তুমি অতঃপর তুমিই পর্ব ২

তুমি অতঃপর তুমিই
পর্ব -০২
Writer Taniya Sheikh

ক্রমশ অতি নিকটে এগিয়ে এলো মানুষটা, এতো নিকটে যে তিলমাত্র স্থান দু’জনের মধ্যে বাকি রইল না। ইমা চোখ বন্ধ করে আছে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বাড়ছে ওর। ভয় এবং সংকোচে মিলে কী এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হচ্ছে ইমার জানা নেই। সে বিছানার চাদর খামচে বন্ধ চোখে বসে আছে। অনুভব করছে মুখের উপর পুরুষালি উষ্ণ নিঃশ্বাস। বড় করে ঢোক গিললো ইমা। ভয়ে, লজ্জায় আড়ষ্ট এই বুঝি তাকে বাহুবন্ধনে পিষ্ট হতে হয়! সেকেন্ড শেষে মিনিট হলো তবুও তেমন কিছু হয়নি ভেবে কৌতূহল বশতঃ চোখ মিললো সে। ঠিক তখনই মানুষটার ওষ্ঠ দ্বারা দংশিত হলো তার সমস্ত মুখশ্রী এবং পরিশেষে থামল দু’ঠোঁটে।

” ইমাপু! এই ইমাপু! কী হয়েছে? এই আপু?”

ইমা মামাতো বোন ইরার ধাক্কাধাক্কিতে চোখ মেললেও নির্বাক চেয়ে রইল। ঘোর তার এখনও কাটেনি। ইরা ভ্রুকুটি করে ফের বললো,

” বলনা? এই আপু?”

” যাহ!” ইমা ইরাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়৷ ইরা ইমার ধাক্কা ধাক্কিতে অভ্যস্ত। এই একটা মানুষের কাছেই সে উঠতে বসতে মার খায়। কারণে কখনো বা বিনাকারনেই। এ’বাড়ির যারা ইমার ছোট তারা ইমার মারকে নিত্যদিনের ডাল ভাত মনে করে বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করে। প্রতিবাদ করার সাহস কিংবা ইচ্ছা কারোরই অবশ্য এ ব্যাপারে নেই। সুতরাং সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে পাশে দাঁড়িয়ে ইরা।

ইমা কোলবালিশের কোনায় মুখ লুকিয়ে ভাবছে। কী দেখল সে? ছিঃইশশ! ভ্যা! ভ্যা! ছ্যা!ছ্যা! ইমা কোলবালিশের সাথে মাথা বারি দিয়ে লজ্জায় নাক,কান লাল করে ফেলেছে। কৈশোরে এসব স্বপ্ন প্রায় সব তরুনীরাই কমবেশি দেখে। যৌনতা নিয়ে সবেমাত্র তাদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ এই সম্বন্ধে তাই আগ্রহটাও প্রবল থাকে। ইমা এখন আর কৈশোরের কোনো বালিকা নয়। এই বসন্ত গেলেই তার জীবন থেকে চলে যাবে বাইশটা বসন্ত। এসব রোমান্টিসিজমে তার ঘোর এলার্জি তবুও কেন এসব দেখল সে? ছিঃ চোখ খিচে বন্ধ করে জোরে শ্বাস ছাড়তেই মনে পড়ল গতকালের কথা। মুহূর্তে ইমার মনের আনাচে কানাচে তোলপাড় শুরু হলো। শিরায় শিরায় বহমান রোমাঞ্চ! বড়োসড়ো ঢোক গিলে একবার ভাবতে চাইল বরটা দেখতে কেমন ছিল? সে কী দেখেছিল তার বরকে? বর! ইমা পারলে এক্ষুণি নিজের গলা নিজে টিপে ধরে। কিসব ভাবছে সে? ওহ আল্লাহ! এই কী নসিবে ছিল? ইমা মনে মনে ফুসতে থাকে কোলবালিশ হাতে পায়ে আঁকড়ে। পণ করেছিল জীবনে বিয়ে তো দূরের কথা প্রেম পর্যন্ত করবে না। অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল তার জীবনে! আচ্ছা কোনোভাবে যদি ওরা চিনে ফেলে ইমাকে?

” আরে রে! মাথা পুরাই নষ্ট হয়ে গেল আমার।” ইমা তড়াক করে বিছানার উপর উঠে বসে। দু’হাতে জোর দিয়ে কপালের পাশটা চেপে ধরেছে। ইরা ভ্রু কুঁচকে তখন থেকে দেখে যাচ্ছে ইমার অদ্ভুত আচরণ। যদিও এমনই ইমা! তার কোনো কথা বা কাজের সচারচর দিক পশ্চিম থাকে না। মুখে,মনে যা আসে বলে দেয়। ইরা পরিস্থিতি প্রতিকূল ভেবে রুম ছেড়ে সতর্কতার সাথে বেরিয়ে আসে। ইরা রুম ছেড়ে বেরোতেই বাড়ির পিচ্চি বাহিনী তাকে ঘিরে ধরে। সমস্বরে বলে,

” আপু বলেছিস? ইমাপু কী রাজি হয়েছে? এই আপু বল?”

” আরে চুপ যা খরগোশের দল। কিছুই বলতে পারিনি আমি।” ইরা গম্ভীর মুখে করিডোরের রেলিং হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আজ ইরাকে দেখতে আসার কথা। ছেলে স্থানীয় তবে স্বভাবে গুণ্ডা। ইরা এ বিয়ে কিছুতেই করবে না বলে ভেবেছে। তার ভাবনার দাম বাবা মা কেউ না দিলেও ইমা দেবে। সে আশায় সকলে মিলে এসেছিল সকাল সকাল ইমার ঘরে। ইমার মন খারাপ হলে কেউ ধারেকাছে ঘেঁষে না খুব একটা। তখন বেশ চটে থাকে মেজাজ ইমার। ইমার অখ্যাত খরগোশ দলের অন্যতম সদস্য সাজ্জাদ বরকত। সব কর্মে ইমার ডান হস্ত রূপে তাকে ভাবা হয়। এ নিয়ে সাজ্জাদের গর্বের শেষ নেই। সবাই যখন চিন্তিত তখন সে নবাবী চলনে ঢংএ বলতে লাগলো,

” ইমাপুর মনের আকাশে আজ ফের দুর্যোগের ঘনঘটা। কে আমাদের আশা দেবে? কে আমাদের ভরসা দেবএএএ,,!” সাজ্জাদের মাথায় আচমকা চড় পড়তেই ঘুরে তাকায় সে। ব্রাশ মুখে, এলোমেলো চুলে, ব্লাক কালার টিশার্ট আর টাওজার পড়ে চোখ ছোট করে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ইমা। সাজ্জাদ এদিক ওদিক সবার দিকে তাকাতেই দেখে সবাই মৃদু হাসছে। এ হাসির স্পষ্ট অর্থ দাঁড়ায় আজ তু তো গায়া বজ্জাত! সাজ্জাদ মনে মনে কল্পনা করল, সে যদি সত্যিই খরগোশ হতো? তবে এক ছুটে পালিয়ে যেত এই সিংহীর সম্মুখ থেকে। সাজ্জাদ মুখটা করুন করে দু’কদম সরতে চাইলে ইমা ওর শার্টের কলার টেনে আরও সামনে নিয়ে আসে। ব্রাশ নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,

” কী রে বজ্জাত! আমাকে নিয়ে মজা করছিলি? গোপাল ভাঁড়, চার্লি চ্যাপলিন ভাবছোস আমারে?”

সাজ্জাদ কাঁদো কাঁদো চোখে ঘাড় নাড়ায়। ইমা ধমক দিয়ে বলে,
” মুখে বল!”

” না!” চমকে মিনমিন করে বলে সাজ্জাদ

ইমা বলে,
” তাইলে করতাছিলি কী এতোক্ষন?”

সাজ্জাদ ভেবে কূল পায় না কী বলবে? সবার দিকে চেয়ে সাহায্যের কামনা করে,কিন্তু কার সাধ্য ইমার সামনে মুখ খোলে। চারজন চুপ করে তাকিয়ে আছে ভীতু চোখে। ইমা সাজ্জাদের গাল ঠেসে ধরতেই সাজ্জাদ অস্ফুটে বলে,

” বলছি! বলছি!”

” বল!”

” নবাব সিরাজউদ্দউলা ছিলেন বাংলার নবাব। স্বাধীন নবাব! তুমিও তো তেমনি আমাদের জন্যে। তিনি বাংলার নবাব ছিলেন। আর তুমি আমাদের খরগোশ বাহিনীর নবাব। তাই কথাটা বলেছিলাম।” সাজ্জাদ ভয়ে ভয়ে বোকার মতো হাসে। ইমা দাঁতের উপর ব্রাশ ঘষে ভাবুক হয় কিছুক্ষণ। তারপর থু করে থুথু ফেলে রেগে বলে,

” আমি তোদের স্বাধীন নবাব হুমম? তাহলে তোরা কী? তুই হচ্ছিস মীর জাফর? আনাস মীরণ আর তুই ইরা? তুই কী?”

” আমি কিছু না! আমি কিছুই না।” ইরা দু’হাত নাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলে।

” তুই ঘষেটি বেগম? ইয়া আল্লাহ! এই দিন দেখার জন্য এগুলোরে মেরে মেরে বড় করছি আমি? এই ছিল তোদের মনে?” ইমা নেকিসুরে বলতেই সবাই সমস্বরে বলে ওঠে,

” তুমি ভুল ভাবছ ইমাপি। আমরা এমন না।”

” সত্যি বলছিস?” এক চোখ ছোট করে বলে ইমা।

” হ্যাঁ! ” একসাথে জবাব দেয় সবাই।

” আমাকে ছুঁয়ে বল?”

সকলে এগিয়ে এসে ইমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ছুঁয়ে বলে। ইমা হেঁসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ভাইবোন গুলোকে। সবার মনে স্বস্তি ফেরে ইমার মুখের হাসি দেখে।

” সাজ্জাদ! এই সাজ্জাদ! ” সাজ্জাদের মা সাবিলা উঁচু গলায় ছেলেকে ডাকতে ডাকতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলেন। এসে দেখলেন তার ছেলে ইমাকে জড়িয়ে ধরে বোকার মতো হাসছে।রাগে শরীর জ্বলে উঠল সাবিলার। ঝাঁঝিয়ে বললো,

” এই তুই এখানে কী করছিস? কয়টা বাজে এখন? স্কুল নাই তোর? আসুক তোর বাপ আজ। মূর্খ গুলার সাথে থেকে থেকে মূর্খ হতে চাওয়ার ইচ্ছা আজ ছুটিয়ে দেব।”

” কী হয়েছে মামি?” নম্রতার সাথে প্রশ্ন করে ইমা। সাবিলা মুখ বাকিয়ে বলে,

” তোকে কেন বলব কী হয়েছে? কে তুই হ্যাঁ?”

মায়ের তিক্ত কথার স্বর সাজ্জাদের পছন্দ হয় না। চেঁচিয়ে ওঠে,

” মা তুমি ইমাপু কে কিছু বলবা না বলে দিলাম।”

” আমাকে চোখ দেখাস? হারামজাদা আজ তো তোকে মেরেই ফেলব। এই অশিক্ষিত, গোঁয়ারদের সাথে থেকে থেকে এই তো শিখবি।” সাবিলা ছুটে এসে ছেলের চুল মুঠ করে হেঁচকা টান দিতে গেলেই ইমা সাবিলার হাত ধরে।বলে,

” সাজ্জাদের চুল ছাড়েন মামি।” ইমার কঠিন গলার স্বরের তোয়াক্কা সাবিলা করে না।

” ছাড়ব না। আমার পোলা, আমার যা মন চাই তাই করুম। তুই বলার কে? মা,মেয়ে মিলে গলা পারা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস এই বাড়ি। যাস না কেন তোরা?”

” মামি ছাড়েন ওর চুল।” ইমা চিৎকার করে ওঠে।

সাবিলা ইমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ছেলের গালে শব্দ করে চড় বসিয়ে দেন। ইমা নিজের রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বশে। মামিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সাবিলা থতমত খেয়ে গেলেও চেঁচিয়ে সেটাকে লুকিয়ে ফেলে।

” তুই আমার গায়ে হাত দিলি?”

” গায়ে হাত দেওয়া মানে কী বুঝান? মেরেছি আপনাকে?”

” তো কী করলি? আজ আসুক তোর মামু। কাল সাপ পুষতাছে বাড়িতে। আসুক আজ।”

” কাল সাপটা কে মামু ভালো করেই জানে। যান এখান থেকে। ছেলে শাসন করবেন কিচ্ছু বলব না। তবে শাসনের নামে শোষন করতে আসলে ইমা আপনাদের ছেড়ে দেবে না। যান, নিচে যান।”

” ওরে পাওয়ার রে! আমিও দেখুম তোর এই পাওয়ার কতোদিন থাকে। তোর জীবন আগুনের মতো জ্বলব। জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবি একদিন৷ পাওয়ার দেহাস হ্যা! এই পাওয়ার সেদিন আর থাকব না৷ পথে পথে ঘুরবি। এই কয়ে রাখলাম আমি।” সাবিলা রেগে ধুপধাপ শব্দ করে নিচে নেমে যায়। ইমা সাজ্জাদের মাথার চুল ঠিক করে মৃদু হাসে। সাজ্জাদ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে,

” তুমি কষ্ট পেয়ো না ইমাপু। আল্লাহ এমন করবে না। আমি দোয়া করব। মা খালি অভিশাপ দেয় তোমারে। আমার মা এমন কেন করে?”

” বোকার মতো কথা বলিস কেন তুই? মামি হয় না তোর মা? মামি মায়ের মতো। এই ঝগড়া হবে আবার এই মিলে যাব দেখিস৷ কান্না থামা। পুরুষ ছেলেদের কাঁদতে নেই।”

সাজ্জাদ তবুও চোখ ডলে ডলে কাঁদছে। ইমা লক্ষ্য করল সাজ্জাদের গালে মামির পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে। কী নির্দয় মা! কেবল মাত্র ইমার এবং ইমার মায়ের সাথে হিংসায় জ্বলে পুড়ে এমন আচরণ করে ছেলে মেয়ে দু’টোর সাথে। ইমার মনটা ভারি হয়ে ওঠে বিষন্নতায়। চুপচাপ ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। ইমার মামিরা ইমাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। মামারাও না। তবে প্রকাশ্যে সেটা বুঝায় না দুই মামা। স্বামী এবং একমাত্র ছেলের আচানক মৃত্যুতে পথে বসেছিল মেয়েকে নিয়ে ইমার মা বিভা চৌধুরী। ইমারা বড় খালামনি বীণার বাসায় ছিল বছর খানেক। বোনের কথা ভেবে ভাইদের কাছে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ চায় ইমার বড় খালা। এতেই যেন এতোদিনের মধুর সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। প্রথমে গড়িমসি করলেও বীণার হুমকি ধামকিতে সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করতে বাধ্য হয়। সেই থেকেই ইমা, ইমার মা এই বাড়িতে আছে। প্রথম প্রথম মামা-মামিদের বৈরী ব্যবহার মেনে নিলেও একসময় প্রতিবাদ শুরু করে ইমা। ব্যস তারপর থেকেই দা-কুমড়ো সম্পর্ক মামিদের সাথে ইমার। ইমার মা বিভা মেয়ের এমন স্বভাব পছন্দ করেন না। বড়োই সহজ সরল তিনি। ভাই ভাবির সকল অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করার ক্ষমতা তার অসীম। মেয়ে কেন এমন হলো না এই তার কষ্ট! ইমা জানে একটু পর তার ঘরের দরজায় টোকা পড়বে। ঠিক তাই হলো। বিভা মেয়ের ঘরে টোকা দিলেও ইমা প্রথমে খুললো না। রাগে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ইচ্ছা করে দেরিতে বেরোল ওয়াশরুম থেকে। ইমার মা এখনও দরজা টুকিয়ে যাচ্ছে। ইমা সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে রেডি হল বাইরে বেরোনোর জন্য। দরজা খুলতেই বিভা বিমর্ষ মুখে বললো,

” এমন কেন করিস তুই? কখন থেকে দরজা টুকাচ্ছি।”

” ভালো করছ। কাজ কাম না থাকলে আর কী করবা? সরো এখন সামনে থেকে।” ইমা বিরক্ত মুখে কুর্তির হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো

বিভা রাগত স্বরে বললো,
” না সরবো না। আগে বল ছোট ভাবির সাথে ওমন ব্যবহার কেন করেছিস?”

” মজা লাগছে তাই করছি।”

বিভা রাগে মুখ শক্ত করে মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দেয়। ইমা চোয়াল ফুলিয়ে মা’কে এড়িয়ে সামনে এগোতে লাগল। বিভা পেছন থেকে ডাকল,

” ইমা শোন! মা আমার শোন! এই ইমা!”

ইমা দাঁড়ায় না। গটগট করে হেঁটে নিচে নেমে গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। দোতলার করিডোরে দাড়িয়ে বিভা কান্না মিশ্রিত স্বরে মেয়েকে গলা উঁচু করে ডাকে।

” ইমা না খেয়ে যাবি না বলে দিচ্ছি? এই ইমা ফিরে আয় বলছি।”

মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে গলির সোজা পথে হাঁটতে লাগল ইমা। বিভার চেঁচানোতে আশেপাশে সবাই মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রয়। ইমা পেছন ফিরে তাকায় না আর। একবারে এসে থামে গলির শেষ মাথায় মেইনরাস্তার ধারে। জিন্সের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করে নুসরাতকে কল দেয়। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় নুসরাতের বাসার দিকে। মনটাকে ভালো করার এই একটা উপায় ইমার।

খান প্যালেসে মঈন খান ছাড়া কারো ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই শানকে নিয়ে। গতকাল থেকে সে না খেয়ে আছে। এমনকি রুম থেকেও বের হয়নি। পুত্র চিন্তায় উদ্বিগ্ন মঈন মোবাইল করে বাসায় এনেছেন ইমরোজকে। ইমরোজ শানের বন্ধু। মঈন খান ব্যক্তিগতভাবে ইমরোজকে পছন্দ করেন না। এর অন্যতম কারন ইমরোজের পেশা। পুলিশের এসপি সে। ইমরোজ চায় না শান মঈন খানের হয়ে এসব অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকুক। অনেক চেষ্টা করে শানকে এসব থেকে দূরে রাখতে, আর সেটাই অপছন্দ মঈন খানের। তথাপি আজ শানের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে বাধ্য হয়ে ডাকতে হলো। নিচতলার ডান দিকের শেষরুমটি শানের। ইমরোজ এ বাড়ি প্রায় আসা যাওয়া করে। শানের বন্ধু জেনে কারো কিছুই বলার সাহস নেই ইমরোজকে। বেশ কয়েকবার দরজা নক করার পর দরজা খোলে শান। বিধ্বস্ত চেহারা তার৷ অতিরিক্ত নেশা করায় ঢুলছে সে। ঢুলুঢুলু চোখের পাতা তুলতেই দেখা গেল রক্তিম চোখ দু’টো। শান ঢুলতে ঢুলতে এসে উপুড় হয়ে বিছানার উপর শুয়ে পড়ল। রুমের সবকটা জানালার উপর পর্দা টানানো থাকায় অন্ধকার আর ভ্যাঁপসা গন্ধ নাকে লাগছে। ইমরোজ নাকে হাত দিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে কপাট সরিয়ে দেয়। হু হু করে বাতাস ঘরে ঢোকে। এলোমেলো হয়ে আছে ঘরটা। ফ্লোরে পড়া কয়েকটা ব্রান্ডির খালি বোতল আর অ্যাশট্রে ভরে আছে সিগারেটের উচ্ছিষ্টে। ইমরোজ ম্রিয়মান হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এগিয়ে গিয়ে বসল শানের শিওরে। মৃদু স্বরে ডাকল,

” শান, শান শুনছিস?”

” হুম বল।” অস্পষ্ট শব্দে জবাব দিল শান।

” কী হয়েছে?”

” অনেক কিছু আবার কিছুই না।”

ইমরোজ বললো,
” ওঠ তুই। গোসল শেষে আমার সাথে চল।”

” কোথায়?” বালিশে মুখ গুঁজেই বললো শান।

” ভাবিকে খুঁজতে। ” ইমরোজ বলল।

শান ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মেলে তাকাল ইমরোজের দিকে। বড়ো বিষন্ন সেই চাহনী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,

” প্রয়োজন নেই। যে ইচ্ছা করে চলে গেছে তাকে খোঁজার প্রয়োজন শানের নেই।”

” এসব কী বলছিস? তুই কী করে বুঝলি সে ইচ্ছা করে পালিয়েছে? এমনও তো হতে পারে তাকে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে কিংবা ভিন্ন কিছু। ”

” কী বলতে চাস তুই?” শান নেশায় দূর্বল হওয়া শরীরটাকে টেনেটুনে বিছানার উপর উঠে বসে৷

” আমি যা বলতে চাচ্ছি তা বুঝতে হলে স্বাভাবিক হতে হবে তোকে আগে। যা গোসল করে আয়। তারপর দুই বন্ধু মিলে বাইরে বেরোব। যা ওঠ।” ইমরোজ হাত ধরে টেনে শানকে ওয়াশরুমে পাঠায়। বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হয় শান। হালকা আকাশী রঙের শার্ট আর ডেনোম প্যান্ট পড়ে। চুলগুলোতে হেয়ারড্রায়ার চালিয়ে শুকিয়ে নিল। শরীরে পারফিউম স্প্রে করে ফর্সা লোমশ হাতে পড়ে নিল রোলেক্স ওয়াচ। কে বলবে একটু আগের বিধ্বস্ত পুরুষটি সে!

ইমরোজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জানাল শানের স্ত্রী সম্পর্কে খুঁটিনাটি খোজ সে নিয়েছে। বেশ নরম স্বভাবের মেয়েছিল কুলসুম। কুলসুম নামটা শুনে শান চমকে বললো,

” কুলসুম! কিন্তু ওর নাম তো ইসরাত জাহান।”

” কী বলিস?”

” হ্যাঁ! বিয়ের সময় এই নামটায় বলেছিল কাজি। আর কাবিনেও লেখা ছিল ইসরাত জাহান।”

ইমরোজ বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। গাড়ি ব্রেক কষে সাইডে থামিয়ে ঘুরে তাকায় শানের দিকে। বলে,

” আর ইউ সিওর?”

” হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর।” দৃঢ় স্বরে জবাব দেয় শান।

“তবে কী কুলসুমের নাম ইসরাত জাহান?” ইমরোজ বিরবির করে বলে ফের শানকে উদ্দেশ্যে করে বললো,” কাজীর ঠিকানা জানিস?”

” জানি না বাট জোগাড় করতে সময় লাগবে না। কিন্তু কেন?” কপাল সামান্য কুঁচকে বলে শান।
ইমরোজ বললো,
” তবে সেখানেই যাওয়া যাক। শান আমার মনে হচ্ছে সেইরকম ঘাবলা আছে এখানে। ভাবিকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান বললো,
” তোর ধারণা এখানে অন্য পক্ষের হাত আছে?”

” থাকতেও পারে। তোর শত্রুর অভাব তো নাই। বেচারী কী হালে আছে কে জানে?” ইমরোজ ড্রাইভ স্টার্ট করে।

এ পর্যায়ে শান অনুতপ্ত হয় স্ত্রীর প্রতি মিথ্যা অভিমান করায়। তার গতকালই এ বিষয়টা ভাবা উচিত ছিল মনে করে খারাপ লাগা অনুভব করে। শান আর কালক্ষেপন করে না। ইমরোজের কথায় সম্মতি দিয়ে চলে আসে কাজী মোতালেবের ঠিকানায়। এখানে এসেও তাদের হতাশ হতে হয়। কারণ কাজী কাবিননামার সত্যতা ছাড়া মেয়ে সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে পারে না। শান, ইমরোজ হতাশ হয়। তবে নামটা যে কুলসুম নয় ইসরাত জাহান সেটা নিশ্চিত দু’জনেই। এবার ওরা এতিম খানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেখানে গিয়েই প্যাঁচটা জটিল লাগে। ভেবেছিল কুলসুমের আসল নাম হয়তো ইসরাত জাহান হবে। কুলসুম নামটা ডাক নাম হতে পারে। কিন্তু সেখানে গিয়ে শোনে তেমন কিছুই না। কুলসুমের বার্থ সার্টিফিকেটে নাম কুলসুম আক্তারই দেওয়া। শান এবার বেশ চটে গেল এতিম খালার কেয়ারটেকারের উপর। ভুলভাল তথ্য দিয়ে কাবিন কেন করল সেই জবাব চায় সে। এই জবাবের কোনো সদুত্তর মেলে না। ইমরোজ বহুকষ্টে শানকে শান্ত করে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ইমরোজ অনেক কিছুই আন্দাজ করছে। তবে আন্দাজ ভেবেই প্রকাশ করল না সে। শানকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল ইসরাত জাহান এবং কুলসুম নামের জট ছাড়াতে। জানে না আদৌ সফল হতে পারবে কিনা!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here