তুমি আসবে বলে পর্ব -০১

“আ’ম সরি পালক,সত্যতা যাচাই না করেই কাল ওভাবে সিন ক্রিয়েট করা উচিত হয়নি আমার”

কাল যেখানে দাড়িয়ে ভরা রাস্তায় অপমান হতে হয়েছিলো,আজ সেই অপমান করা মানুষ টার কাছ থেকে দু শব্দের সরি শুনতেও নেহায়েত উপহাস মনে হচ্ছে।

“কিছু বলো পালক,আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি,ওইরকম বাজে একটা চিঠি দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো নাহ তাই কোনো দিক না ভেবেই…

” কোনো দিক না ভেবেই আপনি ভরা রাস্তায় একটা মেয়েকে চ’ড় মেরে দিলেন তাই তো?”

উনাকে কথা সম্পুর্ন না করতে দিয়েই উত্তর দিলাম

“আসলে বাচ্চা মেয়েটি বলেছিলো চিঠিটা নীল রঙের ওড়না পরা মেয়ে দিয়েছে,তখন সেখানে নীল রঙের ওড়না পরিহিত তোমাকে দেখে আমি”

“ওই থা’প্পড় আমার গালে নাহ,আমার সম্মানে দিয়েছেন। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে,আমাদের কাছে সম্মান টুকুই সব,কাল ভরা রাস্তায় কতো রকম কটুক্তি হজম করতে হয়েছে তার কোনো ধারনা আছে?”

বলেই গাল দিয়ে এক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো,আর যাই হোক এই মানুষটার সামনে আমি কিছুতেই চোখের পানি দেখাতে চাইনি,কিন্তু বেহায়া চোখ আমার মানলো নাহ,নিজের অপমানের কথা মনে হতেই অশ্রুজলে ভিজিয়ে দিলো কপোল।

“আ আমার কথা টা একবার শোনো”

“ব্যাস,কাল তো অনেক শুনালেন,এখনও বাকি আছে?”

বলে আর কোনো শব্দ ব্যায় না করে দৌড়ে, এক প্রকার পালিয়ে এলাম। চোখের সামনে এখনো দৃশ্যমান কালকের সেই বিশ্রী ঘটনা

________________

ঠা’সস শব্দের আওয়াজ টাতে আশেপাশের মানুষ কেপে উঠলো।ভরা রাস্তায় সকলের সামনে থা’প্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছি।আশেপাশের সকলের দৃষ্টি আমার দিকে।এখন যেনো সকলের আকর্ষণের মধ্যবিন্দু আমি।হবোই বা না কেনো। কোনো মেয়েকে যদি রাস্তার সকলের সামনে একটা ছেলে এসে সজোরে থা’প্পড় দেয় তো লোকজনের হা করে তাকিয়ে থাকা টা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। গাল দু’টো এখনো জ্বলছে,ফর্সা গাল দু’টোয় পাচঁটা আঙুলের ছাপ স্পষ্ট, মাথা টা দপদপ করছে।চোখে অন্ধকার দেখছি এখনো, দেখবোই বা না কেনো,ওমন বলিষ্ঠ হাতের একটা চ’ড় আমার মতো মেয়ের মাথা টা ঘুরিয়ে দিতে একটু বেশিই যথেষ্ট। মাথা টা কেমন ভনভন করছে আমার।এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না মাঝ রাস্তায় সম্পুর্ন অচেনা অজানা ছেলের হাতে থা’প্পড় খাওয়ার কারণ।

-ইউ চি’প! এই তোমাদের মতো মেয়েরাই সমাজের আব’র্জনা, এদের জন্য আজ এই পরিস্থিতি। মেয়ে হয়ে এমন একটা কাজ করতে তোমার লজ্জা করলো নাহ? ছিহ্

আমি এখনো স্তব্ধ, কি করেছি আমি? আমি সমাজের আব’র্জনা? কথা টা কানের মধ্যে সুচের মতো বিধলো

-চুপ করে আছো কেনো,স্পিক আউট ড্যাম ইট?
মেয়ে হয়ে এই ধরনের একটা চিঠি দিতে তোমার নুন্যতম লজ্জাবোধ হলো নাহ

বলেই ছোট খাটো একটা চিরকুট আমার সামনে ফেলে দিলো।আমি এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছি নাহ।জ্বলছে ভীষণ। ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে।জ্বলন টা গালে নাহ আমার বুকের ভেতরে,সারা শরীরে। আজ অব্দি এতোটা অসম্মানিত কখনও হইনি।কল্পনাতেও ভাবিনি ভরা রাস্তায় এভাবে অপদস্ত হতে হবে তাও কোনো দোষ ছাড়াই,কিসের চিঠি? কাকে দিয়েছি?

-মেঘ,ভাই চল অলরেডি অনেক সিন ক্রিয়েট হয়ে গেছে,ছেড়ে দে

ছেলেটা আমার দিকে রেষ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভীষণ বিরক্তি আর রাগ দেখিয়ে চলে গেলো গটগট করে।
আমি এখনো স্তব্ধ। আশেপাশের লোকজন নানা মন্তব্য করছে

“আজকালকার মেয়েরাই এমন বে’হায়া”
“আসলেই,ছেলেরা কি মেয়েদের পেছনে পরবে,মেয়েরাই ভালো ছেলে দেখলে ছোক’ছোক করে”

ছিহ,মানুষ কতো সহজেই না জেনে না বুঝে মানুষকে যা নয় তা বলে দেয়।একটাবার ও ভাবে না আসল কাহিনি টা কি। দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও আর পাচ্চজি নাহ আশপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, মাথা টা প্রচন্ড যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। ভেতরের দামামা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়েই যাচ্ছে ছেলেটার বলে যাওয়া শব্দ গুলো আর আশেপাশের মানুষের কটুক্তি।

___________

ভার্সিটির ক্লাস শেষে আমি আর শিমু বেরিয়েছি। কিছু কেনা কাটা করেই ফিরবো।আজ এক্সট্রা ক্লাসের জন্য একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। পারাপারি করে ফিরছিলাম দুজনে। দুপুরের কড়া রোদে অনেকক্ষানি হেটে বেশ তেষ্টা পেয়েছিলো, শিমুকে পানি আনতে দিয়ে রাস্তার একপাশে দাড়িয়েছিলাম আর তখনই কোত্থেকে এসেই কোনো রূপ বাক্য ব্যয় হীনাই সজোরে আঘাত পরলো আমার গালে। শিমু মাত্রই পানি নিয়ে আসছিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সেও অবাক। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতে পারছে নাহ। তার চেয়েও বেশি চড়াঘাত করেছে ছেলেটির বলা প্রতিটি বাক্য। আমি কোনো ভাবেই কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারছি নাহ। নিঃশব্দে নোনাজলে ভিজে একাকার কপোল। গ্রীষ্মের তপ্ত রোদের ঘাম আর চোখের পানিতে ভিজে একাকার। ভাবশূন্য হয়ে দাড়িয়ে আছি
শিমু নিঃশব্দে এসে কাধে হাত রাখলো

-বাড়ি চল পালক

তবুও কোনো হেলদোল হলো না আমার,আমি স্থির দাড়িয়ে। আমাকে এক হাতে আগলে এগোতে লাগলো।আমিও ভাবলেশহীন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছি।

-পালক দাড়া

পেছনে থেকে আসা ডাকে পা দুটো স্থীর হলো, কিন্তু পিছু ফিরে তাকানোর ইচ্ছে হলো নাহ, দৌড়ে এগিয়ে আসলো রাফাত,হাফাতে হাফাতে বললো

-পালক? পালক কি হয়েছে? কে মেরেছে তোকে? তোর গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কার হলো নাম বল পালক।

পালককে চুপ থাকতে দেখে শিমু উত্তর দিলো

-চিনি নাহ,ছেলেটা হুট করে এসে কোনো কথা ছাড়াই থাপ্পড় দিলো
-ওকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে যা শিমু,আমি দেখছি

বলেই আবারও ছুটে চলে গেলো রাফাত।

-জানি তোকে এখন কিছু বলাটাও বৃথা, তবুও বলছি মন খারাপ করিস নাহ,হয়তো কোনো মিসআন্ডাস্ট্যান্ডিং হয়েছে, উনার কথা শুনে মনে হলো কেও উনাকে কোনো চিঠি দিয়েছিলো। চিঠির কথা মনে হতেই পালক দৌড়ে গেলো সেই স্থানে অদূরেই দুমড়ে মুচড়ে ভীষণ অবহেলায় পরে আছে ছোট্ট কাগজের টুকরো টি, পালক গিয়ে কাগজটা তুলে হাতে নিলো। মুচড়ে যাওয়া কাগজের ভাজ খুলতে গোটা গোটা অক্ষরের তিন লাইনের লেখা পড়তেই সারা শরীর রি রি করে উঠলো। ছিহ। এতো বাজেও কারো চিন্তাভাবনা হয়? ওখানে তিন লাইনে লিখা
“মেঘ ইউ আর সো হট,তোমায় প্রথম দেখেই আমি ফিদা হয়ে গেছি,wanna go for a one night stand with me?”

-ছিহহ বলেই আবারও কাগজ টা মুচড়ে ফেললো পালক
-ওটাতে কি লিখা আছে পালক

পালক কোনো প্রতিউত্তর ছাড়াই কাগজ টি শিমুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাটা ধরলো। কাগজ টা খুলে শিমুর ও ভীষণ ঘৃণা হলো, কোনো মেয়ের এতোটা চিপ মাইন্ডেড হতে পারে? হাতের কাগজ টা কয়েক টুকরো করে, পিছু পিছু হাটা ধরলো

__________________

-এটা তুমি কি করলে ভাই? কি করে করলে? কোনো যাচাই বাছাই না করেই ভরা রাস্তায় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুললে?

-মেয়েটাকে তুই চিনিস রাফাত?

-অবশ্যই চিনি,ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পালক

-এমন মেয়ের সাথে মিশতে তোর রুচিতে বাধে নাহ রাফাত

-কি যা তা বলছো ভাই? ওকে তুমি কতটা চেনো? এক দেখায় একটা মেয়ে সম্পর্কে এধরণের মন্তব্য করা তোমাকে মানায় নাহ ভাই

-এক দেখাই? যে মেয়ে এক দেখায় একটা ছেলেকে এধরণের প্রোপোজাল দিতে পারে,তার চরিত্র বুঝতে আর কিছু লাগে নাহ

-কি বলেছে পালক তোমায়?

-সে আক্সড মি ফর ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড ড্যাম ইট

-এটা কি পালক তোমায় নিজে বলেছে?

-সি সেন্ড মি এ নোট

-সেটা কি ও তোমায় নিজে হাতে দিয়েছিলো?

-নাহ একটা বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে পাঠিয়েছিলো, মেয়েটাকে নাম জিগাসা করতেই নীল রঙের ওড়না পরা মেয়ের কথা বলেছিলো, এ্যন্ড সি ওয়াজ দ্যা অনলি গার্ল ওয়ারিং ব্লু দেয়ার

-লাইক সিরিয়াসলি ভাই? তোমার কাছে এটা আনএক্সপেক্টেড ছিলো! তুমি কি করে একটা বাচ্চা মেয়ের কথায় ওকে সকলের সামনে থাপ্পড় দিলে? তোমার মনে হয় যে এধরণের চিরকুট পাঠিয়েছে সে দাড়িয়ে ছিলো তোমার অপেক্ষায় ওখানেই দাড়িয়ে ছিলো? আর নীল রঙের ওড়না পরা মেয়ে কি রাস্তায় দুটো ছিলো নাহ?

-রাফাত কিন্তু ভুল কিছু বলেনি মেঘ,মানুষের চেহারায় অনেক কিছুই প্রকাশ্য।মেয়েটাকে দেখে আমারও সেরকম মনে হয়নি,তোর আগে যাচাই করে নেওয়া উচিত ছিলো।

এ পর্যায়ে এসে মেঘের ও মনে হচ্ছে সে কোনো ভুল তো করলো নাহ? আসলেই তো সে তো আশেপাশে দেখেনি,সামনে তাকিয়ে নীল রঙের ওড়না পরিহিত মেয়েটিকে দেখেই তার মাথা গরম হয়ে গেছিলো,বরাবরই গায়ে পরা স্বভাবের মেয়েরা দা দুচোক্ষের সুল। তার উপর এইধরনের কথাগুলো দেখে মাথা টা আর ঠিক রাখতে পারেনি সে

-আচ্ছা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না তোহ? ঠিকাছে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে মনে আছে তোমার?ও নিজে যদি বলে যে পালক ই সেই চিরকুট পাঠানো মেয়ে নয় তাহলে বিশ্বাস করবে তো,চলো তবে

বলেই মেঘের হাত ধরে নিয়ে গেলো বাজারে ঠিক সেই জায়গা টাই,আশে পাশে তাকাতেই দেখলো রাস্তার এক পাশে বসে বাচ্চা মেয়েটি টাকার কয়েন গুনছে,ওকে দেখতেই মেঘ আঙুল উচিয়ে দেখালো।রাফাত গিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে ডেকে আনলো।

-ভাইজান কিছু কইবেন?
-হ্যাঁ বলবো,তখন এই ভাইকে যেই মেয়েটি কাগজটা পাঠিয়েছিলো সে এই মেয়েটিই নাকি দেখোতো

বলেই ফোন বের করে পালকের একটা ছবি দেখালো রাফাত

-না না ভাইজান,হেই আপা এইডা নাহ,হেই তো ছুডো জামা পইরা আছিলো,হাটুর উপরে,আর চোখে মুখেও কিসব রঙ লাগায়া আছিলো।আর এই আপারে তো চিনি,পালক আপা,হেতি মেলা ভালো, আমারে রোজ বিশ টেকা দেয় ফুল না নিয়েই।

রাফাত পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে দিলো মেয়েটির হাতে,টাকা নিয়েই থানকু বলেই দৌড় দিলো মেয়েটি

-তুমি ভুল করেছো ভাই,অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছো।

মেঘ যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে, সে ভাবতেও পারেনি তার দ্বারা কোনো নির্দোষ মেয়ে লোক সমাগমে এভাবে অপদস্ত হবে।
-শিট,অনেক বড়ো ব্লান্ডার হয়ে গেছে, রাফাত আই নিড টু মিট উইথ হার, তুই ওর সাথে দেখা করার ব্যাবস্থা করে দে

___________

-পালক দাড়া

রাফাতের ডাকে স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে এলাম,হাটা থামিয়ে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখি রাফাত দাড়িয়ে।রাফাত আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড দের একজন, আর আমাকে চ’ড় মারা ব্যাক্তিটি তারই ভাই,যাকে আমরা কেও এতোদিন দেখিনি, পরিচয়ের সূচনা টা এভাবে হবে আশাও করিনি।কাল রাফাত নিজেই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে সবটা

-পালক আমি জানি ভাই যা করেছে সেটা এতো সহজে ক্ষমার যোগ্য নয়,তবুও বলছি কালকের ঘটনা নিয়ে আর মন খারাপ করে থাকিস নাহ।তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে নাহ

-রাগ অভিমান তো আপন মানুষের উপর করে, তোর ভাই তো আমার কেও নয়।

-আচ্ছা ছাড়, চল যাই ক্লাসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে

বাকিটা পথ নিঃশব্দে আসলাম,ভার্সিটির গেট পেরোতেই চোখে পরলো ভীষণ অপছন্দের মুখটা।পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই

সূচনা পর্ব
তুমি আসবে বলে
হুমাইরা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here