দীর্ঘ রজনী পর্ব -১৫+১৬

গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৫

রিমির জন্মদিন আজ। সন্ধ্যায় ঘরোয়া ভাবে জন্মদিন সেলিব্রেট করা হবে। জন্মদিনে সাজি না গেলে কেক কাটবেনা বলেই পন করেছে রিমি। তাই সাজি সকাল সকাল বাবার সাথে কথা বলে যাওয়ার পারমিশন নিচ্ছে।

~ না গেলে হয় না মা? সন্ধ্যায় কোথাও যাওয়া কি উচিৎ?

অভিমানে বুক ভারি হয়ে এলো সাজির। নাক টেনে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠলো,, তুমি এক্ষুনি আসবে বাবা। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি!

একবার বারন করাতেই অভিযোগের ঢালি সাজানো শুরু করে দিলো সাজি।

~~ দুই বছর হয়েছে একবারও এলে না। কেন আসোনি বলো?তোমার কি একবারও তোমার মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করে না? তোমার ইচ্ছে তো করবেই না। করলে এতো বছর থাকতে?

ঠোঁটে ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলে উঠলো,

~রিমির বাবা ওর সাথে কলেজে যায়। কলেজ ছুটি হলে হাত ধরে রাস্তা পার করে ওকে বাড়ি নিয়ে যায়। আইসক্রিম কিনে দেয়। তুমি জানো ও সাইকেল চালাতে পারে। ওর বাবা ওকে এসএসসি পরীক্ষার পর সাইকেল চালানো শিখিয়েছে। আর তোমাকে দেখো! একবারও মেয়ে,বউকে দেখতে এলে না।

জুবায়ের মলিন হেসে মাথা নেড়ে বললো,, অপরাধ হয়েছে আমার। আমি কেন মেয়ে,বউকে দেখতে গেলাম না। জুবায়ের তার মেয়ের মতো মুখ ফুলিয়ে কান ধরলো।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। বাবার উপর রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না সাজি। পৃথিবীতে সব চেয়ে প্রিয় মানুষ গুলোর মধ্যে একজন হচ্ছে “বাবা”। বাবা বললে বিনা বাক্যে নদীতে ঝাঁপ দিতেও দুবার ভাববে না সাজি। বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সাজি।

জুবায়ের কান ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। মেয়ের এমন হাসি মানেই রাগ পড়ে গেছে। মা মেয়ে একই রকম। সামনের জন দোষ নিজের কাঁধে নিলেই তাদের রাগ পড়ে যায়।

সাজি মোবাইল স্ক্রীনে তার বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,, বাবা সত্যি করে বলোতো তুমি কি ওইখানে আরেকটা বিয়ে করেছো? আরেকটা মেয়ে আছে তোমার? বাই এনি চান্স মা যে বিদেশিনী বলে সে তোমার সেকেন্ড ওয়াইফ নয়তো?

জুবায়ের সাজির এহেন কথায় কেশে উঠে বললো,, আম্মু কি বলছিস এইসব। আরেকটা বিয়ে মানে?

সাজি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।

~ তাহলে তুমি আসছো না কেন? কবে আসবে বাবা?তুমি এলেই ঘুরতে যাবো। চলে এসো প্লিজ! দেখো তোমার একটাই মেয়ে। তার এতো টাকা পয়সার দরকার নেই। তার বাবা হলেই চলবে। টাকা না থাকলেও সে তার বাবার প্রিন্সেস।

জুবায়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো। মেয়ের প্রত্যেকটা কথায় বাবার প্রতি তার অভিমান নয় বরং অপূর্ণ আবদারের দেখা মিলছে। আসলেই মেয়েটাকে সময় দেওয়া হয়নি। না দেখেছে ছোট্ট সাজিকে বড় হতে। আদো আদো বুলিতে করা আবদার গুলোও পূরন করা হয়নি।

অফিসের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরোচ্ছিলো সাদ। আর তখনই সাজির গলার আওয়াজ শুনে থেমে যায়।
সাদ বুকে হাত গুঁজে এতক্ষণ সাজির কথা গুলোই শুনছে। আসলেই তো মামা সাজিকে সময় দিতে পারেনি। খুব বেশি হলে দুমাস থেকেছে।

~ ঠিক আছে মা! এতো রাগ দেখাতে হবে না। সাদকে বল। সাদ তোকে রিমিদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। আর হ্যা! ভালো দেখে গিফ্টো কিনে নিবে।

সাজির মুখটা চুপসে গেলেও কন্ঠে ঈষৎ রাগ নিয়ে বললো,

~সব সময় সাদ সাদ করো কেন? তুমি চেনো তাকে? আমি যদি এখন যেতে বলি তখন দেখবে থা*প্পড় মে*রে দাঁত ফেলে দিবে। তোমার বোনের ছেলে ডে*ন্জা*রাস বাবা! কথায় কথায় দাঁ*ত ফেলে দেয়। দরকার হলে জন্মদিনে যাবো না তাও ওই গাড় ত্যাড়াকে বলবো না।

জুবায়ের শব্দ করে হেসে উঠে বললো,,

~ এতোটা ভ’য়ং’ক’র?

~ ভ’য়ং’ক’র মানে! কঠিন ভ’য়ং’ক’র। এর সাথে যাওয়ার চাইতে আমার উচিৎ মিলিটারি ক্যাম্পে চলে যাওয়া।

সাজির কথায় হো হো করে হেসে উঠলো জুবায়ের। সাদকে নিয়ে মেয়ের যে ধারনা তা শুনেই বেশি হাসি পাচ্ছে।

এইদিকে সাদ বেকুবের মত দাঁড়িয়ে নিজের বদনাম শুনছে।কি মেয়েরে বাবা! পিঠ পিছনে এর এতো সাহস? ব*দনামের দোকান খুলে বসেছে দেখছি।সাজির অভিযোগে নিজেকে কোনো ছবির ভিলেন থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না সাদের।ভিলেন বললে কম হবে! কোনো র*ক্ষস মনে হচ্ছে। ফেরিটেলে থাকা রা*ক্ষস! যে সব সময় রাজকুমারীকে ভয় দেখাতে আসে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ভেবে দেখলো আসলেইতো! কখনো নরম হয়ে সাজির সাথে কথা বলেনি। বরং সব সময় থা*প্প*ড়ের ভয় দেখাতো।

সাদ পকেটে দুহাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়ালো।মাথা কাত হয়ে সাজির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সাজি চোখ বড় বড় করে নিখুঁত ভাবে এক একটা এলিগেশন লাগাচ্ছে সাদের উপর। কখনো হাত নাড়িয়ে কথা বলছে তো কখনো কপাল কুঁচকে। কখনো ভীতি প্রদর্শন করছে তো কখনো মুখ ফুলিয়ে রাখছে। সাদ মুগ্ধ হয় এতে। বার বার হাজার বার মুগ্ধ হয়। এতো বছর পার হলো তবুও মুগ্ধতায় ভাটা পড়লো না। বরং সেই মুগ্ধতা বাড়লো ব-ই কমলো না।

~ আচ্ছা বাবা সত্যি করে বলোতো। সাদ ভাই কি সত্যি ফুপ্পির ছেলে?

সাজির প্রশ্নে জুবায়ের চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, হঠাৎ এমন প্রশ্ন?

এইদিকে সাজির এহেন প্রশ্নে ঘোর ভাংলো সাদের। হকচকিয়ে গেল পুরো।এই মেয়ে বলে কি?

~ প্রশ্ন করার কারনতো আছেই বাবা। তা না হলে দেখো। আমার ফুপ্পি কত্তো কিউট!কত্তো ভালো আর শান্ত। কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলে।
ফুফাও খুউউব ভালো ছিল। সব সময় সবার সাথে কতো সুন্দর করে কথা বলতো। রাগ তো একটুও ছিল না। তুমি জানো বাবা ফুফা সবসময় আমার জন্য চকলেট কিনে আনতো। ঠিক যেমন জেঠু নিয়ে আসতো তেমন।

কিন্তু সাদ ভাইকে দেখো! একটা গুনও ফুপ্পি- ফুফার মতো পায়নি। এর থেকে তো সন্দেহ হবেই। নিশ্চয়ই ফুপ্পি এই রাগী বাচ্চাকে এডপ্ট করেছে। এইটা আমার ফুপ্পির ছেলে হতেই পারে না।

জুবায়ের মেয়ের কথায় গুরুত্ব দিলেন। নয়তো চটে যেতে দেরী হবে না। মেয়ে তার মায়ের মত উদ্ভট কথা আর যুক্তিতে ওস্তাদ। তাদের এই উদ্ভট কথা আর যুক্তিতে সহমত পোষণ না করলেই বিপত্তি। জুবায়ের সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো ঠিক বলেছিস তো। আমার মায়ের কথায় যুক্তি আছে।

সাজি মুখে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,, হুম এতো দিন এইটাই ভাবছিলাম।

সাদ দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বলে উঠলো,, একবার খালি হাতের কাছে পাই। চা*পকে সিদে করে দিবো।
রাগে গজগজ করতে করতে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লো সাদ।
~এই মেয়ে আমার মামুর চোখে আমাকে ঘাড় ত্যাড়া প্রমাণ করলো! আমার চাইতে মিলিটারি ক্যাম্পে যাওয়া বেটার! ওয়েট এন্ড সি !আজিবন আমার সাথেই থাকতে হবে। এই গাড় ত্যাড়া ছেলেটাই তোমার বর হবে। ফুপ্পির দত্তক নেওয়ার ছেলের বউটা তুমিই হবে সাজবাতি।
গাড়ির স্টেয়ারিংএ ঘু*সি মে*রে হিস হিস করে বলে উঠলো সাদ।
__

জুবায়ের মুচকি হেসে বলল,, কিন্তু আম্মু, আমিতো দেশে নেই। আর জানিও না দেশের এখন পরিস্থিতি মেয়েদের জন্য কতোটা সেইফ। তবে সাদ জানে, সাদ ভরসার যোগ্য ,ও তোমার খেয়াল রাখবে। তাই সাদকে বলে লক্ষি মেয়ের মতো তৈরি হয়ে রিমিদের বাসায় যাবে ঠিকাছে!

সাজি মাথা নেড়ে হ্যা বুঝালো। জুবায়ের কয়েক সেকেন্ড মেয়ের দিকে তাকিয়ে কল কেটে দিলো। এইবার দেশে না গেলেই নয়। দায়িত্বটা থেকে কিছুদিন অব্যহতি নিয়ে নীড়ে ফিরতে হবে। মেয়ে আর প্রিয়তমা তার ফেরার অপেক্ষায় আছে।

সাজি বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে, ফুপ্পির পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। উদ্দেশ্য সাদকে রাজি করানো। রেনু মিট মিট করে হাসছে।

অনিলা স্মিত হেসে সাজিকে জড়িয়ে ধরল।

~ তা কি পরে যাবি?শাড়ি নাকি থ্রিপিস?

সাজি ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছেনা ফুপ্পি কি বলছে। কোথায় যাওয়ার কথা বলছে?

অনিলা সাজির হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো। আলমিরা খুলে একটা একটা করে সব কটা শাড়ি বের করতে লাগল।

সাজি অবুঝ চোখে অনিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,,

~ কোথায় যাওয়ার কথা বলছো ফুপ্পি?

অনিলা রহমান একটা টকটকে লাল শাড়ি হাতে তুলে নিলো। সেই শাড়ির আচল সাজির মাথায় নিয়ে বললো,, রিমির জন্মদিনে।

~ সত্যি!

~ হুম সত্যি। এখন দেখ শাড়িটা কেমন। আমার তো বেশ লাগছে।

~ আগে বলো তুমি কি ভাবে জানলে?

~ রেনু বলেছে। এই নিয়ে নাকি বাবার সাথে রাগারাগীও হয়েছে।

সাজি মুখ ফুলিয়ে বললো,, রাগারাগী আর কই হলো। বাবার সাথে বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারি না।

অনিলা রহমান অন্য শাড়ি গুলো গুছিয়ে রেখে সাজির হাতে লাল শাড়িটা ধরিয়ে দিলো।

____

বিকেলে অনিলা আর রেনু মিলে সাজিকে শাড়ি পরিয়ে দিলো।

রেনু নিজের ব্যাগ থেকে লাল লিপস্টিক এনে সাজির ঠোঁট দুটো রাঙ্গিয়ে দিলো।

অনিলা সাজির চুলে সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে একটা আর্টিফিশিয়াল লাল ফুল সাজির খোঁপা গেঁথে দেয়।যেটা টিভির পাশে ফ্লাওয়ারবাসে সাজানো ছিল।

কান খালি দেখে রেনু তার লাল ঝুমকো জোড়া এনে দিলো। ঝুমকা জোড়া বেশ পুরোনো,একটা ঝুমকাতে দুই পাথর নেই।এতে রেনু ইতস্তত বোধ করছিলো তবে সাজি বেশ উৎসাহ নিয়েই ঝুমকো দুটো পরলো।

সাজি ভিষন খুশি এই প্রথম এমন সাজগোজ করেছে। বার বার ঘুরে ঘুরে আয়নাতে নিজেকে দেখছে।

রেনু সাজির দিকে তাকিয়ে আ*হত স্বরে বলল,, লাল চুড়ি নেই। মনে হচ্ছে দেশে প্রধান মন্ত্রী নেই।

রেনুর কথা শুনে আনিলা মুখ চেপে হাসছে। সেঁজুতি ঠিকই বলেছে, রেনুর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আফ্রিকার ক্যাঙ্গারু হওয়া বাদেও উল্টো পাল্টা কথা বলার ক্ষমতা।

গাড়িতে বসে মাকে কল দিলো সাদ।

অনিলা সাদের কল পেতেই সাজিকে তাড়া দিয়ে গেইটের কাছে যেতে বললো।

সাজি শাড়ি ধরে পা টিপে টিপে গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সাদ বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামতে যাবে এমন সময় চোখ পড়লো গেইটের দিকে।
বার কয়েক চোখ কচলে আবার তাকালো। সোজা হয়ে বসে লম্বা শ্বাস নিয়ে মাকে কল দিলো।

অনিলা রহমান এতক্ষণ ধরে এই কলটার অপেক্ষাই করছে। কল রিসিভ করে বলে উঠলো,,
তোর বাবা যেই দিন আমাকে প্রথম প্রেম নিবেদন করে, সেই দিন আমি এই শাড়িটাই পড়ে গেছিলাম। কাকতালীয় ভাবে আমার কাছেও লাল চুড়ি ছিল না। শূন্য হাত জোড়া দেখে তোর বাবা আমাকে দু মুঠো লাল চুড়ি কিনে দেয়।

সাদ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে উঠলো,, আমাদের ফিরতে দেরী হবে মা।

অনিলা কল কেটে দিয়ে মুচকি হাসে। সেই দিনের মতো এই ব্যাস্ত শহরে আজও কি প্রেম নিবেদন হবে? কে জানে! হয়তো হবে।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আজ কিন্তু বড় করে দিয়েছি।)গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৬

ঘর থেকে বেরিয়ে গেইট ওবদি পথটা ছোট হলেও, গেইট থেকে গাড়ি ওবদি পথটা খুবই লম্বা মনে হচ্ছে সাজির কাছে। চঞ্চল পা দুটো বরফের ন্যায় জমে গেছে ।পা সামনের দিকে চলছেই না।
শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে সাজি। অন্তঃকোনে জেঁকে বসা মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, ভাবতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। গালের দুপাশ গরম হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
কিছুটা পথ পেরুলেই সেই মানুষটির খুব কাছে গিয়ে বসতে হবে। গুনে গুনে চার, পাঁচ আঙুলের দূরত্ব হবে হয়তো। এইভাবে দেখে কি ভাবছেন উনি! আচ্ছা বাজে লাগছে নাতো? হৃদস্পন্দনের শব্দ কেমন বিদঘুটে শুনাচ্ছে। অন্তঃকোনে প্রশ্নের জটলা পাকিয়ে গেছে। উত্তর খোঁজার ইচ্ছে নেই,আর না আছে উত্তরের আশা।

সাদ সাজির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ সরিয়ে নিতে গিয়ে আবারো দৃষ্টি প্রগাঢ় করলো। এই দিকে হৃৎপিণ্ড শরীরের সাথে বিরোধীতা শুরু করে আন্দোলিত হচ্ছে। মস্তিষ্কের সাথে হৃৎপিণ্ডের বাকবিতন্ডা চলছে ক্রমশো। এমন চলতে থাকলে অনুভূতিরা দৃষ্টি গোচর হতে দেরি হবে না। নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ সরিয়ে নিল সাদ। মনে মনে বলে উঠলো,সময় হোক তখন নাহয় দ্বিধা সংকোচ মিটিয়ে প্রনয়িনীকে দেখবো।আজ তার ছুটি! আজ সত্যি তার ছুটি!

লাজুক দৃষ্টি জোড়া নতো করলো সাজি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে লজ্জা নিবারণের প্রচেষ্টা চালালো। অতঃপর সেই লাজের পর্দা ঠেলে গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গেলো।

সাদ নিভৃতে গাড়ির দরজা খুলে সামনে তাকালো।
সাজি উঠে বসতেই সাদ ভারী কন্ঠে বলে উঠলো, শাড়ির আঁচল সামলে বস।

সাজি আঁচল গুটিয়ে দরজা আটকালো। হৃৎপিণ্ড ঢিব ঢিব শব্দ করছে। ঢিব ঢিব শব্দটা জোরেই হচ্ছে,পাশে বসে থাকা ব্যাক্তি শুনে ফেলর মতো জোরে। মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু হওয়ার আগ মুহুর্ত চলছে।

আড়চোখে পাশে বসা ব্যাক্তিগত রমনীকে দেখে নিলো সাদ। পূর্ণ দৃষ্টি রাখলে হয়তো আরেকটু খুটিয়ে দেখতে পেতো। তবে এতেও খুব একটা কম পরখ করেনি। চুল থেকে পা ওবদি স্ক্যান করে ঠিকই নিয়েছে। খোপায় কৃত্রিম ফুল,কানে পরা ঝুমকার দুটো পাথর নেই, ঠোঁটের লিপস্টিক ছড়িয়ে আছে, ব্লাউজের কাঁধ ভেদ করে বি বেল্ট বেরিয়ে পড়েছে। সবটাই একদেখায় চোখে ধরা পড়লো।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে স্লোলি ড্রাইভ করতে লাগলো সাদ। আপাতত সবটা এইভাবেই থাক। নামার সময় গুছিয়ে দিবে। নয়তো এখনই লজ্জায় সিটিয়ে যাবে।

সাজি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। লজ্জার কারনে জিজ্ঞেস ওবদি করতে পারছে না যে রিমির জন্য কি গিফ্ট নিয়েছে।

সাদ যেন সেই প্রশ্ন শুনতে পেলো। স্টেয়ারিংএ হাত রেখে নিরেট স্বরে বলে উঠলো, রিমির জন্য বড় টেডি বিয়ার, চকলেট নিয়েছি, সাথে মামুনীর পক্ষ থেকে একটা ড্রেস নিয়েছি।

সাদের গলা শুনে সাজি সাদের দিকে তাকালো। সাদ একটা মোবাইল সাজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এইটা রাখ। একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস ছবি তুলিস।তোরা মেয়েরাতো আবার ছবি উঠানো পছন্দ করিস।

সাজি বোবা চোখে সাদকে দেখছে।হুট করে কেমন গলার স্বর বদলে গেছে। এই বদলটা সাজি ভালো করেই চেনে।

~ মোবাইল আমাকে দিলে আপনি কি নিয়ে যাবেন?যদি অফিস থেকে কল আসে তখন? তখন আমি কি বলবো?

~ কিছুই বলতে হবে না। বলার জন্য ওই মোবাইলে কল আসবে না। কল আসলেও সেটা আমিই দিবো। আমার কাছে আরেকটা মোবাইল আছে , তুই এইটা নিয়ে যা।

~ ঠিক আছে।

~একটা ঝুমকোতে দুইটা পাথর নেই। এইটা পরেছিস কেন?

সাদের এহেন কথায় হকচকিয়ে গেল সাজি। দুইটা পাথর নেই এইটাও খেয়াল করেছে? কই তাকাতে তো দেখলাম না! তাহলে! ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো সাজি। মিনমিনে গলায় বলল,,

~ এইটাই ছিল রেনুদির কাছে।

সাদ সরু চোখে তাকিয়ে সুধালো,, রেনুদির কাছে মানে? তোর নেই? তুই রেনুর গুলো নিলি কেন?

সাজি দুপাশে মাথা নেড়ে বুঝালো তার কাছে নেই।

সাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,, নেই কেন?

সাজি ঠোঁট কামড়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,, আমি কখনো এইসব পরিনি তাই নেই। আজ ফুপ্পি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। রেনুদি তার ঝুমকো এনে দিয়েছে। দুটো পাথর নেই তো কি হয়েছে! তাও এইগুলো সুন্দর।

সাদ স্পষ্ট বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, কিছুই সুন্দর নয়। তুমি সুন্দর দেখে তোমাকে জড়িয়ে সব সুন্দর প্রনয়িনী!

সাজির কানে ঈষৎ অস্পষ্ট শোনালেও বুঝতে বাকি রইল না সাদের কথা। তবুও মৌন রইলো সে। বুঝতে দিলো না এই শ্রুতিমধুর বাক্য যে তার কর্ণোগোচর হয়েছে। শুধু শেষ বিকেলের রোদ্দুরে চোখ রেখে মুচকি হাসলো সাজি।

গন্তব্যে পৌঁছালো দু’জন। গাড়ি থেকে নামার আগেই থামিয়ে দিলো সাদ। সিটবেল্ট খুলে এগিয়ে গেলো সাজির দিকে।
সাদের এহেন কান্ডে হকচকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো সাজি।
সাদ শান্ত চোখে সাজির দিকে তাকিয়ে বললো, একটু চুপ করে বস! এলোমেলো হয়ে এই ভাবে ভেতরে যাবি?আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

সাজি শান্ত হতে পারলো না। হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। টেনে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।

সাদ ট্যিসু দিয়ে আলতো হাতে ছড়িয়ে থাকা লিপস্টিক ঠিক করে দিলো। শাড়ির আঁচল টেনে কাঁধে উঠিয়ে মিনমিনে গলায় বলল, রিমির কাছে গিয়ে শাড়ির আঁচল সরিয়ে ঠিক করে নিস। আপাতত এইভাবেই ভেতরে যা।

সাজি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।

সাদ গাড়ি থেকে নেমে সাজির পাশের দরজা খুলে দিল। সাজি নেমে দাড়াতেই ঝুঁকে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে উঠে দাড়ালো সাদ। সাজি স্টেচুর মতো অনূভুতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছেনা যা হচ্ছে তাকি আধেও সত্য! নাকি সবটাই কেবল ভ্রম!

রিমির জন্য আনা গিফ্ট গুলো সাজির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো সাদ। জানালার কাঁচ নামিয়ে সাজিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, ফোন নিজের হাতের কাছে রাখবি,যেন কল দিলেই পাই। আর হ্যা! আমি ঠিক নয়টায় তোকে নিতে আসবো।

দুহাতে জড়িয়ে রাখা টেডির আড়াল থেকে মাথা বের করে বলল, ঠিক আছে।

সাদ মুচকি হাসলো।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটে চললো নিজ গন্তব্যে।

সাদের হাসি সাজির দৃষ্টি এড়ালো না। বরং সেই হাসি দৃষ্টিগোচর হতেই অন্তঃকোনে খানিকটা জায়গা আবারো সাদ ভাই নামক ব্যাক্তিটার জন্য বরাদ্দ করা হলো।

রিমির ঘরে গিয়ে শাড়ির আঁচল সরাতেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো সাজিকে। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে, কেন সাদ ভাই তাকে রিমি ঘরে গিয়েই শাড়ির আঁচল ঠিক করতে বললো। আলগোছে ব্লাউজের আড়ালে বি বেল্ট ঢেকে নিলো। রাগের আড়ালে যত্ন শব্দটা লুকিয়ে রেখেছে ভেবেই ঠোঁট এলিয়ে হাসলো সাজি।

রিমির জন্মদিনে বাইরের কেউ ছিলনা বললেই চলে। রিমির মা-বাবা, ছোট ভাই, বাড়ির মালিকের দুই মেয়ে ,সাজি আর বার্থডে গার্ল রিমি। এই কজন নিয়েই তাদের আয়োজন। চারজন মেয়ে মিলে হইহুল্লোড় করে জন্মদিন সেলিব্রেট করায় ব্যাস্ত। তার চেয়ে বড় কথা সবকটা মিলে ফোনে ছবি তুলে মেমোরি ফুল করা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।

এইসবের মধ্যে বিপাকে পড়েছে সাজি। সাদের ফোনে নাকি ছবি সুন্দর আসে তাই শাড়ি পরিহিত রমনী গুলো সেই ফোনের উপর উপচে পড়ছে।
ভাগ্যিস সাজি সবার আগেই নিজের বেশ কয়টা ছবি তুলে নিয়েছিলো। তাই আপাতত তার ছুটি। সে দিব্যি সোফায় বসে বসে রিমির ভাই রিহানের সাথে গল্প করছে।

এই দিকে রিমি দুকদম এগিয়ে চলছে। যখন থেকে শুনেছে এইটা সাদের মোবাইল তখন থেকেই তার মাথার সয়তানি বুদ্ধি গুলো কিলবিল শুরু করে দিয়েছে।
সাজির আশপাশে ঘুরে ঘুরে সাজির কচাকচ ছবি তুলছে। সাজি বেচারি বিনা দোষে ভুক্তোভোগী।

ঘড়ির কাঁটা নয়টায় পৌঁছতেই সাজির হাতে মোবাইল ফোন স্বশব্দে বেজে উঠলো। চমকে উঠলো সাজি, ঘন পল্লব ঝাপটে ফোনের স্ক্রীনে চোখ রাখলো। পিটপিট করে তাকিয়ে শেষের দুই ডিজিট খেয়াল করলো। সাদের নাম্বারের শেষের দুটো ডিজিটও একই তাও দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে সে। নাম্বার মুখাস্ত করায় সাজি বরাবরই মূর্খতার প্রমাণ করে। শেষের দুটো ডিজিট ছাড়া সব তালগোল পাকাতে থাকে।
সাহস করে কল রিসিভ করলো।

অপরপ্রান্তে বসে থাকা ব্যাক্তি সাজির কন্ঠস্বর শোনার জন্য ব্যাকুল প্রায়। সে জানে আজ কতোটা ধৈর্য নিয়ে নয়টা ওবদি অপেক্ষা করেছে। সে পারলে পুরো পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটা হাত দিয়ে টেনে নয়টায় এনে থামায়। কিন্তু নিরুপায়!তার না সেই ক্ষমতা আছে,আর না সেই ক্ষমতা হবে কখনো।

সাজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে নরম গলায় সালাম দিলো।

সাদ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সালামের উত্তর দেয়।
~ আমি বাইরে আছি। ধীর পায়ে নিচে নেমে আয়। তড়িঘড়ি করে আসবি না। শাড়ির সঙ্গে পা বেজে পড়ে যাবি। সাবধানে।
সাদের অতিশয় আদুরে গলায় কেঁপে উঠলো সাজি। অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গ ত্যাগে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগলো না। বরং ক্ষনে ক্ষনে পুলোকিত হওয়া মন নিয়ে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলো।
শাড়ির কুচি একহাতে সামলে , সামনে পা ফেলে এগোলো।

গাড়ির দরজা খুলে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। সাজি কাছে আসতেই যত্ন করে বসিয়ে আঁচল গুটিয়ে সাজির হাতে দিলো।

অন্ধকার হওয়াতে সুবিধা হলো সাজির। ল্যাম্পপোষ্টের ঈষৎ আলোতে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে নরম গরম মানুষটাকে মন ভরে দেখছে সে।
শার্টের দুটো বোতাম খুলে রেখেছে সাদ। গুটানো হাতা দুটো উপর নিচ হয়ে আছে। চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো হলেও সব মিলিয়ে কাউকে ঘয়েল করার মতো সুন্দর লাগছে।

ড্রাইভিং সিটে বসে আলো জ্বালিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তখনও সাজির দৃষ্টি জোড়া সাদ ভাইয়ে আবদ্ধ।

সাদ বাঁকা হেসে স্টেয়ারিং উইল গুরিয়ে বাড়ির পথের উল্টো দিকে নিলো। প্রনয়িনীর মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে অবগত। সাদ তো বরাবরই চাইতো এইভাবেই তাকিয়ে তার প্রনয়িনী তাকে দেখুক।

গাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে কিনা তা সাজি জানে না। তবে গাড়ি থামলো এক নিস্তব্ধ পরিবেশে। থমথমে পরিবেশ গা ছমছম করার মতো হয়েও, সাজি ভয়ে সিটিয়ে পড়লো না। পড়বেই বা কেন?সাদ ভাই নামক মানুষটা আছে তার পাশেই তো আছে। ভয় পেলো না সাজি না ঘাবড়ালো সে বরং আশেপাশে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। আধেও কি জায়গাটা তার পরিচিত?

ইনশাআল্লাহ চলবে,,,

(ভুল গুলো সুধরে দিবেন। দুঃখিত অসুস্থতার কারণে এতো দিন গল্প দিতে পারিনি। দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here