তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে পর্ব -২০+২১

#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২০
#সুমাইয়া_মনি

ডিল ক্যান্সেল করার কারণে ইভানের ওপর রেগে আছে কোম্পানির মালিক। তিনি ইভানকে নির্দেশ দেয় যেভাবেই হোক এ ডিল যেন ক্যান্সেল না হয়। শক্তপোক্ত মুখে মালিকের কথা শুনলেও সে নিজেও চাইছে না রাদের কোম্পানির সঙ্গে ডিল করতে। কিন্তু বসের আদেশ তাকে মেনে নিতে হবে বাধ্যতামূলক। রাদকে বহুবার কল দিয়েছে। কিন্তু রাদ কল পীক করেনি। বিক্ষিপ্ত রাগ নিয়ে ইনগোর করছে।
রাতের ফ্লাইটে তারা বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। কাপড়চোপড় গোঁজ গাঁজ করছে সকলে। ইসানা রুমেই রয়েছে। আজ সে কষ্ট অনুভব করছে না। বরঞ্চ তার হৃদয়ে শান্তি অনুভব করছে। হয়তো বেশি আঘাত সইতে সইতে মন ধীরেধীরে পাথরে পরিনত হচ্ছে।
ইমরান ইভানের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে রয়েছে। শুধু পারছে না রাগ বাহিরে বের করতে। ইসানার জন্য মন জ্বলছে। ফ্লাইটে বসে কথা বলবে ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে কিছুক্ষণের জন্য।
.
অনবরত ফোন বাজছে। রাদ ফোনের পাশে শান্তভাবে বসে রয়েছে। ক্যান্টিনের ঘটনাটি পুনরাবৃত্তিতে আওড়াচ্ছে। মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। আমেরিকায় আসার আগের কথা তার মনে উঠছে। ইসানা চেয়েছিল না আমেরিকায় আসতে। তার কারণে আসতে হয়েছে। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। যদি তাকে না আনতো তাহলে হয়তো তাকে এমন হেনস্তা ও কষ্ট পেতে হতো না। না আসতো তার অতীত সামনে! এসব ভেবে চোখজোড়া বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
পাশে তাকাতেই দেখে ফোন তখনো বাজছে। প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে রাদ ফোন পীক করে। এক প্রকার খেঁকিয়ে বলে,
‘নেক্সট টাইম কল দিলে আমার চেয়ে খারাপ জগতের কেউ হবে না।’ বলে ফোন রেখে দেয়। ইভান বলার সুযোগটুকু পায় না। রাগ হয় তারও। তবুও নিজেকে শান্ত স্বাভাবিক রাখে।

রাতে এক সঙ্গে তারা এয়ারপোর্টে পৌঁছায়। সকলের সঙ্গে আসলেও মুখ দিয়ে একটি বাক্যও বের করেনি ইসানা। অতি শোকে আজ সে পাথর। এক ধ্যানে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। প্লেইন উঠতে আরম্ভ করে। ইসানার পাশে বসেছে লিসা। লিসা নিজেও ইসানাকে একা ছেড়ে দেয়। নিজ থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করবে ভেবে লিসা ইসানাকে বিরক্ত করে না। তবে মনে মনে কষ্ট অনুভব করছে ইসানার জন্য। তার মধ্যে ইসানার প্রতি হিংসা, ক্ষোভ কোনোটিই এখন আর নেই। সব উবে গেছে।

কয়েক ঘন্টা বাদে তারা বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। রাদ এয়ারপোর্টে থেকেই মামাবাড়ি যাওয়ার আগ্রহ পোষণ করে রাদের নিকট। রাদ না করতে পারে না। যেতে দেয়। ইসানা টেক্সি নিয়ে মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রাদ, লিসা, মুরাদ নিজেদের বাড়ি চলে আসে। হঠাৎ করেই ইসানাকে এবাড়িতে দেখে সুরভী খাতুন কিছুটা অবাক হয়।
ইসানা ভাইবোনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে মামির কোলে মাথা রাখে। চোখ জোড়া বন্ধ করতেই অনবরত পানি জড়ছে। কয়েক ঘণ্টা নিজেকে আঁটকে রাখলেও এখন আর পারছে না। বাঁধভাঙা পানি নিজ গতিতে বর্ষিত হচ্ছে। সুরভী অবাক হয়। কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘বলবি না কী হয়েছে?’
ইসানা মামির কাছে পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করে। আঁখিযুগল তার এখনো বন্ধ। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইসানার মাথায় হাত চালিয়ে বলল,
‘নিজেকে আরো শক্ত কর ইসানা। জীবনের লড়াই সবে শুরু। তোকে যে আরো লড়তে হবে। এ যাত্রায় হার মেনে নিলে চলবে না।’
‘আমি পারছি না মামি।’ অতি কষ্টে ভাঙা গলায় বলল ইসানা।
‘আল্লাহ ভরসা! একদিন তোর কপালে সুখপাখি ঠিক ধরা দিবে।’
‘ক্ষণিকের সুখ আমি চাই না। এর চেয়ে মৃত্যুও মঙ্গলময়!’
‘দ্বিতীয় বার এই বাক্য মুখে আনবি না।’ ধমকের স্বরে বলল।
‘আমি ঘুমাবো মামি। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেও।’
‘ঘুমা।’ আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইসানা ধীরে ধীরে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাচ্ছে।
.
বাড়িতে এসে রাদ নিজেকে একা অনুভব করে। ইসানা ছাড়া পুরো বাড়ি বড্ড ফাঁকা লাগছে। সব স্থানে কেমন নিরবতা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। তার প্রাণের টাইসন কোলে উঠে বসে আছে সেই কখন থেকে। এতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। সে ভাবছে শুধু ইসানাকে নিয়ে। যে ভাবনার প্রতিফলন স্পষ্ট আদলে দেখতে পাচ্ছে টাইসন নিজেও। জড়োসড়ো হয়ে হাতের ওপর মাথা রেখে চুপটি করে বসে রইলো। হয়তো ও ডিস্টার্ব করতে চাইছে না রাদকে। কলিং বেলের শব্দে রাদের চৈতন্য ফিরে। টাইসনকে পাশে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ডেলিভারি বয়কে টাকা দিয়ে খাবার গুলো ভেতরে নিয়ে আসে। ইসানা নেই বিধায় অনলাইনে খাবার অর্ডার করেছিল। টেবিলের ওপর রেখে ফ্রেশ হতে যায়।
__
সকালে রাদ, মুরাদ ও লিসা এক সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে আসে। ইসানা আজ আসেনি। আসবে না সেটিও জানিয়ে দিয়েছে রাদকে। মুরাদ রাদের কেবিনে বসে অল্পস্বল্প বাক্যবিনিময় করছিল।
‘আমি কাল লিসার ব্যবহারে অবাক হয়েছি। শেষে কি-না ইভানকে..। সত্যিই সাহস আছে মনে।’
‘হঠাৎ তার সার্পোট কেন নিলো? তুই লিসাকে কিছু বলেছিস?’
‘কই নাতো!’
রাদ ভাবনার ভঙ্গিমায় তাকায়। মুরাদ বলে,
‘সামনের শুক্রবার ইসানা আপুর মামাতো বোনের বিয়ে। তাকে একেবারে ছুটি দিয়ে দে।’
‘মন চাইছে দিতে, আবার বাঁধা দিচ্ছে। তাকে ছাড়া পুরো বাড়ি শূন্য।’
‘বাড়ি নাকি তুই?’
‘নিজেও!’
‘তোর এই ভালোবাসা তার অব্ধি কবে পৌঁছাবে, আই ডোন্ট নো।’
রাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘সে কি আমার হবে?’
‘রাদ আমি সোহানার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দু ঘন্টা পর ফিরবো।’
‘হুম।’
.
গ্রিন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত! রাদের কোম্পানির ডিল ক্যান্সেল হবার পর দ্বিতীয় ডিল ক্যান্সেল হয়ে যায়। অবশ্য এতে রাদের কোম্পানির কোনো লিঙ্ক ছিল না। ইভানের মালিক তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে রয়েছে। যে ভাবেই হোক নতুন কোম্পানির সঙ্গে ডিলের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো বাকি ক্ষয়ক্ষতি ঘাটতি পূরণ হবে না। বসের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করে। এক রাশ হতাশা নিয়ে আসনে বসতেই হোয়াটসঅ্যাপে শালিনীর কল আসে। ইভান ইনগোর করে ফোন কেটে সাইলেন্ট মুডে রাখে। আপাতত রাগ তার কার ওপর হওয়া উচিত বুঝতে পারছে না। তবে এর মূল জড়িবুটি ইসানা। তাকে দিয়েই সব বিপদের উৎস!
_____
রাতে রাদ বাড়ি ফিরার পর ইসানকে দেখতে পায়। তবে তার খুশি হবার বদলে মন খারাপ হয়ে যায়। কেননা রাদ তাকে বিয়ের আগ অব্ধি ছুটি দিয়েছে। এজন্য ইসানা রাদের বাড়িতে কিছু কাপড়চোপড় নিতে এসেছে। রাদ যখন ড্রইংরুম হয়ে রুমে প্রবেশ করবে তখনই ইসানা পিছন থেকে ডাক দেয়। রাদ ঘুরে দাঁড়ায়। সে বলে,
‘আমি আপনার জন্য রান্না করে রেখেছি।’
‘হুম! আপনি কি এখনই চলে যাবেন?’
‘না আমি সকালে যাব।’
রাদ নজর সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বিছানার ওপর বসতেই টিভির রিমোটে হাত লেগে টিভি আপনাআপনি চালু হয়ে যায়। রাদ টিভির পানে তাকায় বিরক্ত হয়ে। রিমোট তুলে বন্ধ করতে যাবে এমতাবস্থায় থেমে যায়। একটি চ্যানেলে কোরিয়ার সিরিজ হচ্ছিল। সেখানের একটি ভিডিও ক্লিপ দেখে রাদের মাথায় বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠে। দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে টাইপিং করে মুরাদকে টেক্সট পাঠায়। তারপর ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হয়।

সকাল সকাল বাড়িতে ডাক্তার এনে হাজির করেছে মুরাদ। রাদের প্রচণ্ড জ্বর হয়েছে সঙ্গে ঠান্ডাও লেগেছে। ডাক্তার থার্মোমিটার হাতে নিয়ে জ্বর মেপে দেখে ১০৮ ডিগ্রি।
সারাদিন রেস্ট নিতে বলে এবং ঠিকমতো মেডিসিন নিতে বলল। তাকে দেখার জন্য একজন লোক রাখতে বলে তিনি চলে যায়। যাওয়ার আগে এ-ও বলে যায় জ্বর অধিক মাত্রায় বেড়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে। মুরাদ উত্তেজিত হয়। রাদকে গা’ল’ম’ন্দ করে বিভিন্ন কথা বলে,
‘কি এমন কাজ করেছিস হ্যাঁ, এত জ্বর কীভাবে হলো? কাল আমাদের মিটিং রয়েছে অন্য কোম্পানির সাথে আর আজ তুই অসুস্থ হয়ে পড়লি? আন্টি জানলে রক্ষে নেই!’
ইসানা ভয়তে কাচুমাচু হয়ে যায় রেহানা আনসারীর কথা শুনে। দৃষ্টি নত রেখে গভীর ভাবনায় মসগুল সে। রাদ চোখের ইশারায় কথা চালিয়ে যেতে বলে,
‘এখন তোকে কে দেখবে? আপু তো চলে যাচ্ছে। আমাকে করতে হবে প্রজেক্টের কাজ। উফ! সব ঝামেলা এক সঙ্গে এলো।’ বলতে বলতে মাথায় হাত রাখল মুরাদ। রাদ মুরাদের ওভার অভিনয় দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো। তখনই ইসানা মিনমিন স্বরে বলল,
‘আমি যাচ্ছি না ভাইয়া। তার সঙ্গে থাকব। খেয়াল রাখব। আন্টিকে প্লিজ বলবেন না জ্বরের বিষয়টি।’
‘সত্যি আপনি থাকবেন?’ হাসিমুখ নিয়ে।
‘হ্যাঁ! মামিকে বলে দিচ্ছি ফোন করে। মানুষের বিপদ তো আর বলেকয়ে আসে না।’
‘আপনার সমস্যা হলে আপনি যেতে পারেন। আমি একাই নিজেকে সামলে নিবো।’
‘বেশি কথা বলতে হবে না আপনাকে। ভাইয়া আপনি তার কাছে থাকুন কিছুক্ষণ। আমি স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসছি।’
‘আচ্ছা! দ্রুত আসবেন।’
প্রতিত্তোরে ইসানা জবাব না দিয়ে চলে যায়। মুরাদ রাদকে আস্তেধীরে বলে,
‘তোর প্লান সাকসেস দোস্ত!’
‘হতেই হবে। কালকে কম কষ্ট পোহাতে হয়নি। ঠান্ডা পানির মধ্যে ত্রিশ মিনিট বসার ফলস্বরূপ আজ আমি জয় হাসিল করেছি।’ হাস্যমুখ দিয়ে বলল।
মুরাদ বিরক্ত বোধ নিয়ে বলল,
‘এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। ড্রামার ফল এটি। আর তাকে হাসিল তো করিস নি।’
‘ইনশাআল্লাহ! একদিন করব।’
‘তুই থাক। আমি অফিসে গেলাম।’
‘তু..’ বাকিটা বলার আগে জোরেশোরে হাঁচি দিয়ে ফের বলে,
‘যাহ!’
‘নতুন প্লান করার আগে আমাকে বলিস।’
‘আচ্ছা।’
মুরাদ চলে গেলো। টাইসন পাশে বসে রাদকে দেখছে। কাছে টেনে নেওয়ার পূর্বে দরজায় নক পড়ে। ইসানা ভেতরে প্রবেশ করে।
স্যুপ পাশে রেখে মেডিসিন গুলো বের করে দেয়। বলে,
‘খেয়ে নিবেন। দরকার হলে ডাকবেন আমাকে।’ দরজার দিকে এগিয়ে গেলে রাদের মনঃক্ষুণ্ন হয়। কারণ সে ভেবেছিল ইসানা তাকে খাইয়ে দিবে। রাদ স্যুপের বাটির পানে চেয়ে মৃদু হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
‘একদিন আমার এই স্বপ্ন পূরণ হবে।’
_
পরদিন ইভানকে অফিসে ডেকে স্টাফদের সামনে অপমানিত করা হয়। এবং তাকে চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়। শুধু ডিল ক্যান্সেলের জন্য এটা করা হয় না। মূল কারণ হলো সে কোম্পানির ডিটেইলস কপি করে অন্য কোম্পানিতে বিক্রি করতো। এবং-কি প্রতি মাসে নিজের একাউন্টে এক লাখ টাকা জমা রাখতো কোম্পানি থেকে লুকিয়ে। বস তাকে পুলিশে দিতে চেয়েছিল ফ্রট কেসের জন্য। কিন্তু মানবতার খাতিরে তাকে শুধু বরখাস্ত করেন। ব্যাংক থেকে সব টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। কার্ডগুলো ক্যান্সেল করে দেন।
অফির থেকে তাকে যে বাড়ি দেওয়া হয়েছিল সেটিও নিয়ে নেওয়া হয়। আপাতত সে পথের ফকির!
হাতের কোটটি খুলে মাঝপথে বসলেন। বিদেশের মাটিতে তার অনেক ফ্রেন্ড রয়েছে। তাদের কাছে সাহায্য চাইতে তার ইগোতে বাজছে। এখন একটি পথ খোলা রয়েছে। বাংলাদেশ! তাকে বাংলাদেশ যেতে হবে। খুব দ্রুত।
.
কান থেকে ফোন সরিয়ে রাদ তৃপ্তির হাসি দেয়। ইভানের অধঃপতনের নিউজটি তাকে প্রচণ্ড আরাম দিয়েছে। এর সব হয়েছে তার কারণে। ইমরানকে আমেরিকায় রেখে গোয়েন্দাগিরি করে ভেতরের খবর সব সামনে এনেছে। ইভানকে পথে নামিয়ে তার বেশ শান্তি লাগছে।
ইসানার জীবন থেকে চারটা বছর কেড়ে নেওয়ার শাস্তি সে পেয়েছে। খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে মাথা রেখে ভাবে আগে কেন তার সঙ্গে দেখা হলো না। তাহলে হয়তো এত কষ্ট পোহাতে হতো না। মাথা উঠিয়ে ইসানাকে ডাকলো রাদ,
‘শুনছেন সানা!’
ইসানা ড্রইংরুমে ছিল। রাদের মুখে সানা নামটি শুনে মিনিট কয়েক চুপচাপ তাকে। হয়তো ভুল শুনেছে। তাই আরেক বার ডাক শোনার অপেক্ষায় আছে।
‘আপনি কি আছেন ড্রইংরুমে?’
ইসানা এগিয়ে যায় দরজার সামনে। রাদ ওঁকে দেখে বলে,
‘গরম পানি হবে?’
‘দিচ্ছি।’ বলে যেতে চাইলে রাদ পিছন থেকে বলে উঠে,
‘সানা নামে আপনাকেই ডেকেছি। আপনি কি রাগ করবেন এ নামে ডাকলে?’
ইসানা ঘুরে না তাকিয়ে ঘাড় হালকা কাত করে বলে,
‘রাগ করব না। সঙ্গে আপু বললে ভালো হবে।’ বলে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।
রাদের ঠোঁটের হাসি কোথায় যেন উবে গেল। এসে ভর করল এক রাশ হতাশা। বিড়বিড় করে ‘সানা আপু’ আওড়াতেই এক ফালি ক্রোধ এসে জড়ো হয় আদলে। ক্রোধের বশে কি যে করবে বুঝতে পারছে না।

রাতে রাদ খাবার খাচ্ছিল টেবিলে বসে। ইসানা নিজ কক্ষে ছিল। একটু জোরে হাঁকিয়ে ডাকল,
‘সানা শুনুন?’
ইসানা এগিয়ে আসে রাদের নিকট। রাদ বলে,
‘এক কাপ কফি বানাবেন।’ বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। ইসানা কিছুটা বিরক্ত চোখে রাদের যাওয়ার পানে তাকায়। আপু ছাড়া সানা নামটি তার কাছে বিরক্তিকর!
সব গুছিয়ে রাদের জন্য কফি বানিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। টেবিলে রেখে চলে যাওয়া ধরলে রাদ পিছন থেকে বলে,
‘রিমোটটি দিবেন সানা?’
রাগী নিশ্বাস ফেলে ইসানা। পরপরই রিমোট রাদের দিকে এগিয়ে দেয়। এবারও বাহিরের দিকে এগোতেই রাদ ফের ডাকে ‘সানা’ বলে। ইসানা এবার আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। রাগ নিয়ে তেজি কণ্ঠে শুধালো,
‘ভুলে গেছেন আমি আপনার বড়ো? বলা স্বর্তেও আপু বলছেন না কেন?’
ইসানার তেজি কণ্ঠের স্বর রাদকে সুখ দিয়েছে। খুশিতে বিমোহিত! ইসানার নাকের ডগায় তীব্র রাগ দেখতে পাচ্ছে সে। ক্ষুব্ধ রাগ নিয়ে রাদের পানে চেয়ে রয়েছে। পরক্ষণে প্রস্থান করে। রাদ নজর নিচের দিকে সরিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। যতবার ইসানার কথা মনে পড়ছে ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসির দেখা মিলছে।
.
.
.
.#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২১
#সুমাইয়া_মনি

কড়ায়ে গরম তেলে মাছ ভাঁজছিল ইসানা। হাতে খুন্তি নেওয়ার সময় হঠাৎ থেমে যায়। অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে আরম্ভ করে রাদের জ্বরের বিষয়টি। থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপার পর যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে তাকে জ্বর বলা যায়। ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত খুব জ্বর এবং ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে খুব বেশি জ্বর ধরে নেওয়া যায়। সেহেতু রাদের জ্বর মেপে ডাক্তার ১০৮ ডিগ্রি বলেছিল। তাহলে তো রাদকে হাসপাতালে নিতে হবে। ইসানা বিড়বিড় করে বলে,
‘এখনই মুরাদ ভাইয়াকে বলা উচিত।’ কথাটা বলে এগিয়ে গিয়েও থেমে যায়। পরক্ষণেই ফের বলে,
‘ ওয়েট, তার জ্বর যদি এতোই হয়ে থাকে। তাহলে তো তার অবস্থা করুন হবার কথা। তাকে তো এখন বেশ ভালোই দেখাচ্ছে।’ বলতে বলতে এগিয়ে গেল রাদের রুমের নিকট। ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে রাদ ও মুরাদের কথপোকথন কানে আসে। ইসানা পাশে চেপে দাঁড়ায়।
‘ডক্টর ১০৮ডিগ্রি বলে মিস্টেক করেছে। সানা ধরতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি।’
‘আমি তাকে ১০৪ডিগ্রি বলতে বলেছি। সে বাড়িয়ে ৮ বলেছে। এখানে আমাদের তো কোনো দোষ নেই। এখন সে তো এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে, তুইও এড়িয়ে যা, সিম্পল।’
‘গেলাম এড়িয়ে। যদি ধরতে পারে তবে আমাদের প্লান খ*ত*ম।’
‘ডোন্ট ওয়ারি!’
ইসানা দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে রাগী নিশ্বাস ফেলছে। তাদের চালাকি এখন বুঝেছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না তার সঙ্গে মিথ্যা কথা কেন বলা হলো।
.
সন্ধ্যার সময় মুরাদকে কল দিয়ে বাড়িতে আসতে বলে ইসানা৷ এই মুহূর্তে রাদ ও মুরাদকে প্রচণ্ড ঠান্ডা পানিয়ে পা ভিজিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসানা৷ সঙ্গে ড্রইংরুমে এসি ফুল স্প্রিডে ছেড়ে রেখেছে। দু’জনের চেহারা ভেজা বেড়ালের মতো হয়ে আছে। নজর মেলাতে পারছে ইসানার নজরে। ইসানা স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন ফিল হচ্ছে?’
দু’জনে সংকোচ বোধ নিয়ে তাকিয়ে আবার নজর সরিয়ে নেয়। ইসানা গম্ভীর কণ্ঠে ফের শুধালো,
‘জ্বর নিয়ে কেন মিথ্যে বলেছিলেন আমার সঙ্গে? কারণটা জানতে চাই।’
সেকেন্ড কয়েক দু’জনে চুপ থেকে মুরাদ রাদকে কনুই দ্বারা গুঁতো দিয়ে বলে,
‘তুই বল।’
‘আমি পারব না তুই বল।’ রাদ পাল্টা গুঁতো দিয়ে বলে।
‘নাহ তুই বল।’
‘তুই!’
‘তুই!’
‘তুই বল শালা।’
‘তু…’
‘থামুন!’ ধমক দিয়ে বলল ইসানা। দু’জনে ইসানার দিকে তাকায় অপরাধ বোধ নিয়ে। ইসানা বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,
‘বলবেন নাকি আমি এক্ষুণি চলে যাব বাড়ি ছেড়ে।’
‘নাহ! বলছি।’ মিনমিন স্বরে বলল মুরাদ।
‘বলুন।’
মুরাদ বলল,
‘আপনি চলে যাবেন দেখে রাদ এটা করেছে।’
‘আমার চলে যাওয়ার সঙ্গে এটার কি সম্পর্ক?’
‘ও একা হয়ে যাবে। আপনাকে মিস করবে।’
লাস্টেরটুকু বলে রাদের দিকে তাকাতেই দেখে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে রাদ। নজর সরিয়ে নেয় মুরাদ।
ইসানা দু’জনের দিকে সন্দেহ নজরে তাকায়। বলে,
‘আমাকে কী বোকা মনে হয় আপনাদের। যতোক্ষণ না আমি উঠতে বলব, ততক্ষণ এখানেই বসে থাকবেন আপনারা।’
আমতা আমতা কেটে মুরাদ বলল,
‘বলছি কি আপু পানি অনেক কুল। শাস্তি….’
‘কোনো কথা শুনব না আমি। বসে থাকুন।’ বলে চলে যায় ইসানা।
মুরাদ রাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। আঙুল তুলে বলে,
‘সব তোর বাকোয়াস প্লানের জন্য হলো। ওই মা, কী ঠান্ডা পানি।’ কেপে কেপে বলল।
‘তোকে কে ঐ কথাটা বলতে বলেছে হ্যাঁ! আমার মান-মর্যাদা শেষ!’
‘তোর মান-মর্যাদা আমি ঠান্ডা পানিতে চু’বি’য়ে দেবো। কখনো কি ঠিকমতো প্লান সাকসেসফুল করেছিস? করিস নি। আগে জানলে আমি আসতামই না বাড়িতে।’
‘চল পা*লি*য়ে যাই!’ আস্তেধীরে বলল রাদ।
‘হ! পালাই। তারপরে ঠান্ডা পানিতে চু’বি’য়ে দিক আপু। তুই কোনো কথাই বলিস না।’
রাদ চুপ হয়ে রইলো। মুরাদ কাপছে। রাদেরও শীত লাগছে। একে তো ঠান্ডা তার ওপর বেশ কাল পানিতে পা চু’পি’য়ে রেখেছে। থরথর করে কাপছে দু’জনে। পাশের রুম থেকে ইসানা তাদের কথপোকথন শুনেছে এবং সোহানাকেও শুনিয়েছে। তারা বুঝতে পারছে না জ্বরের নাটক কেন করেছিল রাদ। বিষয়টি ইসানার কাছে ঘোলাটে।

বিশ মিনিট পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মুরাদ দ্রুত পা মুজা পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে পালায়। ইসানা রাদকে উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে ডাক দেয়।
‘সানা শুনুন।’
‘ইসানা আমার নাম।’ ঘুরে তাকিয়ে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল।
রাদ ইসানার কথাতে পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘আই এম স্যরি সানা! এই নামেই আপনাকে ডাকবো।’ পুরো কথা বলে রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাঝপথে থাকে। ঘাড় হালকা ঘুরিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘আপনি চলে গেলে সত্যি মিস করব আপনাকে সানা।’ অংশটুকু বলে রাদ কক্ষে চলে এলো। ইসানা রাদের দরজার পানে কপাল কুঁচকে তাকায়। সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে তার রুমে আসে। ধীরে ধীরে বিছানায় বসে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে আরম্ভ করে রাদের বলা বাক্যগুলো। প্রত্যেকটা কথার পিছনে ইসানা অন্যরকম ভাবনায় ডুবে যায়। বুঝতে পারছে না রাদ কি তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে কি-না। এমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে সে নিজ দায়িত্বে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল হয়।
_
রাতের ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফিরে ইভান। তাকে বাংলাদেশে ফিরার পিছনে ওর এক বন্ধু সাহায্য করেছে। তার মাধ্যমেই নিজের মাতৃভূমির মুখ দেখতে পেরেছে পুনোরায়। রাস্তা, পথ অলি-গলি বেরিয়ে নিজের বাসস্থানে চলে আসে। ভেতরে প্রবেশ করে নিজের বৃদ্ধ মাকে জড়িয়ে ধরে। এতদিন বাদে ছেলেকে দেখে অভিমান করে বসে থাকতে পারে না। জড়িয়ে নেয় বুকে। বাড়ির বাকি লোকজন তাকে দেখে ছুটে আসে। শুরু হয় তাদের কুশল বিনিময়। পরিশেষে ইসানা ও চাকরির বিষয়টি উল্লেখ করে। ইসানার কথা শুনে সাজেদা বানু মুখ শুকনো করে বলল,
‘আমরা অনেক অন্যায় করেছি ওর সঙ্গে। এ বাড়ির বউ হিসাবে ইসানাই যোগ্য ছিল।’
ইভান হতভম্ব হয়ে মায়ের মুখের পানে তাকায়। সে ভাবেনি তার মায়ের মুখে এরূপ বাক্য শুনবে। তিনি আবার বললেন,
‘ইসানার মামার অর্ধেক যৌতুকের টাকা দিয়ে তুই বিদেশে গিয়েছিলি। নয়তো তোর বিদেশ যাওয়া হতো না। তুই ভেবেছিলি বাকি টাকা আমরা দিয়েছে। নাহ! লিয়াকত আলি দিয়েছিলেন। ইসানার মা ওর বিয়ের জন্য টাকা রেখেছিল। সেটাই তিনি দিয়েছেন আমাকে। আমি তোকে মিথ্যে বলেছি বাবা। ক্ষমা করিস। নিজের ভুলগুলো শুধরে নে।’
ইভান দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে। চোখ বন্ধ করে ভাবে ইসানাকে দেখার প্রথম মুহূর্তটি। পাপের পথ বেছে নিয়ে অর্জন করেছিল নিজের সাফল্য। কিন্তু শেষে ধ্বংসের পথে এসে অন্তিম হয় তার পাপের কর্জকাজ। ইসানার ওপর জমে থাকা রাগ পানি হয়ে গেল। নিরুত্তর হয়ে রইলেন তারা।
_
সকালে….
রাদ রান্নাঘরে এসে ইসানাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে চাইলে না করে দেয়। এফন রাদের জ্বর অনেকটা কমে গেছে। ইসানা এপাশে এলে রাদ ওর পাশে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ইসানা বুঝতে পেরে সরে গেলেও রাদ সেদিক গিয়েই দাঁড়ায়। ইসানা পুনরায় সরে না গিয়ে ডিরেক্ট রাদকে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘লাগবে না হেল্প! যাবেন নাকি আমি চলে যাব এখান থেকে?’
‘যাচ্ছি! আমিই চলে যাচ্ছি।’ নিচু কণ্ঠে কথাটি বলে রাদ নিরাশ হয়ে রান্নাঘর ত্যাগ করে। টাইসনকে নিয়ে টেবিলে বসে গাল ফুলিয়ে। কিছুক্ষণ বাদে ইসানা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাদকে টেবিলের ওপর বসে থাকতে দেখে। রাদ টাইসনকে শুনিয়ে ইসানাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
‘শোন টাইসন। সানাকে তুই সানা আপু বলে ডাকবি।’
‘সঙ্গে আপনিও!’ ইসানা আঙুল তুলে জোর গলায় বলল।
‘রাদ যেটা না বলে সেটা না-ই থাকে।’ কিছুটা কাঠিন্য স্বরে বলল রাদ।
ইসানা চোখ পাকিয়ে তাকায়। রাদ ইসানার চাহনি দেখে মৃদু হেসে দেয়। যেটা দেখে তেলেবেগুনে ক্ষেপে ইসানা কাঁটাচামচ ছুটে দেয় টেবিলে। চলে যায় রান্নাঘরে। রাদ উঁকি দিয়ে ইসানার যাওয়ার দিকে দেখে ঠোঁটের হাসি চওড়া করে।
অসুস্থতার জন্য রাদ নিজেও চারদিনের ছুটি নিয়েছে।
এ চারদিন ইসানাকে কৌশলে তার মনের বার্তাটি বোঝাবে। অনুভব করাবে তাকে ভালোবাসে।
.
.
.
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here