তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -১৯+২০

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (১৯)

” তুমি আমার পরিবার হবে, মিহু? ”
” পরিবার! ”

মিহির কণ্ঠ থেকে বিস্ময় গলে পড়ল। ইমদাদ তাকে ছেড়ে গালদুটো আঁজলে নিয়ে থুতনি উঁচু করল। জোসনারঙা মুখটাতে চেয়ে বলল,
” আমি চাইলে হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব, বউয়ের মর্যাদা দিতে পারব। সন্তান আনতে পারব। একটা ছোট্ট গুছানো পরিবার গড়তে পারব। কিন্তু মন যে চাইছে না অন্য কাউকে বিয়ে করতে। ”

মিহি কৌতূহলপূর্ণ চোখ মেলে বলল,
” কেন? ”

ইমদাদ মিহিকে আরেকটু কাছে টেনে নিল। কৌতূহলপূর্ণ মনিদুটোতে চেয়ে বলল,
” সে যে তোমার সরলতা, নিঃস্বার্থতা, বোকা চাহনির লোভে পড়েছে। মিহু, হবে তো আমার পরিবার? ”

ইমদাদের কাতর অনুরোধে মিহি নিশ্চুপ, নির্বাক, মূক। ইমদাদ অস্থিরতায় কাঁপছে। চোখের পলক ফেলছে ঘন ঘন। মিহিকে আরেকটু কাছে টেনে ছেড়ে দিল। অন্যদিকে ঘুরে বলল,
” আমার কেমন জানি লাগছে। এত অসহায়, উগ্র, পাগলামি বোধ হয়নি কখনও। নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগছে খুব। ভরসাহীন, আশাহীন হয়ে পড়ছি। পরগাছা, ঝঞ্জাট মনে হচ্ছে নিজেকে। বেঁচে আছি কেন তাই বুঝতে পারছি না। ”

ইমদাদ পেছন ঘুরল। মিহির দিকে এগিয়ে এসে পাগলের মতো বলল,
” এতদিন অন্যদের বিরক্ত করেছি, এখন তোমাকে করছি। মিহি, আমি এত খারাপ কেন? ”

মিহির দিক থেকে কোনো উত্তরের আশা করল না ইমদাদ। তাকে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় পা ফেললে মিহি পেছন পেছন ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় যাচ্ছেন? ”

ইমদাদ দাঁড়াল না। হাঁটায় থেকে বলল,
” চলে যাচ্ছি। ”
” এত রাতে? পথ চিনবেন না। ”
” না চিনলে হারিয়ে যাব। আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই, খোঁজ করবে না কেউ। ”
” ইশাদ ভাইয়া অপেক্ষায় থাকবে, আপনার খোঁজ করবে। ”

এ পর্যায়ে ইমদাদ থামল। মিহির দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
” হয়তো করবে কয়েকদিন, তারপর ঠিক ভুলে যাবে। বয়স হলে বন্ধুত্ব এমনি ছুটে যায়। ”

ইমদাদ বারান্দা ছেড়ে উঠোনে নামল। গেইটের কাছে গিয়ে থামল। পেছন ঘুরে বলল,
” সব প্রশ্ন করা শেষ? ”

মিহি একহাত দূরে দাঁড়িয়ে নীঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালে ইমদাদ বলল,
” তাহলে পেছন পেছন আসছ কেন? ভেতরে যাও। ”

মিহি নড়ল না। মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ইমদাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। কয়েক কদম হেঁটে আবার দাঁড়াতে বাধ্য হলো। চোখ বন্ধ করে শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়ল। পেছনে না তাকিয়ে বলল,
” মিহি, পেছন পেছন আসা বন্ধ করো। ”

মিহির গলার স্বর পাওয়া গেল না। পায়ের শব্দও না। ইমদাদ উল্টো ঘুরে মিহির সামনে এসে দাঁড়াল। বুকে হাত বেঁধে কঠিন স্বরে বলল,
” তোমার মাকে ডেকে দেখাব, তুমি বড়দের কথা শোনো না? ”

এতক্ষণে মিহি কথা বলব,
” আমিও বলে দেব, আপনি ইচ্ছে করে হারিয়ে যাচ্ছেন। ”

ইমদাদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” বলে দিলে কী হবে শুনি। আমাকে মারবে নাকি? ”
” মারবেই তো। ছেলে বখে গেলে মা মারবে না? ”

ইমদাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কাঁদছ? ”
” না। ”

ইমদাদ থুতনি উঁচু করে ভেজা চোখে চেয়ে বলল,
” তুমি কাঁদছ। ”

মিহি নিজেকে ছাড়িয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়াল। হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল,
” না, কাঁদছি না। ”

ইমদাদ হেসে ফেলল। মিহিকে আলতো জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” তোমার সরলতা আমার খুব পছন্দ। কেন কঠিন হচ্ছ? ”

মিহি এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। আহ্লাদে গলে পড়ে বলল,
” আমি তো অভিমান করেছি। অভিমান না ভাঙিয়ে আমাকে ফেলে চলে গেলে কাঁদব না? ”

ইমদাদের হাসি চওড়া হলো। বলল,
” হ্যাঁ, কাঁদবেই তো। ”
” সেজন্যই কাঁদছি। ”
” আচ্ছা, কাঁদো কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে অভিমান ভাঙবে কী করলে সেটা বলো। ”
” বলব না। ”
” কেন? ”
” অভিমান ভাঙার দায়িত্ব আপনার তাহলে আমি বলে দেব কেন? ”
” কিন্তু অভিমান তো তুমি করেছ, আমি না। তাহলে ভাঙব কিভাবে? ”

মিহি ইমদাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
” তাই তো। ”

ইমদাদ শব্দ করে হাসছে। সেই হাসির শব্দ চারপাশের নির্জন, নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে তুলছে। মিহি ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে পড়লে ইমদাদ কোলে তুলে নিল। উঠোন পার হতে হতে বলল,
” কোন দিকে যাব? মায়ের রুমে নাকি তোমার রুমে? ”
” দিয়ে আবার চলে যাবেন? ”

ইমদাদ বারান্দায় উঠে বলল,
” তুমি বললে চলে যাব। ”
” না বললে? ”
” যাব না। ”
” আর যদি কিছুই না বলি? ”

ইমদাদ হাঁটা থামিয়ে দিল। অবাক চোখে চেয়ে বলল,
” তোমার মাকে ডেকে দেখাব, তুমি মোটেও লক্ষ্মী নও। খুব দুষ্টু? ”

মিহি ভয় পেল। ইমদাদের বুকে মুখ লুকিয়ে অনুরোধ করল,
” আর করব না। মাকে ডাকবেন না, প্লিজ। ”

ইমদাদ দুষ্টু হাসল। দুই রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” মিহু, তোমার বয়স কত? ”

মিহি মুখ বের করে বলল,
” সতেরো। ”

ইমদাদ মায়ের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
” আমার চেয়ে অনেক ছোট। ”

মিহি কিছু একটা বলতে চাইলে ইমদাদ ফিসফিস করে বলল,
” আর কথা নয়, মা জেগে যাবে। ”

মিহি সচেতন হলো। ইমদাদ তাকে মায়ের পাশে শুয়িয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” তুমি ছোট দেখে শুরু থেকেই খারাপ লাগত। কিন্তু আজ মন থেকে খারাপ লাগছে। মিহু, চোখের পলকে বড় করার যাদুটা যদি কারতাম! ”

ইমদাদের আফসোসের কারণ ধরতে পারল না মিহি। প্রথমের কথা ধরে মনখারাপের সুরে বলল,
” আমাকে আপনার পছন্দ নয়? তখন যে বললেন পছন্দ? ”
” হ্যাঁ, পছন্দ তো। খুব পছন্দ। শুধু তোমার বয়সটা পছন্দ না। ”
” কেন? বয়স কী দোষ করল? ”

ইমদাদ একহাতে মিহির দুইগাল চেপে ধরল। হাতের চাপে ঠোঁটদুটো ফুলে উঠতে সেখানে নিজের ঠোঁট ছুঁয়াল সাবধানে। তারপর বলল,
” সেভাবে ঘুমাতে পারছি না বলে। ”

ইমদাদের ঠোঁটের ছোঁয়ায় মিহির চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ে বরফের মতো জমে যাওয়া শরীরটা দেখতে ভীষণ আদুরে লাগল ইমদাদের। সরতে ইচ্ছে হলো না, ঐ পাশে গিয়ে শুতে ইচ্ছে করল না। চোখের ঘুমটুকু কয়েক রাতের জন্য বেচে দিতে ইচ্ছে হলো শুধু। অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করল, ‘ তুমি আমার নিঃসঙ্গ জীবনে সঙ্গ দিতে নয়, অনুভূতিহীন মনটাকে অনুভূতি দ্বারা পাগল করতে এসেছ। ‘

পরেরদিন সকালে মিহি ব্যাগ গুছিয়ে ইমদাদের সাথে সংসার সাজাতে চলে গেল। রুবিনাকে সাথে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিল ইমদাদ, পারেনি। তার এককথা, এই বয়সে স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তবে কথা দিয়েছে, মাঝে মাঝে তাদের ওখান থেকে বেড়িয়ে আসবে।

______
গোসল সেরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল তিহি। চুল আলগা করে দিল রোদের আলোয়। সতেজ মনে চারপাশটা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। বাড়ির পাশের পুকুরটা শুকিয়ে ভরে এসেছে প্রায়। কচুরিপানার বদলে জংলী লতাপাতা গজিয়েছে। পুকুরটার ওপাশের রাস্তাটা আগের চেয়েও বড় করেছে। অনায়াসে দুদিক থেকে রিকশা, ভ্যান, অটো চলছে। তিহি মন দিয়ে পরিবর্তনগুলো দেখছিল। সেসময় তীব্র শব্দ করে একটি মোটরসাইকেল এসে থামল। হয়তো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। মোটরসাইকেলের মালিক সেটাই সারানোর চেষ্টা করছে। তিহি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাজকে কল্পনায় নিয়ে আসল। সেদিন সিঁদুর পরিয়ে দেওয়ার পর যখন জানল তিহি মুসলমান তখনই মোটরসাইকেল নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছিল তাজ। বেশ কয়েকদিন আর দেখা যায়নি। তিহিও ভয়ে মা-বাবাকে কিছু বলেনি। ভেবেছিল আর কখনও আসবে না। এদিকে নিজের বিয়েটা আটকাতেও ব্যর্থ হয়ে পড়ল। আকদ করতে চলে এলো মাতব্বরের পরিবার। আতিথেয়তা শেষ করে তিহিকে নিতে আসবে। সে সাজছিল। আহামরি কিছু না। একটু পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি সাজ। সাজ শেষ হলে খালি রুম পেয়ে তিহি মুখ ঢেকে কাঁদছিল। তন্মধ্যে কেউ একজন বলল,
” তিহি? ”

তিহি চমকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। পুরো রুম অন্ধকার! সে চিৎকার করতে চাইল তার আগেই নাকে তীব্র গন্ধ পেল। জ্ঞান হারাতে হারাতে শুনল,
” আমি থাকতে অন্য কোথাও তোমার বিয়ে হতে পারে না। ”

তিহির জ্ঞান ফিরেছিল কখন সে বুঝতে পারেনি। কারণ, যে ঘরে রাখা হয়েছিল সে ঘরে কোনো জানালা ছিল না। ঘড়ি ছিল না। বাইরের আলো-বাতাস ঢোকার মতো ছোট্ট ছিদ্রও ছিল না। বাতি নিভিয়ে দিলেই গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যেত তিহি। তাজ প্রথমে আদুরে ভাষায় আইনি নিয়মে তাকে বিয়ে করার জন্য বলেছিল। অনুরোধ করেছিল। তিহি রাজি হয়নি। একে তো ধর্মের মিল নেই, তার মধ্যে মানুষটাকে সামান্যতমও মনে ধরছিল না। ঘৃণায় চোখ-মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। একসময় তাজের ধৈর্য্য ভেঙে যায়। ভালোমানুষি ভাবটা হারিয়ে হিংস্র হয়ে পড়ে। চিৎকার করে বলে, ‘ তোর ভালোর জন্যই রেজিস্ট্র করতে চেয়েছিলাম। পছন্দ হয়নি তো? ভালো। হিন্দু ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী তুই আমার বউ। আমি সেটাকে ধরেই সংসার করব। ‘ তাজ নানানভাবে তিহির মন পাওয়ার চেষ্টা করেছে, ভালোবাসা অর্জন করার চেষ্টা করেছে। কেন জানি কিছুতেই তিহিকে দুর্বল করতে পারছিল না। শেষে জোর করে দৈহিক মিলন করে। তারপরে তিহি একেবারে ভেঙে যায়। বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে। তাজ জোর করেও খাওয়াতে পারে না। তিহি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাজ বাধ্য হয়ে ডাক্তার আনে। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে পরামর্শ দেয়, যথেষ্ট আলো-বাতাস আছে এমন কোথাও রাখতে। তারপরেই তিহির সেই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটি থেকে মুক্তি মেলে। তাকে নিয়ে একটা নতুন বাসায় উঠে তাজ। একতলা বাসাটা বেশ খোলামেলা। গাছগাছালিতে ভরা। সেই বাসার শীতল হাওয়াও তিহি নিজের মতো করে উপভোগ করার সুযোগ পায় না। হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়ে তাজ বলেছিল,
” তুমি যেদিন আমাকে নিবে সেদিন স্বাধীনতা পাবে, আমি সেই প্রহরের অপেক্ষায় আছি, নেশাবউ। ”

তাজ এই নামে সম্বোধন করলে ঘৃণায় তিহির গা রি রি করে উঠত। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে যেতে ইচ্ছে হতো। সে বুঝে যেত এখনই ভোগের স্বীকার হবে। এই এত ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্টের মধ্যেই তিহি অন্তঃসত্ত্বা হলো। প্রথমে তাজকে বুঝতে দিল না। অপেক্ষা করছিল, একটা সুবর্ণ সুযোগের। তাজের থাবা থেকে বের হতে পারলেই বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলবে। তিহি খুব ভালো করেই জানত, তাজ বাচ্চার ব্যাপারে জানলে আরও বেশি পাগল হয়ে পড়বে। সময় যত এগুচ্ছিল, তিহি মুক্তির পথ খোঁজায় তত মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বেশ কয়েকটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে সেই সুবর্ণ সুযোগ পায়। সে রাতে তাজ প্রচুর মদ্যপান করেছিল, তিহির সামনেই। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে। সেই সুযোগে তিহি তাজের পকেট থেকে চাবির ছড়া হাতিয়ে নেয়। হাত- পা উন্মুক্ত করে রুম থেকে বের হয়। লন পেরিয়ে পুব দিকের দেয়ালের কাছে আসে। তিহি গুনে গুনে হিসেব করেছে এই দিকের দেয়ালটা একটু নিচু। পার হতে পারলেই রাস্তা। এপাশ থেকে রিকশার ক্রিংক্রিং শব্দ পাওয়া যায়। তিহি চারপাশে ছোটাছুটি করে বিভিন্ন জিনিসের সাহায্যে উঁচু টিলা বানায়। তাতে দাঁড়িয়ে দেয়ালে উঠবে তখনই শুনতে পায়,
” আমাকে রেখে চলে যাচ্ছিস? ”

তিহি ভয়ে টিলা থেকে পড়ে যায়। তাজ দৌড়ে এসে তাকে তোলে। চুল গুছিয়ে সোজা করে শীতল চোখে চেয়ে থাকে অনেক্ষণ। তার এই নীরব আচরণে তিহির কলিজা শুকিয়ে যায়। নিজ থেকে বলে,
” আমাকে মুক্তি দিন। ”

তাজ হালকা হাসে। হাসতে হাসতে সিগারেট ধরায়। নাকে-মুখে ধোঁয়া ছুঁড়তে ছুঁড়তে বসে পড়ে। তিহির ডানপা টেনে ধরে চিৎকার করে উঠে,
” এই পা আছে বলেই পালাতে পারছিস, যদি না থাকে? ”

বলতে বলতে পায়ের তলায় সিগারেটের জ্বলন্ত মুখ চেপে ধরে। তিহি সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। আরও একবার ডাক্তারের আগমন ঘটে এবং তাজকে সুসংবাদ জানিয়ে দেয়। তারপরে তাজ অনেকটাই বদলে যায়। তিহির প্রতি নরম ব্যবহার করে সবসময়। একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে আসার জন্য আবার চেষ্টা চালায়। সবকিছু পাল্টে গেলেও তিহির বন্দীদশার সমাপ্তি ঘটে না। তিহি হাঁপিয়ে উঠে। তাজের ভালো ব্যবহারও সহ্য করতে পারে না। একসময় বুঝে ফেলে তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। এই মানুষটার থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে বশে আনতে হবে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাজের মতো তিহির আচরণেও বেশ পরিবর্তন হয়। তাজ খুশি হয়। ভেবে নেয় তিহি তাকে মেনে নিচ্ছে, ভালোবাসছে। তাদেরও অন্য সবার মতো একটা সুন্দর গোছানো সংসার হবে। তেমন স্বপ্নে যখন বিভোর তখনই তিহি বাইরে ঘুরতে যাওয়ার আবদার করে বসে। প্রথমে তাজ মানতে না চাইলেও পরবর্তীতে রাজি হয়। মাঝরাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তিহিও মুক্তির আশায় দিশাহারা হয়ে পড়ে। দিগভ্রান্ত হয়ে তাজের উপর হামলা চালায়। তাজ গাড়ি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে কাতর স্বরে অনুরোধ করেছিল বার বার,
” পাগলামি করো না, তিহি। তোমার কিছু হলে আমার বাচ্চাটা বাঁচবে না। ”

তিহির কল্পনা ছুটে যায়। হাত গিয়ে পড়ে পেটে। জামা সরিয়ে পেটে হাত রেখে উচ্চারণ করল,
” আমার বাচ্চা! ”
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (২০)

তিহি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেটের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। চোখে, মুখে উৎকণ্ঠা! ডানহাতটা পেট থেকে সরাতেই পারছে না। কোথায় গেল তার সেই ফুলো পেট? ফাঁটা ছাপ! সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল না? নাকি আট মাস? তিহি মনে করতে পারছে না। চোখে নরম জল চিকচিক করছে। মুহূর্তে তিহির অন্তর কেঁপে উঠল। মমতাময়ী মায়া ছড়িয়ে পড়ল মুখজুড়ে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, ‘ আমার বাচ্চাটা কোথায়? এখানেই তো ছিল! দেখতে পাচ্ছি না কেন? নড়ছে না কেন? ‘ তিহির গলা ধরে এলো। নিশ্বাস আটকে এলো। পেট খামচে ধরে দরজার দিকে ছুটে চিৎকার করল,
” মা? বাবা? ”

চেঁচামেচি করে বাড়িসুদ্ধ কাঁপিয়ে তুলল। সকলে তার সামনে উপস্থিত হয়ে যখন একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল তখন তিহি চুপ হয়ে গেল। মনে পড়ল এক্সিডেন্টের কথা। সে ধীরে ধীরে বারান্দার চেয়ারটাতে বসে প্রশ্ন করল,
” আমার কি বড় অপারেশন হয়েছে, মা? ”

তিহির মা সাথে সাথে উত্তর দিতে পারলেন না। স্বামীর দিকে তাকালেন। রশিদ মিয়া স্ত্রীকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। তিহি বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমিই তো চেয়েছিলাম আমার মতো ও মুক্তি পাক। তাহলে এত কষ্ট কেন হচ্ছে, বাবা? ”

বলতে বলতে ঝরঝরে কেঁদে ফেলে তিহি। রশিদ মিয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘ তোর মেয়ে বেঁচে আছে। এটা তো তুইও জানিস মা, তাহলে কেন কাঁদছিস? একটু মনে করার চেষ্টা কর। ‘

___________

বাসরঘরের বাসি ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ইশাদ। শুকিয়ে যাওয়া গাঁদা ফুলের একটা লতা টেনে গন্ধ টানল। চোখ বুঁজে বলল, ‘ আমার গভীর ছোঁয়াগুলো কী করে ভুলে গেলে, তিহিপাখি? ‘

” তুমি আমার বাবাই? ”

ইনার কণ্ঠস্বরে ইশাদ চোখ মেলল। লতা ছেড়ে তাকে কোলে করে খাটের কিনারে বসিয়ে বলল,
” আমাকে দেখে বাবাই মনে হয়? ”

ইনা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকল। পেছন থেকে ইমদাদ বলল,
” বাবা কি মুখ দেখে হয়? ”

ইনা চটপটে বলল,
” এই আংকেলটা বলছে, তুমি আমার বাবাই। আর যেন আংকেল না বলি। ”

ইশাদ ইনার গালে চুমু খেল। হেসে বলল,
” তোমার আংকেল ডাকতে ভালো লাগলে তাই ডেকো। ”
” ঐ আংকেল যদি বকে? ”
” বকবে না। আমি মানা করে দেব। ”

ইনা খুশি হলো। ইশাদ ইমদাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোকে তো বলেছিলাম ঠিকানায় পৌঁছে আমাকে কল দিতে। দিসনি কেন? যাসনি? ”

ইমদাদ ইশাদের কাছে এসে বলল,
” মানুষটার সাথে তো আমার কথা বলার দরকার ছিল, তোর না। তাই দেইনি। ”
” কথা বলা শেষ? ”
” না, এখনও কিছু কথা বাকি আছে, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ”

ইশাদ অবাক হয়ে হাসল। ইমদাদের বুকে হালকা আঘাত করে বলল,
” এতদিনে সুবুদ্ধি হলো। ”

ইমদাদ কৃতজ্ঞতায় ইশাদকে জড়িয়ে ধরল। ছেড়ে বলল,
” মিহিকে এখানে রেখে যাচ্ছি। নতুন বাসা সাজিয়ে নিয়ে যাব। ”
” নতুন বাসা কেন? ঐটা কী হয়েছে? ”

ইমদাদ চোখ নামিয়ে বলল,
” আমি চাই মিহিকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখতে। যেখানে আমার পাপের কোনো চিহ্ন থাকবে না। ”

ইশাদ বিস্ময় চোখে তাকাল। বন্ধুর এই আমূল পরিবর্তনে তার থেকে বেশি খুশি আর কে হতে পারে?

দুই বন্ধু রুম থেকে বের হবে তখন ইনা বলল,
” আমাকে নামাবে না, বাবাই? ”

দুজনে চমকে দাঁড়িয়ে পড়লেও ঘাড় ফিরে তাকাল শুধু ইমদাদ। উত্তেজনায় তার চোখ ছানাবড়। ইশাদকে ফেলে ইনাকে কোলে তুলে নিল। কোল থেকে কাঁধে নিয়ে বলল, ‘ আহ! মন জুড়িয়ে দিলি। ‘ ইমদাদের পাগলামির জন্য ইনা কোনো কথা বলার সুযোগই পাচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর বুকে ধুকপুক নিয়ে বলল, ‘ আমি বাবাইয়ের কোলে যাব। ‘

ইমদাদ অনেকটা বলের মতো ঢিল মেরে ইশাদের কাছে দিল। একটু বেখেয়ালি হলেই হাত ফসকে পড়ে যেত। ইনা ইশাদের গলা জড়িয়ে ধরলে ইমদাদ কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, ‘ কী রে, পৃথিবী ত্যাগ করলি নাকি? নড়ছিস-টড়ছিস না যে? ‘

ইনা সে অবস্থায় ইশাদের দুগাল চেপে ধরল। মুগ্ধ গলায় বলল,
” তুমি আমার সুন্দর বাবাই। আম্মু বলেছিল, তোমাকে বাবাই ডাকলে আমাকে অনেক আদর করবে। ”

ইশাদের জড়তা কাটল। ইনাকে পাগলের মতো কতগুলো চুমু খেয়ে জড়িয়ে নিলে সে বলল,
” বাবাই, আম্মু কখন আসবে? ”

____________
তৃপ্তির হাতের চিকন চুড়ি জোড়া দেখতে দেখতে তিহি বলল,
” তোর বিয়েও হয়ে গেছে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সেদিনই তো গায়ে ওড়না জড়ালি! ”

তৃপ্তি কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। বোকা চোখে তিহিকে দেখছে শুধু। চাচা-চাচির কাছে সব শুনে কান্না পেয়ে গেছিল। দেখা করতে চাইলে বলেছিল, সাবধানে কথা বলতে। তিহির মনে যেন সন্দেহ না জাগে। তাহলে নাকি মাথায় চাপ পড়বে।

” তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। বাব্বাহ, চুল তো কোমর ছাড়িয়েছে। চেহেরায় সেই বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা নেই। ”

একটুখানি চুপ থেকে আবার বলল,
” তোদের বাসায় বরই গাছটা এখনও আছে না? চল বরই খেয়ে আসি। ”

তৃপ্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠোনে ছুটে এলো তিহি। রাস্তায় পা দেওয়ার আগে তৃপ্তি মনে করাল,
” চাচিকে বলবে না আপু? চিন্তা করবে তো। চলো বলে আসি। ”

তিহি শুনল না। তৃপ্তিকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে আসল।

তিহির মা রান্না করছিলেন। বারান্দায় আসতে দেখেন তিহি নেই। ছুটে যান ভেতরে। আতঙ্কে ফেটে পড়ে স্বামীকে বললেন,
” তিহিকে কোথাও দেখছি না! ”
” দেখছ না মানে? কোথায় গেছে? ”
” জানি না, মাত্রই তো তৃপ্তির সাথে কথা বলছিল! ”

রশিদ মিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকলেন না। হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাসা থেকে।

চলবে
চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here