তোমার পরিনীতা -৩৩
ফায়জা করিম
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
শ্রাবণ কলেজগেটে দাড়িয়ে সুমনকে খুঁজে না পেয়ে, দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই.. দারোয়ান বললো, সুমন বাড়ি চলে গিয়েছে একটু আগেই।
শ্রাবণের রাগ এবার বাড়ার বদলে কমলো। সুমো ওকে এড়াচ্ছে কেনো? শ্রাবণ ওকে এমন কিছুকি বলেছে যে সুমো রাগ হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা হয়তো এমন হলোই কিন্তু তাতে ওর সাথে সুমোর দেখা না করার কি হলো? নাকি এটা শ্রাবণের শাস্তি।
হমম.. সেটাই মনে হয়। দগদগে ঘায়ের মধ্যে একটু শান্তির প্রলেপ পড়লো শ্রাবণের। সুমোটা একটা পাগল… কতক্ষন ওর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচবে, সারাদিন বাইরে বাইরে থাকলেও রাতে তো সে ফিরবে না কি?
হাসতে হাসতে গাড়ির কাছে ফিরে আসলো শ্রাবণ। শেষ চেষ্টার মতো আর একবার সুমনকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা কিন্তু লাভ হলোনা। রিং বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেলো।
“তোকে হাতে পেয়ে নেই একবার, কাঁচা চিবিয়ে খাবো,” গজগজ করতে করতে ঠোঁট বেকাত্যাড়া করে গাড়ির দরজাটা খুলতে যাচ্ছিলো শ্রাবণ, কিন্তু কিছু একটা ওর চোখের কোনে আটকে গেলো। একটা গাড়ি সাঁই করে ওর সামনে দিয়ে বামে মোড় ঘুরলো। শ্রাবন এতো অবাক বহুকাল হয়নি। সুমো, আদিত্যর সাথে গাড়িতে বসা… দুজনে একসাথে কোথাও যাচ্ছে।
গাড়িটা ওর দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যাবার পরও শ্রাবণ অনেকটা সময় হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো। সুমো, আদিত্যর সঙ্গে কেন? ভিতরে ভিতরে একটা প্রলয় শুরু হলো, আগুন বলকে উঠতে লাগলো।
” সুমো…., ” রাগে অন্ধ হয়ে এবার দাঁতে দাঁত ঘষলো শ্রাবণ।
সুমনের মাথা তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো আদিত্যর কথায়। বীরেন বাবু অসুস্থ, বাড়িতে ডাক্তার এসেছে। সুমন বইয়ের ব্যাগটা দুহাতে চেপে ধরেও কাঁপুনি থামাতে পারছিলনা।
দাদু ছাড়া আসলে ওর সত্যিকারের আপন বলে কেউ নেই আর। দাদুর কিছু হলে এই এতোবড় পৃথিবীতে সুমন কার কাছে গিয়ে দাড়াবে?
সুমনের সবচেয়ে রাগ হলো অনুজদার উপর। স্বার্থপরের মতো পরিবারের কারো কথা চিন্তা না করে একা একা বিদেশি এক ইংরেজ বিয়ে করে নিয়ে এসেছে সে। সেই নিয়ে ওদের বাড়িতে তোলপাড় তো হচ্ছেই সাথে পাড়ার সব বাড়িতে ছি ছি পড়ে গেছে।
সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে, সুমন সেদিন শান্তনুদার ছেলেটাকে দেখতে যাচ্ছিলো চৌধুরী বাড়ি, কিন্তু রামনাথ ওকে মাঝ সিরিতে দাড় করিয়ে পরিস্কার বলে দিয়েছে, ও যেন আর শ্রাবণের সাথে মেলামেশা না করে। অনুজদা বিধর্মী বিয়ে করে ভিন্ন জাতের হয়ে গেছে, চৌধুরী বাড়ির কেউ আর ওদের সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নয়।
সুমন সেদিন থেকে অনেকবার শ্রাবণকে কথাগুলো বলতে চেয়েছে। কিন্তু শ্রাবন ওর ফোন ঠিকমতো ধরছিলোই না, ধরলেও কোনমতে দায়সারাভাবে কথা বলছিলো। সুমনও তাই আর জোর করেনি।
কিন্তু গত পরশু কাকাবাবু নিজেই সুমনকে তার ঘরে ডেকেছিলেন। সুমন বুঝতেই পারছিলনা মানা করার পর কাকাবাবু ওকে নিজেই কেন আবার চৌধুরী বাড়ি যেতে বলেছেন। ভয়ে সুমনের হাত পা সেধিয়ে যাচ্ছিলো, রামনাথের সামনে। কিন্তু রামনাথের কথা শুনে ও ভয় পাওয়া তো বটেই, নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিলে। রামনাথ কিভাবে ওদের মন্দিরে বিয়ের খবর জেনে গিয়েছেন কে জানে?
সুমন বোকার মতো দাড়িয়ে কেবল রামনাথের কথা শুনছিলো। রামনাথ ওকে কড়াভাবে শ্রাবণের জীবন থেকে সরে যেতে বলেছে। সাথে এটাও বলেছে,” কটা টাকার জন্যই তো এসব করেছো…. ঠিক আছে টাকা দেবো কিন্তু শ্রাবণের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য সরে যাবে। ”
সুমন প্রথমে শুধু শুনেছে। রামনাথ ওদের বিয়ের খবর জেনে ফেলেছে শুনে প্রথমে ভয়ও পেয়েছে। কিন্তু টাকার জন্য বিয়ে করেছে! সেই প্রথম সুমনের ভিতরে একটা আগুন জ্বলে উঠেছিলো। শ্রাবণের কাছ থেকে সরে যাবে… তাউ আবার চিরদিনের জন্য। তখন প্রথম সুমন শান্ত গলায় উত্তর দিয়েছিলো যে, ” আমি আপনার ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকবো কিন্তু সে আমার স্বামী। সে ডাকলে আমি তার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য।”
সুমন উত্তর দিবে একথা রামনাথের স্বপ্নেরও বাইরে। রাগে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো সে।
” স্বামী! কিসের স্বামী…. ওরকম চুরি করে একা একা নিজেরা যা ইচ্ছা করলেই কি বিয়ে হয় নাকি?”
সুমনের আস্পর্ধা দেখে রাগে কাঁপছিলেন রামনাথ।
” যা ইচ্ছে তো করিনি আর আপনার ছেলে সজ্ঞানে আমার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে, আপনি না মানলেই তো সব মিথ্যে হয়ে যাবে না? ”
“সিঁদুর পরালেই বা কি? রেজিষ্ট্রেশন করা হয়েছে? প্রমান কই যে মন্দিরে বিয়ে হয়েছিলো? ”
রামনাথের গলায় চ্যালেঞ্জ।
সুমন বাকশূন্য হয়ে তাকিয়ে রইলো। প্রমান.. কিসের প্রমান দিবে ও? ওরা স্বামী- স্ত্রী সেটার প্রমান দেয়া লাগবে ওকে পুরো দুনিয়ার কাছে! সুমন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলনা। বুঝতে পারছিলো চারদিক অন্ধকার করে ঝড় আসছে ওর জীবনে। প্রিয় মুখটা তাতে হারিয়ে যাবার ভয় সুমনকে ক্রমশ বিহ্বল করে তুলছিলো।
সুমনের অন্ধকার মুখ দেখে রামনাথ একটু একটু করে ভরসা পাচ্ছিলেন।
” আমার কথা শোন সুমন। তোমার বয়স এখনো অল্প, অযথা শ্রাবণের সাথে জড়িয়ে নিজের জীবনটাকে জটিল করে তুলোনা। তোমার মামাকে বলে যে কোন ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলো, ভালো থাকবে। ”
খসখস করে একটা চেক লিখে, সুমনের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন রামনাথ। সাথে আবারো সতর্ক করেছিলেন, শ্রাবনের থেকে দূরে থাকতে। শ্রাবণ চাইলেও যেন সুমন নিজে থেকে কোন রকম যোগাযোগে না রাখে।”
সুমন ঝাপসা চোখে রামনাথের কার্যকলাপ দেখছিলো। শেষের কথাগুলো রামনাথ মোটেও সহজ সুরে শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো বলেননি, রীতিমতো হুমকি দিচ্ছিলেন। সুমনেরও আর কোন কথা বলার রুচি হয়নি। নিজের ছেলের বিয়ে করা বউকে যে অন্য পুরুষ দেখে বিয়ে করতে বলে, তার সাথে কথা বলার প্রবৃত্তি সুমনের আর ছিলোনা। বাড়ি ফেরার পথে কেবল এটাই মাথার মধ্যে ঘুরছিলো যে শ্রাবন দেশে ফিরে এলে ও তাকে কি জবাব দিবে? কি করে ওর কাছে আসা ফিরাবে?
“সুমন!”
“উমম….”
“আমরা তোমাদের বাসায় চলে এসেছি।”
“ধন্যবাদ আদিত্য… আ.. আমি ভিতরে যাই।”
“আমিও আসছি।”
সুমন আর আদিত্য যখন ঘরে ঢুকলো, বীরেন বাবু তখন বিপদ কিছুটা কাটিয়ে উঠেছেন। ডাক্তার চলে গেলেন।
সমীর, অনুজ আর তার বউকে বীরেন বাবুর ঘরে আসতে সম্পূর্ন নিষেধ করে দিয়েছেন। অনুজ বাবার বকাবকিতে বউ নিয়ে হোটেলে গিয়ে উঠেছে আর সেই ক্ষোভে মঞ্জু রান্না খাওয়া সব ছেড়েছেন।
সুমন গিয়ে দাদুর মাথার কাছে বসলো।
বীরেন বাবুর অবস্থা ভালো নয়। আদিত্য কাছে যেয়ে বসতেই তিনি আদিত্যর দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলেন।
শ্রাবণ বাড়ি এসে গুম হয়ে বসেছিলো। সুস্থ কোন চিন্তা ওর মাথায় আসছিলনা। সুমনকে আদিত্যর সাথে দেখে ওর বিদঘুটে চিন্তা গুলো একেক সময় একেক রূপ নিচ্ছে। কিন্তু মন মানছেনা… ওর সুমো ফাঁকি দিয়ে আদিত্যর হয় কি করে… সুমোতো ওকে ভালোবাসে।
কিন্তু নিজের কথাটাই যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে ওর কাছে।
ভালোবাসে! সত্যিই ভালোবাসেতো? নাকি এতোদিন অভিনয় করেছে? কিন্তু সুমোকে ও এতোটুকু থেকে চেনে…. সেই চেনাকি তাহলে ভুল ছিলো?
অজস্র চিন্তা কিলবিল করে ওর মাথার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়াতে থাকে বিষধর সাপের মতো।
“শ্রাবণ! ”
নির্মলা শ্রাবনকে এমন বিদ্ধ্যস্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন। ছেলেটা এসেই কোথায় বাইরে ছুটলো আর এখন আবার এমন উস্কোখুস্কো চেহারায় করে শুয়ে আছে।
মাকে দেখে শ্রাবন উঠে বসলো, চোখের কোন আলতো করে মুছে নিলো। দুঃখরা সব আজ একসাথে মিছিল শুরু করে দিয়েছে, বাইরে আসতে ওরা আজ বদ্ধ পরিপক্ব।
” কিরে এমন করে শুয়ে আছিস কেন? এসেই বাইরে ছুটলি আর এখন না খেয়ে শুয়ে আছিস। ”
” খিদে নেই, লাগলে খাবো।”
” খিদে নেই! বাইরে কিছু খেয়েছিস বুঝি? আমি আরও তোর জন্য মাংস রাঁধলাম। ”
মাংস… শ্রাবণের গলা দিয়ে এখন একফোঁটা জলও ঢুকবেনা। মাথাটা মনে হলো ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে ওর।
” তাহলে তুই এক্ষুনি তোর বাবা বাড়ি আসার আগে একটু সুমনদের বাড়ি ঘুরে আয়।”
সুমন নামটা শুনতেই মেজাজ আবার খিচড়ে গেলো শ্রাবণের। ঝাঁজিয়ে মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই নির্মলার কথায় থমকে গেল ও, বোকার মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“কে অসুস্থ?”
” বীরেন কাকাবাবু। তুই এক্ষুনি একবার যা দেখি। ”
শ্রাবন কোনমতে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়েই প্রীতিদের বাড়ি ছুটলো। সুমো তাহলে এ জন্য আদিত্যর সাথে বাড়ি ফিরেছে! আর ও কি সব উল্টাপাল্টা ভাবছিলো। এই গাধা বউটা ওকে কোনদিনও শান্তিতে থাকতে দিবেনা।
সুমন রান্না শেষ করে এসে দেখে আদিত্য তখনও বসা। দাদু ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ায় ঘুমাচ্ছে.. সমীর আর আদিত্য কথা বলছে।
“মামাবাবু…. ”
সুমনের পা থেকে মাথা অব্দি কেঁপে উঠলো। কতদিন পর শুনলো স্বরটা এতো স্পষ্ট করে। আস্তে আস্তে পিছনে ফিরে তাকালো সুমন। শ্রাবন সত্যি এসেছে, সুমনের ইচ্ছা হচ্ছিলো দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিন্তু সেটা সম্ভব না। হাতটা মুঠি করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো সুমন শোকেসের একপাশটা ধরে।
“আরে শ্রাবন এসো এসো.. কি সৌভাগ্য.. আমি তো মনে করেছিলাম তোমরা আর আমাদের সাথে কোন সম্পর্কই রাখবে না বাবা। এসো.. ”
নিজের চেয়ারটা খালি করে বিছানার একপাশে চেপে বসলেন সমীর।
শ্রাবণ বীরেনবাবুর খবর নেয়ার ফাঁকে সুমনকে দেখছিলো। অনেক শুকিয়ে গেছে সুমন আর সেটা যে বিভিন্ন রকম টেনশনে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি ওর। রাগে দাঁত কিড়মিড় করছিলো ওর। গাধী, উল্লুক, ফালতু একটা মেয়ে কোথাকার। কোথ থেকে একগাদা বাজে বাজে ঢং শিখেছে আর সেগুলো ওর উপরে এপ্লাই করে এই শয়তান মেয়েটা।
” সুমন যাতো মা, শ্রাবন আর আদিত্যর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা কর। এক কাজ কর ভাতই দে।”
” আদিত্যবাবুর খাবার টেবিলে দেয়া হয়েছে কিন্তু আর কেউ খাবে তাতো জানা ছিলোনা। তাই বসানো হয়নি,” সুমন স্পষ্ট কাটা কাটা স্বরে বললো।
সুমনের কথায় সমীর লজ্জা পেয়ে বোকার মতো হাসলেন,” ওহ, আসলে বুঝলে শ্রাবণ তোমার মামী, অনুজ হোটেলে যেয়ে ওঠায় সন্ন্যাস নিয়েছেন। আমিতো সেই সকালে দুমুঠো খেয়ে অফিসে গিয়েছিলাম আর সেই সন্ধ্যায় খাবো, তুমি বাবা হালকা চা নাস্তাই তাহলে খাও।”
সমীরকে বিপাকে পড়তে দেখে আদিত্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “আমি বরং বাসায় যেয়ে খাই। সেই সকালে বেড়িয়েছি… মনোদিদি দুশ্চিন্তা করবে।”
শ্রাবন, সুমনকে দেখছিলো। সুমো ইচ্ছে করে ওকে অপমান করতে চাইছে কেন ওর মাথায় এলো না। খাবার নেই এটা ওকে আস্তে করে বলা যেতো, খাবার খেতে তো এ বাড়ি আসেনি ও।
” আমি মাত্রই খেয়ে এলাম সমীর মামা, এখন আর এক দানা ভাত ওতে ঢুকবেনা। আপনারা বরং খান আমি ততক্ষন দাদুর কাছে বসি।”
আদিত্য যখন খাবার ঘরে গেলো, সমীরের সাথে সাথে সুমনও চলে গেলো। শ্রাবন অনেকটা সময় অনাহুতোর মতো বসে রইলো। বুঝতে বাকি রইলো না যে, সুমো একদম জেনেবুঝে ওকে অবহেলা করছে।
বের হয়ে যাবার সময় কি মনে করে আবার সুমনের ঘরের দিকে তাকাতেই রোখ চাপলো শ্রাবণের। নিঃশব্দে সুমনের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো ঘরের।
সুমন ও ঘর থেকে এসে কেবল মাত্র খোঁপাটা খুলছিলো, হ্যাচকা টানে শ্রাবনের বুকের উপরে যেয়ে পড়তেই ভয় পেয়ে গেলো ও।
“এসব কি হচ্ছে.. তু.. তুমি এঘরে কেন এসেছো? ” দূরে ঠেলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো সুমন। গলা ভেঙ্গে যাচ্ছে আবেগে।
কিন্তু কথার উত্তর দেয়া দূরে থাক উল্টো সুমনের থুতনি চেপে ধরে একভাবে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণ। সুমনের মুখটা যেনো চোখ দিয়ে গিলছে।
“ছাড়ো, ব্যাথা পাচ্ছি। ” কাঁকিয়ে উঠলো সুমন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ছেড়ে দেয়া দূরে থাক সেকেন্ডের মধ্যে সুমনের ঠোঁট দুটোর উপর নিজের পুরু ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো শ্রাবন। সুমন টের পেলো আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে শরীর চির চেনা স্পর্শে৷ জোর করে নিজেকে ছাড়াতে মরিয়া হলো ও। রামনাথের কথাগুলো কানে বিষের মতো বেজে উটলো তখন। শ্রাবনের জীবন থেকে দূরে থাকো, টাকার জন্য ভদ্র ঘরের ছেলে গুলোকে ফাঁসাও তোমরা। নিজের অজান্তেই কখন হাতটা অবাধ্য হয়ে শ্রাবণের গালের উপর জোরের সাথে যেয়ে পড়লো… সুমন নিজেই ঠিক করে বুঝে উঠতে পারলনা।
সুমন অপমান করছে ইচ্ছে করে সেটা শ্রাবন বুঝতে পেরেছিলো কিন্তু তখনও ওর মনে হচ্ছিলো বউ ওর রাগ হয়ে আছে। কিন্তু এখন যা ঘটলো তাতে শ্রাবণের বিস্ময়ের সীমা রইলো না। সুমন ওর গায়ে হাত তুলতে পারলো!
“আমি বার বার বলছি ছাড়ো অথচ তুমি ছাড়ছিলেনা, অসভ্যর মতো আচরন করছিলে তাই হাত উঠাতে বাধ্য হলাম।”
সুমন যথেষ্ট রূঢ় স্বরে কথাগুলো বললো।
শ্রাবন তখনও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সুমনের আচরন আজ এতোই অপরিচিতো লাগছিলো যে শ্রাবন সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছিলো।
সুমন তখন মনে মনে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। রামনাথের রাগ শ্রাবনের উপর ঢালার কোন মানে হয়না, কিন্তু ও শ্রাবণের থেকে দূরে থাকবে সে কথাও তো ও রামনাথকে দিয়েছে। কিন্তু ওর মন যুক্তি দিলো তুই তো যাসনি, শ্রাবন নিজে তোর কাছে সেধে এসেছে। তাহলে?
” ভাত নেই, তুমি চা টা কিছু খাবে? ” নরম গলায় বললো সুমন। বড্ডো বড় ভুল করে ফেলেছে আজ।
“নাহ.. ” সুমনকে ছেড়ে দরজা খুললো শ্রাবন। বের হয়ে যাবার সময় অভিমান ভরা গলায় বলে গেলো, ” ভোরে প্লেনে ওঠার পর হালকা কিছু খেয়েছিলাম তারপর আর পেটে কিছু পড়েনি।”
সুমনেরও আর তারপর কিছু খাওয়ার রুচি হলোনা। কষ্টগুলো বড় বড় ফোঁটায় বালিশের উপরই গড়িয়ে পড়তে লাগলো। চোখ বন্ধ করলেই মুখখানা ভেসে উঠে অথচ জগত বলে সেটা দেখা ওর বারন।
চলবে…….
তোমার পরিনীতা -৩৪
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
“আমি তোর মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিনা। সুমন তোর সাথে কথা বলতে চাইছেনা মানে! তোদের কি কোন ঝগড়া হয়েছে? ”
” ঝগড়ার কোন অপশনই নাই। আমি বাইরে যাওয়ার সময় সে কাঁদতে কাঁদতে ফিট হচ্ছিলো কিন্তু এখন আমার ছোঁয়া দূর, আমার চেহারা দেখলেও তার ঘেন্না হচ্ছে।”
মৌমিতা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
“এ কথা সুমন তোকে বলেছে? ”
“বলা লাগবে কেন, বলার কি আছে? ” সুমনের হাতের থাপ্পরটা এখোনো শ্রাবণের মনে দাগ কেটে আছে। সেই মুহুর্তে ভীষন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো শ্রাবণ কিন্তু এখন প্রতি মুহূর্তে সেই রাগ দ্বিগুন হচ্ছে ওর। সুমনের বেয়াদবি ওর চিন্তারও বাইরে।
“আমার তো মনে হয় না সুমন এরকম কিছু করতে পারে, দেখ হয়তো কোন রকম টেনশনে আছে।”
“টেনশনে আছে…. কতো টেনশনে আছে? আমার চেয়েও বেশি টেনশনে আছে যে কিভাবে ফ্যামিলিকে সামাল দিবে বিয়ের কথাটা বলার পর! টেনশনে আছে.. মাই ফুট, আবার কিছু হলেই ম্যাডামের মুড অফ হয় যে জামাইকে ধরে থাপ্পর দেয়।”
শেষের কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে বললেও মৌমিতার কানে সেগুলো ভালোভাবেই পৌঁছে। সুমন থাপ্পর দিয়েছে মানে বড় কোন ঝামেলা হয়েছে। যদিও এটা সত্যিযে শ্রাবণ আর লাবন্যর বিয়ে হলে, মৌমিতা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। কিন্তু যাক যেটা আর হবার নয় সেটা ভুলে যাওয়াই ভালো। কিন্তু শ্রাবন আর সুমন আবার কি নিয়ে এতোবড় ঝগড়া বাঁধালো? মৌমিতা ভাবতে থাকে।
ওই টিংটিঙে পুচকি মেয়ে… শ্রাবণকে থাপ্পর মারে, মেয়েটার সাহস আছে বটে।
মৌমিতার একবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো যে শ্রাবনকে জিজ্ঞেস করে তুই শুধু থাপ্পর খেলি না দিয়েও আসলি কতোগুলো? কিন্তু শ্রাবন অসম্ভব রাগ হয়ে আছে, মৌমিতা আর ওকে ঘাটানোর সাহস পায়না।
…………..……………
“সুমনদি…. বড়মা তোমাকে ডাকছে। ”
প্রীতি এসে সুমনকে ডেকে তোলে। কলেজ থেকে এসে সুমন সোজা শুয়ে পড়েছিলো, খাওয়া হয়নি।
বড়মা ডাকছে! সুমন চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। ইশ কতদিন হলো ও বাড়িতে চৌধুরী বাড়ি যায়না, বুকটা ব্যাথায় মোচড় খেয়ে উঠে সুমনের।
চৌধুরী বাড়ির দোতালার শেষ ঘরটা সুমনের জন্য স্বর্গ কিন্তু সেই স্বর্গে যাওয়ার পথটা এখন ওর জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
বড়মার দেখা পেয়ে নিজের চোখের জলটা সামলানো কঠিন হয়ে আসে সুমনের জন্য, নির্মলাও সুমনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন, আঁচলের কোন দিয়ে সুমনের মুখটা ভালো করে মুছিয়ে দেন।
সুমনের মনে হয় বড়মার শাড়ির আঁচলে মায়ের শরীরের স্নেহের যে সৌরভ ও পায় সেটা এতোদিন হারিয়ে ফেলেছিলো ও , মনের জোরটাও তাই হারিয়ে গিয়েছিলো।
“কিরে পচা মেয়ে, তিনদিন হয়ে গেছে আমি এসেছি আর একবারও তোর আমার কথা মনে হয়নি ? ”
নির্মলার অভিমানে ভরা অনুযোগে সুমনের মনের হাজারো দরজা যেন হাট করে খুলে যায়, কথার ফুলঝুরি ছোটে। এই দেড়টা মাস এই কথাগুলো কেউ ওকে বলেনি, এতো আদর করে… সাথে একটু বকাও কিন্তু মায়ায় জড়ানো। সুমন, নির্মলাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকে অনুজের বিয়ের কথা, দাদুর শরীর খারাপের কথা। বাসার ভিতরে সবার মন খারাপ, মঞ্জুমামী এখনও মামার সাথে কথা বলেনা ভালো করে, এসব নিয়ে ওদের বাসার ভিতরে খুবই বিচ্ছিরি একটা অবস্থা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে।
“তোর উচিত ছিলো তোর শ্রাবনদাকে কথাটা জানানো, তাহলে আমি আরো আগেই চলে আসতাম।”
নির্মলা একবাটি সেমাই তাড়াতাড়ি সুমনের হাতে ধরিয়ে দেয়। বাটিটা হাতে নিতেই সুমনের পেটে যেন হাজারো রাক্ষস হাউমাউ করে উঠে।
নির্মলা আদ্র চোখে সুমনের খাওয়া দেখতে লাগলেন। সুমনের শুকনো মুখ, গর্তে পড়া দুটো চোখ নির্মলাকে মুহুর্তের মধ্যে সব জানিয়ে দিয়ে গেছে। তিনি আর অতিরিক্ত প্রশ্ন করে সুমনের খাওয়ার ব্যাঘাত ঘটালেন না।
নির্মলার দেয়া দুটো কাপড় হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্রাবণের ঘরের কাছে আসলো সুমন। দরজার সমান লম্বা দরজাগুলোর শিকের ফাঁক দিয়ে শ্রাবণের ঘরের সবটাই প্রায় দেখা যায়। সুমন মুখটা একটু ভিতরে ঠেলতেই শ্রাবণকে দেখতে পেলো, বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমুচ্ছে।
কতদিন যে এমন করে দেখা হয়না….. সুমন হুশ জ্ঞান খুইয়ে দেখতে লাগলো। আজকাল হুট হাট শ্রাবণকে ভীষন ছুঁতে ইচ্ছে করে… ছোঁওয়া হয়না। গুমরে কাঁদতে ইচ্ছে করে, কাঁদা হয়না। দীর্ঘশ্বাস গুলো ধোয়ার মতো পাক খেয়ে আবার বুকের গভীরেই বাসা বাধে যক্ষার মতো।
দূর থেকে কে যেন সদর দরজাটা খুলে দিতে বলে, রামনাথ বাসায় এসেছে।
সুমন এবার ঘাবড়ালো। রামনাথ ওকে দেখে ফেলে যদি? সিড়ির মুখে দাড়িয়ে তার না দেখার কথা না। সুমন দ্রুতো মাথায় ওড়না দিয়ে শ্রাবণের ঘরে ঢোকে।
আকাশটা কেমন মরিচা রঙ ধরছে, সন্ধ্যে নামার আগের দৃশ্যগুলো যেন একেবারেই আলাদা। বাড়ির নিচ থেকে কাজের লোকগুলোর সরগোল শোনা যাচ্ছে… সুমন অপলক চোখে ঘুমন্ত রাজপুত্রকে দেখতে থাকে। সেদিন অমন দুম করে ওর হাত উঠে গিয়েছিলো বলে রাগে আর একবারও ফোন করেনি ওকে শ্রীমান শ্রাবন চৌধুরী। মনে মনেই নিজের হয়ে ওকালতি করে সুমন, বেশ হয়েছে.. অমন করলে এরকম দু এক ঘা পড়াই উচিত,রাক্ষস একটা।
শ্রাবণের খাড়া নাকের একপাশটা দেখা যাচ্ছে আবছা, মুখের অর্ধেকটা বালিশে ডুবে আছে, রেশমের চুলগুলো ফুলে ফেঁপে বালিশের উপর ছড়ানো… সুমন হাত বাড়িয়ে আলতে করে মুঠো করে ধরে…
সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে উঁকি দিয়েই হারিয়ে যায় সুমনের,তারপরই ঝরঝর করে করে কেঁদে ফেলে।
“প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ,
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ।”
.
.
.
শ্রাবন উঠে বসার পরও কিছুক্ষন ঝিম মেরে তাকিয়ে থাকে, আবারও ভালো করে দেখে। না… কোথাও নেই। চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, কয়েকটা মশা পুন পুন করছে ওর কানের কাছে কিন্তু শ্রাবণের ইচ্ছাও করে না মারতে।
ওর কেবলি মনে হতে থাকে সুমো এসেছিলো ওর ঘরে। কিন্তু আসলে ওকে না বলে চলেই বা যাবে কেন? তারপর মনে হলো সুমো ওর ঘরে আসার কোন কারন নেই আসলে, যা দরকার সেগুলো তো এখন আদিত্য খুব ভালই সাপ্লাই দেয়। গাড়িতে লিফটও দেয়, শ্রাবণের কাছে আসার আসলেই আর কোন দরকার নেই সুমোর।
তারপরও ফোনটা আরো একবার দেখে শ্রাবন, যদি সুমো ফোন করে। কিন্তু না… আজকাল সুমোর, শ্রাবণের প্রয়োজন হয়তো ফুরিয়েছে তাই ওর আদর, ভালোবাসা সবই অসহ্য লাগে।
সুমনকে বাসায় ঢুকতে দেখে মঞ্জুর মেজাজ খারাপ হলো। আদিত্য ছেলেটা সেই কতক্ষন ধরে বসে আছে ওদের অনুজের হোটেলে নিয়ে যাবে বলে আর মহারানী সেই বিকেলে গিয়ে এখন কানা রাত করে এলো।
শ্রাবনকে হালকা নাড়াচাড়া করতে দেখেই জানালাগুলো টেনে দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে এসেছে সুমন। মশাগুলো তখনও উড়ছিলো কিন্তু শব্দ হবার ভয়ে মারতে পারেনি সুমন, কেবলই মনে হচ্ছিলো মশারিটা টাঙ্গিয়ে দিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো।
“বলি আরো খানিক থাকতি ও বাড়ি… এতো সকাল সকাল আসলি কেন? ”
মামীর কথাগুলো ফলার মতো সুমনের কানে এসে বিঁধতে লাগলো। কিন্তু কি নিয়ে মামী হঠাত এতো ক্ষেপে গেলো বুঝতে পারলনা সুমন। চৌধুরী বাড়িতে তো ও আজ নতুন করে যাচ্ছেনা। বরঞ্চ গত দেড়মাস ধরে ওর স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিক ছিলো। এই যে আজ এতোক্ষণ ও বাড়িতে থেকে এলো, এখন একটু ঠিকঠাক লাগছে ওর… শান্তি লাগছে।
সুমনকে উদ্ধার করতে প্রীতি এসে বীরেনবাবুর কথা বলে সুমনকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলো। শ্বশুর ডাকছে শুনে মঞ্জু তিক্ত চোখে একবার সুমনের দিকে তাকিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেলো হাত ব্যাগটা নিতে।
অনুজকে কি করে বাসায় ঢোকাবে সেই চিন্তায় মঞ্জুর ঘুম হয়না। প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছে নিয়ম করে দু’বেলা।
কি সুন্দর ফর্সা টকটকে একটা বউ এনেছে তার ছেলে তার জন্য অথচ এই শ্বশুরের জ্বালায় নিজের জানের টুকরোটাকে সে বাসায় ঢোকাতে পারছেনা। অনুজকে রেখে কিছু খেতেও মঞ্জু পারছেনা ভালো করে।
“ওমা চলো.. আদি ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে,” ছোট ছেলে ডাব্বুর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হলো মঞ্জু।
সুমনকে না দেখে একটু থম মেরে রইলো আদিত্য। বেশ অনেকটা দিন হয়ে গেছে, কিন্তু সুমন এখনো নিশ্চুপ। আদিত্য বাড়ি যাওয়ার আগে একদম সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিলো সুমনকে কিন্তু সুমন ওকে কিছু না বলেই চলে এসেছিলো। আদিত্য দ্বিধায় ছিলো যে, সুমন ওকে না বললো না লজ্জা পেলো। কিন্তু সুমনের আচরন ওর কাছে গোলকধাঁধার মতো লেগেছিলো আর আজও তাই। তবে হ্যাঁ সুমন কখনই গায়ে পড়ে ওর সাথে কথা বলেনা, সৈজন্যমূলক দুই একটা কথাতেই আলাপ সাড়ে কিন্তু এতে আদিত্যর তৃষ্ণা আরও বাড়ে। সুমনকে খুব কাছ থেকে জানতে ইচ্ছা হয় ওর, সুমনের পছন্দ, অপছন্দ সব।
মামীরা বের হয়ে গেলেই সুমন ঘরে দরজা দেয়। ওর আর সহ্য হয়না। কি এমন পাপ সুমন করেছিলো যে এতো দুঃখ ওর পাওনা। বরাবরের মতোই মায়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সুমন।
চলবে…..