তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৭
_______________
অরূণী,
মুখ জুড়ে তোমার গাঢ় মায়ার আস্তরন।চঞ্চল চোখ দুটোতে এক সরোবর মুগ্ধতা।তুমি হাসলে মনে হয় সূর্যের তির্যক আলো জলধির বুকে পড়ে ঝলমল করছে! কখনো বলা হয় নি তোমার কাজল রঙা চোখ দু’টো সুন্দর।আমি অনেক কিছুই বলি না। ভালোবাসা তো অনুভব করার বিষয়।এত বলাবলি কীসের?
রুদ্র
চিঠি’টা পড়া শেষে অরূণীর দিকে তাকালো সূর্য।অরূণীর হাত-পা জমে হিমশীতল হয়ে গেছে ততক্ষনে।শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। সমস্ত চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেছে। কি লেখা আছে চিঠিতে? রুদ্রর নাম লেখা আছে? সূর্যর চোখ দু’টো ধিকধিক করছে।মূহুর্তেই অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো। অরূণীর দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ। সূর্যর দিকে তাকানোর সাহস নেই।মনের মাঝে যে ভয়ঙ্কর শঙ্কা কাজ করতো সেটা আজ সত্যি হয়ে গেল? সূর্য অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো, “কীসের চিঠি এটা? রুদ্রর সাথে তোর কীসের সম্পর্ক?”
কথাগুলো অরূণীর কানে বিঁধতেই অরূণী রক্তশূন্য দৃষ্টিতে তাকালো।কী হবে এখন?অরূণীর হাত-পা কাঁপছে।ভয়ে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে যেন।প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। সূর্য কয়েক পা এগিয়ে অরূণীর কাছে গেল।গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, “রুদ্রর সাথে প্রেম তোর?কথা বলিস না কেন তুই?”
অরূণী কথা বলতে পারছে না।গলা ধরে আসছে।হাত-পা অনাবরত কাঁপছে। চেঁচামেচি শুনে সেলিনা আহমেদ দ্রুত পায়ে অরূণীর রুমের দিকে আসলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, “কী হলো তোদের?”
সূর্য দরজার দিকে ফিরে সেলিনা আহমেদের উদ্দেশ্যে বলল, “আব্বা বাসায়?”
সেলিনা আহমেদ বিষয়’টা বোঝার জন্য রুমের ভিতরে ঢুকলো।অরূণীর মুখের দিকে বিস্ময় ভাব নিয়ে তাকালো। সূর্যের চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। সেলিনা আহমেদ অরূণীর কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “কী হয়েছে তোদের?”
সেলিনা আহমেদের কথা শেষ হতে না হতেই সূর্য সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলো অরূণীর গালে। সেলিনা আহমেদ হতবুদ্ধি হয়ে তাকালো।তিনি ধমক দিয়ে বলল, “সূর্য তোর সমস্যা কী?”
– “সমস্যা কী আপনার মেয়ে’কে জিজ্ঞেস করেন।আব্বা কোথায়?বাসায়?”
– “তোর আব্বা ছাদে।গাছে পানি দিচ্ছে।”
সূর্য রুম ছেড়ে বেরিয়ে তৎক্ষণাৎ ছাদের উদ্দেশ্যে পা ফেলে।অরূণী যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে ই দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁয়। সামনের দিকে পা ফেলতে পারছে না।ভয় আর আতঙ্কে হাত-পা অবশ হয়ে রয়েছে। নিঃশ্বাস বার বার বন্ধ হয়ে আসছে। সূর্য চলে যাওয়ার পর সেলিনা আহমেদ অরূণী’কে প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে?কথা বলছিস না কেন? সূর্য কী তোকে কোনো কারণ ছাড়া মেরেছে? উল্টাপাল্টা কিছু করেছিস?সূর্য এত রেগে আছে কেন?”
সেলিনা আহমেদ ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাচ্ছে।অরূণীর কাছ থেকে কোনো উত্তর আসছে না। অরূণী’কে এভাবে নিরুত্তর দেখে সেলিনা আহমেদেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।সাহেদ আহমেদ অরূণীর রুমে আসে। সেলিনা আহমেদের দিকে তাকিয়ে উগ্র রোষ নিয়ে বলল, “মেয়ে কোথায় যায়?কোথায় কী করে এই সামান্য বিষয়ে তুমি খেয়াল রাখতে পারো না?”
সেলিনা আহমেদ অজ্ঞাত শঙ্কা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী করেছে অরূণী?”
সাহেদ আহমেদ অরূণীর দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। তারপর বলল, “অরূণী তোমার মোবাইল’টা দেও আমার কাছে।হ্যাঁ এটা আবেগের বয়স।সম্পর্কে জড়ানো খুব বেশি অপরাধের কিছু না। কিন্তু বুঝেশুনে কাজ করা ভালো।যা হওয়ার হয়েছে,ভুলে যাও ওসব।”
সাবলীল গলায় কথা গুলো বলল সাহেদ আহমেদ।অরূণীর বুকের ভিতর ধ্বক ধ্বক করতে লাগলো।কী ভুলে যাবে? সেলিনা আহমেদ এতক্ষণে ব্যাপার’টা বুঝতে পারলো।অরূণীর বিছানার বালিশের কাছ থেকে ফোন’টা হাতে নিলো।অরূণী চোখ তুলে তাকালো একবার সেদিকে। মনে হচ্ছে কেউ ওঁর কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। একটু সময়ের ব্যবধানে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।
________________
অরূণী নিস্তেজ শরীর নিয়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। শরীর’টা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিছু ভাবতে পারছে না। রুদ্রর সাথে যোগাযোগ কীভাবে করবে?সম্পর্ক’টা এগিয়ে নিবে কীভাবে?অরূণী কাঁদতে পারছে না। এতক্ষণে এক ফোঁটা জলও পড়ে নি চোখ থেকে।সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে।রুমে কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছে অরূণী। কিন্তু চোখ মেলে তাকালো না। বাসায় মানুষের এই রূপ একদম নতুন অরূণীর কাছে। মানুষ’টা আস্তে আস্তে এসে অরূণীর পাশে বসলো।
– “ভুল তো সবাই ই করে।আমরা কেউই ভুল ক্রুটির ঊর্ধ্বে না।ভুল শুধরে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।”
অরূণীর কর্ণরন্ধ্রে সেলিনা আহমেদের কথা গুলো বিদ্ধ হয়।কীসের ভুল করেছে অরূণী?অরূণীর চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। চিৎকার দিলো না,চোখ বন্ধ রেখেই শান্ত গলায় বলল, “তোমাদের কী মনে হয় না তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করছো? অতিরিক্ত কিছু ভালো না আম্মা।”
– “অতিরিক্ত? কীসের অতিরিক্ত? কীসের বাড়াবাড়ি?তুই কোন মুখে এসব বলছিস,তোর লজ্জা করে না?”
অরূণী উত্তর দিলো না। সেলিনা আহমেদ পুনরায় বলল, “ভালো ভাবে কথা বলছি বলে গায়ে লাগছে না?তোর বিবেক বিবেচনা লোপ পেয়েছে?আর কোনো ছেলে ছিলো না পৃথিবীতে?”
সেলিনা আহমেদ একা একা কথা বলে যাচ্ছে।অরূণীর কাছ থেকে কোনো উত্তর আসছে না।অরূণীর বুকের ভিতর কষ্টের মহাতরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। অসহ্য লাগছে সব কিছু। রাত দেড়’টা বেজে গেছে।অরূণী নির্জীব মনে তাকিয়ে আছে। রুদ্রর সাথে কথা বলায় তৃষ্ণায় ক্রমশ তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠছে। রুদ্রর সাথে কথা বলা প্রয়োজন খুব। কিন্তু কোনো উপায় নেই।কী লেখা ছিলো চিঠিতে?কী হবে এখন?সম্পর্ক’টা এখানেই শেষ হয়ে যাবে? রুদ্র তো এসবের কিছুই জানে না। রুদ্র কি ফোন দিয়েছে?ফোন’টা কার কাছে? সূর্যর কাছে না-কি সেলিনা আহমেদের?অরূণীর বন্ধ চোখের কোটর বেয়ে এবার পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তীব্র ছটফটানি নিয়ে একটা দীর্ঘ নির্ঘুম রাত পার করলো অরূণী। কষ্টের সময় গুলো এত দীর্ঘ কেন হয়?
(চলবে)