তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -২৩ ও শেষ

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
#অন্তিম_পর্ব

গাড়ি থেকে নেমে রুকমিনি মুখার্জি বললেন,
” তুমি যাবে না? ”

ইশাদ নিবিড় দৃষ্টি রাখল তিহিদের বাড়ির দিকে। দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল,
” সবই তো জানেন, আমাদের দেখা হওয়া মানেই বিপদ। ”

ইশাদের ভাবাবেগ বদনখানিতে রুকমিনি মুখার্জি সহানুভূতি চাহনি রাখলেন। অল্প সময় চুপ থেকে বললেন,
” আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি চলে যাও। অনেক দিন বাদে মেয়েটাকে দেখব। কখন ফিরব ঠিক নেই। ” বিলম্বিত অপেক্ষায় যদি ভুল করে দেখা হয়ে যায়, তাহলে বিপদটুকুর সাথে লড়তে চাই। ”

রুকমিনি মুখার্জি আবার চুপ হয়ে গেলেন। স্নেহপূর্ণ চাহনি রেখে চাপা নিশ্বাস ছাড়লেন। তিহিদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রার্থনা করলেন, ‘ যদি দৈবশক্তি পেতাম তাহলে তিহির অতীতটুকু মুছে দিতাম। ‘

উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় পা রাখতে এক অপরিচিত মহিলার সাথে ধাক্কা খেলেন রুকমিনি মুখার্জি। অসাবধানে পড়েই যাচ্ছিলেন প্রায়। সিমেন্টের পিলার চেপে ধরে নিজেকে রক্ষা করলেন। মহিলার দিক থেকে কোনোরূপ ক্ষমা প্রার্থনার প্রবোধ আসল না। ভীষণ বিরক্ত ও রাগ নিয়ে তাকালে সে বলল,
” কাজটা দেখছেন? ভুল লিখে আমার কাগজটা নষ্ট করছে, আবার বলে কিনা আমি পাগল! আমারই ভুল, কেন আসছিলাম এ বাড়িতে? একটু সুন্দর হাতের লেখায় আবেদন লিখতে চাওয়াই এভাবে অপমানিত হলাম। প্রিয়ার বাপ ঠিকই বলে, নিজের যা তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ”

অপরিচিত মহিলার গড়গড় করে বলা কথাটুকুর আগামাথা কিছুই বুঝছেন না রুকমিনি মুখার্জি। কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকলে মহিলাটি হাতের কাগজ সামনে ধরলেন। কোণার দিকের তারিখের উপর আঙুল দিয়ে আঘাত করতে করতে বললেন,
” আমি শুধু বলছিলাম, ‘ মা, ২০১৩ সাল কেন লিখছ? এখন তো ১৯ সাল চলে। ‘ ব্যস, আমাকে অপমান করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। আরে, আমি অশিক্ষিত নাকি মুর্খ যে সাল মনে রাখতে পারব না? ”

রুকমিনি মুখার্জির মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। মহিলাটি যার কথা বলছে সে তিহি না তো? তার পিল চমকে উঠতে দেখলেন রশিদ মিয়া হাত জোর করে বলছেন,
‘ ভাবি, আমার মেয়েটা অসুস্থ। এবার একটু চুপ করেন। ”

মহিলাটি অনুরোধ শুনলেন না। গলা ছেড়ে একনাগাড়ে বকেই চললেন। এই চিৎকার চেঁচামেচি ছাপিয়ে সঙ্কিত গলায় বললেন,
” তিহি কোথায়? ”

তিহির মা দরজা থেকে বললেন,
” ভেতরে আসেন। ”

রুকমিনি মুখার্জি বড় বড় পা ফেলে ভেতরে ঢুকলেন। তিহিকে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ক্যালেন্ডারের দিকে একপলক চেয়ে ডাকলেন,
” তিহিমা? ”

তিহি চমকাল। ঘাড় ফিরিয়ে এক ঝলক রুকমিনি মুখার্জির মুখটায় চেয়ে আবার ক্যালেন্ডারে দৃষ্টি স্থির করল। কয়েক সেকেন্ট পর বলল,
” আপনি কি আমাকে সত্যিটা বলবেন নাকি ভীষণ মাথা যন্ত্রণায় মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করব? ”

কথাটা বলেই তিহি পেছন ঘুরল। ধপ করে মেঝেতে বসে কেঁদে ফেলল। রুকমিনি মুখার্জির দুইপা চেপে ধরে বলল,
” আমি কিছু মনে করতে পারছি না। সত্যিই কি স্মৃতি থেকে সাতটা বছর হারিয়ে ফেলেছি? চুপ করে থাকবেন না। বলুন, আমার মন আপনাকেই সত্য মানতে চাইছে। ”

রুকমিনি মুখার্জি তড়িঘড়িতে তিহির থেকে নিজের পা ছাড়ালেন। সামনে ঝুঁকে তিহিকে দাঁড় করিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শান্ত করার জন্য চেষ্টা করলে তিহি বুক থেকে ছুটে গেল। চিৎকার করে বলল,
” আম্মা, আমার সত্য-মিথ্যার ভারী দেয়াল ভেঙে দিন। এত ভার সইতে পারছি না। ”

তিহির মরণপণ আর্তনাদে রুকমিনি মুখার্জির বুক ভেঙে যাচ্ছে, মন দুর্বল হয়ে পড়ছে, চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে। মায়ার পর্দায় ইশাদের মুখটা ভেসে উঠতে তিনি বললেন,
” শান্ত হয়ে দাঁড়া, আমি আসছি। ”

তিহিকে রেখে রুকমিনি মুখার্জি বাসার বাইরে চলে আসলেন। ইশাদকে টেনেধরে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে রশিদ মিয়া বললেন,
” আপনি কী করতে চাচ্ছেন? ”

রশিদ মিয়ার বাঁধায় ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলেও পিছুপা হলেন না। দ্বিধাগ্রস্ত ইশাদকে হেঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
” লুকোচুরি অনেক হয়েছে, আর নয়। সত্য সূর্যের মতোই তেজি ও আলোকময়। মিথ্যার অন্ধকারকে ধ্বংস করতে স্বপরিকল্পনায় হাজির হয়। ”

ইশাদকে ধাক্কা দিয়ে তিহির মুখোমুখি দাঁড় করালেন রুকমিনি মুখার্জি। দুজন কিছু বুঝার আগেই তিনি দৃঢ় গলায় বললেন,
” তোর সত্য তোর সামনে। ”

তিহি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালে রুকমিনি মুখার্জি সব খুলে বললেন। ইশাদের বাঁধা মানলেন না। সবটা শোনার পর তিহি কান চেপে ধরল। পেছনে পেছাতে পেছাতে বলল,
” বিশ্বাস করি না, আপনি মিথ্যে বলছেন। ”

তিহি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলে ইশাদ দৌড়ে কাছে যায়। তিহিকে ছুঁতে গেলে সে চিৎকার করে উঠল,
” ছুঁবেন না আমাকে। এসব আপনার পরিকল্পনা। তাজের মতো আপনিও আমাকে নিয়ে খেলতে চাচ্ছেন। ”

ইশাদের থেমে যাওয়া হাতটা জোর করে তিহির শরীরে রাখলেন রুকমিনি মুখার্জি। তিহির দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বললেন,
” তুই বলেছিলি আমাকে সত্য বলে মানিস, তাহলে বিশ্বাস করতে পারছিস না কেন? ইশাদ তোর স্বামী। ভালোবেসে বিয়ে করেছিস। আমি নিজে তোদের বিয়ে দিয়েছি। ”

তিহি মানতে চাইল না। এক কদম সরে দাঁড়াল। রুকমিনি মুখার্জি নিজের ফোন থেকে তিহি আর ইশাদের বিয়ের ছবি বের করে দেখালেন। এক আঙুলে একের পর এক ছবি পাল্টাতে গিয়ে ইনার ছবি আসে। রুকমিনি মুখার্জি থেমে গিয়ে বললেন,
” তোর মেয়ে ইনা। দেখ তো চিনতে পারিস নাকি? ”

তিহির চোখে-মুখে আগ্রহ ফুটল। কাঁপা হাতে ফোন নিজের হাতে নিয়ে ইনার মিষ্টি মুখটায় চেয়ে থাকল অনেক্ষণ। সেখানে দৃষ্টি স্থির রেখে মোহিত স্বরে বলল,
” আমার মতো কিছু পায়নি! নাক, মুখ, চোখ, গায়ের রঙ…”
” তাজের মতো পেয়েছে। সেজন্যই তো এখনও তোর থেকে দূরে আছে। ”

তিহির ঘোর কেটে গেল। একপলক ইশাদের দিকে চেয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অন্য রুমে খিল টেনে বলল,
” এসব মিথ্যা। আমি মানি না। আমি কাউকে ভালোবাসি না, বিয়ে করিনি। তোমরা চলে যাও, চলে যাও। ”

ইশাদ তিহির পেছন পেছন দৌড়ে এসেছিল। তিহির বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে ব্যথিত স্বরে বিড়বিড় করল, ‘ এত সহজে অস্বীকার করতে পারলে, তিহিপাখি? একটাবার আমার কথা ভাবলে না? হৃদয়টা যে আমার দেহ ত্যাগ করতে চাচ্ছে। ‘ ইশাদ আবার দ্বিধায় পড়ে গেল। তবে কি তিহি তাজকে ভালোবাসে? সেই চিঠির কথা মনে পড়ল। যেখানে স্পষ্ট লেখা ছিল তারা ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করছে। কিন্তু সেই লেখা তো তিহির ছিল না! একরাতে তিহির দেওয়া সেই দুই টাকার নোটটা ইশাদের বুক পকেটেই রয়ে গিয়েছিল। যেখানে তিহি নিজ হস্তে কয়েকটা শব্দ লিখেছিল। সে লেখার সাথে চিঠির লেখার কোনো মিল না পাওয়ায় ইশাদ ধরে নিয়েছিল চিঠিটি তাজের লেখা। তাহলে কি লেখা তাজের হলেও ভাষাগুলো তিহির মনের ছিল?

রুকমিনি মুখার্জি দরজা খোলার জন্য অনেক ডাকাডাকি করলেন, সত্য মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, বুঝাতে চাইলেন। এসব কিছু ইশাদের কাছে বৃথা মনে হলো। রুকমিনি মুখার্জিকে থামাতে বলল,
” ছেড়ে দিন, আন্টি। তিহিকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে আমি অপেক্ষা করতে রাজি। ফিরে চলুন। তিহির বিশ্রামের প্রয়োজন। একা থাকতে দিন। ”

___________

সত্য মানার ভয়ে মনটা যখন একটুখানি হয়ে লুকিয়ে পড়ল কোথাও, তখন চোখ ভরে সকালের নীলাকাশ দেখছে তিহি। অভুক্তে দিনরাত কাটিয়ে আগ্রহী চোখদুটো শুধু পাল্টে যাওয়া প্রকৃতি ও সময়কে দেখছে। এই এতদিন পর তার হঠাৎ পাল্টে যাওয়া পরিচিত পথ, ঘাট, মাঠকে এখন পরিচিত মনে হচ্ছে। একটু একটু করে বিশ্বাস করছে বদলে যাওয়া চারপাশটা হঠাৎ নয়, সাত বছরের অদেখার দীর্ঘ বদল!

” উঠে গেছিস? আমাকে ডাকলি না? তোর বাবাকে মাত্রই বললাম, তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস। ”

মায়ের গলা পেয়েও তিহি পেছন ঘুরল না। নিষ্প্রাণ দেহখানার ভার জানালায় ফেলে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেয়ের এমন আচরণে মা রাগ হলো না। কাছে এসে মমতাময়ী কণ্ঠে বললেন,
” মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। হাত-মুখ ধুয়ে আয়। আমি খাবার নিয়ে আসছি। ”

এ পর্যায়ে তিহির শরীর নড়ল। মায়ের দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলল,
” খাব না। আবার এসেছ? বলেছি না আমার রুমে আসবে না। অসহ্য! ”

বিরক্তে চোখ-মুখ কুঁচকে রুমের অন্যপাশে হেঁটে গেল তিহি। আঁটসাঁট হয়ে বলল,
” চলে যাও এখনি। ”

তিহির মা গেলেন না। মেয়ের কাছে হেঁটে এসে আদুরে গলায় বললেন,
” এভাবে না খেয়ে থাকলে তো বিছানায় পড়বি। আয়নায় নিজেকে দেখেছিস? ”
” পড়লে পড়ব, তাতে তোমার কী? মরে গেলেই তো বাঁচি। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। কোথাও শান্তি নেই আমার! ”

তিহির রেগে বলা কথায় মায়া হলো তার মায়ের। ভীষণ কাতর স্বরে বললেন,
” এমন বলতে নেই, মা। তুই-ই তো আমাদের সব। ”
” আমি তোমাদের কিছু না। তোমাদের জন্যই আজ আমার এ অবস্থা। না তুমি আমাকে বুঝেছ, না বাবা! ”

তিহির মায়ের ভেতরটা অনুতাপে পুড়তে লাগল। তিহির এই অবস্থার জন্য কোনোভাবে কি সে দায়ী? অপরাধী? মেয়ের ভালোর জন্যই তো বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল। এমন ভালো সম্বন্ধ কি সবসময় আসে?
” আমার জীবনটা তোমরা কঠিন ও দুর্বিষহ করে ফেলেছ, মা। আমি কী করে সামনে…..”

তিহি কথা শেষ করতে পারল না। চারপাশটা অন্ধকার করে মাথা ঘুরে যেতেই বল হারিয়ে নিচে লুটিয়ে পড়লে তিহির মা দৌড়ে এসে কোনো রকমে মাথাটা রক্ষা করে চিৎকার করলেন,
” তিহির বাবা? জলদি এসো! ”

____________

গাঁয়ের ডাক্তার তিহিকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার সময় তিহির জ্ঞান ফিরল। তিহি দুর্বল চোখে বাবা-মায়ের দিকে তাকাতে শুনতে পেল,
” সুখবর, মিয়া ভাই। মিষ্টি না খেয়ে কিন্তু আমি ফিরছি না। ”

তিহির বাবা-মা বিভ্রান্ত চোখে তাকালে ডাক্তার বললেন,
” আপনারা নানা-নানি হতে চলেছেন। ”

বিস্ময়ের বুলেটটা গিয়ে তিহির কলিজায় ফুটল!

_____________
” আন্টি বলল, তুই নাকি রাতে বাড়ি ফিরছিস না। হসপিটালেই থাকছিস। এসবের মানে কী ইশাদ? সকলকে দুঃশ্চিন্তায় রেখে খুব আনন্দ পাচ্ছিস? ”

ইশাদ রোগী দেখছিল। তার হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আনন্দকে আমি ছুটি দিয়েছি। ”

ইমদাদ চেয়ার টেনে বসল। বন্ধুর দিকে ঝুঁকে বলল,
” তোর এসব হেয়ালি কথাবার্তা শুনতে আসিনি। ”
” তাহলে কেন এসেছিস? ”
” বাসায় নিয়ে যেতে। গোসল করিসনি কতদিন ধরে? গন্ধে তোর কাছে ঘেষা যাচ্ছে না! ”

ইশাদ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
” তোকে ঘেষতে বলেছি? ”

ইমদাদ বিস্ময় নিয়ে বলল,
” আসলেই গোসল করিসনি? ”

ইশাদ হঠাৎ রেগে গেল। টেবিল ডেঙিয়ে ইমদাদের কলার চেপে ধরে বলল,
” মার খাবি নাকি চোখের সামনে থেকে দূর হবি? ”

ইমদাদ কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। এক চোখ টিপে বলল,
” দূর হব কী রে? গায়ের সাথে ল্যাপ্টে থাকব। তার আগে গোসল করাতে হবে। এতদিন আমাকে ডেটল দিয়ে গোসল করিয়েছিস, আজ তোকে আমি করাব। নিজের হাতে। চল। ”

ইমদাদ ইশাদের দুই হাত চেপে ধরে উঠে দাঁড়াবে সেসময় কেউ একজন বলল,
” মি. ইশ! ”

দুজনেই চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল দরজার কাছে দাঁড়ানো এলোমেলো নারীটিকে। দুজনের মুখ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ল,
” তিহি, তুমি? ”

ইশাদ ইমদাদের কলার ছাড়ল। তিহির কাছে হেঁটে আসল দ্রুত। উদ্বিগ্ন ও অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
” তুমি এখানে? ”
” আমি মা হতে চলেছি! ”

পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য ও সমুদ্র মাপের আনন্দের সুসংবাদটি এভাবে শুনবে তা কি ভেবেছিল ইশাদ? শীতল হাওয়ায় মনটা ভিজে উঠলেও ইশাদ খুশিটুকু প্রকাশ করল না। তিহিকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে বলল,
” তুমি ঠিক নেই। সাথে কেউ আসেনি? এভাবে একা…”
” পৃথিবীতে আমিই কি একমাত্র অভাগী যে জানে না তার বাচ্চার বাবা কে! ”

ইশাদ আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না, সামলাতে পারল না। বিবেকের দেয়াল অশ্রুতে গলে পড়ল ইশাদের। তিহিকে বুকের মধ্যে আপন করে বলল,
” তুমি অভাগী নও, আমার মনের রানি। লালরঙা ভালোবাসাগুলো তোমার দাসী। এভাবে ভেঙে না পড়ে, মনে করার চেষ্টা করো। আমাদের পথচলা সবেই তো শুরু। ”

তিহি নিজেকে ছাড়াল না। চোখ থেকে জল ফেলতে ফেলতে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” এই গন্ধটা আমি চিনি। ”

ইশাদ তিহির মাথা আলগা করে জিজ্ঞেস করল,
” কোন গন্ধ? ”

তিহি ভেজা চোখে ইশাদের মুখটায় চেয়ে থাকল। সেভাবেই বলল,
” আপনি আমাকে জড়িয়ে নেওয়ার পর যে গন্ধটা পেলাম ঐটা। ”

ইশাদ কী বলবে খুঁজে পেল না। তার নিশ্চুপতা দেখে তিহি বলল,
” আপনাকে চিনি না। তবুও আপনার কাছে থাকতে ভালো লাগছে, শান্তি পাচ্ছি। ”

ইশাদ ক্লান্ত হাসল। দু-হাত তিহির মুখে রেখে ভীষণ আহ্লাদে অনুরোধ করল,
” তোমাকে ভালোবাসার একটা সুযোগ দেবে? আগেরবার প্রেমে ফেলার চেষ্টা করিনি, তবুও পড়েছিলে। এবার নাহয় মন-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব! কথা দিচ্ছি, বিরক্তের কারণ হব শুধু, কষ্টের নয়। ”
” একটু সরে দাঁড়ান তো। ”

তিহির থেকে এমন ব্যবহারে হতাশ হলো ইশাদ। নিরাশ মনে তিহির থেকে হাত সরিয়ে নিলে তিহি বলল,
” একটু দূরে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। ”

ইশাদ ভ্রূ বাঁকাল। জানতে চাইল,
” সোজা হয়ে দাঁড়াব? কেন? ”
” আগে দাঁড়ান তারপর বলছি। ”

ইশাদ আর কথা বাড়াল না। দূরে গিয়ে তিহির দিকে মুখ করে শিরদাঁড়া টান টান করে দাঁড়াল। তিহি আপাদমস্তক ভালো করে দেখে বলল,
” মিলছে না। ”
” কী মিলছে না? ”
” আমার মনের মানুষের সাথে। ”
” মনের মানুষ! তোমার মনে অন্য কেউ আছে নাকি? ”

তিহি চোখের পানি মুছে মুখ শুকনো করে বলল,
” আমার কেন, প্রত্যেকটা মেয়ের মনেই মনের মানুষ থাকে। নিজেদের পছন্দসই তুলির রঙ দিয়ে তার মুখশ্রী বানানো। ”

ইশাদ বিস্মিত হলো, আশাহতও হলো। একটু কেন তিহির মনের মানুষের সাথে মিল হলো না? মেয়েটাকে বার বার পেয়েও হারিয়ে ফেলছে। একটা সুযোগকেও কাজে লাগাতে পারছে না! ইশাদ ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে মাথা কিঞ্চিৎ ঝুঁকে ফেললে তিহি বলল,
” আপনি তার চেয়েও দেখতে ভালো। ”
” কার চেয়ে? ”
” আমার মনের মানুষের চেয়ে। ”

তিহি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ইশাদের নিকট এসে ফিসফিস করে বলল,
” আপনাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া হলো। দেখি, আমাকে কেমন প্রেমে ফেলেন। ”

ইশাদ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছ এমনভাবে হাসল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে তিহিকে ঝাপটে ধরল।

ইমদাদ দূর থেকে দেখল দুটো পাগল মনের আবার এক হওয়া। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে নির্লজ্জের পরিচয় দেওয়ার চেয়ে নীরবে সরে পড়াই ভালো মনে হলো। ইশাদের চেম্বার ছেড়ে বের হতে মিহির কথা মনে হলো। ইচ্ছে হলো পাখির মতো উড়ে গিয়ে তার ভালোবাসার সমুদ্রে স্নান করতে। কিন্তু এই ইচ্ছে আপাতত পূরণ হওয়ার নয়। একটা জরুরি রোগী দেখতে যেতে হবে। উপরতলা থেকে বিশেষ সুপারিশ এসেছে।

” আমার মেয়েকে দেখাবেন না? ”

তিহির প্রশ্নে ইশাদ বলল,
” মেয়েকে দেখতে হলে মেয়ের আম্মুকে যে তার বাবাইয়ের প্রেমে পড়তে হবে। ”
” মানে কী? ”

তিহির বোকা চোখদুটোতে চেয়ে ইশাদ বলল,
” ইনার আম্মু ইনার বাবাকে তুমি সম্বোধন করে। তুমি তো আপনি বলছ, আবার প্রেমে পড়ে তবেই তো তুমি বলবে তাই না? ”

তিহি এতক্ষণে ব্যাপারটা আঁচ করল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” ইনার ছবিটা দেখার পর থেকে মনটা ছটফট করছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার একটা মেয়ে আছে, তাও সাত বছর বয়সী! ”

তিহির ব্যাকুলতা দেখে ইশাদ হাসল। বলল,
” মায়ের মন মেয়ের জন্য তো ছটফট করবেই। এসো আমার সাথে। ”

ইশাদকে অনুসরণ করে হাতপাতালের করিডর পেরুচ্ছে তিহি। নিচতলায় নামতে নামতে বলল,
” আপনি খুশি হননি? ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে। ”
” হয়েছি। ”
” আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না। ”

ইশাদ থমকে গেল। তিহির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
” তুমি দেখতে চাও? ”

তিহি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। হ্যাঁ বলবে নাকি না? ইশাদ আবার বলল,
” বলো, দেখতে চাও? ভেবে বলো কিন্তু, দেখে ফেললে ভীষণ লজ্জায় পড়বে। ”
” কারও খুশি দেখলে কেউ লজ্জা পায়? ”
” অন্যেরটা জানি না, কিন্তু তুমি পাবে। একবার হ্যাঁ বলে দেখ। ”

তিহি কৌতূহলী হয়ে বলল,
” হ্যাঁ, দেখতে চাই। ”

কথাটা শেষ হতেই ইশাদ তিহিকে পাঁজাকোলা করে ঘুরতে শুরু করল। হলরুমের সকলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল,
” আমি বাবা হতে চলেছি, আপনারা শুনতে পারছেন? আমি দ্বিতীয়বারের মতো বাবা হতে চলেছি। ”

ইশাদের এমন কাণ্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল তিহি। লজ্জায় মিশে যেতে চাইল হাওয়ার সাথে, আলোর সাথে। তিহিকে নিচে নামিয়ে ইশাদ ফিসফিস করে বলল,
” আমার কথা মিলল তো? ”

তিহি চোখ মেলে তাকাতে পারল না কোথাও। ইশাদের একটা হাত চেপে ধরে বলল,
” ইশ! এমন পাগলামি করে কেউ? আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। ”

ইশাদ সশব্দে হেসে ফেলল। তিহিকে নিয়ে মূল ফটকের দিকে এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে। রিকশা ডাকার জন্য রাস্তায় দাঁড়াতে দেখল রুকমিনি মুখার্জি ইনাকে নিয়ে এদিকে আসছেন। তিনি দূর থেকে তিহিকে দেখেই তাড়াহুড়োয় রিকশা থেকে নামলেন। তিনি কিছু বলার আগেই ইশাদ বলল,
” আপনি এখানে? ”
” তোমার আংকেল কল করেছিল। যেতে হবে, ইনাও তোমার কাছে আসবে বলে কান্নাকাটি করছিল। তাই ভাবলাম ও কে তোমার কাছে দিয়ে বিদায় নিয়ে যাই। ”

তিহি রুকমিনি মুখার্জিকে এড়িয়ে ইনার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আদুরে মুখটায় আলতো ছুঁয়ে বলল,
” আম্মুকে জড়িয়ে ধরবি না? ”

আম্মুর অনুমতি পেয়েই ইনা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।

ইশাদের কাছ থেকে সবটা শোনার পর রুকমিনি মুখার্জি বললেন,
” সুখী হ তোরা। আর কোনো বিপদ যেন তোদের ছুঁতে না পারে! ”

রুকমিনি মুখার্জি বিদায় নিলে ইশাদ রিকশা ডাকল। তাকে তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলছিল তখন ফোন বাজে। কথার ফাঁকে কল রিসিভ করলে ইমদাদের গলা পেল,
” ভিডিও কলে আয়। জলদি। ”

ইমদাদের গলায় কিছু তো ছিল যার জন্য সে তখনই ভিডিও কলে যোগ দিল। ওপাশ থেকে ইমদাদ বলল,
” চিনতে পারছিস? ”

ইশাদের হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। নিশ্বাস আটকে দুনিয়া ভুলে ফোনের স্ক্রিনে স্থির চেয়ে আছে। চোখদুটো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না এই হুইলচেয়ারে বসে থাকা ছেলেটা তাজ। সাথে তপন মুখার্জিকে না দেখলে হয়তো মিথ্যা বলে চেঁচিয়ে উঠত।

রুকমিনি মুখার্জি রিকশায় বসে থেকে ইশাদকে খেয়াল করছিলেন৷ আগ্রহ চেপে রাখতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন,
” ইশাদ, কোনো সমস্যা? ”

ইশাদ অসহায় চোখে তাকাল। মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
” আপনার ছেলে বেঁচে আছে। ”

রুকমিনি মুখার্জি একটুও অবাক হলেন না। ফোনটা ঠেলে দিয়ে বললেন,
” আমি সেদিন ভগবানের কাছে একটা দৈবশক্তির প্রার্থনা করেছিলাম। দৈবশক্তি না দিলেও একটা সুযোগ ঠিকই দিয়েছেন। ”

ইশাদ জিজ্ঞেসা চোখে চেয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” কাল রাতেই তাজের খোঁজ পেয়েছি। তোমার আংকেলের কাছ থেকে ওর শারীরিক অবস্থা শোনার পর আমি ভেঙে পড়ি। তখনই বেরিয়ে পড়ি ছেলেকে দেখার জন্য। তুমি বাসায় ছিলে না বলে জানতে পারনি। ও কে দেখার পর আমার যে পরিমাণ কষ্ট হয়েছে সে পরিমাণ রাগও হয়েছে। বার বার মনে হয়েছে, তিহির সাথে করা অন্যায়গুলোর শাস্তি পাচ্ছে। ”

ইশাদ কিছু একটা বলার জন্য উতলা হলে তিনি বললেন,
” আর পেছনে ঘুরো না বাবা, তিহির ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা আমি তাজের মা নয়, তিহির মা হিসেবে নিয়েছি। আমি চাই ওর সুখ ও ভবিষ্যৎ তুমি হও। ”

কৃতজ্ঞতায় ইশাদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। রুকমিনি মুখার্জি রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিলেন। ইশাদ ভিডিও কল কেটে একহাতে তিহি ও অন্যহাতে ইনাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঁজল। মনে মনে বলল, ‘ তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ‘

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here