তোমাতেই বিমোহিত পর্ব -১৯+২০

#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)

ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে রাফসান। ভিতরে রিনিকে দেখছে ডাক্তার।তখন বাইরে চেঁচামেচির শব্দে রাফসান বাইরে বেরিয়ে আসে এবং দেখে রিনিকে ধরে বসাচ্ছে কয়েকজন মেয়ে।ওখানে গিয়ে জানতে পারে রিনি নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাই রাফসান তাকে নিয়ে পাশের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে এসেছে।

রাফসান চাইলে অন্য কলিগদের দিয়ে রিনিকে হসপিটালে পাঠাতে পারত তবে রাফসানের বারবার মনে হচ্ছে রিনির অসুস্থতা রাফসানের জন্য। তাই রাফসান নিজে নিয়ে এসেছে রিনিকে।রাফসান বসে বসে এসব ভাবছিল তখন ডক্টর এসে হাজির হয়।ডক্টর নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

“চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার ওয়াইফ সুস্থ আছে। তবে ওনি হয়তো ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেন না। তাই এমন টা হয়েছে। আমি একটা স্যালাইন দিয়ে দিয়েছি। ওটা শেষ হলে ওনাকা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন।”

ডাক্তার এর কথা শুনে রাফসান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ডক্টর তো রিনিকে ওর ওয়াইফ ভাবছে।কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়।তাই রাফসান বলে উঠল,

“মেয়েটা আমার ওয়াইফ না।আমরা একই অফিসে জব করি।ও আমার জুনিয়র। ব্যাস এটুকুই।”

রাফসানের কথা হয়তো ডক্তরের পছন্দ হলো না।কেমন করে যেন দেখল রাফসানের দিকে। রাফসান একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল ডক্টর এর এমন চাহনিতে। তবে মুখের ভাবে সেটার প্রকাশ ঘটতে দিল না।তখন ডক্টর বললেন,

“আচ্ছা ঠিক আছে। ওনি ভেতরে আছেন।একটু পরই জ্ঞান ফিরে আসবে। আর স্যালাইনটা শেষ হলে ওনাকে নিয়ে যাবেন।”

রাফসান ডক্টর এর ফিস মিটিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে গেল যেখানে রিনি আছে।

চুপ করে শুয়ে আছে রিনি।নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে প্রথম এ অবাক হলে ও পরে কিছু টা আন্দাজ করতে পেরেছে। তবে এখানে তাকে কে এনেছে আর কি ভাবে এনেছে এটাই জানে না রিনি।

তখনই কেবিনে প্রবেশ করে রাফসান। রাফসানকে দেখে একটু অবাক হয় রিনি।মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে তাকে এখানে কি রাফসনই এনেছে।জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে রিনির তবে একটা সংকোচ ও কাজ করছে। এসব ভাবছিল রিনি।তখন রাফসান রিনির বেডের পাশে রাখা টুল টা তে বসল।নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“আর ইউ ফিল বেটার নাও?”

অপ্রস্তুত হলে ও সৌজন্য হেসে রাফসানকে বলল,

“হ্যাঁ এখন ঠিক আছি।”

“ডক্টর বলল তুমি নাকি ঠিক ঠাক খাওয়া দাওয়া করো না।এটা কিন্তু ঠিক না মিস.রিনি।তোমার এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আজ অফিসের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছিলে যদি রাস্তায় ঘাটে এমনটা হতো কত বিপদ হতে পারত তুমি জানো।সো বি কেয়ারফুল ফ্রম নাও।”

রাফসানের কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে রিনি।এই কি সেই রাফসান যে গতকাল তাকে এত অপমান করল।তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে বলেছিল।অথচ আজ সেই কিনা রিনির সাথে এত সাবলীল ভাবে কথা বলছে যেন কালকে কিছুই হয় নি।কিন্তু না রাফসান সব ভুলে গেলে ও রিনি এত সহজে ভুলবে না।সে কখনোই আর রাফসানের কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাবে না। এমনকি কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখবে না ভেবেছি রিনি।কিন্তু আজ সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। যে রাফসানের থেকে দূরে যেতে চাইছিল সেই রাফসানই আজ তাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। নিজের ওপর আজ প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে রিনির।

রিনি চুপচাপ আছে। রাফসানের কথায় উত্তর দিলো না।রাফসান বুঝল কালকের বিষয় টা নিয়ে হয়তো রিনি এখনো আপসেট। তাই হয়তো কথা বলল না।রাফসান হঠাৎ বলে উঠল,

“আম সরি রিনি।কালকের ব্যাবহারের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত।”

রিনি রাফসানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। রাফসান তাকে সরি বলছে। কিন্তু রিনি যতটুকু জানে রাফসান খুব হার্ড পারসোনালিটির তাহলে কি সে সত্যি অনুতপ্ত। রিনিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাফসান বুঝে যায় যে রিনি কেন অবাক হয়ে গেছে তাই বলে,

“আজ অফিস থেকে আমাদের দুজনের জন্যই ছুটি নিয়েছি।স্যালাইন শেষ হলে আমার সাথে এক জায়গায় যাবে রিনি!”

রাফসানের অনুরোধ ফেলতে পারে না রিনি।তাই রাফসানের কথায় সায় জানায় সে।
_____________________
সকাল থেকে নিজের ঘরে মুখ গোমড়া করে বসে আছে আরোহি। ইহান এভাবে চলে গেছে এটা মানতে পারছে না সে।আরোহি জানে তার দোষেই ইহান চলে গেছে। কিন্তু আরোহি তো এটা চায়নি।সে চেয়েছিল ইহান যেন তার ওপর জোর দেখায়, তাকে বলে আরোহি যেন না যায়।

নারী চরিত্র বড়ই বিচিত্র। বড়ই আহ্লাদিত। আর আরোহি সেটা আবারও প্রমান করে দিল।

তবে আর নয়।এখন তো দুজনের কাছেই সব পরিষ্কার তাহলে এই দূরত্ব অযাচিত দুজনের কাছে। যে কোনো একজন এগোলেই সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হবে।আর আরোহি সিদ্ধান্ত নিলো সেই এগিয়ে যাবে।অনেক তো হলো কষ্ট দেওয়া নেওয়া, অনেক তো হলো মান অভিমান। এবার না হয় অভিমান, রাগ ইগোটাকে দূরে সরিয়ে ভালোবাসা টাকে বেশি গুরুত্ব দিল।

এসব কথাই মনে মনে ভাবছে আরোহি। তখনই আরশি বেগম আয়ানকে নিয়ে আরোহির কাছে এলেন।তার বউমা নামক মেয়েটার যে অভিমান হয়েছে সেটা বুঝতে পারলেন তিনি। তবে তিনি সবটা ওদের দুজনের ওপর ছেড়ে দিলেন।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মান অভিমান হবে, আবার মিটে ও যাবে কিন্তু সেটার মধ্যে বারবার বড়দের ঢোকা ঠিক না।তাই তিনি আরোহিকে একটা কথা বলতে এসেছেন। আরশি বেগম আরোহির পাশে বসলেন।বললেন,

“এত ভাবিস না মা।একটু রাগ হয়েছে।সময় মতো ঠিক ফিরে আসবে।ফোন করেছিল একটু আগে।সন্ধ্যায় ফিরবে বলেছে। ”

খালামনির কথায় আলতো হাসল আরোহি যদিও সেটা দেখানো হাসি। আরশি বেগম তখন বলে উঠল,

“আমরা আজ একটু গ্রামের বাড়িতে যাবো আরোহি।ইহানের দাদি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ইহানের বড় চাচু ফোন দিয়েছিল। তোকে নিয়ে যেতাম তবে তোর বড় বাবা ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপারে কথা বলেছেন।কালকেই ভর্তি হতে হবে তোকে। এরপর আর সিট পাওয়া যাবে না। ইহানকে আমি যা বলার বলে দেব।তোকে ওই তোকে কাল ভর্তি করিয়ে দেবে।তারপর ইহানের সাথে গ্রামের বাড়িতে চলে যাস।আর ওখান থেকে ফিরে ক্লাস শুরু করিস।কেমন!”

খালামনির কথায় হ্যাঁ বলল আরোহি। কারণ খালমনির কথা বা পরিকল্পনা যথাযথ।আরোহিকে সবটা বুঝিয়ে দুপুরের দিকে রওনা হলেন ইদ্রিস সাহেব আর আরশি বেগম।সাথে আায়নকে ও নিলো।আরোহি বলেছিল আয়ানকে রেখে যেতে কিন্তু আরশি বেগম এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেছেন আয়ানকে।আর আয়ান ও এখন আরশি বেগম এর কাছে থাকে।

হয়তো ইহান আর আরোহি একটু একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে পারবে এটা ভেবে আয়ানকে জোর করে নিজেদের সাথে নিয়ে গেছেন তিনি। আরোহি ওনাদের বিদায় দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
_____________________

রাফসানের বাড়িতে এসে অবাক হয়ে গেছে রিনি।একটা ব্যাচেলার ছেলে যে এতটা পরিপাটি হতে পারে সেটা জানা ছিল না রিনির।রিনি চারিদিক মুগ্ধ হয়ে দেখছিল।রাফসান তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় শুনে একটু অবাক হলে ও খুশি হয়েছিল রিনি।রাফসানের মুখে সরি শোনার পর রাগগুলো যেন নিমিষেই ভেনিস হয়ে গেছে।হয়তো এটাই ভালোবাসা।

হঠাৎই দেওয়ালে একটা মেয়ের হাস্যজ্জল ছবি দেখে ভ্রু কুচকে গেল রিনির।রাফসানের বাড়িতে এমন ছবি হয়তো আশা করেনি রিনি।আবার পাশে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি ও আছে।রিনি এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মায়াবী চেহারার অধিকারি সেই মুখটার দিকে। অনেক কিছু ভেবে ও ঠিক বুঝতে পারছে না ছবিটি কার।রাফসান রিনিকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে কিচেনে গিয়েছিল কফি বানাতে। এসে দেখে রিনি এক দৃষ্টিতে দেওয়ালে টানানো ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। রাফসান হালকা শব্দ করতেই রিনি পিছনে ফিরে দেখতে পেল রাফসান কফি হাতে দাড়িয়ে আছে। রিনি সৌজন্যে হেসে কফিটা নিল।সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিতে লাগল।তখনই রাফসান বলে উঠল,

” ওই ছবিটা আমার ওয়াইফ এর।”

রাফসানের কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে বিষম খেল রিনি।রিনির অবচেতন মন একটাবারের জন্য ও আন্দাজ করতে পারেনি রাফসান বিবাহিত। এখন রিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছে রাফসান কেন তাকে এখানে এনেছে। তখনই রাফসান আবার ও বলে উঠল,

“পাশের ছবিটা আমার ছেলের।নাম আয়ান।”

এবার যেন রিনি দ্বিতীয় ধাক্কা টা খেল।রাফসানের দিকে এমন করে তাকালো যেন বলতে চাইছে,

“মন ভাঙবি ভালো কথা। কিন্তু এভাবে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারার প্লান কেন করেছিস?”

রাফসান নিজের ফোন টা বের করে রিনির সামনে ধরল সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বধু বেশে সেই রমনি দাঁড়িয়ে আছে আর পাশে বরবেশে রাফসান দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ অবিশ্বাস থাকলে ও এখন আর সেটার উপায় নেই। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল রিনির।
#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ২০💝💝(স্পেশাল পর্ব)💝💝
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)

রাত ৯ টায় বাড়িতে ফিরল ইহান।সকালে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এক্সট্রা চাবি নিয়ে গিয়েছিল। তাই কলিং বেল না চেপে নিজে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। সে জানে বাড়িতে আরোহি ছাড়া কেউ নেই। তবে ইহান মনে প্রাণে চাচ্ছে আরোহির মুখোমুখি না হতে। আজ বাদে কাল তো চলেই যাবে তাই এখন থেকে তার থেকে দূরে থাকবে ইহান। ইহান এর পরিকল্পনা নিরবে গেস্ট রুমে ঢুকে যাবে আর কালকে সকালে বের হবে।এইসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে গেল ইহান।
ড্রয়িং রুমে আরোহি নেই দেখে স্বস্তি পেল।হয়তো নিজের ঘরে আছে।ধীর পায়ে গেস্ট রুমে ঢুকে গেল সে।গেস্ট রুমে ইহানের জামা সহ সব প্রয়োজনীয় জিনিস থাকায় অসুবিধা হলো না ইহানের।বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল ফ্লাটের। অবাক হলো ইহান।সচারাচর এমন সময় কারেন্ট যায় না কিন্তু আজ কি হলো! তবে বেশি ভাবলো না সে একটু পরেই আই পি এস চলে আসবে,তাই চিন্তার কিছু নেই।ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে বসল ইহান।কিন্তু ৫ মিনিটের জায়গায় ১০ মিনিট হওয়ার পর ও কারেন্ট আসছে না।আরোহি ঘরে একা সেই জন্য একটু চিন্তা হচ্ছে ওর জন্য ইহানের।এদিকে ১০ মিনিট পার হওয়া স্বত্তেও আই পি এস এলো না।আবার আরোহি ও কোনো সারা শব্দ করছে না। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে গেছে। না হলে ড্রয়িং রুমে এসে তো মোমবাতি টা নিতো অন্তত। অনেক চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে মাথায়।খুবই রাগ হচ্ছে ইহানের। যত এই মেয়েটার থেকে দূরে থাকতে চায় তত যেন বেশি কাছে যেতে হয়।

” নাহ এভাবে আর বসে থাকলে চলবে না।আর আরোহি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গেছে তাই তো কারেন্ট না থাকা স্বত্তেও কোনো সারা শব্দ করল না।আচ্ছা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তো ভয় পাবে মেয়েটা!”

বিরবির করে বলে উঠল ইহান।

ইহান সিদ্ধান্ত নিলো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আরোহির ঘরে রেখে আসবে যাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ভয় না পায় আরোহি। আবার ক্যারেন্টর ব্যাপার টা ও দেখতে হবে।এসব ভেবে ফোন এর ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা মোমবাতি নিয়ে জ্বালিয়ে ঘরের দিকে গেল ইহান।

দরজা লাগনো আছে তবে ভেতর থেকে লক করা কিনা বুঝতে পারছে না ইহান। আবার দরজার ফাক দিয়ে হালকা আলো আসছে বলে মনে হচ্ছে ইহানের। তবে কি আরোহি আলোর ব্যাবস্থা করেছে।অনেক চিন্তা ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত দরজার লক ঘোরালো ইহান।দরজা খোলা আছে।তবে দরজা খুলে যে এমন কিছু দেখবে তেমনটা আশা করেনি সে।হাতের মোমবাতি টা কখন যে হাত থেকে পড়ে নিভে গেছে টের পেল না ইহান।
_______________________

সারা ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রিনি।আজ রাফসান এর কাছ থেকে এত বড় সত্যি জানবে ভাবতে পারেনি।একটা মানুষের জীবন এমন ও হয় ভেবেই আরো বেশি কান্না পাচ্ছে রিনির।

ফ্লাসব্যাক,

রাফসানের ফোনে রাফসান আর মায়ার ছবি দেখে রিনি বুঝে যায় যে রাফসান সত্যি বলছে।আর তাই না চাইতে ও রিনির চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে।রিনি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে রাফসানকে তখন জিজ্ঞেস করে,

” আপনার ওয়াইফ কোথায়? দেখছি না যে!”

রিনির এমন প্রশ্নে রাফসানের মুখ টা নিমিষেই কালো হয়ে যায়।বলে ওঠে,

“কয়েক মাস আগে আমার ছেলেকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। ”

রাফসানের শান্ত কন্ঠে যেন রিনি আরো ভেঙে পড়ে। আবার ও জিজ্ঞেস করে ওঠে,

“আর আপনার ছেলে?”

তাচ্ছিল্য হাসে রাফসান। তারপর তার জীবনে ঘটে যাওয়া অতীত টা বলতে থাকে রিনিকে।তবে ইহানের নাম না নিয়ে।

রাফসানের কথা শুনে অবাক এর শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় রিনি। রাফসান নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছে। একটা ছেলে ও আছে কিন্তু বাবার অধিকার নিয়ে নিজের ছেলের কাছে যাওয়ার উপায় নেই।

রাফসান তখন বলে ওঠে,

” জানো রিনি, আমি কিন্তু চাইলেই আয়ানকে মানে আমার ছেলেকে আমার কাছে আনতে পারি।হ্যাঁ মায়ার ভাই আমাদের বিয়ের সমস্ত প্রমান নষ্ট করে দিলে ও আয়ানের শরীরে আমার রক্ত বইছে। একটা ডি এন এ টেস্ট আর আয়ান আমার।এত কিছু করা ও লাগবে না যদি আমি একবার তাকে মানে মায়ার সেই স্বামীকে কে বলি আয়ানকে ফিরিয়ে দিতে সে বিনা বাক্যে দিয়ে দেবে।কিন্তু এতে যে আমার মায়া কলঙ্কিত হবে। সমাজের চোখে মায়া ইহানের স্ত্রী ছিল। কিন্তু সে আমার সন্তানের মা এটা জানলে যে সবাই মৃত্যুর পর ও মেয়েটাকে কথা শোনাতে কম করতো না। আজ যদি আমার কাছে আমাদের বিয়ের একটা প্রমাণ থাকতো তাহলে আমি আয়ানকে আমার কাছে নিয়ে আসতাম কিন্তু আমি নিরুপায়।”

কথাগুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাফসান।আর রিনি হতভম্ব হয়ে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা প্রতি মুহূর্তে এতটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

রাফসান তখন আবার ও বলতে শুরু করল,

“আমি চাইলেই নতুন কাউকে নিয়ে আমার জীবন টা আবার শুরু করতে পারি। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না রিনি। আমি মায়াকে মন থেকে ভালেবাসি আর সারাটা জীবন ভালোবাসব।আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো, হয়তো ভালো ও বাসো কিন্তু এটার কোনো ভিত্তি নেই রিনি।এত সহজে মায়াকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করা আমার পক্ষে সম্ভব না।তার থেকে তুমি ভালো কাউকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নাও।এতেই তোমার ভালো হবে। ”

ছলছল চোখে তাকালো রিনি।সত্যি কি ভালোবাসা ভুলে অন্য কাউকে এত সহজে আপন করা যায় তবে রাফসান কেন পারছে না।রিনি বলে উঠল,

” আজ থেকে আপনার কাছে কখনো প্রেমের দাবি নিয়ে যাবো না রাফসান। কথা দিলাম।তবে আপনাকে ভুলে অন্য কাউকে জায়গা দেওয়া আমার পক্ষে ও সম্ভব নয়।আমি কোনো টিন এজ এর মেয়ে না যে আজ একজনকে ভালো লাগল তো কাল আর একজন কে৷ আমি মন থেকেই আপনাকে ভালোবাসি।আর ভালোবাসা যে ভোলা যায় না সেটা আপনিই আমাকে বললেন। আমি অপেক্ষা করব রাফসান। মায়াকে ভোলার না।মায়ার জন্য বরাদ্দ জায়গায় পাশে যদি একটুখানি জায়গা পায় এই আশার।আমি কখনোই আপনাকে মায়াকে ভুলে যেতে বলব না তবে অপেক্ষায় থাকব যদি আমার ভালোবাসা দিয়ে আপনার মনের কোনে একটুখানি জায়গা করে নিতে পারি।
তার মানে এই নয় যে আজ থেকে সব সময় আপনার সাথে থাকব,পিছু ঘুরবো।যদি আমার ভালোবাসা সত্যি হয় তাহলে আমার অপেক্ষাই আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে এটা আমার বিশ্বাস। ”

কথাগুলো বলেই সেখান থেকে চলে গেল রিনি।রাফসানের সামনে শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও বাড়িতে এসে কান্নায় পড়েছে সে।আর রাফসান তো রিনির কনফিডেন্স দেখে অবাক!
_____________

ঘরে ঢুকে এমন কিছু দেখবে তা স্বপ্নে ও ভাবে নি ইহান।আরোহি আকাশি রঙের একটা পাতলা শাড়ি পরে সারা ঘরে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। মুখে মেকাপ না থাকলে ও মোটা কাজল আর আইলাইনারের দারা নিজের চোখ দুটোকে সুন্দর করে সাজিয়েছে আরোহি।আর ঠোঁটের লাল লিপস্টিক যেন মোমের আলোতে জ্বলজ্বল করছে।আরোহিকে যেন মোমের আলোতে অপসরীর মতো লাগছে।ইহান আরোহি কে দেখায় এতো বিভোর ছিল যে আরোহি কখন ইহানকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে সেটা খেয়ালই হয় নি। যেন পাথর হয়ে গেছে সে। আরোহির চুটকির শব্দে ধ্যাণ ভাঙে ইহানের। তবে অবাকের রেশ কাটাতে পারে নি। মনে মনে ভাবতে থাকে,

“আরোহি এই রুপে কেন।আমার জন্যে নাকি অন্য কোনো কারণ!”

ইহানকে ভাবনার জগতে দেখে আরোহি আলতো করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

“মেইন সুইচ তো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি, তাহলে এই ঘরে আসছিলেন না কেন?”

ইাহন এবার বুঝতে পারে কারেন্ট যাওয়ার রহস্য।তবে অবাক হয় আরোহির এমন কথায়। প্রশ্ন করে,

” আমি কখন ফিরেছি তুমি জানো?”

আরোহি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।এবার ইহানের কাছে সব ব্যাপার পরিষ্কার। আর আরোহির এমন সাজের মানে ও।আরোহি যে সব টা ঠিক করতে চাইছে সেটা ও বুঝতে বেগ পেতে হলো না ইহানের। হঠাৎই আরোহির কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো ইহান।ইহানের এমন হঠাৎ আক্রমণে আরোহি অবাক হলে ও লজ্জা লাগছে তার।ইহান আরোহির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

“হ্যাপি থার্ড মান্থ এনিভার্সিটি ওয়াইফি।”

শিউরে উঠল আরোহি। ইহানের মনে আছে আজকের দিনটা। ভাবতেই মনের কোনে ভালোলাগা ছেয়ে গেল। আরোহি ইহানের দিকে তাকালো তবে সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিল। কারণ আজ এই চোখেই তার মৃত্যু। তবে সে মৃত্যু আনন্দের। ইহান কিছু না বলেই আরোহিকে কোলে তুলে নিয়ে বেলকনিতে নিয়ে গেল। আরোহি ও কিছু বলল না।
দুজনে চুপ করে চাঁদ দেখতে লাগল।আরোহি ইহানের বুকে মাথা আর পিঠ ঠেকিয়ে চাঁদ দেখছিল কিন্তু তারপরই ভাবল ইহানকে সরি বলবে তাই একটু পরেই ইহানের দিকে ফিরে বলতে শুরু করল,

“আমি জানি ইহান আমি অনেক”

আরোহির কথা শেষ হতে দিল না ইহান।তার আগেই চুপ করিয়ে দিলো আরোহিকে। তারপর নিজ থেকে বলতে লাগল,

” কম বেশি আমরা দুজনেই অনেক দোষ করেছি আরোহি। সেটা জেনে অথবা না জেনে।তাই নো সরি। তবে আজ থেকে আমি একটা নতুন আরম্ভ চায় আরোহি। যেখানে কোনো অবিশ্বাস, মান অভিমান থাকবে না।পুরানো সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে চায়।তাই আর অতীতটাকে টেনো না আরোহি।”

ইহানের কথা শুনে পরম শান্তিতে ইহানের বুকে মাথা রাখল আরোহি।সত্যি তো সরি যদি দুজনের মন থেকে আসে তাহলে সেটা মুখে প্রকাশের কি খুব দরকার।

অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর ইহান আরোহিকে নিজের দিকে ফেরালো।ইহানের চেখ কিছু বলছে সেটা বুঝতে পারল আরোহি।তাই মাথা নিচু নিলো সে।হাসল ইহান।এত বছর এর প্রেম! হয়তো কখনো প্রকাশ পায় নি তবে ছিলে তো! তারপর ও মেয়েটা লজ্জায় লাল হচ্ছে।

ইহান কানের কাছে আবার ও ফিসফিস করে কিছু বলল আরোহির।সারা মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠল আরোহির।

চারপাশ নিস্তব্ধ।মোমবাতির আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। একটু একটু করে কমছে ঘরের আলো।এক সময় পুরো ঘরই আঁধারে ডুবে গেল।শুধু বেচে রইল দুই কপোত কপোতির প্রণয় আর উষ্ণ আলিঙ্গন।

চলবে,
চলবে,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here