দহন পর্ব ১

#দহন
#পর্ব_১
#লেখা_মিম

কাল দুপুরে শিমুলের বিয়ে। হাতে মেহেদি লাগিয়ে ফ্যানের নিচে বসে আছে শুকানোর জন্য। ওকে ঘিরে চারদিকে ছোটখাটো একটা জটলা পাকিয়ে আছে। আগামীকাল এই বাড়ির ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই এই বাড়ির লোকজনের ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠছে। রফিক সাহেবের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট হচ্ছে শিমুল। সবার বড় হচ্ছে শিমুলের বড় বোন নদী। এরপর দুইভাই সৈকত আর মুকুল। সব কয়টার বিয়ে রফিক সাহেব সম্মানের সহিত সম্পন্ন করেছেন। শিমুলটাই শুধু বাকি ছিলো। অবশেষে এটাও কাল সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন। এই মেয়েটা ঘরের সবার অসম্ভব আদরের। এমনকি ভাইয়ের বউদের বলতে গেলে চোখের মনি সে। যার সাথে শিমুলের বিয়ে হচ্ছে সেও শিমুল বলতে অজ্ঞান। শিমুলকে ছাড়া সে কিছু ভাবতেই পারে না। দীর্ঘ চার বছরের প্রেমের ইতি ঘটতে যাচ্ছে কাল। তবে শিমুল অনিমকে বলে রেখেছে বিয়ের পরও তার সাথে প্রেম চালিয়ে যেতে হবে। আর নয়তো অনিমের সংসার সে করবে না। মুকুলের বউ ফোন হাতে দৌঁড়ে শিমুলের দিকে আসছে।
-শিমুল, শিগগির ফোন কানে নে। অনিম ফোন দিয়েছে।
– তুমি কানে ধরে দাও। দেখছো না মেহেদি লাগিয়ে রেখেছি। আমার পক্ষে ধরা সম্ভব না।
শিমুলের কানে মুকুলের বউ বৃষ্টি ফোনটা ধরলো।
– হ্যাঁ, অনিম বলো।
– কই ছিলা তুমি এতক্ষণ?
– কোথায় থাকবো আবার? রাত পোহালেই তো আমার বিয়ে। নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে ঘর ছাড়া কোথাও যাবো না।
– সেই কতক্ষন ধরে তোমার মোবাইলে ফোন দিচ্ছি রিসিভ করোনি কেন?
– মোবাইলটা তো আমার হাতে নেই। কোথায় আছে সেটা ঠিক বলতেও পারবোনা। ঘরভর্তি মানুষ। কোথায় না কোথায় পড়ে আছে কে জানে?
– তুমি জানো কতবার ফোন দিয়েছি তোমাকে আমি?
– না জানি না।
– এক্ষুনি মোবাইল খুঁজে বের করে দেখো কতবার ফোন দিয়েছি।
– আচ্ছা দাঁড়াও……..
এই আপা আমার মোবাইলটা একটু খুঁজে দেখ তো কোথায়?
– আমি তোর ফোনটা ওয়্যারড্রবে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। এত মানুষের ভীড়ে কখন আবার হারিয়ে যায় তাই।
– দে দেখি ফোনটা।
নদী শিমুলের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো।
– দেখ তো কয়বার অনিম ফোন দিয়েছে আমাকে?
– তিনবার।
– অ্যাই ছেলে……..
– কি?
– তুমি না বলেছিলে অনেকগুলা ফোন দিয়েছো আমাকে?
– হ্যাঁ দিয়েছিই তো?
– তুমি মাত্র তিনবার ফোন দিয়েছো।
– তুমি এটাকে মাত্র বলছো? তুমি জানো না আমি ফোন দেয়ার সাথে সাথে তুমি রিসিভ না করলে আমি কতটা অস্থির হয়ে যাই? তোমার জন্য চিন্তা হয় আমার?
– আমি বুঝিনা তুমি এমন কেন করো? আমি কি সবসময় ফোন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো নাকি?
– হ্যাঁ ঘুরে বেড়াবা। আমার চিন্তা হয় তোমাকে নিয়ে।
– আরে বাবা, এত চিন্তার কি হলো? আমি তো আমার ঘরেই আছি নাকি?
– তবুও কেন জানি না এমন হয়। আসলে তুমি আমার চিন্তাটা বুঝো না তাই তুমি আমার কথা শুনতে চাও না। মোবাইলটা সবসময় নিজের হাতে রাখলে কি এমন সমস্যা হয়ে যাবে তোমার?
– আমার ঘরভর্তি লোকজন। এত মানুষের মাঝে আমি আছি এতেও তুমি আমকে নিয়ে এত ভাবছো। আর তোমার ঘরে তো তুমি আমি ছাড়া আর একটা মানুষও নেই। তুমি তো ঘরে থাকো না বললেই চলে। তোমার ব্যবসা, রাজনীতি এগুলোর জন্য তো সারাদিনই বাহিরে থাকো। কাল থেকে তো তোমার ঘরে সারাদিন আমার একাই থাকতে হবে। তখন তোমার চিন্তা হবে না?
– হবে না আবার! আগে ফোন দিতাম এক দেড় ঘন্টা পরপর। আর এখন ফোন দিবো ২০ মিনিট পরপর। আর এজন্যই তো তোমার বাবার বাসার পাশেই বাসা নিয়েছি যাতে তোমার বিশেষ কোনো সমস্যা না হয়।
– হুম, তারপর আর কি খবর তোমার? রাত পোহালেই বিয়ে। এতদিন বিয়ে করবো, বিয়ে করবো বলে বলে তো মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলে আমার। শেষমেষ বিয়ে তো হচ্ছে। অনুভুতিটা বলো, শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
– মুখে প্রকাশ করে বোঝানোর মত না। একজন এতিম মানুষের জীবনে ফাইনালি কেউ আসছে যাকে আমি একান্তই আমার এবং আমার পরিবার হিসেবে দাবি করতে পারবো। বছর দেড় দুয়েকের মধ্যে আমার খালি ঘরটায় বাচ্চার হাসি-কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাবে। আমার খালি ঘর আর খালি থাকবে না। একজন এতিমের জন্য এর চেয়ে খুশির আর কিইবা হতে পারে শিমুল?
– তুমি আমাকে পেয়ে খুশি তো অনিম? বিয়ের পর আবার আফসোস করবে না তো কেনো আমাকে বিয়ে করলে?
– পাগল মেয়ে……. কি যে বলো না! তোমাকে পেয়ে আমি পূর্ন। আমার মনের প্রতিটা কোনায় তুমি ভালোবাসায় পূর্ন করেছো। তোমার মত একজন কে বিয়ে করে আমি আফসোস করবো! এ কথাটা তোমার মাথায় আসে কিভাবে? তুমি জানো আমি কতটা খুশি? তুমি আন্দাজ করতে পারবে না আমি কতটা খুশি। বিকেলের দিকে মুহিবের মা আমার হাতে মেহেদি পড়িয়ে দিতে দিতে বলছিলো, তুই আর মুহিব তো আমারই ছেলে। মুহিবকে যে নজরে দেখি তোকেও ঠিক এক নজরেই দেখি। জানিস তোর জন্য একেক সময় খুব কষ্ট হতো তুই একা থাকিস, কি খাস না খাস, তোর যত্ন করার একটা মানুষও নেই। তোকে হাজারবার বলেছি আমার বাসায় চলে আয়। তুই আসিস নি। সপ্তাহে একদিন দুদিন এসে তোর পায়ের ধুলা আমার বাসায় ফেলিস। খুব চিন্তা হতো তোর জন্য। কাল থেকে সব চিন্তা শেষ। শিমুল মেয়েটা অনেক লক্ষী। আল্লাহ তোর জীবনে একজন ফেরেশতা পাঠিয়েছেন তোকে ভালো রাখার জন্য, তোর যত্ন নেয়ার জন্য। কাল থেকে তোকে আর মাঝরাতে গেটের তালা খুলে ঘরে ঢুকতে হবে না। কেউ একজন দরজা খুলে তোর অপেক্ষা করবে। এই কথাগুলো শোনার পর কতটা খুশি লাগছিলো সেটা প্রকাশ করার মতো না। তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি।
– আন্টি মানুষটা তোমাকে খুব ভালোবাসে। কোনো মানুষ তার ছেলের বন্ধুকে এতটা ভালোবাসতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। উনাকে না দেখলে বিষয়টা আমার অজানাই থাকতো।
– হ্যাঁ আন্টি আমাকে খুব ভালোবাসে। মুহিবও আমাকে খুবই ভালোবাসে। আমার কোনো ছোট বোন থাকলে মুহিবের সাথেই বিয়ে দিতাম।

কাজ ফেলে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে বিরক্ত লাগছে বৃষ্টির।

-এই শিমুল, ফোনটা রাখ না। আমি কাজ ফেলে আসছি। কতক্ষন এভাবে তোর কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো?
– ওহ্ আমার তো তোমার কথা খেয়ালই ছিলো না। এই অনিম, পরে কথা বলি। আমার হাতে মেহেদি লাগানো। তাই ছোট ভাবী এতক্ষন কানে ফোনটা ধরে রেখেছিলো। ফোনটা এখন রাখো। পরে কথা হবে।
– ভাবী ধরে রাখলে সমস্যাটা কোথায়? ধরে রাখুক না আরো কিছুক্ষন। আরেকটু কথা বলবো তোমার সাথে।
– তুমি না আসলেই কেমন যেনো। সমস্যা বুঝতে চাও না। বাড়িতে কত্ত কাজ! এই মুহূর্তে আমার কানে ফোন ধরে যদি ভাবী দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কাজ করবে কে?
– আজকেই তো শেষবারের মতো প্রেমিক হিসেবে তোমার সাথে কথা বলবো। কাল থেকে তো তুমি আমার বউ হয়ে যাবে। তাই চাচ্ছিলাম আজ রাতটা তোমার সাথে প্রেম করে কাটাতে।
– তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো তোমাকে বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই বলেছিলাম বিয়ের পরও আমার সাথে প্রেম করতে হবে আর নয়তো……..
– হ্যাঁ.. হ্যাঁ বুঝেছি। আর নয়তো তুমি আমার সংসার করবে না।
– হুমম…. কথাটা যেনো আপনার মনে থাকে। আমাদের প্রেমের ইতি ঘটছেও না আর রাত জেগে আমার সাথে কথাও বলতে হবে না। এখন ফোনটা রাখছি। কাল দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।
– শোনো শিমুল…
শিমুল বৃষ্টিকে ইশারা দিলো কান থেকে ফোনটা সরিয়ে কেটে দেয়ার জন্য। শিমুল জানে অনিম কথা বলতেই থাকবে। সারারাতেও তার কথা ফুরোবে না। তাই সে অনেকটা জোরপূর্বকই ফোনটা কেঁটে দিলো।
– শুনেছিলাম প্রেমের সম্পর্ক দেড় দুইবছর থাকলেই নাকি মায়া, আকর্ষন কমে যায়। অনিমকেই দেখলাম সম্পর্কের চারবছর শেষ হওয়া সত্ত্বেও তোর প্রতি ঠিক সেই আগের মতই আকর্ষন রয়ে গেছে। দোয়া করি বিয়ের পরও তোর প্রতি একই আকর্ষন যেনো সারাটাজীবন থেকে যায়।
– ভাবী, ও মানুষটা খুব ভালো। প্রিয় মানুষদের নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে আগলে রাখে। হতে পারে ওর নিজের পরিবারের কেও নেই তাই হয়তোবা প্রিয় মানুষদের এতটা যত্নে রাখে।
– ও ভালো তাইতো আমরা সবাই রাজি হয়েছি এই বিয়েতে। আমরা নিশ্চিন্তে ওর হাতে তোকে তুলে দিচ্ছি।

পরদিন সকালে নাস্তার পর সব মেয়ে মানুষরা মিলে শিমুলকে গোসলখানায় নিয়ে হলুদ মাখিয়েছে। শিমুলের মা নেই। মায়ের পরিবর্তে ওর গায়ে প্রথম হলুদ ওর বড় বোন মাখিয়েছে। এরপর ওর বড় ভাবী আফসানা ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে। ওকে খাওয়ানোর সময় শিমুল দেখতে পেলো ওর বড় ভাবীর চোখ পানিতে ছলছল করছে। ও বেশ বুঝতে পারছিলো তার চোখে পানি কেনো। তাই ও কিছু জিজ্ঞেস করেনি ভাবীকে। শিমুলের মা যখন মারা যায় তখন সে ক্লাস এইটে পড়ে। নদীর তখন বিয়ে হয়ে শ্বশুড়বাড়ি গিয়েছে আট মাস হবে। ঘরে একটা মেয়ে মানুষের খুব প্রয়োজন ছিলো যে ঘরে শিমুলের মায়ের জায়গাটা পূরন করবে। তাই রফিক সাহেব বেশিদিন দেরী না করে বড় ছেলেকে বিয়ে করানোটাই শ্রেয় মনে করলেন। তাইতো মাত্র একুশ বছর বয়সেই ছেলেকে বিয়ে দিয়েছিলেন। এর দু’বছর পর ছোট ছেলের বিয়েটাও সেড়ে ফেললেন। শিমুলকে বাড়ির দুজন বউই একদম নিজের বোনের মত আগলে রাখে। আজ তাদের সেই বোনটা চলে যাবে অন্যের ঘরে। তাইতো আজ দুজনের চোখই ছলছল করছে। যদিওবা শিমুলের হবু বর পাশের গলিতেই বাসা নিয়েছে। তবুও….. তাদের মনে কষ্ট ভর করছে। সকাল নয়টা নাগাদ ঘরের সব মুরুব্বিদের সালাম করে শিমুল পার্লারে চলে গেলো। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত অনিম তাকে পাঁচবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। এমনকি পার্লারে বসে সাজার সময় সে সাতবার ফোন দিয়েছে। যিনি শিমুলকে সাজাচ্ছিলেন সে মহিলা অনেকটা বিরক্ত হলেন অনিমের উপর। লাস্ট ফোন কলের পর সেই মহিলা শিমুলকে বলেই ফেললো,
– সাজানোর সময় এতবার যদি বিরক্ত করে তাহলে কিভাবে হবে? জীবনে অনেক বউ সাজিয়েছি। কারো বরকে দেখিনি এতবার ফোন দিতে।
শিমুল সেই মহিলার কথার কোনো উত্তর দিলো না। শুধু মুচকি হাসলো। শিমুল এমন কথা আরও বহুবার শুনেছে। সবাই শিমুলকে একই কথা বলে, “কারো প্রেমিককে আজ পর্যন্ত দেখিনি এমন ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে। সে তোমাকে এত কেনো ফোন করে?”
প্রথম প্রথম শিমুল কথাগুলোর উত্তর দিতো, “সে আমাকে প্রচন্ড রকমে ভালোবাসে তাই ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়।” আজকাল শিমুল এই প্রশ্নের উত্তর আর দেয়না। একই কথা বারবার বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গেছে। সাজগোজ শেষ করে শিমুল কমিউনিটি সেন্টারে এসে পৌঁছেছে। এর ঘন্টাখানেক পর অনিম এসেছে বরযাত্রী নিয়ে। অনিমের আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউই নেই। বরযাত্রীর মধ্যে একদম গুনে গুনে দশ বারোজন আত্মীয় পাওয়া যাবে। বাদবাকি যতসব মানুষ দেখা যাচ্ছে এরা সবাই হচ্ছে অনিমের বন্ধু বান্ধব। বরযাত্রী বিয়ে বাড়িতে আসার দশ মিনিট পরই মুহিব এসেছে শিমুলের কাছে। সে শিমুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুবই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে।
– শিমুল……
– জ্বী, মুহিব ভাই।
– এত সুন্দর বউ আমি আগে কখনো দেখিনি। বিয়ের সাজে একটা মেয়েকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে?
– ফ্লার্ট করছেন ?
– মোটেই না। বিশ্বাস করো তোমাকে অসম্ভব সুন্দরী দেখাচ্ছে। তুমি অনিমের বউ তাই এখনও হাত পা গুটিয়ে বসে আছি। আর নয়তো তোমাকে কিডন্যাপ করে আমিই বিয়ে করে ফেলতাম।
কথাটা বলেই মুহিব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মুহিবের কথা শুনে শিমুল হাসতে হাসতে বললো,
– কি যে বলেন না মুহিব ভাই!! আপনি আমার চেয়ে আরও অনেক ভালো মেয়ে পাবেন।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here