তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
অষ্টম পর্ব
রুবিনা ঘরে ঢুকে দেখলেন , মেয়ে চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে I মেয়েটাকে দেখলে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে I কতদিন পর্যন্ত ওর চোখের দিকে তাকাতে পারেননি I বিশেষত যখন ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল I হাসান সাহেব একটু সুস্থ হওয়ার পর পঞ্চগড় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল রুবিনার I কিন্তু নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপ সদর হাসপাতালে সম্ভব নয় I রংপুর থাকাটাই সমীচীন মনে করেছিলেন I রংপুরে রুবিনার এক দুরসম্পর্কের ভাই থাকে I তাদের বাড়িতে উঠতে হয়েছিল I তাদের আর্থিক অবস্থা যে খুব ভালো তা নয় I ভাই আর ভাবি ছেলেকে নিয়ে থাকেন I দুই রুমের ছোট একটা বাসা I ভেবেছিলেন কিছুদিন থাকার পর হাসান সাহেব সুস্থ হলে ফিরে যাবেন I কিন্তু দুর্ভাগ্য হাসান সাহেবের শরীর ভালো হবার পরিবর্তে আরো খারাপ হতে লাগল I যতদিন টাকা-পয়সার যোগান দিতে পেরেছেন ভাই ভাবি ভালই ব্যবহার করছিলেন I কিন্তু দিনকে দিন তাদেরও ব্যবহার খারাপ হতে শুরু করলো I
এক প্রতিবেশীর সহায়তায় পঞ্চগড়ের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে স্কুলে গিয়ে সব টাকা-পয়সা নিয়ে এসেও সুবিধা করতে পারছিলেন না রুবিনা I অনিমা ইউনিভার্সিটিতে তার অবস্থা জানিয়ে দরখাস্ত করেছিল I ভেবেছিলো সাময়িকভাবে কিছুদিন হয়তো পড়াশোনা বন্ধ থাকবে I কিন্তু সেটা হলো না I হাসান সাহেবের শরীরের নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেল I সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য একজনকে প্রয়োজন I কাজেই রুবিনাকে চাকরি ছেড়ে তার সঙ্গেই থাকতে হলো I ততদিনে ভাই ভাবীর ব্যাবহার অনেক খারাপ হয়ে গেছে I টাকা পয়সা দিয়েও তাদেরকে আর সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না I অনিমা হন্যে হয়ে চাকরির জন্য এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলো I রংপুর মেডিকেলে ওর এক বন্ধু পড়ে I তার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা টিউশনির ব্যবস্থা করল I তাতে যা আসতো তা একেবারেই নগণ্য I ধীরে ধীরে রুবিনার সমস্ত গয়না বিক্রি হয়ে গেল I উপায়ন্তর না দেখে অনিমা ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার কে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে ইমেইল করল I স্যার দ্রুতই আনসার দিলেন I ওর মত একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে খুব আফসোস করলেন I তবে আশ্বাস দিলেন স্টাডি ব্রেক নিলেও ওর পড়াশোনাটা নষ্ট হবে না I ও চাইলে আবার দুই এক বছর পর নতুন করে শুরু করতে পারবে I চেয়ারম্যান স্যার চিঠি লিখে দিলেন I রংপুর এর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস এডমিন হিসেবে অনিমার চাকরি হয়ে গেল I অনিমা সাহস করে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে নিল I চাকরি আর টিউশনির টাকায় চলে যাচ্ছিল I হাসান সাহেবের চিকিৎসা ও চলছিল I কিন্তু এসব কিছু তে অনিমার পড়াশোনাটা বন্ধ হয়ে গেল বলে বাবা-মা দুজনেই কেউ ওর মুখের দিকে চাইতে পারতেন না I
এক বছরের মধ্যে অনিমা অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এর পাশাপাশি ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিল I বেতন বাড়লো কিছুটা I এদিকে তত দিনে হাসান সাহেব ও একটু সুস্থ হয়ে উঠেছেন I রুবিনা ও আশেপাশে কয়েকটা স্কুলের বাচ্চাকে পড়ানো শুরু করেছে I ওদের ভালোই চলে যাচ্ছিল কিন্তু সমস্যা বাধলো প্রতি মাসেই রুবিনার ভাই এসে টাকা দাবি করতে লাগলো I ছয় মাস তাদের বাসায় থাকা খাওয়া সহ নানান সার্ভিস দেয়া হয়েছে বলে I রুবিনা স্বামী বা মেয়েকে কিছু জানালেন না I নিজে থেকে কিছু কিছু করে দিতে লাগলেন I কিন্তু ধীরে ধীরে তারা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল I
একদিন দুপুরে তিনি ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরে দেখলেন ,তার ভাই মিনহাজ বসে হাসান সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে I হাসান সাহেবের মুখ থমথমে Iসমস্ত ঘটনা জানার পর তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল I মিনহাজ চাইছে তার ছেলের সঙ্গে অনিমার বিয়ে দিতে I তারপর সবাই মিলে একটা বাড়ি ভাড়া করেই থাকবে I অনিমার যেহেতু এখন ইনকাম ভালো আছে ,আর তো কোন সমস্যা নেই I মিনহাজের ছেলে বয়সে অনিমার চার বছরের বড় I এইচএসসির পর আর পড়াশোনা করেনি I সম্ভবত পাশ করতে পারেনি I ওরা বলছে বিয়ের পর একটা ব্যবসা শুরু করবে I
হাসান সাহেব বরাবরই শান্ত প্রকৃতির মানুষ I কিন্তু আজ হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে গেলেন I রুবিনা অস্থির হয়ে ছুটে গেলেন I এই ধরনের উত্তেজনা তার শরীরের জন্য ভালো নয় I রুবিনা বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভাইকে বিদায় করলেন I হাসান সাহেব বাচ্চাদের মতন হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন I বারবার শুধু একটা কথাই বলতে লাগলেন যে, আজ তার কারণে তার মেয়ের এই অবস্থা হয়েছে I এর চেয়ে তাঁর মরে যাওয়াই ভাল ছিল I
অনিমা বাড়িতে ফিরেই বুঝল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে I ও একটা ভালো খবর নিয়ে এসেছিল I গত সপ্তাহেই ও চেয়ারম্যান স্যারের কাছে ইমেইল করেছে I জানিয়েছে ও আবার পড়াশোনা শুরু করতে চায় I এখানকার ইউনিভার্সিটিতে ওর এক বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে I যদি ঢাকায় একটা চাকরি পাওয়া যায় তাহলে ও সপরিবারে ঢাকায় শিফট করতে চায় I চেয়ারম্যান স্যার ততদিনে রিটায়ার করেছেন I ঢাকার বেশ নামকরা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে জয়েন করেছেন I আজই উনি ইমেইল পাঠিয়েছেন যে তার বিশ্ববিদ্যালয় অনিমার একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে I ও চাইলে সামনের মাস থেকে জয়েন করতে পারে I এখানে চাকরি করার পাশাপাশি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটা ও কমপ্লিট করতে পারবে I
রুবিনা বুঝতে পারছিলেন না কি করে মেয়েকে এসব বলবেন I কিন্তু না বলেও উপায় নেই I অনিমা বাবার কাছে ছুটে গেল I হাসান সাহেব বললেন তারা পঞ্চগড় ফিরে যেতে চান I অনিমা যেন ঢাকায় চলে যায় আর পড়াশোনা শেষ করে Iঅনিমা হেসে ফেলল I তারপর বলল
– আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন I
সব শুনে রুবিনা আর হাসান সাহেব হাফ ছেড়ে বাচলেন I
অনিমা ওর যে কয়েকজন পরিচিত বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল রেবা তাদের মধ্যে একজন I রেবার বিয়ে হয়ে গেছে I স্বামীকে নিয়ে মালিবাগে থাকে I ওরা দুজন মিলেই অনিমাদের জন্য বাড্ডায় একটা একতলা বাড়ির ব্যবস্থা করে দিল I অনিমার ইউনিভার্সিটি গুলশানে I এখান থেকে যাতায়াত করতে সুবিধা হবে I অনিমা বলে দিয়েছিল যেন একতলা বাড়ি দেখা হয় I এতে করে ওর বাবা হুইল চেয়ার নিয়ে যাওয়া আসা করতে পারবে I
এক সপ্তাহের মধ্যেই ওরা ঢাকায় শিফট করে গেল Iরেবা কিছুতেই ওদের অন্য কোথাও উঠতে দিল না I রেবার বাসায় থেকেই সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ক’দিনের মধ্যেই নিজের বাসায় উঠে গেল অনিমা I পুরনো দিনের বাসা বলে একটু বড় বড় ঘর I সামনে ছোট একটা খাবার ঘর I আলাদা করে কোনো ড্রইং রুম নেই I এক চিলতে একটা বারান্দা I অনিমার ভীষণ মন খারাপ হলো I পঞ্চগড়ে নিজেদের বাড়িটার কথা বারবার মনে পড়তে লাগলো I রুবিনার যে মন খারাপ হলো না, তা নয় I কিন্তু মেয়ের সামনে প্রকাশ করলেন না I বরং খুশি হয়ে বললেন
ছোট বাসাই ভালো I গুছিয়ে রাখতে সহজ হবে I
চাকরির পাশাপাশি অনিমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার তৃতীয় বর্ষ থেকে ক্লাস শুরু করলো I ততদিনে ওর সহপাঠীরা পাস করে বেরিয়ে গেছে I ওদের ব্যাচের কেউই ডিপার্টমেন্টে ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেনি I বেশিরভাগই দেশের বাইরে চলে গেছে I অনিমা ইচ্ছা করেই ক্লাস শূরু হয়ে যাবার পর ক্লাসে ঢুকে আবার শেষ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় I কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না I ইউনিভার্সিটিতে আসলে পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে I কত সুন্দর সুন্দর স্মৃতি যে আছে I কারো খোঁজ নিতে ইচ্ছা করে না I এতদিনে নিশ্চয়ই নীলা আর মুনিরের বিয়ে হয়ে গেছে I ছাড়া ছাড়া ভাবে শুনেছিল ওরা দেশের বাইরে আছে I যাক , ভালই হয়েছে I
মায়ের ডাকে অনিমার ঘুম ভাঙলো I অনিমা দেরী করলো না I দ্রুতই তৈরি হয়ে একটা উবার নিয়ে চলে গেল I ধানমন্ডির একটা কমিউনিটি সেন্টারে বৌভাতের অনুষ্ঠানে হচ্ছে I ও একটু অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো I চারপাশের সবাই অপরিচিত I ফোন বের করে জুনিয়ার একজন কলিগকে ফোন করল I সুব্রত ও এ বছরই জয়েন করেছে I ফোন পেয়ে গেটের কাছে এসে ওকে নিয়ে গেল I রাবেয়া ম্যাডাম সহ অন্যান্য কলিগরা খুব খুশী হলেন ওকে দেখে I আজকে ওনারা আগত অতিথি তাই তেমন কোনো দায়িত্ব নেই I বরং তাদেরকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে I সবাই মিলে একটা টেবিলে খেতে বসলেন I অনিমা বিশেষ একটা খেতে পারলো না I খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে গেল I তখনো বাকি সবাই গল্প করতে করতে খাচ্ছে I অনিমা হাত ধুয়ে এসে আবার বসল I রাত ভালোই হয়েছে I প্রায় এগারোটার উপরে বাজে I বাড়ি ফেরা দরকার I রাবেয়া ম্যাডাম বলেছিলেন ওকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন I এখন এ অবস্থায় এটা বলতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে I অনিমা একটু ইতস্তত করে বলল
– ম্যাডাম আমি আজকে যাই ?
– আরে বস না I তোমাকে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করব
– অনেক রাত হয়ে গেছে I আমি বরং একটা উবার নিয়ে চলে যাই
– এত রাতে তোমাকে আমি একা ছাড়বো না কি ? তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে I ওই তো চলে এসেছে I
অনিমা পেছন ফিরে দেখে বরফের মতো জমে গেল I মুনির এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলল
– কেমন আছো অনিমা ?
অনিমা কথা বলতে ভুলে গেছে I এখন ওর সঙ্গে যেতে হবে ?
রাবেয়া ম্যাডাম এগিয়ে এসে বললেন I
-ও আমার দেবরের ছেলে মুনির I তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে I
অনিমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ লাগছে I ও ঠিক করল মুনিরের সঙ্গে কিছুতেই যাবে না I কিন্তু রাত অনেক হয়ে গেছে I সবচেয়ে ভালো হয় আজকে না গেলে I অনিমা একটু ইতস্তত করে রাবেয়া ম্যাডামকে বলল I
– আপনি বলছিলেন আজ রাতে থাকতে I আমি বরং আজকে থেকেই যাই I
– তাহলে তো খুবই ভালো হয় I সারারাত গানের অনুষ্ঠান হবে I মেহেদী পড়ানো হবে I তুমি থাকলে ভালো হবে I মুনির তুই বরং কয়েকজন করে নিয়ে বাসায় নামিয়ে আসতে শুরু কর I
-আচ্ছা I নাজমা ও অনেকক্ষণ ধরে যেতে চাইছে I চলো অনিমা I নাজমা আজকে গন্ডার আঁকার জন্য আরো দুটো এক্সট্রা হাতে পেয়ে গেল I
রাগে অনিমার গা চিড়বিড় করছে I ও নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে গেছে I এখন চলে যাবে বলারও কোন উপায় নেই I কেন যে থাকার কথা বলেছিল I এখন অসহ্য লাগছে I
চলবে……….