তোমার পরিনীতা পর্ব ৩৯+৪০

তোমার পরিনীতা -৩৯

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

“তারমানে তোমার সুমো ম্যাডাম ভুলে আরেক জনের খাবার তোমাকে দিয়ে গিয়েছিলো?” মোহনা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো শ্রাবণের মুখে সুমনের খাবার পৌছে দেয়ার গল্প শুনে।

“হুমম… এতো বড়ো গাধী , ওর মামী কি বলেছে সুমো শোনেই নি, লাফাতে লাফাতে আমাদের বাসায় চলে এসেছিলো টিফিন ভর্তি খাবার নিয়ে।”

” কি আর করা তোমার মতো লোকের জিএফ একটু গাধী হবে এটাই স্বাভাবিক। ” মোহনা বলেই দূরে সরে দাঁড়ায়, বলা যায় না কপালে খারাবি থাকলে ওকেও চড় থাপ্পড় মেরে বসতে পারে শ্রাবণদা।

” তারমানে কি, আমি একটা গর্দভ ? ” শ্রাবণও একটু চটে গিয়ে জানতে চায়।

” সে কি কথা, না না তা নয়, আমি বুঝতে চাইছি তোমার মাথার কোন সাইডটায় প্রবলেমটা একটু বেশি… দাদাভাই? ” মোহনা মুখ টিপে তখনও হাসছে।

” মানে? ” শ্রাবণ, মোহনার এই আচরনে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় , সাথে দাদাভাই ডাকটা ওকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু নিজেরা দুই ভাই বলে একটা বোনের প্রতি শ্রাবনের বরাবরই ভীষন রকমের আগ্রহ ছিলো, সেজন্যই সুমো কাছে টানতে ওর সময় লাগেনি আর সেই সম্পর্কের ভবিষ্যত সব দিক থেকে শ্রাবনকে মানষিক ভাবে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে। মোহনার এতো আগ্রহের ডাকটা তাই শ্রাবণকে কেমন বিপর্যস্ত করে তোলে। মোহনাকে বিশ্বাস করাটা কি ওর জন্য ঠিক হবে? মোহনাও ওকে সুমনের মতো মাঝ নদীতে রেখে পালাবে নাতো?

” মানে তুমি খালি বোকার মতো ভালই বেসেছ আর গাড়লের মতো রাগ করতে শিখেছ, আর কিচ্ছু শেখনি। তোমাকে দিয়ে কিস্যু হবেনা, তোমাকে আমার সাদাতোর কাছে সপ্তাহখানিক ট্রেনিং করানো খুব জরুরি,” মোহনা বিজ্ঞের মতো রায় দেয়।

মোহনা যতো হাসছিলো শ্রাবণের রাগ ততো বাড়ছিলো। এতে এতো হাসির কি আছে সেটাই ও খুঁজে পাচ্ছিলো না মোহনার খিক খিক হাসি শুনে। শ্রাবণের অন্ধকার মুখটা দেখে শেষ পর্যন্ত হাসি সামলে আবারো মুখ খুললো মোহনা,” রাগ করছো কেন, তুমি একটা মেয়েকে ফুল গিফট করোনি কোনদিন আর দাবী করছো যে তুমি তাকে ভালোবাসো! ”

“আশ্চর্য ফুল দেয়ার সাথে ভালোবাসার কি সম্পর্ক? ”

“আলবাত সম্পর্ক আছে। একশর মধ্যে সাতানব্বই পারসেন্ট মেয়ে ফুল পেতে পছন্দ করে তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে আর তুমি নিজে বলছো সুমন প্রায় দিনই তোমাকে ফুল কুড়িয়ে এনে দিতো।”

“আরে সেতো আমি ফুল পছন্দ করি বলে।”

” ও দাদাভাই… তুমি তো মন পড়তেই জানো না, ও মেয়ে নিজে অবশ্যই ফুল পছন্দ করে। আচ্ছা মনে করো সে করে না, তাহলে কি দাড়ালো.. কেবলমাত্র তোমার জন্যই ও ফুল গাছ বুনে, তার যত্ন করে। তারমানে তোমার জন্য সুমনের মনে কতোটা জায়গা আছে বলো দেখি? ”

অনেকদিন পর শ্রাবন একটু থতমত খায়, এটা সত্যি সুমোর মতো কেয়ার ওকে বাড়িতে মা ছাড়া আর কেউ করেনা। কিন্তু ইদানীং তো সুমোর মোটে সময়ই হয়না ওর জন্য,বড্ডো বাড় বেড়েছে।

” কি হলো বলো?” মোহনা উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

” মোহনা তুমি সুমোকে চেনোনা, সুমো অনেক পাল্টে গেছে। ”

” হয়তো.. কিন্তু একটা মানুষ তো এমনি এমনি পাল্টায় না। কিছু না কিছু কারন থাকে তার পেছনে। তোমার উচিত সেই কারন গুলো খুঁজে দেখা। তারপর যদি তোমার মনে হয় যে, সুমন দোষী তো ঠিক আছে, ওর কাছ থেকে সরে আসো। পারলে ওকে শাস্তি দাও। অবশ্য সে শাস্তিতে তোমার স্বস্তি আসবেনা এটা আমি বুঝে গেছি।”

শ্রাবন আর কথা বাড়ায়না। এতো অল্পদিনের পরিচিতিতেই মোহনা অনেক বেশি কাছে চলে এসেছে ওর,আর এগুতে দেয়াটা শ্রাবণের কাছে ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। বেশি এগুলেই তারপর কাছের মানুষগুলো কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলে সম্পর্ক থেকে, তার চেয়ে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই ভালো। সম্পর্ক ভাঙ্গার চেয়ে বড়ো যন্ত্রনা এ জগতে আর নেই।

……………………………………

সুমন বার বার বলতে চেয়েও কথাগুলো বড়মার সামনে তুলতে পারছেনা। বড়মার মুখের দিকে চাইলেই মনে হচ্ছে ও ঠগ, জোচ্চোর। কিন্তু পুরো ঘটনায় শ্রাবণের ইচ্ছেটাই জোরদার ছিলো বেশি। কিন্তু ওই যে সুমন মেয়ে, ও অনাথ, ও গরীব… এই দোষগুলো ও নিজের গা থেকে সরায় কি করে? আর শ্রাবণের প্রতি ওর দুর্বলতা আকাশ সমান, সেখানে ওই লোভনীয় ডাক ও উপেক্ষা করতোই বা কি করে?

কিন্তু এখন সেগুলো সব শুদে আসলে উঠছে। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, সুমনের এখন সেই দশা। কেবল ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যতোদিন বহাল ছিলো ততোদিন কোন কিছুরই পরোয়া করতে হয়নি সুমনকে,কিন্তু আজকাল চুন থেকে পান খসলেও তাতে সুমন নিজের দোষ খুঁজে পায়।

সত্যিই তো… ও আগে ভালো না বাসলে শ্রাবনও হয়তো সম্পর্কের মধ্যে অনেক ফাঁক খুঁজে পেত। তখন সুমনকে বিয়ে করার মতো এতোবড়ো কান্ড হয়তো শ্রাবন সত্যি করতে পারতো না।

” কিরে সুমন, ওরকম ছটফট করছিস কেন? কোন সমস্যা হচ্ছে, পেট ব্যাথা করছে নাকি তোর, মুখ অমন আমশি হয়ে আছে কেন রে মা ?

সুমন এবার সত্যি সত্যি মরিয়া হয়ে উঠে বিয়ের কথাটা বড়মাকে বলার জন্য। একমাত্র বড়মাই পারে এখন ওকে বাঁচাতে, না হলে যে ওর জীবন পাপে ছেয়ে যাবে। কিন্তু বিধাতার মর্জি বোঝা দায়। হুট করে অসুরের মতো কোথা থেকে রামনাথ এসে ঢুকলেন বড় ঘরটার মাঝে।

“নির্মলা আমার সিল্কের একটা পাঞ্জাবি বের করে দাওতো দেখি।”

” সুমন মা তুই এই কাপড়গুলো একসাথে করে একপাশে থাক দেতো, আমি তোর কাকাবাবুর পাঞ্জাবিটা বের করে দিয়েনি।”

সুমন নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। রামনাথ ঘরের মধ্যে এসে দাড়িয়েছেন। আর বোধহয় ওর কথা বলার কোন সুযোগ রইলো না। শ্রাবন কোথায়, কেমন আছে সেটা জিজ্ঞেস করার অবসরটুকু সুমন পায়নি, সাহসেও কুলোচ্ছিলো না, আর এখন থেকে বোধহয় সেই সুযোগ ওর সারা জীবনের জন্য হাতছাড়া হলো। কাউকে অভিযোগ করারও ওর আর রাস্তা রইলো না, সব ওর এই পোড়া কপালে লেখা ছিলো।

পাঞ্জাবিতে চেইন লাগানো সোনার বোতাম লাগাতে লাগাতে আড়চোখে সুমনকে বার কয়েক দেখে নিলেন রামনাথ চৌধুরী। নির্মলার মুখ দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর আত্মতুষ্টির সাথে স্ত্রীকে তরল গলায় বলে বসলেন,” তোমার এই শাড়ির রংটা চমৎকার লাগছে, বড় বৌমা আর ছোট বৌমার জন্য এরকম রঙের দুটো শাড়ি কিনে রাখো সামনের পূজোর জন্য।”

নির্মলা নিজের শাড়িটা এক ঝলক চেয়ে দেখলেন। বেশ একটা কচি কলাপাতা আর লেবুরঙের মিশ্রন শাড়িতে, একে ঠিক কি রঙ বলে জানেন না তিনি। তাতে আবার ছোট ছোট সোনালি বুটির কাজ করা। এছাড়া পাড়টায় গাড় সবুজ রঙের লম্বা দাগের উপর লাল রঙের কলকি আঁকা। একেবারেই সাদামাটা, মোটেই আহামরি কিছুনা বাড়ির নতুন বৌয়ের জন্য।

তবে নির্মলা স্বামীকে এমন হঠাত প্রশংসায় প্রগলভ হতে দেখননি বহুদিন। পরিহাসের ছলেই তাই তিনিও বলে উঠলেন, ” তোমার ছোট ছেলের মতি গতির কোন ঠিক ঠিকানা নেই, কোন অপ্সরাকে যে তিনি চান, মেনকা না উর্বশী তা শুধু তিনিই জানেন। শেষকালে যদি কোন চাপা রঙের মেয়েকে ঘরের বৌ করে আনতে হয়, এ রঙ তখন তার গায়ে মোটেই খাটবে না। ”

” দুশ্চিন্তা করোনা শান্তনুর মা, এ বাড়ির ছোট বৌ যে হবে তার রঙ দুধে আলতা হতে হবে। কোন হেঁজিপেঁজি ঘরের নাম পরিচয় বিহীন মেয়ে এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবে না,” রামনাথ সতর্কবার্তা দিয়ে দিলেন।

কথাগুলো ঠিক কাকে লক্ষ্য করে বলা সেটা বুঝতে সুমনের মোটেই বেগ পেতে হলোনা, যদিও দুধে আলতা না হলেও সুমনের গায়ের রঙ মোটেই শ্যামবর্ণের নয়, আর নাম পরিচয়বিহীন তো ও একেবারেই নয়। কিন্তু বিষাক্ত কথার তীরটা যে ওর জন্যই বিশেষ করে ছোড়া সেটা একটা পাগলেও বুঝবে, সুমন হাতের কাপড়গুলো খামচে ধরে নিজের পড়ে যাওয়াটা ঠেকাল। আজ বিয়ে উপলক্ষে সবাই আদিত্যদের ওখানে চলে যাবে ওরা। সেখানেই একটা অল্প পয়সায় বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে মাস খানেকের জন্য। আসলে বিয়ের খরচটা সম্পূর্ণ আদিত্যই বহন করছে, তাই তার পরিবারের সব প্রস্তাবই অগ্রাধিকার পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর মঞ্জুমামীর পক্ষে সুমনের বিয়ের জন্য এমন প্রস্তাব ছাড়া সম্ভব ছিলো না, একেবারেই নিঃখরচার বিয়ে।

সুমন দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবছিলো আসলেই ওর চেয়ে অপয়া আর অভাগী বোধহয় দুনিয়ায় দুটো নেই। নিঃশ্বাসটুকুও সময় করে বেঈমানী করেনা ওর সাথে, দিব্যি বেহায়ার মতো হাওয়া খেয়ে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। যমদূত ওর কাছে আসা দূর, ওর চেহারার দিকে চাইতেও ভীষন অনিচ্ছুক।

রামনাথের এটা ওটা নাড়া দেখে শেষকালে নির্মলা, সুমনকে বাড়ি যেতে বলতে বাধ্য হলেন। সাংসারিক আলাপের মধ্যে বাচ্চা মানুষ না থাকাই ভালো, সাথে ঠিক কি কারনে কর্তা হঠাত এঘরে এসেছে বুঝে উঠতে পারছিলেন না নির্মলা।

অবস্থা বুঝে সুমনও আর কথা না বাড়িয়ে শ্বাশুড়িকে প্রনাম করে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এ বাড়িতে আর হয়তো কোনদিন আসা হবে না ওর। শেষ বারের মতো কিছু দিনের অলীক রাজপ্রাসাদটাকে ছুঁয়ে দেখার সাধটা এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো যে, একছুটে শ্রাবণের ঘরে এসে ঢুকলো সুমন। ঘরের প্রতিটা আসবাব যেনো ওকে হা করে চেয়ে চেয়ে দেখছিলো। জানতে চাইছিলো… এই বোকা মেয়ে তুই অমন করে কাঁদছিস কেন? আর সবার চেয়ে বেশি প্রশ্ন যেন ঘরের আলমারিটার। সে রীতিমতো অভিযোগ করে বসলো, সুমন আজকাল বড্ডো আলসে মেয়ে হয়ে গিয়েছে। একেবারেই দেখা সাক্ষাত করে না তার সাথে, টাকার আজকাল কোন মূল্য নেই নাকি?

সুমন মেঝেতে বসে হাপুস নয়নে কেঁদে কেটে কিছুটা সময় কাটাল, তারপর এক সময় ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা আবার আগের মতো ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। আসার সময় সুমনের হাতের মুঠিতে জড়ানো একটুকরো নীল কাপড় লুকিয়ে রইলো, শ্রাবন মাঝে মাঝেই এই রুমলাটা মুখ মোছার কাজে ব্যাবহার করতো।

“দুটি পাখি দুটি তীরে

মাঝে নদী বহে ধীরে
একই তরু শাখা পরে

ছিল বাধা লীলা ভরে
অজানা সে কোন ঝড়ে

ভেঙে নিল বাসাটিরে

বিধাতার আভিশাপ

নিয়তির হল জয়
ছিঁড়িল বীণার তার
মুছে গেল পরিচয়

ছিল যেথা আলো হাসি
ফুলদল মধু বাঁশি
আজি সেথা কিছু নাহি
বায়ু কেঁদে যায় নীড়ে।”

কথাঃ গিরিন চক্রবর্তী
সুরঃ কমল দাশগুপ্ত

………………………………………………..

” তুই আসবি জানলে আমি ওদের কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়ে রাখতাম। ”

মায়ের কথা শুনে শ্রাবণ বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে রইলো। হিসেব অনুযায়ী আজ ২২শে শ্রাবন , সুমনের সাথে আদিত্যর বিয়ে সেই হিসেবে দু’দিন আগেই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে হলো কি হলোনার চাইতে বড়ো বিষয় হলো যাওয়ার আগে সুমন নিজে এসে নির্মলার কাছে প্রনাম করে আশীর্বাদ নিয়ে গেছে তার স্বামীর জন্য। নির্মলাও প্রান ভরে আশীর্বাদ করে দিয়েছে নব দম্পত্তির জন্য, এখানে তাই কোন কিন্তুর আর কোন অবকাশ নেই।

শ্রাবণের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে, নির্মলা ছোট ছেলেকে আবার প্রশ্ন করতেই… শ্রাবন হনহন করে হেটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিলো। বাবুর মেজাজ গরম হলেই সে তার ডেরায় গিয়ে ঢোকে, সুমনের বিয়ের খবরটা এভাবে আঁতকা জানতে পেরেই যে এতো বিড়ম্বনার তৈরি, সেটা মনে করে নির্মলা হাসলেন। সুমনের বিয়েতে তাদের পুরো পরিবারেরই দাওয়াত ছিলো কিন্তু কয়েক ঘন্টার যাত্রা যেমন তেমন, রামনাথ এখন সমীরের নাম শুনলেই চির বির করে উঠেন। নির্মলা তাই ভয়ে ওদের ঠিকানাটাও মঞ্জুর কাছে শোনেননি, কেবল সুমনের বিয়ের উপহার হিসেবে বেশ কয়েক হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন সুমনের হাতে।
তোমার পরিনীতা – ৪০

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

“তোরা পারসিও? ” মিতুলকে প্যাম্পার্স পরাতে যেয়ে অমিয়র নাকানিচুবানি অবস্থা দেখে, শ্রাবন হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। মৌমিতা আর অমিয়র মেয়ে মিতুল। আজ তার এক বৎসরের জন্মদিন। তাই তার ড্রেসআপ আজ পরীর মতো, কিন্তু পরীর পাখা তো দূর… জামা কাপড় পরাতেই মৌমিতা আর অমিয়র ঘাম ছুটে যাচ্ছে।

“এতো দাঁত বের করিস না.. বিয়েটা একবার হোক, বাচ্চা তো দূর লাবন্যর প্যারা সামলাতে সামলাতেই তোর জান হালুয়া হবে,” অমিয় মেয়েকে এবার কোনমতে হাত মুঠিতে ধরে প্যাম্পার্সটা আটকাতে সমর্থ হলো।

” আমি এসব ফালতু ঝামেলাতে যাবোই না। মায়ের আবদার ছিলো বাবা মারা যাবার পরে সে সংসারের কাজ থেকে অবসর নেবে,সো বিয়ে করতে মত দিয়েছি কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা নো ওয়ে, ওসব আমাকে দিয়ে হবেনা,” শ্রাবণের কন্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ে।

“আগে বিয়েটা কর, তারপর বাচ্চা কি করে পালতে হয় তাও শিখিয়ে দিবো,”মৌমিতা হাসে। বহু কাঠখর পোড়াতে হয়েছে ওকে আর মাসিমাকে, শ্রাবণকে এই বিয়েতে রাজি করাতে। প্রায় চার বছর হয়ে গেছে সুমনের বিয়ের কিন্তু এই গারলটা এখনও সেই ধরে বসে আছে। তার সুমনের উপর অভিযোগ আর অভিমান মোটেই কমেনি, ওদিকে লাবণ্যও আশা ছাড়েনা। শেষমেশ এবার মাসিমা মরার দোহাই দেয়াতে গড়িমসি করতে করতে কোন রকমে হ্যাঁ বলেছে শ্রাবণ। কিন্তু মৌমিতা কেন যেন দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারেনি,কিছু একটা কারন তো ছিলো সুমনের এমন আচরনের যেটা হয়তো ওরা কেউ জানেনা। কিন্তু এখন ওসব পাস্ট টেন্স তাছাড়া লাবণ্যর খুশি মৌমিতার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সবসময়।

মিতুলের জন্মদিনের কেকটা কাটা হলো, সবাই যার যার মতো ফটোসেশনে ব্যাস্ত। মৌমিতা একদম হাওয়ায় উড়ছে মেয়েকে কোলে নিয়ে আর অমিয় ওদের পিছে পিছে। লাবন্য সোফায় বসে ওদের দেখছিলো। কবে ও আর শ্রাবন এমন ব্যাস্ত সময় পার করবে? বিয়ের তারিখটা অবশ্য কাছিয়ে এসেছে এবার সত্যি সত্যি। ভাবতেই দু’গালে ঈষৎ লালিমা ছড়ালো লাবণ্যর। অবশেষে শ্রাবণ বাবু ওর কাছে ধরা দিচ্ছে, তাও আবার স্বেচ্ছায়… ভাবা যায়!

সুজয়কে ঢুকতে দেখে শ্রাবণের খাওয়ার গতিটা স্তিমিত হয়ে এলো। আচ্ছা সুজয় আর ওর মধ্যে আদৌ কোন পার্থক্য আছে কি ? মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা দুটোই আসলে শব শুধু বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায়না। মাঝে মাঝে শ্রাবণের মনে হয়, এই যে আগুন বুকের ভিতরে অহর্নিশি ধিকি ধিকি করে জ্বলে, তার কিছু স্ফুলিঙ্গের তেজ বড়ো বেশি। সুজয়ের জ্বালাটা বোধহয় তেমন আর ওর নিজেরটা ছাইচাপা আগুন। সুজয়ের ব্যাথায় সবাই মলম দেয় আর ও জ্বলে জ্বলে অঙ্গার।

তবে সুজয়কে লাবন্য কখনো ঠকায়নি, কিন্তু সুমো… উহ এই নাম, এই নামটাই যতো যন্ত্রনার উৎস। একদম নির্মূল করে দিবে, একেবারে সমূলে উপরে ফেলবে সব স্মৃতি। লাবণ্যপ্রভাকে তাই ও স্বীকৃতি দেবে, ওর স্ত্রী, সন্তানের মা… সব। সুমো ওকে দেখাতে চেয়েছে নিজের বড়লোক স্বামী আর তার ক্ষমতার বহর, ঔ দেখিয়ে দেবে সুখী হওয়া কাকে বলে। বৈধতা অবৈধতার দায় যখন সুমোর ছিলো না মেয়ে হয়ে, শ্রাবণেরই বা এতো কি দায় পড়েছে সেটা খুঁচিয়ে উঠাবার? অন্তত মন ভাঙ্গার অপরাধ তো আর ও করেনি।

“আমাকে একটু বাসায় ড্রপ করে দেবে, বাবার এক জায়গায় কাজ ছিলো বলে ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়েছি বিকেলেই,” লাবণ্য এসে শ্রাবণের পাশে দাড়াল।

“হমম, আমার খাওয়া প্রায় শেষ। তোমার হলে এখনি বের হতে পারি।”

লাবন্য সাথে সাথে ওর পার্সটা আনতে ছুটলো মৌমিতার রুম থেকে। আসলে সুজয়কে দেখলে ওর ভারী ইরিটেশন হয়। এতো বেহায়া, লাবন্য ডিরেক্ট না করে দেওয়া সত্বেও ওর পিছ ছাড়ে না।

গাড়িতে শ্রাবণের পাশের সীটটা দখল করে বসতেই অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে যায় লাবণ্যর মন। চরম অশান্তির পর খুব বেশি শান্তির আভাস পাওয়া গেলে মনটা যেমন চনমনে হয়ে উঠে তেমন। লাবণ্যর খুব ইচ্ছে হয় শ্রাবণের কাঁধে মাথা রাখতে কিন্তু এতো খটখটে ছেলেটা, কবে ওর সাথে একদম সহজ হবে কে জানে? হাতটাও ছুঁতে দেয়না,আজব।

পুরোটা পথ কোন কথা নেই তবুও অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ছেয়ে থাকলো লাবণ্যর মন। বাড়ির গেটে শ্রাবণের গাড়ির হর্ণ শুনতেই দারোয়ান দরজা খুলে সরে দাড়ালো। শ্রাবণ যে এবাড়ির হবু ছোট জামাই সেটা এখন এবাড়ির সবারই জানা।

লাবণ্য গাড়ি থেকে নামতেই ফোনটা উৎকট ভাবে গুড়গুড় শব্দ করে বাজতে লাগলো শ্রাবণের। স্ক্রীনে তাকাতেই ওর ভ্রু দুটো একটু বাঁকা হলো। অভিজিৎ! এতোদিন বাদে অভিজিৎ কোথা থেকে ফোন করছে ওকে ?

“হ্যালো”

” শ্রাবন ”

“হ্যাঁ, বলছি।”

” আমি অভিজিৎ বলছি, আমাকে চিনতে পারছিস,আমরা একসাথে কোচিং করতাম বসুদার কাছে।”

” পারছি, এতোদিন বাদে হঠাত,” শ্রাবন জানতে চায়।

“আসলে একটা ইনফরমেশন দরকার ছিলো।”

” কি ব্যাপারে? ”

” আসলে একটা বাড়ি বিক্রি হবে, পজিশনটা তোদের বাসার আশপাশে, আমাকে একটু বাড়িটা সম্মন্ধে তথ্য দিতে পারিস। বাড়ির মালিক বীরেন বাবু বোধহয় তোর মতো উকিল ছিলেন, দেখতো ভাই একটু চিনতে পারিস নাকি? ”

শ্রাবণের মনে হলো অনেক অনেক দিন আগের কোন কাহিনী, যেখানে এক রাজা ছিল আর ছিলো এক রানী। ভুলেই তো গিয়েছিলো বেশ ওকে, আবার এতোদিন পরে কেন দুঃস্বপ্ন হয়ে আঘাত করতে আসছে সুমন? বীরেন বাবু বলতে তো সুমনের দাদুকেই চেনে ও।

লাবণ্য তখনও গাড়ির দরজা ধরে দাড়িয়ে, শ্রাবন হাতের ইশারায় জানিয়ে দিলো ও জরুরি ফোনে ব্যাস্ত তাই নামতে পারবেনা। লাবণ্য একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে পার্সটা সীট থেকে তুলে নিয়ে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে গেটের ভিতরে ঢুকে পড়লো। মেজাজটা মনে হলো ওর গ্যাস বেলুনের মতোই উপরে কেবল উড়ছে আর উড়ছে… শ্রাবন একদম রাস্তার কুকুরের মতো আচরন করে ওর সাথে, এতোদিন হয়ে গেলো তবু লাবন্য, শ্রাবণের মন পেলো না।

.

.

.

.

বাড়িতে ঢুকতে সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেলো শ্রাবণ। বাসায় কোথাও মাকে খুঁজে পেলনা। এই চার বছরে অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে চৌধুরী বাড়িতে। বাবার অবর্তমানে দাদাই এখন ওদের পারিবারিক ব্যবসাটা পুরোপুরি দেখে, বৌদি দিব্যকে নিয়ে ব্যাস্ত… এ বছরই তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে, বৌদি তাই নিয়ে সর্বদা ব্যাস্ত। শ্রাবণ দুপুরে বাড়ি ফিরে কদাচিত, নির্মলার হাতে তাই এখন অগাধ সময়। রান্নাবারার পরে তাই হয় একটু বই পড়ে বা টিভি দেখে সময় কাটান তিনি।

মাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে জোরে জোরে রাজুকে ডাকতেই উত্তর আসলো, “মা ও বাড়ি গিয়েছেন ছোট দাদাবাবু। ”

” ও বাড়ি! সেটা আবার কোথায়? ” গায়ের কোটটা অবহেলায় ছুড়ে মারলো শ্রাবন সোফার উপরে, মোজা খুলে জুতোতে ঢোকাতেই হাতটা থেমে গেলো।

” পাশের সুমন দিদিমনিদের বাড়ি, ওরা সব আজ সকাল সকাল এখানে চলে এসেছে।”

শ্রাবন নিশ্চল হয়ে বসে রইলো বিছানায়। সবাই এসেছে! সুমনের বিয়ের পরে কি কারনে জানে না শ্রাবন, তবে প্রীতিরা কেউ আর ফিরে আসেনি এখানে। তারপর থেকে ওই বাড়িতে এক স্কুলের শিক্ষক ভাড়া থাকেন তার পরিবার নিয়ে। এসব তথ্যের বেশিরভাগই অবশ্য সামনের বাড়ির রুমা বৌদির কল্যানে শ্রাবণের কানে এসেছে। সুযোগ পেলে এখনো সুমনের নামে দু’চারটে বিষাক্ত কথা বলতে ভুলেন না তিনি সময় করে কিন্তু শ্রাবন এখন ওসব মন দিয়ে শোনেও না, মনেও রাখার চেষ্টা করেনা। কিন্তু এতোদিন পরে সেই বিষফোঁড়ার আবার ওকে প্যারা দেয়ার শখ হলো কেন সেটাই শ্রাবনকে বেশ করে ভাবাতে লাগলো।

আচ্ছা এতোদিন পরে হিপোক্রেটটার সাথে দেখা হলে কি করা উচিত শ্রাবণের? বেশ অনেক ভেবে ভেবে নিজের বিয়ের কার্ডটা ওর মুখের উপর ছুড়ে মারার শখটা সামলালেও নিজের হাতে দেবার লোভটা কেন যেন সামলাতে পারলনা। কাপড়চোপড় ছেড়ে তাই মায়ের ঘরে যেয়েই বসে রইলো শ্রাবণ খবর শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে।

নির্মলা আজ বহুদিন বাদে একটু শান্তি পেলেন মনে। কতগুলো দিন পরে মেয়েটাকে দেখলেন তিনি, চোখের শান্তি এক আলাদা জিনিস। আগের চেয়ে লম্বায় অনেকটাই বেড়ে গেছে সুমন, চেহারায় চপলতা ছাড়িয়ে গাম্ভীর্যের ছড়াছড়ি, দক্ষহাতে সুমনকে প্রতিবেশীদের চা- নাস্তা পরিবেশন করাতে দেখলেন তিনি সোফার এক কোনে বসে বসে।

.

.

.

“জানিস ছোট, সমীর ঠাকুরপো নেই এ খবরটা শুনে আমিতো কোন কথাই বলতে পারছিলাম না প্রথমে। পরে সুমন তাড়াতাড়ি এসে মাথায় একটু পানি চেপে ধরলো তাই মনে হলো বেঁচে আছি। ”

মায়ের মুখে সমীর মামার মৃত্যুর খবর শুনে শ্রাবনেরও চোখ ভিজে এলো। লোকটা বড্ডো সাধাসিধা ধরনের ছিলো, বেঁচে থাকতে আনন্দের চেয়ে কষ্টই বেশি করে গিয়েছেন। অনুজ এখন পাকাপোক্ত ভাবে আমেরিকাতেই থাকে, সামনের বছর এসে তাই মঞ্জুকে নিজের সাথে ওখানেই নিয়ে যেতে চায় সে।

শ্রাবণের একবার মনে হলো তাহলে বীরেন দাদুর কি হবে… কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নিলো। কি দরকার ওর আগ বাড়িয়ে কিছু শোনার, যাদের দায়িত্ব তারা যা বুঝে করবে। ওর কি?

কথা প্রসঙ্গে মা ওদের বাড়ির জামাই আদিত্যর কথা তুলতেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো শ্রাবন, যেনো ঘুমে পড়ে যাচ্ছে। নিজের ঘরে ঢুকে শক্ত করে দরজা বন্ধ করলো যেনো স্মৃতিরা চাইলেও আর এ ঘরে ঢুকতে না পারে। সুমো নামের কাউকে ও চিনতো এক সময়, এমনকি চোখ বুঁজেও ওর গন্ধ টের পেতো কিন্তু আজ আর এ নামে কাউকে চেনে না শ্রাবন, চিনতেও চায় না।

“হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়ায়ে ঝরা ফুল একেলা আমি
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি ।

চারিদিকে মোর উড়িছে কেবল
শুকানো পাতা মলীণ ফুল দল
বৃথাই সেথা হায় তব আঁখিজল
ছিটাও অবিরল দিবসযামী ।”

– কাজী নজরুল ইসলাম।

চার কি পাঁচ দিন পরের কোন এক দুপুরে কোর্ট ফেরত শ্রাবণের ডাক পড়লো মায়ের ঘরে। শান্তনু তার ম্যানেজারের হাত দিয়ে শ্রাবণের বৌভাতের কার্ডের স্যাম্পল পাঠিয়েছে। কালকের মধ্যেই কার্ড ফাইনাল করার তাগাদা দিয়েছে শান্তনু, পরশু সব ঠিক থাকলে কার্ড শুভ কাজের জন্য ছাপানো শুরু হবে।

শ্রাবন লঘু পায়ে মায়ের ঘরের কাছাকাছি আসতেই খুব পরিচিত একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর ওর আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিলো। ঠিক কত বছর পর কন্ঠস্বরটা শুনলো ও? পা বাড়াবে কি বাড়াবে না এই দ্বিধায় দুলতে দুলতে অবশেষে… মা ডেকেছে বলে অনিচ্ছা সত্বেও আসলো এমন চেহারা করে ঘরের দরজায় জুতো জোড়া খুললো শ্রাবন। ঢুকেই এক পাশের সোফায় যেয়ে বসলো। সুমন একভাবে নিচে বসে যে কাজ করছিলো সেটাই করতে লাগলো। যেন শ্রাবণের আসা না আসায় ওর কিছু আসে যায় না,হাত একই গতিতে চলছে।

স্রষ্টা জানেন, হয়তো আড়চোখে দু’পক্ষই একজন আরেকজনকে দেখার সর্বোচ্চে চেষ্টা করছিলো কিন্তু আচরনে তাদের মধ্যকার অবস্থানের তাপমাত্রা ছিলো মাইনাস চার ডিগ্রী হিমাঙ্কেরও উপরে।

শেষ পর্যন্ত নির্মলার প্রশ্নে বরফখণ্ড থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এলো শ্রাবন, তবু জিভ এতো আড়ষ্ট যে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছিল ওর। আসলে ভিতরে গলে একাকার আর বাইরে জমে পাহাড়, দুটোকে এক করতে যেয়ে শ্রাবণের অবস্থা জলবৎ তরলং।

অথচ বেঈমানটা দেখো দিব্যি মায়ের পাশে বসে কাপড়ের স্তুপ তৈরি করছে। আহা… সুমোর পরনের কাপড়গুলো দেখে ভিতরে ভিতরে হেসে সারা হলো শ্রাবন। যত্তোসব ঢঙ… এখনও কি দারুন নাটক করে বেড়ায় সুমো ম্যাডাম, সহানুভতি কাড়বার অনবদ্য সব আইডিয়া বুঝি এর ঝুড়িতে স্টক করাই থাকে… হিপোক্রেটের চুড়ান্ত। এতো বড়োলোক স্বামী আর তার বউ কি একটা কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো যে সুমনের ওর মায়ের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার এক একটা রাস্তা সেটা এখন বেশ ভালই জানে শ্রাবণ।

” হ্যাঁরে ছোট তুই একটা কার্ড বেছে ঠিক করতো দেখি… আমার তো সবগুলোই এতো সুন্দর লাগছে যে মনে হচ্ছে সবগুলোই একটা করে ছাপতে দেই, আমার ছোট বাবাটার বিয়ে বলে কথা।”

নির্মলার মুখটা আনন্দে চকচক করছে, শ্রাবণের এতো কষ্টের মধ্যে কষ্টটা আরো যেন কয়কগুন বাড়লো। মা জানবেও না এগুলো ওর আনন্দের নয় বরঞ্চ সব ওর মরনের পরোয়ানা জারি করতে হাজির হয়েছে আর বিচারক হলো ওই… ওপাশের ঘাড় গুঁজে বসে থাকা লিকলিকে শয়তান ডাইনিটা। ওর গলাটা একবার মন মতো চেপে ধরতে পারলে বেশ হতো, মরার আগে কিছুটা শান্তি করে মরতে পারতো শ্রাবণ।

“সুমনকেও জিজ্ঞেস করলাম, ওই পাগলেরও একই উত্তর। বলে বড়মা সবগুলো পঞ্চাশটা করে ছাপালে কেমন হয়? ” নির্মলা বলে দুলে দুলে হাসতে লাগলেন।

শ্রাবণের মনে হলো এতক্ষণে যুতসই প্রশ্ন পেয়েছে ও। উত্তরটাও তাই বেশ সময় নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে দিতে লাগলো সে……

” কিছু কিছু মানুষ আছে মা কোনভাবেই একটাতে সন্তুষ্ট হয়না, তা সে যতো ভালো জিনিসই হোক না কেন। জিনিস কেনার আগে তাই তারা হাজারোবার বাজারে যায়, ভালোটা দেখে বাছাই করে। ভাব এমন ধরে যে মনে হয় এই বুঝি তার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস, দোকানিও এদের মন ঠিক ভালো বুঝে উঠতে পারে না কিন্তু নেয়ার সময় এরা পাশ কাটিয়ে ঠিক অন্য একটা জিনিস নিয়ে সটকে পরে।”

” তা বাপু জিনিস পছন্দ না হলে খারাপ জিনিস কিনে ঠকবে কেন? আমি তো বরং বাজার যাচাই করে জিনিস কেনার পক্ষে,” নির্মলা ছেলেকে নিজের রায় জানান মন খুলে, এতো প্যাঁচঘোচ তার আসে না।

“আমিও পক্ষে মা, তবে প্রতিটা জিনিসেরই একটা ন্যূনতম মূল্য আছে, ব্যবহার করে ভালো না লাগলেই তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া উচিত না।”

কথাটা বলে শ্রাবন আর দাড়ায় না, হনহন করে বের হয়ে আসে ও ঘর থেকে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here