা ঢাকা শহরের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। একসময় ছিলেন সন্ত্রাস এখন সন্ত্রাসের গডফাদার। দিনে দুপুরে লোকসম্মুখে মানুষ খুন করলেও নাকি তার বিরুদ্ধে কেস হয় না। সাক্ষী দেওয়ারই সাহস কারো থাকে না, কেস কী করে হবে? মঈন খানের ডান হাত তার মেঝ ছেলে শান নিহান খান। ছেলে বলতে ঔরসজাত নয়, পালক পুত্র। চারনম্বর জোড়ার বরটাই মঈন খানের পালক পুত্র শান নিহান খান। জনহিতকর অনেক কাজের সাথেই মঈন জড়িত থাকেন। পাপ মোচনের পন্থা ভাবেন আরকি! আগামী কালের পেপারে ফন্ট সাইজে ছাপা হবে তার ছবি এবং এই গণবিয়ের আয়োজনের কথা। আশেপাশে সাংবাদিক টুক টুক করে ছবি তুলছে। টেলি মিডিয়াতেও দেখানো হবে তার জনকল্যানকর কাজের চিত্র। অন্য সব বারের চেয়ে এবারের কাজটাই সুনাম তার বেশিই ছড়িয়েছে। এজন্যই স্ত্রীর বুদ্ধি মহা বুদ্ধি তবে সর্বক্ষণ নয়। মঈন খানের স্ত্রী শায়লা বুদ্ধিটা দিয়েছিল বলেই না আজ পত্রিকায় টিভিতে তার সুনাম। নয়তো দুর্নাম তার বেশিই ছড়ায়। সুনামে বুক টান করলেও মনটা তার খারাপ হয়ে যায় শানের কথা ভেবে। এতিম বলে ছেলেটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য তিনি কোনোদিন করেন নি৷ নিজের দুই সন্তান অধিক মহব্বত, আদর করেন শানকে তিনি। ব্যবসা, গোপন সকল কাজ,খুন,খারাবি সবকিছুর ভার শানের উপর ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তদারকি তিনি করলেও শান তার ডান হাত। ডান হাত বিনা কোনো কাজ কী ঠিকঠাক হয়? আজকাল তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন। শরীরে আগের মতো বল পাননা। সকল দায় দায়িত্ব অঘোষিতভাবে শানই দেখছে তাই। নিজের চাইতেও বেশি ভরসা শানের উপর তার। স্ত্রীর কথার মোহে পড়ে কাজটা তার কী অনুচিতই হলো? অদূরে বরের সারিতে, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত শানের গম্ভীর মুখখানি দেখে বেজায় খারাপ লাগলো তার। এই মুহূর্তে বিয়েটা ক্যান্সেল করতে পারলে বুঝি শান্তি পেতেন।
বরের সারিতে অমনোযোগী হয়ে বসে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছে শান। প্রচন্ডরকম অস্বস্তিতে ভুগছে সে এই মুহূর্তে।
” ভাইসাহেব কী বিবাহ করিতে আসছেন? আমার নাম নওশাদ শিকদার। আমিও কিন্তু বিবাহ করিতে আসিয়াছি।”
পাশে বসা পাঁচ নম্বর বর অর্থাৎ নওশাদ একগাল হেঁসে প্রশ্ন করলো। শান চোয়াল শক্ত করে রুক্ষ হাসি হাসে। নওশাদ আরও প্রসস্থ হাসি ঠোঁটে টেনে বললো,
” ভাই সাহেব কী বোবা? তা জন্ম বোবা না কোনো এক্সিডেন্টের কারনে?”
শান মোবাইল অফ করে ঘুরে বসল নওশাদের দিকে।নওশাদকে এক লহমায় দেখে নিল। প্রচন্ড রকম বিরক্ত এবং মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার এই লোকটার কথার পীড়নে। শান নিরস হাসি হেঁসে কনের সারির দিকে তাকিয়ে বললো,
” আপনার হবু স্ত্রী কোনজন?”
” ঐ যে আপনার জনের পাশের জন৷ বড় করে ঘোমটা দিয়ে আছে যে’জন সে তো আপনার স্ত্রী। আর তার পাশে বসা একটু স্বাস্থ্যবতী যিনি, তিনিই আমার,,,! ” নওশাদ লজ্জা রাঙা হয়ে মুখ টিপে হাসে। এক ফাঁকে অদূরে বসা হবু স্ত্রীর সাথে শুভদৃষ্টিও সেরে নেয়। সেদিকে তাকিয়ে ফের হেঁসে হেঁসে বলে,
” আসলে সে যে স্বাস্থ্যবতী তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। বিয়ের সময় আমাকে বলায় হয়েছিল তার ওজন সত্তর কেজি। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে মন খারাপ করত কিন্তু আমি করি নাই। কেন করি নাই বলি? স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের প্রতি আমার প্রথম থেকে দূর্বলতা আছে। একটা নাদুসনুদুস বউ পাব, সেই শখ আমার বহু আগে থেকেই বুঝলেন ভাইসাহেব৷ একটা মজার কথা বলি শুনুন! স্বাস্থ্যবতী বউ থাকার উপকারীতে কিন্তু অনেক। তন্মধ্যে একটা হলো বিছানায় বালিশের প্রয়োজন হবে না।” কথাটা বলেই ফিক করে হেঁসে উঠল নওশাদ। শান হাত মুঠ করে বসে আছে। দাঁত কামড়ে হাসল সে। বললো,
” আপনার স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীর জন্যে কিন্তু খারাপ লাগছে আমার।”
” কেন?” ভ্রুকুটি করে তাকায় নওশাদ।
” বেচারী বিয়ের আসরেই বিধবা হবে। ইশশ!” কঠিন স্বরে বলে অনিচ্ছাপূর্বক হাসে শান।
” আস্তাগফিরুল্লাহ! এটা কী বললেন ভাই সাহেব?” মুখটা বিবর্ন হয়ে গেল নওশাদের।
” আর একটা কথা যদি বলেছিস? আই সয়্যার এখানেই গুলি করে মেরে ফেলব তোকে। একদম চুপ করে বসে থাকবি। একদম চুপ।” শান চাপা ধমক দিতেই নওয়াদ ভয়ে চুপ হয়ে যায়। অবনত মুখে বসে আছে ভয়ে ভয়ে। তার ইচ্ছা করছে এই ভয়ানক লোকটির কাছ থেকে উঠে যেতে। কিন্তু পারছে না।
এতিম হওয়ার আক্ষেপ শানের ভেতর সবসময়ই ছিল। আজ যেন ফুলে ফেঁপে উঠছে তা। বড় বাবা তাকে পুত্রবৎ ভেবেও এমন আবদার করলো বলে মনে মনে কষ্ট পেয়েছিল সে। পরে নিজের জায়গা বুঝে সামলে নিল নিজেকে। অন্য এতিম ছেলেদের মতো তো তাকে অন্নের জন্য পথে পথে ঘুরতে হচ্ছে না; ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়ে মাথা ঠুকতে হচ্ছে না এই বা কম কিসের? এতিম হয়েও পরিবার তুল্য পরিবার পেয়েছে। ভালোবাসা পেয়েছে তাই বা ক’জন পায়। জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে বিধাতার লিখন। তার জন্ম যেখানে এতিম রুপে হয়েছে বিয়ে তবে অন্য ভাবে কী করে হয়? এটাই স্বাভাবিক! শান নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করলো। হবু স্ত্রীর প্রতি সকল দায় দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গিকার করে অবশেষে কবুল বললো শান। মনটা তার এখন আর তেমন খারাপ লাগছে না। যা হয়েছে এই বেশ! বিপত্তি ঘটলো একটু পরেই৷ ছবি তোলার জন্য বর কনে সবাইকে স্টেজের সামনে ডাকা হয়েছে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো সব। সবার কনেই এসে দাঁড়িয়েছে বাদ শুধু শানের কনে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন কনে এলো না, খোঁজাখুঁজি লেগে গেল সর্বত্র।
শান বিব্রতবোধ করছে প্রচন্ডভাবে। মনে মনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কনের প্রত্যাশায়। একমাত্র তার নববধূর আগমনেই এই লজ্জার পরিসমাপ্তি ঘটবে। ভীষনরকম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে সে পড়েছে এই মুহূর্তে। আশেপাশের সবার নজর তার উপর। শূলের ন্যায় বিঁধছে প্রতিটি নজরের চাহনী। উপহাস কেবল উপহাস ঐ চাহনীগুলোতে।
গণবিয়ের আসরে হুলস্থূল লেগে গেল কনে পালানোর খবরে৷ তারচেয়েও বেশি যেটা চাউর হলো তা হচ্ছে খান বাড়ির নববধূ বিয়ের আসরে লাপাত্তা। প্রথমটা মেনে নিলেও শেষেরটা শানের ভেতরের সুপ্ত রাগটাকে জাগিয়ে তুললো। রাগে মুখ, চোয়াল কঠিন হয়ে গেছে তার। স্টেজ থেকে নেমে এসে হন্যে হয়ে খুঁজছে নববধূকে শান। কোথাও সে নেই। রাগে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মঈন খান অবস্থা বেগতিক বুঝে দ্রুত ছেলেকে জোর করে গাড়িতে এনে বসায়। ম্যানেজার এবং বডিগার্ডদের এদিকটা দেখতে বলে ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন মঈন খান। রাগে মুখ চোখ রক্তিম শান নিহান খানের। রিভলভারের সবগুলো গুলি বের করে ফেলে রেখেছে একপাশে। গুলি শূন্য রিভলভারের ট্রিগার চাপছে বারংবার শান। সামনে স্থির চোখে ধনুকের ন্যায় বাঁকা হয়ে বসে আছে গাড়ির ব্যাক সিটে। কপালের রগ দপদপ করছে এই মুহূর্তে শানের। মঈন খানের অনুতাপের শেষ রইল না এসব দেখে।
“কী রে কই তুই?” ইমা বিয়ের আসর ছেড়ে দু’তিন বিল্ডিং পরের একটা পুরোনো বিল্ডিংএ লুকিয়ে আছে। বান্ধবী নুসরাতকে কল করে আসতে বলেছে ইতোমধ্যে। নুসরাতের দেরি হওয়াতেই আরেকবার কল করে ঝাড়ি দিল ইমা। বহু ঝক্কি ঝামেলা এড়িয়ে নুসরাত এসে পৌঁছায় সেখানে। ইমাকে বধূর সাজে দেখে চক্ষু চড়কগাছ ওর। হাঁ করে তাকিয়ে ইমার আপাদমস্তক দেখে বললো,
” সত্যি কী বিয়ে করে ফেলেছিস তুই?”
” আবে সেমরি আমি ইচ্ছা করে করছি নাকি? মাইনক্যা চিপায় হান্দায়া গেছিলাম।” ইমার মুখটায় রাগের আভাস।
নুসরাত ভ্রু তুলে বললো,
” মানে?”
ইমা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
” অনিক্যারে তো চিনস? আমাদের পাশের বিল্ডিংএর সভাপতির পোলা। পাক্কা বদ! আমার মামাত বোন ইরারে লাভ লেটার দিছে। ভাবতে পারোস কত্ত বড় কইলজ্জা হালার! ঐটারে দৌড়ানি দিয়া এই পর্যন্ত আইছিলাম। ঐ যে স্কুল দেখতাছোস! ঐ খানে গণবিয়া হইতাছিল। অনিক্যারে দাবড়ানি দিয়া খুঁজতে গিয়া দেখি এক মাইয়্যা গলায় ফাঁস নেয়।”
” তারপর?” নুসরাত বিস্মিত হয়ে বলে
ইমা বললো,
” তারপর আমিই টাইনা টুইনা নামাইলাম। জিগাইলাম সমস্যা টা কী? মাইয়্যা কী কইল জানোস?”
” কী?” নুসরাত প্রশ্ন করে।
ইমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“ওর নাম কুলসুম। ও এতিম! বাপ মা নাই। এতিম খানায় বড় হইছে। ঐ এতিম খানায় এক পোলা খাবার সাপ্লাই দিত। তার লগে প্রেম ছিল কুলসুমের। বেচারীর সরলতার সুযোগ নিয়া পোলায় ওরে ব্যবহার করছে। কুলসুম এখন তিনমাসের গর্ভবতী। গর্ভবতী হইয়্যা কেমনে বিয়ে করব আরেকজনরে? তাই মরতে গেছিল।”
” আল্লাহ কী কষ্ট মেয়েটার!”
” হুমম রে! আমি ওরে নাসরিন আপার ঠিকানায় যাইতে কইছি। কিন্তু সমস্যা হলো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যাইব কেমনে? শেষে আমার বোরখা ওরে পড়াইয়া পাঠাই দেই। আমার সমস্যাও ঐখান থেইকা শুরু। ততোক্ষণে পার্লারের মাইয়্যাগুলা আমারে ঐ ঘরে দেখে জোর করে বউ সাজাইয়া দিল। আমি কিছু কমু তহনই দেখি মহিলা পুলিশ আইসা খাড়ান সেখানে। তুই তো জানোস পুলিশ দেখলে কী হয় আমার?” ইমার মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। নুসরাত ইমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
” এখন কী করবি? ”
” কী করমু মানে কী? একমাত্র তুই আর আমিই জানি এটা। ওখানকার কেউ ভালোমতো দেখে নি আমাকে। ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখছিলাম।”
” পার্লারের মেয়েগুলো তো দেখছে।”
” ওরা ওতো মনে রাখছে নাকি চেহারা। আর দেখোস না মোটামুটি সাজছি আমি। তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি কেউ আমারে। সুতরাং আমি বিবাহিত এটা কেউ জানে না। আর কোনোদিন জানবেও না। ওয়াদা কর!”
ইমা হাত বাড়িয়ে দেয় নুসরাতের দিকে। নুসরাত চিন্তিত হয়ে পড়ে। ইমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
” বিষয়টা কী ঠিক হচ্ছে? একবার ছেলেটার কথা ভেবে দেখ।বিয়ের আসর ছেড়ে বউ পালালে বেচারার মানসম্মান কী থাকবে?”
” আরে সেমরি হুদাই প্যাঁচাল পারিস না তো? কোটিপতির পোলা নাকি যে মানসম্মান যাইব গা জানাজানি হইলে। মেয়েগুলাও যেমন এতিম বরগুলাও তেমন। দুইদিন খারাপ লাগব তারপর আবার আরেকটা বিয়া কইরা সব ভুইলা যাইবগা। চিল মার!”
” আর তোর কী হবে?”
” আমার কী হবে মানে? আমি তো বিন্দাস পাব্লিক! এসব কিছু ইমা কেয়ার করে না।” ইমা মাথার ওড়না খুলতে খুলতে বলে।
” প্রথম স্বামীকে তালাক না দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে কী জায়েজ?” নুসরাত শুধায়
” দ্বিতীয় বিয়ে কেডা করতাছে? আমি তো কোনোদিনই বিয়া করমু না। আর কী স্বামী! স্বামী লাগাইছোস তুই? আরেকবার যদি এসব কইছোস চোপার মধ্যে দিমু কইলাম। একটু আগে কী ঘটছে আমিও ভুলে গেছি তুইও ভুলে যাবি৷ ওকে?” ইমা বেশ গম্ভীরমুখে বলে। নুসরাতের হাতটা নিজের হাতে উপর চেপে ধরে বলে,
” ওয়াদা কর।”
” ইমা! আরেকবার ভাব বোন।” নুসরাত অনুরোধের সুরে বলে। ইমা উতপ্ত কন্ঠে বলে,
” তোরে ওয়াদা করতে বলছি আমি।”
নুসরাত বুঝল বরাবরের মতো ইমাকে বোঝানো তার পক্ষে অসম্ভব। বান্ধবীকে বোঝাতে ব্যর্থ নুসরাত মুখ কালো করে বললো,
” ওয়াদা!”
ইমা জাপটে ধরে নুসরাতের গালে চুমু দিয়ে হেঁসে বলে,
” এই জন্যেই তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আশা করব এমনি থাকবি চিরকাল। এই সিক্রেট ভাঙবি তো তোর সাথে বন্ধুত্ব শেষ আর শত্রুতা শুরু। আমার শত্রুতা কতো খারাপ জানিস তো?”
নুসরাত ঘাবড়ে যায় ইমার চোখ রাঙানো দেখে। মৃদু হাসে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে ইমা। নুসরাতকেও নিরুপায় হয়ে হাসতে হয়। সে ইমাকে চেনে। খুব বেশি ভালো করেই চেনে। তাতেই তার ভয় হয়। ইমা বিয়ের ওড়না মজা করে নুসরাতকে পড়িয়ে নিজে বোরখা পড়ে নেয়। বিয়ের আসরে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসাটা সহজ ছিল না। পুলিশের চোখের সম্মুখ থেকে সরতেই চুপিচুপি পালিয়ে এসেছিল এখানে। ইমা একদন্ড সময় নষ্ট না করে নুসরাতকে নিয়ে দ্রুত এই এলাকা ছাড়ে। নিজ এলাকায় আসতেই বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। স্বাধীন!হ্যাঁ সে স্বাধীন! তার এই স্বাধীন জীবনে কোনো পুরুষের কতৃত্ব বরদাস্ত করবে না সে। মুক্ত বিহঙ্গী রবে আজীবন। বিয়ে, স্বামী-সংসার এসব প্যারার মধ্যে সে নেই।
#তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব-০১
Writer Taniya Sheikh- Tanishq
চলবে,,,