#তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
ভারি বর্ষণের মাঝেও খরার মতো সময় কাটছিল নিতুর। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। নতুন বাসায় আসার তিনদিনের দিনই জিয়ান তাদেরকে নিয়ে এসেছিল। হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছে। নিতুকে ভিক্ষা চেয়েছে। জিয়ানের ওপর তারা ক্ষুব্ধ থাকলেও সেটা ছিল সাময়িক। একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে নামক শব্দ জুড়ে গেলে কি ছেড়ে যাওয়া এতটাই সহজ? অন্তত বাঙালি মেয়ের জীবনে তো নয়। এজন্যই হয়তো রাগ-জেদকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাবা-মা, বোন, দুলাভাই সকলেই নিতুকে সবটা মেনে নিতে বলেছে। সংসারে ঝামেলা হয়ই। ঝামেলা হয় সেটা নিতুও জানে। তাই বলে প্রতারণা? মা, বোন যখন মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাচ্ছিল নিতু কিচ্ছুটি বলেনি। চুপচাপ সবার কথা শুনে গেছে। কী-ই বা বলবে সে? তার আগেও কিছু বলার ছিল না আর এখনও নেই। তবে মনে মনে ঠিকই সে ভেবে নিয়েছে আজ হলেও সে জিয়ানকে ছেড়ে চলে যাবে, কাল হলেও যাবে। এজন্য সে কাউকেই কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনি। কিছুদিন বাদে শ্বশুর-শাশুড়ীও এসেছিল। তারাও তাদের ভুলের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু নিতু যেন স্তব্ধ, জড়বস্তু পুতুলের মতো। যার মাঝে কোনো রাগ, ক্ষোভ, প্রাণ কিছুই নেই।
ভাবির জন্য জিয়ান নিতুকে নিয়ে আলাদা থাকছে। এতে বাবা-মায়েরও সায় রয়েছে। কারণ তারা কেউই চায় না মিনার জন্য আবার ওদের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক। মাহিরাও আজকাল ও বাড়িতে আসছে। নিতু নিশ্চয়ই এসব ভালোভাবে নেবে না। মনের ওপর ফের বাজে প্রভাব পড়বে। জিয়ান কোনোমতেই নিতুকে হারাতে চায় না। তাই সে নিতুকে নিয়ে আলাদা থাকাটাই শ্রেয় মনে করছে।
নিতু বসে আছে বারান্দার ফ্লোরে। রান্নাঘর থেকে শব্দ এলো। কিছু পড়ে গেছে হয়তো। জিয়ান অফিস থেকে এসেই রান্না করতে চলে গেছে। শুধু আজ নয়; এক মাস ধরেই এই নিয়ম চলে আসছে। চাইলেই কাজের খালা রাখা যায়। তবে জিয়ান চাইছে সে নিজেই নিতুর জন্য রান্না-বান্না করবে। সব রকম কেয়ার করবে। অতি আদরে বেড়ে ওঠা নিতু রান্নাবান্নার ‘র’-ও জানে না। কখনও তাকে রান্নাঘরের গণ্ডিও পেড়োতে হয়নি। হেঁশেল সর্বদা মা এবং কাজের মেয়ে সামলাত। নিতুর ভীষণ ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর সে তার শাশুড়ির থেকে রান্না শিখবে। শখ, ইচ্ছে তো আরও কতকিছুই ছিল। এখন যেন সব মরিচিকা।
জিয়ান হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ঘরে এলো। ওয়ারড্রব, ড্রেসিংটেবিলের সবগুলো ড্রয়ারে ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। ঘুটুরমুটুর শব্দ শুনে নিতু বারান্দা থেকে ঘরে চলে এলো। ওকে দেখামাত্রই জিয়ান জিজ্ঞেস করল,
“বার্না মলমটা দেখেছ?”
নিতু জিয়ানের হাতের দিকে তাকাল। ডান হাতে আঙুলের কাছের অনেকখানি জায়গা লালচে হয়ে আছে। সে কোনো প্রশ্ন না করেই নিশ্চুপ থেকে মলমটি খুঁজে হাতে দিল। তৎক্ষণাৎ আবার কী যেন ভেবে নিজেই জিয়ানের হাতে মলম লাগিয়ে দিল। এই ঘটনায় যেন জিয়ানের সমস্ত কষ্ট ধুয়ে পানি হয়ে গেছে। ভাতের গরম মাড় হাতে পড়ায় যতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল, এখন তার চেয়েও অধিক বেশি আনন্দ অনুভব হচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে,
“ভাগ্যিস ভাতের মাড় পড়েছিল!”
মলম লাগানো শেষে নিতু ভারী কণ্ঠে বলল,
“রান্না শেষ?”
জিয়ান বলল,
“উঁহু! তরকারি বাকি আছে।”
নিতু কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। তার আজ নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন যে আগে সে রান্নাটা শিখল না! নিতুর রাগ-জেদ যত বেশি মনটাও ঠিক ততটাই নরম। জিয়ানের প্রতি তার ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও এখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে নিরবতা কাটিয়ে বলল,
“রান্না করতে হবে না। দোকান থেকে কিছু এনে দিন।”
“কিন্তু তুমি তো বাইরের খাবার পছন্দ করো না।”
“একদিন খেলে কিছু হবে না।”
“আমি রান্না করতে পারব নিতু। তুমি বিশ্রাম নাও।”
নিতু বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল। সারাদিন কাজ করে এসেছে সে। আর বিশ্রাম নিতে বলছে নিতুকে! জিয়ান রান্নাঘরে চলে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে নিতুও রান্নাঘরে গেল। থমথমে মুখে বলল,
“আপনি আমাকে গাইড করুন। আমি রান্না করছি।”
জিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“না, না। একদম না। বাবা-মায়ের কাছে যখন ছিলে তখন রান্নাঘরের আশেপাশেও যাওনি। আর এখন আমি তোমাকে দিয়ে রান্না করাব? অসম্ভব! তুমি রুমে যাও।”
“এত আহ্লাদ করতে হবে না। বিয়ের আগের আর পরের জীবন কি এক?”
“তুমি আগেও যেমন ছিলে, এখনও তেমনই থাকবে। এমনিতেই আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আর কোনো কষ্ট দিতে চাই না।”
নিতু জেদ ধরে বলল,
“ঠিক আছে। আজ তাহলে আমি খাবও না।”
জিয়ান দমে গেল। নিতুর রাগ সম্পর্কে সে অবগত। তাই নিজের অপারগতা মেনে নিয়ে বলল,
“রাগ কোরো না। আমি বলে দিচ্ছি। তবে তরকারিটা বসিয়েই তুমি ঘরে চলে যাবে। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারব। ঠিকাছে?”
নিতু প্রত্যুত্তর করল না। জিয়ান যেভাবে যেভাবে বলে দিল নিতুও ঠিক সেভাবেই তরকারি বসিয়ে ঢেকে দিল। জীবনে প্রথমবারের মতো সে রান্না করছে। কিছুটা ভীতি ও কিছুটা আনন্দ কাজ করছে তার মাঝে। নিতুর হাসি হাসি মুখ দেখে সাহস সঞ্চয় করল জিয়ান। আলগোছে পেছন থেকে বাম হাত দিয়ে নিতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুঁতনি রাখল। হাসি বন্ধ হয়ে গেলেও নিতু সরল না। কিছু বললও না। জিয়ানের সঙ্গে তার মনে মনে ঝগড়া চললেও সে জিয়ানকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি। যখন কাছে চেয়েছে নিতু রাজি হয়েছে। বারণ করেনি। তবে সে যে মন থেকে সায় দেয়নি এটাও জিয়ান বুঝতে পারত।
জিয়ান ক্ষীণস্বরে বলল,
“আমার ওপর কি এখনও রাগ আছে তোমার?”
“গরম লাগছে। ঘরে যাব।”
জিয়ান ছেড়ে দিল নিতুকে। ছোটোখাটো এই মুহূর্তগুলোতে নিতু সবসময়ই তাকে এড়িয়ে চলে। ওপর থেকে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে মনে হলেও ভেতর থেকে একদমই নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল নিতু।
কয়েকদিন যাবৎ নিতুর মুড সুইং বেশি হচ্ছে। খেতে ভালো লাগলে না। মাথা ঝিমঝিম করে। বমি বমি লাগে। কয়েকদিন স্বাভাবিক অসুস্থতা মনে হলেও এখন ভয়টা মনে চেপে বসেছে। গত মাসে পিরিয়ড হয়নি। এই মাসেও মিসিং। ভয়, সংশয় থেকেই জিয়ানকে বলেছিল প্রেগন্যান্সী কিট আনতে। জিয়ান রাতে বাড়ি ফেরার পথে নিয়ে এসেছিল। রাতে খেয়ে-দেয়ে নিতু অপেক্ষা করছে সকাল হওয়ার। রাতে দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো তার ঘুমও হয়নি। সারা রাত প্রায় জেগেই ছিল। ভোর পাঁচটার দিকে উঠে সে ওয়াশরুমে গিয়ে প্রেগন্যান্সী কিট দিয়ে টেস্ট করে। রেজাল্ট দেখে তার চোখ ছানাবড়া। বুক কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ থম মেরে কিটের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জিয়ানকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করে। জিয়ান ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে। চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
নিতু কিট ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর। জিয়ান হাতে তুলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে। রেজাল্ট পজেটিভ দেখে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে তার মুখ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কিছু বলার পূর্বেই নিতু চিৎকার করে বলে,
“কেন করলি এই কাজ! কেন বেবি দিলি। বেবি নিব বলছিলাম?”
জিয়ান নিতুকে শান্ত করতে বলল,
“আমার কথা শোনো নিতু…”
“কীসের কথা শুনব? তুই ইচ্ছে করে করেছিস এটা যেন আমি তোকে ছেড়ে যেতে না পারি তাই না?”
রাগে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করে নিতু। অবস্থা বেগতিক দেখে জিয়ান উঠে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করলেও পরে নিতু চুপ হয়ে যায়।
চলবে…
[