তোমার পরিনীতা পর্ব ৪৩+৪৪

তোমার পরিনীতা – ৪৩

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

বিয়ের নতুন পাঞ্জাবিটা গায়ে পরতে পরতে বাইরে এসে দাড়াল শ্রাবণ। চোখে মুখে তখনও অপর্যাপ্ত ঘুমের চিহ্ন, আরো ঘুম প্রয়োজন ছিলো ওর।দুপুরে ভরপেট খেয়ে বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে গড়িয়ে পড়েছিলো ওর চোখের উপর, সুমোর সাথে একটা কথা ভালো করে বলতে পারেনি আর ঘুমে ঢলে পড়েছিলো। আসলে শান্তি করে ঘুমায়নি তো ও বহুকাল।

দরজা খুলতেই প্রীতি আর আদিত্যকে সামনে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে বোকার মতো একটু হাসলো শ্রাবণ। লজ্জা আর অনুশোচনা দুটোই হচ্ছে ওর কাল থেকে। নিজের বেয়ারা রাগের উপর নিজেই যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছিলো ও, সুমোরও হবে এটাই স্বাভাবিক।

“শ্রাবনদা, সুমনদি কোথায় বলতে পারো? ” প্রীতির প্রশ্ন শুনে মাথা চুলকাতে লাগলো শ্রাবণ। আসলেই তো সুমো কোথায় ?

“মায়ের ঘরে আছে কিনা দেখতো প্রীতি ,আমি একটু শুয়েছি আর অমনি চোখ লেগে এসেছিলো , সুমো যে কখন ঘর থেকে বেরিয়েছে জানিই না।”

শ্রাবণের উত্তর শুনে প্রীতি সোজা নির্মলার ঘরে চললো। আদিত্যও যাচ্ছিলো প্রীতির পিছু পিছু কিন্তু শ্রাবণ পেছন থেকে ডেকে উঠায় থামতে বাধ্য হলো।

এই প্রথম শ্রাবণের চোখে মুখে আদিত্যর জন্য ঈর্ষার কোন ছায়া ছিলোনা। আদিত্য ঘুরে এসে শ্রাবণের মুখোমুখি দাড়াতেই শ্রাবণ লজ্জাটে ভঙ্গিতে গতদিনের ব্যবহারের জন্য আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইলো, এমনকি শেষ পর্যন্ত আদিত্যর সাথে কোলাকুলিটাও করে ফেললো টুক করে। শ্রাবন আসলে সত্যিই খুব লজ্জিত।

” আসলে আমি জানতাম না যে আপনারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করেন। তাহলে কখনোই এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে অপ্রস্তুত করতাম না, আর নিজেও এভাবে ভরা মন্ডপে অপদস্ত হতাম না,” আদিত্য বলে উঠে।

” তার মানে? ” শ্রাবন অবাক হয়ে জানতে চায়, ভরা মন্ডপে!

” সে অনেক কাহিনী, তবে ভাগ্য ভালো যে দি আমাকে বলেছিলেন সরাসরি তার অসম্মতির কথা। নাহলে হয়তো অন্য কেউ ঘটনাটা চাপিয়েই আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতো আর তখন আমরা সবাই সারাজীবন জ্বলে পুড়ে মরতাম,” আদিত্য হাসার চেষ্টা করে। সেদিনের স্মৃতিগুলো বড়ো দুঃসহ ছিলো ওর নিজের জন্য, যদিও আজকের এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ওকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে প্রীতি।

” হমম… আসলে সব দোষ আমার, আমি সুমোকে বলার কোন সুযোগই দেইনি, এই বেয়ারা রাগটা আমার.. একদম অন্ধ করে দেয় নিজেকে,” দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা যেন নিজের হঠকারিতার প্রমান দিতেই শ্রাবণের বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে।

আদিত্য উত্তর না দিয়ে কাষ্ঠ হাসি হাসে। সামনে দাড়ানো এই বিদঘুটে লোকটার জন্য সুমন ওর জীবনে আসেনি, প্রায় অবুঝ প্রীতিকে জেনেশুনেই গলায় মালা দিতে হয়েছে। সূক্ষ্ম একটা হাহাকার কি এখনো রয়ে গেছে নিজের অজান্তেই… আদিত্য ঠিক জানেনা তবে প্রীতিকে বড্ডো ভালোবাসে এখন সে। তাই সুমনও তার স্বামীর সংসারে সুখি হোক এটাই চায় সে।

.

.

.

একে বাসর রাত বলে কিনা জানা নেই তবে,
সুমনের অভিমানে ঘেরা মুখটা দেখে শ্রাবণ জোর করেই ওর হাতটা নিজের মুঠিতে ধরে বসে রইলো সারারাত। সুমন বার কয়েক জোর করে হাত ছাড়াতে গিয়ে ব্যার্থ হয়ে এখনো ওভাবেই হাত রেখে বসে আছে, মাঝে শুধু গঙ্গা- যমুনা বয়ে গিয়েছে নিরন্তর। শ্রাবণ চাইলেও সেটা মুছে ফেলার সাহস পায়নি। কে জানে কত-শত দুঃখের কান্না এটা, সব শ্রাবণের দোষে মানছে ও কিন্তু তাও তো সুমো বশ মানছে না।

” হাত ছাড়ো সকাল হচ্ছে, আমার কাজ আছে,” সুমন দৃঢ় স্বরে বলে উঠে।

” আগে বল তুই আমার উপর আর রাগ ধরে রাখবিনা, মনে যা আছে বলে রাগ ভুলে যাবি,” আদুরে আবদার জানায় শ্রাবণ।

” আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না,ছাড়ো, ” সুমন সুযোগ পেয়ে এক ঝটকায় হাতটা এবার ছাড়িয়ে নেয়।

শ্রাবণ হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কি বললে, কি করলে ওর পাপমোচন হবে কেউ যদি একটু বলতো তাহলে ও নির্দ্বিধায় সেটা করতো এখন, কিন্তু বউ ওর মুখ খুলতেই রাজি না।

এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও একই ঘরের মধ্যে দুজনের দূরত্ব যেন আকাশ সমান, বুকের ভেতরের দুঃসহ যন্ত্রনা অজগর সাপের মতোই প্রকান্ড থেকে প্রকান্ড আকার ধারন করতে চাইছে । শ্রাবণ যতো এগুতে চায়, সুমন ততোই নিজেকে গুটিয়ে নেয়… কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার পরও সুমোর কিসের এতো অভিমান তার তল খুঁজে পাওয়া শ্রাবণের কাছে অসম্ভব মনে হতে থাকে।

“আমি চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে চাই,ওখানে বাচ্চাদের একটা স্কুলে আমি পড়াতাম।”

কথাটা বলেই সুমনের মুখ আবার বন্ধ।

মনে হয় শ্রাবণ একটা বোবা মানুষের সাথে সংসার করছে। সুমন কেন যেন শ্রাবণের জন্য ওর মনের দরজা জানালা সব বন্ধ করে রেখেছে। কি করলে এই অসহ্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

এর পরে শ্রাবণ আসলে কি উত্তর দিবে খুঁজে পায়না। সুমন ওর টাকা নিতে চায়না এটা ও এই কদিনেই বুঝে গেছে কিন্তু স্বামীর দায়িত্ব তার স্ত্রীর ভরণপোষণ করা আর শ্রাবন তো কোন সম্পর্ক ছাড়াই সেটা বহুকাল ধরে করে এসেছে, তাহলে আজ কেন? সুমো চাকরি করলে ওর আপত্তি নেই কিন্তু ওর পয়সা নেবে না সেটা ও মানতে পারবেনা। সুমোর জন্য ওর আলমারির দেরাজটা এখনও এখনো খোলা।

মনে মনে এবার একটু রাগ আর বিরক্তির উদ্রেক হয় শ্রাবণের। সুমো কি মাত্রা ছাড়াচ্ছে না? আর সব দোষ শ্রাবণ নিজের ঘাড়ে নিয়েছে কিন্তু সুমোরও কি দায়িত্ব ছিলো না ওর ভুলটা ভাঙ্গানোর? মাকে নিয়ে বাইরে থেকে আসার পর শ্রাবণ নিজে কি সুমোর কাছে ছুটে যায়নি? তখন সুমো কেন ওরকম অদ্ভুত আচরন করেছে ওর সাথে যার ব্যাখা সুমো আজও ওকে দেয়না। জিজ্ঞেস করলে শুধু কথা এড়ায়…

………………………….

নির্মলা রান্নাঘরে ঢুকেই একগাল হাসলেন। বন্দনা এবাড়ির বড়ো বউ হলেও রান্নাঘর থেকে একশ হাত দূরে থাকতে পছন্দ করে। রান্না-বান্নার প্রতি আসলে কোন রকম আগ্রহ বন্দনার নেই। সে শৌখিন মানুষ , সুন্দর করে ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে। নিজেকে টিপটপ রাখতে পছন্দ করে।

নির্মলা তাই বন্দনার হাতে ঘর গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন নিশ্চিন্তে। মনে হলেই বন্দনা নতুন নতুন ফার্নিচার, শোপিস, বেড কাভার,পর্দা এসব কিনে এনে চৌধুরী বাড়ির নতুন চেহারা দেয়। সব সময় জিনিসগুলো নির্মলার রুচিমতো না হলেও বন্দনা কেবল নিজের জন্য নয়, বাড়ির সবার জন্যই কাজগুলো আগ্রহ করে করে, তাই শাশুড়ি বউতে কোন বিরোধ হয়না। কিন্তু এতোকাল পরে বুঝি এখন এই ছোটবউয়ের সাথে বিরোধ ঘটতে যাচ্ছে নির্মলার, এতোদিনে মেয়েটা ওকে রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে ছুটি দিতে চাচ্ছে।

“সুমন তুই আবার এসে এই গরমের মধ্যে ঢুকেছিস, ছোট দেখলেই চিল্লাতে শুরু করবে কিন্তু, ” অসন্তুষ্ট স্বরে কথাগুলো বলেন নির্মলা।

সুমন শাশুড়ির কথায় হেসে আবার কাজে মনোযোগ দেয়। গুনের ঘাট নেই তার, অসভ্য ধরনের একটা মানুষ, এ কাজ সে অনায়াসেই করতেই পারে তাতে কোন সন্দেহ নেই সুমনের।

” হাসিস না তো, তুই যা দেখি এখান থেকে, ঘরে গিয়ে ভালো করে স্নান করে নে,” নির্মলা রাগ করেন, নতুন বৌ… ওকে কে বলেছে এসে হাড়ি ঠেলতে?

” ডালে ফোড়নটা দিয়ে নেই বড়োমা তারপর যাচ্ছি,” সুমন জবাব দেয়।

” আবারো বড়োমা, কতোবার করে বলছি এখন থেকে মা বলবি! ” নির্মলা তেড়ে আসেন।

” অভ্যাস যে, আস্তে আস্তে ঠিক হবে। ওকেই এখনো শ্রাবনদা বলি, “বলেই সুমন জিভ কাটলো। শাশুড়ির সামনে একথা বলা বোধহয় ওর ঠিক হলোনা।

কিন্তু নির্মলা যা বললেন তাতে সুমনের মুখ নয় শুধু কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেলো।

“সে তোরা পারিস বটে, দুটোতে জোট করে কি বুদ্ধি পাকিয়েছিস… ঘুনাক্ষরেও টের পেলামনা যে তলে তলে তোরা এই অকাজ করে বসে আছিস, সোজা বিয়ে। বলি আমাকে বললে কি আমি না করতাম না কি ? ”

সুমনের হাতের বাটিটা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, আজ রামনাথ বেঁচে থাকলে এখনো কি ওকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতেন? সুমন শাশুড়িকে কিছু বলার সাহস পায় না।

নির্মলা আর কিছু বলেন না, মুচকি হেসে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। ছোটকে বলতে হবে সুমনকে নিয়ে দুদিন কোথাও ঘুরে আসতে, মেয়েটা এতোদিন অনেক কষ্ট করেছে তবু মুখ ফুটে কোন দাবী করেনি। আদিত্যকে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারতো কিন্তু তার বদলে একা একা সব অপমান আর কষ্ট সহ্য করেছে, শ্রাবণের উচিত সুমনের ইচ্ছেগুলোকে খুব বেশি করে সম্মান দেখানো।

.

.

.

সুমন অনেক চেষ্টা করেও হাতপাখাটার নাগাল পাচ্ছিলো না।

বারে বারে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে, আইপিএসটাও ঠিকঠাক কাজ করছে না, না পেরে কোমরের কাছে শাড়ির আঁচলটা খুব ভাল করে পেঁচিয়ে গুজলো সুমন। এবার একটু লাফিয়ে হাতপাখাটা ধরতে গেল কিন্তু হাড়বজ্জাত পাখাটা ওর সাথে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে, ওর হাতের ধাক্কায় ওটা উল্টো ওর হাতে না এসে ঘুরে আলমারি আর দেয়ালের খাঁজের মধ্যে ঢুকে ঝুলতে লাগলো।

সুমন রাগ হয়ে দেয়ালে মাথা কুটতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই হঠাত ওর পা মাটি থেকে সরে গিয়ে আকাশে উঠে গেলো, পুরো আলমারির মাথাটা ও এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

“নে এবার দেখ..”

শ্রাবণ, হাঁটুর কাছে ধরে সুমনকে এমন ভাবেই উঁচু করে ধরেছে যে এখন আলমারির উপর একসাথে তিন তিনটা হাতপাখা নজরে পড়ছে সুমনের।

“মাগো,ছাড়ো… ছাড়ো বলছি। বলা নেই কওয়া নেই অমন হুট করে মানুষ কাউকে উপরে তুলে? আমার মাথা ঘুরছে,” সুমন, শ্রাবণের দু’কাঁধে হাত রেখে কোনমতে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখছিল,কিন্তু শ্রাবণ, সুমনের কোন কথাতেই কর্ণপাত করলো না।

” আমি তুলি, এখন কি পাড়ছিলি উপর থেকে ওটা নামা তাড়াতাড়ি।”

” কি করে পাড়ব? তালগাছের মতো এক পায়ে দাড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে… আলমারির ছাদ থেকে এক হাত উপরে আমি,” সুমন মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে, সত্যি ও এখন আকাশে উঠে আছে।

“ওহ,আচ্ছা দাড়া নামিয়ে দিচ্ছি ”

“মাগো…” সুমন হঠাত চেঁচিয়ে উঠে।

” কি হলো, “অবাক হয়ে জানতে চায় শ্রাবণ। সে তো খুব সাবধানেই নামাল।

” কিছু হয়নি, ” বিরবির করে বললো সুমন। ও কি করে বলে অমন জাপটে ধরে নামালে দাড়ির ঘষায় ওর পেট জ্বলে পুড়ে যায়, বললেই উল্টো ইতরামি শুরু করবে। কিন্তু সুমন সেটা চায়না, কেন যেন শ্রাবণ যতো সহজে নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছে ততো সহজে সুমন ওকে ক্ষমা করে দিতে পারছেনা। ঠিক কিংবা ভুল কিন্তু সুমনের মনে অভিমানের পাহাড় জমেছে, সেটা ও চাইলেই মন থেকে দূর করতে পারছেনা।

” এই তোর হলো?” শ্রাবন হালকা ঝাঁকুনি দিলো। সুমনের গায়ের গন্ধে কেমন বুক ভরে আসে ওর, সদ্য ফোটা রজনীগন্ধার সৌরভ… শ্রাবণের কেমন মাতাল মাতাল লাগে।

” হ্যাঁ, কিন্তু শ্রাবণদা… ওখানে আরো দুটো পাখা আছে কিন্তু বড্ডো ময়লা, ” সুমন তখন মনোযোগ দিয়ে পাখা দেখছে।

” তুই ফের আমায় দাদা ডাকছিস? ”

” ইশশ.. “সুমন জিভ কাটল। “ভুলে হয়েছে কিন্তু হয়েছে তো হয়েছে, বেশ করেছি… তুমি দাদা ছিলে বেশ ছিলে এখন একদম বাজে হয়ে গিয়েছ।”

“কি বললি আমি বাজে?”

শ্রাবণ জোরের সাথে সুমনকে বুকের সাথে আকড়ে ধরে। আজ বহু বছর পর মনের টানপোড়নের সাথে সাথে আবেগের ঢল নেমেছে, সুমনকে এখন ওর চাই, পুরোপুরি একদম নিজের করে।

চলবে………
তোমার পরিনীতা – ৪৪

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

হেমন্তের বিকেলটা কেমন যেন মন খারাপের রঙ জড়ানো, গায়ের চাদরটা গলা অব্দি তুলেও শীত শীত ভাবটা এড়ায় না সুমনের। কাল অবেলায় চুল ভিজিয়ে আজ সকাল থেকে শুধু নাক দিয়ে পানি গড়াচ্ছে ওর। সেই থেকে এ পর্যন্ত নির্মলা ছয়বার চা করে দিয়ে পাঠিয়েছেন কিন্তু শ্রাবণের মনে হচ্ছে মেয়েটার এবার জ্বর আসলো বলে।

” তুই কথা কেন শুনিস না বল দেখি, কাল অত বেলা করে গুষ্টিশুদ্ধ সবার ভাত রাঁধতে কে বলেছিলো, তাও আবার একশ পদ করতে হবে, ভারী এক রান্না শিখেছেন উনি,” শ্রাবণ অভিযোগ করতেই থাকে, আসলে সেই সকাল থেকেই করছে।

কিন্তু সেই একই অবস্থা, শ্রাবণ নিজের মতো করে এক পাথরের দেয়ালের সাথে বকে চলেছে, কারো তাতে কিচ্ছুটি এসে যায় না। সুমন শুধু ওর কথা শুনে, কখনো কোন উত্তর দেয় না। বাইরে থেকে মনে হবে সুমন এখন বড়ো হয়েছে, সমঝদার হয়েছে কিন্তু আদতে শ্রাবণ জানে, সুমন ওর উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। মৌন প্রতিশোধ, প্রতি মুহুর্তে তিল তিল করে ওকে কষ্ট দিচ্ছে আর শ্রাবণ জানে এই তিল থেকেই একদিন তাল হবে। কেমন রঙ মিলিয়ে যাওয়া বাষ্পের মতো অনুভূতিহীন হয়ে গেছে ওর আদরের বউটা, মোহনার কথাগুলো মনে হয়…’ তুমি তো মন পড়তেই জানো না। ‘

সত্যিই তো, শ্রাবণ তো মন পড়তেই জানে না। নাহলে এতোবড়ো ভুল ও করলো কি করে? কিন্তু ওর সাজার মেয়াদ কতোদিন, সেই শাস্তি আর কতো ভারী?

সুমনের মনে হয় আজকাল বসে থাকলেও ওর মাথা ঘুরায়, হাতড়ে হাতড়ে ঘরের সাথের লাগোয়া বাথরুমটাতেই গিয়ে দাড়ায় ও। থেকে থেকে বমি পাচ্ছে খুব কদিন থেকে, গলায় চিরবিরে কিছুর অনুভব, তারপরই চারপাশটা একদম অন্ধকার হয়ে আসে সুমনের।

“এতোক্ষন কি করছিস, অ্যাই সুমো? ”

ভারী কাঠের দরজাটা ঠকঠক শব্দ করে কেঁপে উঠে।

সুমনের দম মারা ভাবটা কাটে, কেমন এক ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলো ও… খেয়ালই নেই যে কল থেকে জল তখনও গড়িয়েই যাচ্ছে। তোয়ালটা মুখে চেপে ধরে বের হয়ে আসে ও।

লক্ষ্য করে শ্রাবণ চেয়ারে বসেই ওকে তেরছা চোখে দেখছে।

বিয়ের দু’মাস পেরিয়ে গেলেও সুমনের গায়ে মাংসের চেয়ে হাড়র সংখ্যা বেশি দেখায় এখনো। অথচ আগে হালকা পাতলা থাকলেও কখনই এমন রুগ্ন দেখাতোনা সুমোকে। খচ করে যন্ত্রনাটা খোঁচা মেরে জানিয়ে যায় সব ওর দোষ, ওকে যন্ত্রনা দিতে মহারানী কিছু মুখে তুলেন না।

“এতোটা সময় বাথরুমে কি করলি?”

” মুখ ধুলাম, ” সুমন অনিচ্ছার সাথে উত্তর দেয়, শ্রাবন শুধু অহেতুক প্রশ্ন করে আজকাল।

” সেতো আমিও দেখছি, কিন্তু শুধু মুখের চামড়া ধুলি না মুখের হাড় মাংস সব আলাদা আলাদা করে খুলে তারপর ধুলি? ”

সুমন উত্তর দিলো না, ওর আজকাল অযথা কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়না একদম। শ্রাবন তো জানেই ও কি করে তারপর অযথা কেনো ওকে নিয়ে খোঁচান। ও তো শ্রাবনকে বিয়ে করতে সাধেনি… কেন শ্রাবণ গায়ে পড়ে ওকে নিজের জীবনে টেনে আনলো, বেশ থাকতে পারতো লাবন্যদিকে বিয়ে করে।

” কিরে চুপ করে রইলি কেন?”

কিন্তু সুমনের কিচ্ছু বলতে ইচ্ছে করেনা। এই চার বছরে ও বদলে গেছে না নতুন করে জন্মেছে জানেনা সুমন।

” সুমো আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। এরকম চুপ করে থাকলে আমার মেজাজ গরম হয়, আমি তো বলছি আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। কিন্তু সেই রাগে তুই না খেয়ে খেয়ে নিজের এই হাল কেন করবি? আমাকে শাস্তি দিতে? ”

” আমার খেতে ইচ্ছে হয়না…।”

ব্যাস কথা সব যেন ফুরিয়ে গেলো।

সুমনের খেতে ইচ্ছা হয়না.. এটাও এখন শ্রাবনকে মেনে নিতে হবে। যে মেয়ে পিজা, বার্গার, চটপটি শুনলে লাফাতে লাফাতে চলে আসতো তার খাবারের প্রতি এতো অনীহার কারন শুধুমাত্র শ্রাবণের অন্ধ রাগ আর অবিশ্বাস। বুকের মধ্যে একটু টনটন করে বৈকি… শ্রাবণের ভালোবাসায় তবে কি খাদ ছিলো কোন ?
.

.

.

মায়ের কথায় শ্রাবণ আনন্দ করবে না অভিমান ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। শরীর প্রচন্ড রকম খারাপ দেখে নির্মলা সুমনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার অনেকগুলো পরীক্ষা করে বলে দিয়েছে, পেটের বাচ্চা বাঁচাতে হলে সুমনকে খুব ভালো করে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ওজন বাড়াতে হবে, না হলে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

শ্রাবণের এই এত্তো আনন্দ হচ্ছিলো খবরটা শুনে কিন্তু সুমোটার উপর খুব রাগও হচ্ছিলো। এতো রাগ কেন এই মেয়েটার মনে ?

কিন্তু বাড়ি এসে সুমনের চেহারা দেখে শ্রাবণের সব আনন্দ কেমন মিইয়ে যায়। সুমনের চোখেমুখে কোন উত্তেজনা, কোন চমক নেই। পাথরের মতোই দুর্ভেদ্য এক দেয়াল দু’জনের মাঝে। শ্রাবণের ইচ্ছেতে এই পাথরের গায়ে কোনদিন ফুল ফুটবে কি?

…………………………………

প্রেগনেন্সির পুরো সময়টা কেমন এক ইঁদুর- বেড়াল খেলার মতো করে পার হয়। শ্রাবন পাহারা দিয়ে যতোই খাওয়ানোর চেষ্টায় লেগে থাকুক সুমন তার অভিমান নিয়ে অনড়, সুযোগ ফেলেই খাবার খায় না, ভিটামিন নেয় না, নিজের উপর অত্যাচার চলে তার পুরো দমে।

শ্রাবণের এক এক সময় অসহ্য লাগতো। ইচ্ছে হতো খুব করে ঝগড়া বাঁধায় আগের দিনের মতো। কিন্তু সুমো তো তার ধার কাছ দিয়েই যায় না।

.

.

ভোর থেকেই আজ চৌধুরী বাড়ির সবার মাঝে বেশ একটা টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বেলা আটটায় আজ সুমনকে হসপিটালে ভর্তি করা হবে । নির্মলা তাই আজ বড়ো বৌয়ের হাতে রান্নার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।

শ্রাবণকে ঠিক আটটায় সুমনকে ভর্তি করিয়ে কোর্টে ছুটতে হলো। বেছে বেছে আজই একটা গুরুত্বপূর্ণ কেসের ডেট পড়েছে, আজ এটা কোর্টে না উঠলে কেসটা আবার অনেকদিনের জন্য ঝুলে যাবে আর শ্রাবণ সেটা একদম চাচ্ছে না।

বাচ্চাটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে শ্রাবণের ইচ্ছা, পিচকু একটু হাত পা নাড়তে শিখলেই শ্রাবন ওদের নিয়ে বেড়াতে যাবে অনেকদিনের জন্য। এবার হয়তো সুমো আর মন খারাপ বেশিদিন ধরে রাখতে পারবেনা ওর উপরে।

কোর্টে ফোন সাইলেন্ট করার আগেও ডাক্তারের সাথে কথা হয় শ্রাবণের, ডাক্তার অভয় দেন কোন সমস্যা হলে অবশ্যই ওকে সব জানাবেন তিনি।

….…………..

শান্তনু ফোন দেয়ার আগেই শ্রাবণ এসে হসপিটালে ঢুকলো হুড়মুড় করে। ছেলেকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে একগাল হাসেন নির্মলা, তবে দুষ্টুমির লোভ সামলাতে পারেন না।

” ছোটকে আজ একদম ভিতরে আসতে দিবিনা শান্তনু… পাঁজি ছেলে, এতোক্ষণ পরে ওর দাদুমনিকে দেখতে আসার সময় হলো।”

” মা… আমি মোটেই দেরী করতে চাইনি, কিন্তু আজকের কেসটায় আমার উপস্থিত থাকা খুব জরুরি ছিলো, শেষ করে আসতে তাই দেরী হয়ে গেলো,” শ্রাবন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে জানায়। ওর চোখদুটো তখন মায়ের কোলের গোল প্যাঁচানো তোয়ালটার দিকে। আহ! ওখানে ওর রাজকণ্যা ঘুমিয়ে আছে।

” থাক বসে তোর কেস ধরে, আমার দাদুমনির কাছে একদম আসবি না। থাক যেয়ে তোর ওই সব কি বলে মামলার আসামী নিয়ে।”

” মা… সবাই শুধু আসামী হয়েই আসেনা,
আরো অনেক প্রবলেম নিয়ে আসে। প্লিজ, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও আর কোনদিন এমন হবে না।”

” ঠিক তো.. আর কক্ষনো এমন করবিনা।”

” আর কক্ষনো হবে না, কথা দিলাম।”

” আয় তবে, নিজের মেয়েটাকে দেখ,” নির্মলা এতোক্ষনে ছেলেকে কেবিনে ঢোকার ছাড়পত্র দেন।

শ্রাবণ কোর্টে থাকতেই খবর পেয়েছিলো সুমোর ডেলিভারি হয়ে গিয়েছে, সিজার করতে হয়নি। কাজ শেষ হতেই ও তাই প্রায় পাগলা ঘোড়ার মতো হাসপাতালের দিকে ছুটেছে।

মেয়েকে কোলে নিয়ে শ্রাবণ যখন সুমনের পাশে এসে বসে, সুমন তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। শ্রাবন ঝুকে আলতো করে সুমনের কপালে ঠোঁটটা চেপে ধরতেই সুমন নড়ে উঠে, চোখদুটিতে সুমনের রাজ্যের ক্লান্তি।

“না, না তুই ঘুমো.. উঠিস না।”

সুমন এক ঝলক দেখেই আবার চোখ বুজে।

শ্রাবণ তখন মায়াভরা চোখে ওর পুতুল টাকে দেখছে। কি আজব, আজ থেকে ও কারো বাবা.. কেমন একটা অনুভূতি। এতোকাল বড়ো হয়েও বাড়ির ছোট নামটা ওর দখলেই ছিলো যদিও দিব্যকে শ্রাবন এখন ছোটু ডাকে। কিন্তু আজ থেকে সেই দিব্যও বড়োদাদা হয়ে গেলো।

“কিরে বোকার মতো হাসছিস কেন ছোট, তোর মেয়ের চেহারা তো পুরো মায়ের মতো লাগছে।”

” মায়ের নাতুবুড়ি মার মতো হবে নাতো কার মতো হবে… বলো,” শ্রাবন মেয়েকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। ওর সন্তান, কেমন একটা মায়ার ঢেউ ওঠে।

” হ্যাঁ, তাও ঠিক। বড়ো হয়ে দিদুনকে আচ্ছামতো সাইজ করবি ঠিক আছে মামনি? ” শান্তনু আলতো করে নবজাতকের গালটা ছুঁয়ে দেয়। বড়ো করে একটা সোনার চেইন বানাতে দেয়া হয়েছে চৌধুরী বাড়ির এই নতুন অতিথির জন্য।

নির্মলা একটু দূর থেকে পুরো দশ্যগুলো মনের অ্যালবামে ধারন করতে থাকেন। রামনাথ হুট করে একদম না বলে কয়ে ওপারে চলে গেলেন। শ্রাবণের বিয়ের কোন কিছুও দেখে যেতে পারলেন না,অবশ্য ছেলের তার যে উৎপটাং কাজ কারবার। এরকম চুরি করে বিয়ে করেছে জানলে কি করতেন রামনাথ সেটাও ভাবার বিষয় ছিলো।

.

.

.

” এই নে ”

কাগজের একটা বড়ো প্যাকেট সুমনের হাতে ধরিয়ে দেয় শ্রাবণ।

“কি এটা? ”

“খুলেই দেখ।”

সুমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে হাতের সীল দেয় কাগজটার দিকে , তারপর ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে ” এই দলিলে আমার নাম কেনো? ”

“কারন বাড়িটা তোর নামে কেনা, এটা আজ থেকে তোর সম্পত্তি। ”

” কিন্তু বাড়ি আমার নামে হবে কেনো? ”

” আমি চেয়েছি বলে,” শ্রাবন ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে।

“এটা ঠিক না, তোমার জিনিস তুমি চাইলে যাকে ইচ্ছে তাকে দিতে পারো কিন্তু আমাকে এসব থেকে দূরে রাখো প্লিজ, আমার এসব কিছু চাইনা।”

শ্রাবণের ভিতরে রাগটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। সুমোর রাগ কি কোনদিনো যাবেনা? মেজাজ দুম করে আজ ওর মাত্রা ছাড়া হলো।

“সুমো বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু এবার। আমি এই এক বছরে তোর কাছে হাজার বার ক্ষমা চেয়েছি, কিন্তু তুই নির্বিকার। বিছানায় তুই একটা কাঠের পুতুলের মতো পড়ে থাকিস। আমি তাও মেনে নিয়েছি, যে হয়তো একদিন তোর অভিমান ভাঙ্গবে। কিন্তু এখন এতোদিন হয়ে গেলো, অনিন্দিতা হওয়ার পরও তুই অস্বাভাবিক। কেন? কিসের এতো রাগ তোর।”

” আমার কোন রাগ নেই।”

” সুমো মেরে আজ তোর আমি গাল ফাটাবো আর একটিবার এই কথা বললে। তুই আমাকে কোনটা জেদ আর অভিমান চেনাতে আসিস। মনে রাখবি এই আমার হাতেই বড়ো হয়েছিস তুই, মাঝখানে তিন চার বছর কি গিয়েছে তার জন্য সারাজীবনের জন্য জ্ঞানী হয়ে যাওনি তুমি।”

সুমন কি একটা বলতে যেয়েও থেমে যায়। শ্রাবণকে রাগিয়ে দেয়া ওর উদ্দেশ্য নয়, ওর আসলেই এখন কিছু ভালো লাগে না… তবে বহুদিন পর আজ শ্রাবন ওকে তুমি বলে ডাকলো।

” কি হলো, চুপ করে গেলি কেন? কথা বল, আজ আমি তোর বস্তায় আর কতো অভিযোগ আছে শুনবো।”

“আমার কোন অভিযোগ নেই।”

” আলবাত আছে। সুমো… আমাকে খেপাস না আজ, অনেকদিন ধৈর্য ধরেছি কিন্তু আজ আমার সেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে।”

” আমার কিছু বলার নেই।”

” কিন্তু আমার আছে, তোর আমাদের মেয়েকে নিয়ে কি সমস্যা? ”

” সমস্যা! মেয়েকে নিয়ে আমার আবার কি সমস্যা? ” সুমন অবাক হয়ে জানতে চায়।

” সেটাই তো জানতে চাইছি। তুই অনুকে এমন ভাবে দেখভাল করিস মনে হয় তুই ওর মাইনে করা কাজের লোক। তার বাইরে ওর জন্য তোর কোন ইমোশনই যেন কাজ করেনা।”

সুমন অনেকদিন পর শ্রাবণের কথায় হেসে ফেললো মুখ নামিয়ে, ” আমার ইমোশনের আবার দাম আছে নাকি? যা হোক অনুর ভালেবাসার কোন কমতি হবেনা, ওর জন্য ওর পরিবারের লোকের ভালোবাসাই যথেষ্ট। ”

সুমনের কথাগুলো এমন যে শ্রাবণ না পারলো সইতে আর না পারলো গিলতে। সুমো এমন হয়ে গেলে কেনো… কোন যাদুমন্ত্রবলে ও ওর আগের সুমোকে ফিরে পাবে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here