#তোমারই_আছি_আমি
পর্ব-২০
#SaraMehjabin
সাত বছর আগে
সারাকে আকাশ প্রথম দেখেছিল আকাশদের বাসার ড্রয়িংরুমে। তখন আকাশ পড়ে থ্রি অথবা ফোরে। একদিন বিকালে খেলাধুলা করে বাসায় ঢুকেই দেখে, একটা লাল টুকটুকে ফ্রক গায়ে পিচ্চি ফ্লোরের চারদিকে খেলনাপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। মানুষটা পিচ্চি হলেও মাথাভর্তি লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলো দুই পাশে লাল ব্যান্ড দিয়ে ঝুটি করা, চোখে গাঢ় করে কাজল, কপালের পাশে কালো নজরফোটা। কোলের ওপর একটা পুতুল নিয়ে অবিকল বুড়ো মানুষের মতো দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছিল। আকাশের খুব মজা লাগছিল দৃশ্যটা।
আকাশের ছোটবেলা তে বাচ্চা-কাচ্চা একদম পছন্দ ছিল না। অদ্বিতী ছাড়া কোন বাচ্চাকে কোলে নিয়েছে কিনা মনে পড়ে না। কিন্তু অদ্ভুত মায়া লাগছিল বাচ্চাটার প্রতি। ইচ্ছা করছিল সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই পিচ্চিটার পুতুলখেলা দেখতে। মেয়েটা যখন দুইপাশে মাথা নাড়িয়ে কথা বলছিল আকাশের ইচ্ছা করছিল জড়িয়ে ধরে গালে চুমু বসিয়ে দেয়। মেয়েটা এত্ত বেশি গুলুমুলু যে চোখ ফেরাতে পারছিল না।
আকাশ কোলে নেওয়ার জন্য অগ্রসর হতেই গুলুমুলু বাচ্চাটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার।
“তেলে ধলা,,তেলে ধলা এসেচে। আমাকে ধলে নিয়ে যাচ্চে।বাতাও বাতাআআআও ( ছেলে ধরা, ছেলে ধরা এসেছে। আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁচাও বাঁচাআও।”
বাচ্চাটা এই কথা বলামাত্র আকাশ আরো বেশি বেশি বাচ্চাটার দিকে এগোচ্ছিল। আসলে কেন যেন বাচ্চাটার তোতলা তোতলা চিৎকার শুনতে খুব মজা লাগছিল তাই ইচ্ছা করেই কাঁদিয়ে দিচ্ছিল।
আরেকটু কাছে আসতেই বাচ্চাটা তার ছোট্ট ব্যাগ খুলে পেন্সিল চোখানো শুরু করে এবং যেই মুহূর্তে আকাশ কোলে নিতে যাবে দিল পেন্সিলের এক গুতা।
: পতা তেলে ধলা আমাকে ধততে আতে। পেন্তিল দিয়ে গুলি কবব।( পচা ছেলে ধরা আমাকে ধরতে আসে। পেন্সিল দিয়ে গুলি করব)
বাচ্চাটার নন স্টপ কান্না আর চিৎকার শুনে উপরতলা থেকে একে একে দাদু মা অদ্বিতী সাথে একজন মহিলা (যাকে আকাশ কখনো দেখে নি)আসল।
অদ্বিতী: থারা কাঁদতিত কেন? ( সারা কাঁদছিস কেন?)
মনিরা এসে সারাকে কোলে নিলেন। অনেক চুমুটুমু দিয়ে কান্না বন্ধ করলেন।
মনিরা: আম্মু সারা কাঁদছ কেন? কি হয়েছে বাবু,বলো বাবু মামনিকে বলো।
জাফরিনা: আরে বড়ভাবি ওরে অতো আহ্লাদ করো না। হয়তো কোন জিনিস টিনিস ভাঙছে এখন যাতে কেউ কিছু না বলতে পারে এইজন্য চিৎকার শুরু করেছে। ওকে তো চিনো না।
মনিরা: আহ চুপ করো তো। বুঝতে দাও আমাকে। কি হয়েছে মা?
সারা(আকাশের দিকে দেখিয়ে): ঐ পতা তেলেধলাটা আমাকে ধলতে এতেতিল। (ঐ পচা ছেলেধরাটা আমাকে ধরতে এসেছিল)
মনিরা সহ সবাই ছেলেধরাকে দেখে শকড। আকাশ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত নিজের বাসাতে তাকে ছেলেধরা উপাধি দেওয়া হলো।
মনিরা: ছিঃ মা ঐটা তোমার ভাইয়া হয়। তোমার বড়মামার ছেলে। এই আকাশ এই যে এটা হচ্ছে তোমার ফুপি। ছোটফুপি। সালাম করো ফুপিকে।
আকাশ এগিয়ে এসে সালাম করল।
: আর এইযে পুচকাটা তোমার ফুপির ছোট মেয়ে। ওর নাম সারা। তোমার বোন হয়।
সেইদিন আকাশ পুরোটা সময় ঐ বাচ্চাটার কথাই চিন্তা করল। ওর ঠোঁট ফুলিয়ে ছেলেধরা ছেলেধরা কথাটা বারবার চোখের সামনে ভাসছে। খুব হাসি পাচ্ছে ঐ কথাটা মনে পড়ে।
এরপরের থেকে বাচ্চাটার ওপর অদ্ভুত মায়া জন্মে গেল। সারারা মাঝে মাঝেই আসে। সারার ভাই সায়ানের সঙ্গে প্রথম দিকে কথা না বললেও পরে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়। আকাশের খুব মন চায় বাচ্চাটাকে ধরে আদর করতে। কিন্তু আকাশ কাছে গেলেই বাচ্চাটা তারস্বরে চিৎকার করে। আকাশকে দেখলে সহ্য-ই করতে পারে না। অদ্বিতী আর সারা একত্রে বসে খেলে। আকাশ দূরের থেকে দেখে। বাচ্চাটার ফ্রক তুলে গোল হয়ে বসে থাকা দেখতে এতো মিষ্টি লাগে। কিন্তু মিষ্টি লাগলেও কিছু করার নেই। ধরতে নিলেই আবার ভাঙা রেডিও চালু হয়ে যায়।
একদিন আকাশ স্কুল থেকে ফিরেই শোনে কোথা থেকে খুব কান্নার শব্দ আসছে। গলাটা তার খুব চেনা। সারা এইভাবে কাঁদে। সারার কিছু হলো না তো? কোথাও পড়ে ব্যথা পেয়েছে নাকি? আকাশ অস্থির হয়ে অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে আবিষ্কার করল সারা তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে পা আটকিয়ে কাঁদছে। রক্ত বেরোচ্ছে ওর পায়ে দিয়ে। আকাশ ওর পা’টা আস্তে ধীরে ছুটিয়ে ওকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। খুব সাবধানে ওষুধ লাগিয়ে দিল কাটা জায়গায়। ওষুধ লাগানোর সময় কান্নাকাটি করছিল বলে ফ্রিজ থেকে একগাদা চকলেট দিল। আকাশ সেদিনই সারার জন্য তার দেওয়া বিশেষ নামটা ঠিক করল “পুতুল”।
তারপর থেকেই সারা ও আকাশের গল্পের শুরু। ভালবাসার গল্প; একে অন্যের মাঝে মিশে যাওয়ার গল্প,হাত ধরে পথ পাড়ি দেওয়ার না বলা কথার গল্প। আকাশের কাছে সারা একটা পুতুলের মতোই ছিল। আকাশের শুধু ওকে ভালবাসতে ইচ্ছা করত। এর আগে কাউকে কখনো এভাবে ভালবাসতে ইচ্ছা করে নি। সারা ঠিক ওর জন্য নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল,,,একটাবার না দেখলেই ভেতরটা একদম শূন্য লাগত। সারাও একদম নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আকাশের ওপর। আকাশ ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইত না। কারো সঙ্গে সহ্য হতো না ওর আকাশকে। আকাশকে সবসময় নিজের কাছে আটকে রাখতে চাইত। আকাশের সময় কম দেওয়া মেনে নিতে পারত না। ইচ্ছা করেই অভিমান না করেও অভিমানের ভান করে থাকত কারণ আকাশের রাগ ভাঙানোর জন্য করা ভালবাসার পরশগুলো ওর ভীষণ প্রিয়। একটু বড় হতেই আকাশের সমস্ত দায়-দায়িত্ব সারা নিজের ওপর নিয়ে নিল। আকাশকে সে যেমন কাউকে দিতে পারে না আকাশের কোন দরকারেও সে অন্য কাউকে মানতে পারত না। দিনে দিনে সারার যত্ন শাসন বারন অভিমান আকাশকে পাগলপ্রায় করে তুলছিল। বুকে আগলে রাখা ছোট্ট পুতুলটা কবে এত বড় হলো আকাশ টের-ই পায় নি। সারা যেন একটা জীবন্ত নেশা; যাতে আকাশের সারাক্ষণ ডুবে থাকতে মন চাইত। আবার এই সারাই তার নেশা কাটানোর ওষুধ, জীবনে চলার অনুপ্রেরণা। সারা না বুঝলেও আকাশ বুঝে গেল এটা কোন মায়া নয়, এই সম্পর্কের অন্য কোন নাম নেই, এই সম্পর্কের নাম একটাই ভালোবাসা।
সারা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। ক্লাস এইটে উঠে গেল সারা। চার বছরের ছোট্ট বাচ্চা এখন চৌদ্দ বছরের এক মায়াবী কন্যা। যে তার মায়ায় আকাশের ঘর ভরে রাখে। কিন্তু ছোটবেলার সাথে বড়বেলার বিশাল একটা পার্থক্য হচ্ছে ছোটবেলায় আকাশকে কারো সাথে সহ্য করতে পারত না সারা। অথচ বড় হওয়ার পর সারার এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আকাশ একটা নয় তার সামনে হাজারটা মেয়ের সঙ্গে থাকলেও সারা কিছুই বলত না। অথচ আকাশ ভীষনভাবে চাইত সারা বলুক। সবার থেকে আলাদা করে সারা তাকে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখুক। সারা কিছু না করলেও আকাশ যেন দিনে দিনে চরম হিংসুক হয়ে উঠছিল। সারার দিকে কোন ছেলের তাকানোটুকু পর্যন্ত সহ্য হতো না। সারাকে স্কুলে দিয়ে আসছে,,হঠাৎ নজরে পড়ল রাস্তা থেকে একটা ছেলে সমানে চোখ দিচ্ছে সারার দিকে। অমনি আকাশ তাকে ধুমাধুম মারল কয়েকটা। সারার স্কুলে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন ছেলে মার খেতে লাগল সারার কারনে। কারো হয়তো পড়া বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল ছেলেটা এসেছিল সারার কাছে পড়া বুঝতে আকাশ সেই দৃশ্য দেখেই তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিল। যেহেতু আকাশ ও সারা যেখানে পড়ত সেটা এক-ই সাথে হাই স্কুল এবং কলেজে সুতরাং আকাশের চব্বিশ ঘন্টা নজর থাকত সারার দিকে।
সারার অসহ্য লাগত এগুলো। আকাশকে খুব বকাবকি করত মারামারির জন্য। কিন্তু সারা যতই বকুক অপমান করুক আকাশ পারবে না সারাকে কারো সাথে সহ্য করতে। এদিকে সারা কিছুতেই বোঝাতে পারত না এসব কারণে সবাই আকাশকে খারাপ বলে। আর আকাশকে খারাপ বললে তার কেমন লাগে এটা কি আকাশ বোঝে!
এসব নিয়ে দুজনের মধ্যে হালকা ভুল বোঝিবোঝি হতে হতে সবসময় ঝগড়া শুরু হলো। যেন কেউই কারো কথা বুঝতে চাইত না; কেউই অপরজনের মনের অবস্থা টা দেখত না। কিন্তু ভালবাসার কমতি ছিল না।
তেমনই একদিন। আকাশের সঙ্গে সারার দুইদিন আগেই ঝগড়া লেগেছে। বিকেলবেলা মুখ ঢেকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারা’র রাগ ভাঙানোর বিভিন্ন প্ল্যান ভাবছে আকাশ। তার পুতুলটার ঐ কষ্ট কষ্ট মুখটা দেখতে একদম ভালো লাগে না তার। বুঝতে পারছে সব দোষ তার। অবশ্য ঝগড়াঝাটি করে সারা যেমুহুর্তে কান্না কান্না চেহারা করে বলে আপনার সাথে আমার এইটাই শেষ কথা। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। তখন-ই আকাশের মনে হয় সব দোষ তার। এই ঝগড়ার জন্য সেই দায়ী। তার কারণে সারা এতো কষ্ট পেয়েছে। নিজের উপর চরম মেজাজ খারাপ হয়।
হঠাৎ চেনা গন্ধটা নাকে আসতেই আকাশ বেশ অবাক হয়। ঝগড়ার পরে রাগ ভাঙানো আগ পর্যন্ত সারা আকাশের ঘর দূরে থাক এই বাসায়-ই আসে না। আজ হঠাৎ কি কারনে?
সারা: আকাশভাইয়া,, এই বিকালবেলা মানুষ শুয়ে থাকে?? উঠো, এক্ষুনি উঠো। আর ঘরের এই কি হাল করেছ? দুইদিন আগেই না গুছায়া গেলাম! এইটা ঘর না ডিস্ট্রিকের বাজার?
আকাশকে বকতে বকতে পুরো রুম গুছানো শেষ করে সারা ধীরপায়ে বিছানায় আকাশের গা ঘেঁষে বসল। সারাকে কাছে পেয়ে আকাশের মনে হচ্ছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি নেমে গেছে। এইবার পুতুলটার রাগ একা একাই ভেঙেছে।
: আকাশভাইয়া তোমার মাথায় বিলি দেই?
সারা আকাশের চুলে হাত রাখে। আকাশ তো পুরোই স্তম্ভ হয়ে গেছে। সারা রেগে থাকলে কখনো মাথায় বিলি কাটে না। এর উদ্দেশ্য কি? যাই হোক এত বড় সুযোগ নষ্ট করার লোক আকাশ নয়। পরে উদ্দেশ্য বিধেয় ঐসব ভাবা যাবে।
সারা ধীরগতিতে চুলে আঙ্গুল চালাচ্ছে।
: আকাশভাইয়া তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
: আজকের দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ রে বোইন স্যরি বৌ।
: মেয়েদের মতো বিড়বিড় করছ কেন? তুমি কি মেয়ে?কি বলছ জোরে বলো।
: কৈ কি বললাম। কিছু বলি না তো।
: আচ্ছা ঠিক আছে। সারপ্রাইজটা দেখো।
বলেই সারা তার ব্যাগ থেকে টিফিন ক্যারিয়ার টা বের করল। সেখানে সারা আকাশের সব পছন্দের জিনিস বানিয়েছে। চিকেন বিরিয়ানি, রোস্ট, ফিরনি,পুডিং আরও অনেক কিছু ছিল।
: তুই এতো কিছু একসাথে কেন করেছিস?নিশ্চিত ফুপিকে কিছু ধরতে দিস নি। সব একাই করেছিস। এই গরমের মধ্যে এতসময় তুই রান্নাঘরে থাকলি?
: আপনার আমাকে নিয়ে এতো চিন্তার দরকার নেই। দুইদিন ধরে কোন হিসাবে না খেয়ে আছেন আমি সেটা জানতে চাই?
: কি করব? তুই বড় হওয়ার পরে আমার নিজে হাতে খাওয়ার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। কিভাবে খাইতে হয় ভুলে গেছি।
: ঢঙের আর জায়গা পাও না। এইদিকে আসো। হা করো।
সারা নিজে হাতে আকাশকে খাইয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল। সব আকাশের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এত ভালো কেন?
সারা: তোমার সারপ্রাইজ আরো বাকি আছে।
আকাশ: আরো? এত সারপ্রাইজ আমি হজম করব কেমনে?
সত্যিই এরপরের সারপ্রাইজ হজম করার শক্তি আকাশের ছিল না। যে সারা প্রতিদিন তিনবেলা তার রুমে সিগারেটের প্যাকেট খোঁজে; একবেলা সিগারেট খাওয়ার অপরাধে দুইদিন কথা অফ করে,,,যার ভয়ে আকাশ স্টোররুমে সিগারেট রাখে সেই সারা তাকে সিগারেট গিফট করছে।
আকাশ: তোর মতলবটা কি বল্ তো। আসল উদ্দেশ্যটা কি এসবের পেছনে?
সারা: আসল উদ্দেশ্যটা হলো বুধবার স্কুলের থেকে কক্সবাজার যাবে। ফারিহা আজমী ওরা সবাই যাবে। অনেক মজা হবে ওখানে। যাই আমি?
আকাশ: না।
সারা: আমার অনেক ইচ্ছা কক্সবাজার দেখব। একবার যাই? আর যাইতে চাব না।
আকাশ: না মানে না।
সারা: প্লিজ।
আকাশ: না বললাম তো।
সারা: ঠিক আছে। যাব না আমি কোথাও। সবাই ঘুরতে যাক,,সবাই মজা করুক। আর আমি হা করে ওদের আলাপ শুনি। এত মানুষ যায় ওরা কেউ হারায় না আর আমি গেলেই হারিয়ে যাব? ভাল্লাগে না কিছু।
সারা দ্রুত টিফিন ক্যারিয়ার গুছিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
আকাশের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সারাকে একা কোথাও যেতে দিতে ওর খুব ভয় করে। পৃথিবী সম্পর্কে ওর কোন ধারনাই নেই। তারওপর স্কুলের পিকনিক মানে ছেলেরাও থাকবে। আকাশের সবচেয়ে বড় ভয় এখানেই।
সন্ধ্যাবেলায় আকাশকে সায়ান খবর দিল বাসায় ফেরার পর থেকে সারা ভীষণ কান্নাকাটি করেছে। কাঁদতে কাঁদতে এমন অবস্থা যে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ও যেন খুব দ্রুত হসপিটালে চলে আসে।
কথাটা শুনে আকাশ আর এক মুহূর্ত না বসে দ্রুত হসপিটালে চলে এল। সারাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। সারার এই অবস্থা দেখে আকাশ পাগলপ্রায়। ওর জন্য বারবার ওর পুতুল কষ্ট পায়। ও তো চায় না ওর পুতুলকে কষ্ট দিতে।
সায়ান আকাশকে অনেক বোঝায় যাতে যেতে দেয় সারাকে। আকাশ অবশেষে রাজি হয়। সারাকে দেখে রাখার দায়িত্ব থাকে নিবিড়ের ওপর। নিবিড় আকাশের বেস্ট ফ্রেন্ডের ছোট ভাই। একটা রোড এক্সিডেন্টে নিবিড়ের বাবা-মা বড় ভাই তিনজনে স্পট ডেড। বেঁচে যায় শুধু নিবিড়। এরপর থেকে নিবিড় এই বাসাতেই থাকে। সারার ছোট খালা অর্থাৎ আকাশের ফুপি নিবিড়কে অত্যন্ত ভালবাসেন। নিবিড় তাকে মা বলে ডাকে। নিবিড় বয়সে সারার চেয়ে দুই এক বছরের বড় কিন্তু মাঝখানে অসুস্থতার জন্য গ্যাপ যাওয়ায় সারাদের সঙ্গে পড়ে। সারা অবশ্য ভাইয়া-ই ডাকে তাকে।
একমাত্র নিবিড়ের সঙ্গে আকাশ সারাকে কথা বলতে নিষেধ করে নি। খুব ভরসা নিবিড়ের ওপর।
পিকনিক থেকে ফিরে এসে সারা ভীষণ চুপচাপ। বিষয়টা আকাশ লক্ষ্য করছে। কারণে-অকারণে আকাশের ওপর রাগ করত। যেন আকাশকে সহ্য-ই করতে পারে না। বিষয়টা অদ্ভুত লাগে আকাশের। ও বুঝতে পারে সারা কোন একটা মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
আকাশের ল্যাপটপ নিবিড়ের কাছে ছিল। সেটা আনতেই আকাশ নিবিড়ের রুমে যায়। হঠাৎ ল্যাপটপের পাশে ডায়েরীটা ওর নজরে পড়ে। নিবিড়ের পার্সোনাল জিনিস ভেবে আর ধরে না। কিন্তু ডায়েরীর ভেতর থেকে অর্ধেক বেরিয়ে আসা কয়েকটা ছবি আকাশের নজরে পড়ল। অর্ধেক ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব বাজে কিছু ছবি। নিবিড়ের কাছে এ ধরনের ছবি কেন? নিবিড় কি কোন ভুল পথে চলে যাচ্ছে? আকাশকে দেখতে হবে। নিবিড় এখন ওর দায়িত্ব।
আকাশ ডায়েরীটা খোলে। ছবিতে থাকা মুখ দুটো দেখে ওর হৃৎযন্ত্রের শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। নিবিড় ও সারার প্রচণ্ড অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি। আকাশ বারবার ছবিগুলো দেখে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো? নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে। এরকমটা হতে পারে না। কখনোই পারে না।
হঠাৎ বাতাসে ডায়েরীটার একটা পাতা উল্টে যায়। আকাশ ডায়েরীটা পড়তে শুরু করে….
চলবে