#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২১
#Writer_Fatema_Khan
সময় নদীর স্রোতের মতন বহমান। কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। ঠিক তেমনি আয়াত আর মেহেরের জীবনও থেমে নেই।
আজ দুই সপ্তাহের মতো গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে তারা৷ সবাই নিজের কর্ম জীবন নিয়ে ব্যস্ত এখন৷ বিথীর বিয়ে খুব ধুমধাম ভাবে হয়ে গেছে। বিথীর চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ছিল। যেনো প্রতীক্ষিত মানুষের কাছে যাওয়ার আনন্দ। মেহেররা নিজেরাও খুব আনন্দ করেছে বিয়েতে। বিথীর বিয়ের এই কয়টা দিন আর আয়াত আর মেহের আলাদা করে কথা বলতে পারে নি৷ কথা বলার সুযোগ হয় নি কথাটি ভুল। আসলে মেহের আয়াতের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে৷ আয়াত ওই রাতের পর কয়েকবার মেহেরের সাথে আলাদা কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু মেহের তা বুঝতে পেরে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত। তবে বিয়ের সকল অনুষ্ঠানের মাঝেও দুইজনের চোখাচোখি হয়ে যেত প্রায়ই। মেহের যেখানে আয়াতকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করতো, আয়াত সেখানে মেহেরের দিকেই তাকিয়ে থাকত৷ এমন সাদামাটা চলাফেরার মেয়েটা যখন সেজেগুজে সামনে আসে তখন এতটা আবেদনময়ী লাগতে পারে তা আয়াতের জানা ছিল না। বিয়ে বাড়ি বলে সবার সাথে মিল রেখে না চাওয়া সত্ত্বেও সাজতে হয়েছে মেহেরকে৷ আর আয়াতের চোখ আটকে রয়েছে সেই মায়াবী মুখশ্রীতে। মেহের না তাকালেও বুঝতে পারত আয়াত যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ আনিকেকেও অনেক সুন্দর লাগছিল৷ বলতে গেলে বিথীর পর আনিকাকেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিল৷ আনিকা বারবার খুটিয়ে খুটিয়ে নিজেকে দেখে সব মেয়েদের কাছেই জিজ্ঞেস করছিল তাকে কেমন লাগছে দেখতে। সবাই সুন্দর বললেও তার মন ভরতো না। কারণ যার জন্য এত সাজ সে তার দিকে ফিরেও তাকাতো না৷ একদিন তো আয়াতের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে৷ ভাইয়া আমাকে কেমন লাগছে৷ আয়াত মুচকি হেসে শুধু সুন্দর বলেই চলে গেছে৷ এতে আনিকার মনক্ষুণ্য হলেও কিছুই করার ছিল না। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। প্রথম দিকে না বুঝলেও বিথীর বিয়ের সব অনুষ্ঠানে আয়াতকে খুব ভালো করে খেয়াল করেছে সে৷ আর আয়াত যে মেহেরে আবদ্ধ সেটাও খুব ভালোই বুঝেছে সে। তাই তো ফেরার দিন মেহেরের হাত ধরে বলেছিল,
“তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু। এমন একজনকে দূরে ঠেলে দিও না, আগলে রেখো। অনেক সুখী হবে।”
তারপর জড়িয়ে ধরে মেহেরকে। মেহের কথার সারমর্ম না বুঝলেও এটা বুঝেছে আনিকা কিছু একটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। তবুও আনিকাকে জিজ্ঞেস করলো তার কি কিছু হয়েছে? আনিকা হেসে জবাব দিল কিছুই হয় নি, তবে সবার সাথে অনেকদিন ছিল তাই মন খারাপ হচ্ছে৷ এই বলেই বেড়িয়ে পরলো নিজ গন্তব্যে। তার কিছুক্ষণ পরেই মেহেররাও নিজেদের গন্তব্যে বেড়িয়ে গেলো।
আজ দুই সপ্তাহ নিজেদের বাড়ি ফিরে এলেও মেহের নিজেকে আয়াতের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলে৷ কারণটা তার নিজেরও অজানা৷ অফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে বাসায় আসে মেহের। আয়াত, কাসফি এতক্ষণে বাসায় এসে গেছে৷ মেহেরের বাবা আর চাচা গেছেন কোনো এক কাজে। মেহের নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেলো। নিজের জন্য এক কাপ কড়া চা করে নিল। মাথা ব্যাথা করছে তার। মাথা ব্যাথা হলে লিকার বেশি দিয়ে অনেকক্ষণ জাল দিয়ে চা তৈরি করে মেহের। তবে তাতে চিনি দেয় না। তার ধারণা চিনি দিলে কড়া ভাবটা চলে যাবে আর এটি একটি অতি সাধারণ চায়ে পরিণত হবে। তাই চিনি ছাড়া লিকার বেশি সাথে অনেকটা সময় ধরে জাল দেওয়া গরম গরম চা খেলেই বোধহয় তার মাথা ব্যাথা কমবে এটাই তার ধারণা। তবে এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এটার কোনো ধারণা নেই, এটা মেহেরের নিজস্ব ধারণা বলা যায়। চুলায় চা বসিয়ে আরেক চুলায় এক প্যাকেট নুডলস বসালো মেহের। মাহি তার নানুর সাথে খেলছে। আসার সাথে সাথে আগেই নিজের মেয়ের খবর নিয়েছে সে৷ মাহিকে খেলতে দেখে নিজের ঘরে চলে যায় সে। নুডলস আর চা হয়ে গেলে একটা বাটিতে নুডলস আর একটা কাপে চা নিয়ে উপরে চলে গেলো মেহের। কাসফির ঘরের সামনে এসে দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। মেহের ভেতরে গিয়ে দেখে কাসফি বারান্দায় বসে আছে। হাতের ট্রে টা খাটের এক সাইডে রেখে সে নিজেও বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। কাসফি কে ডাক দিয়ে মেহের বললো,
“কাসফি আছিস?”
বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো কাসফি একটা ছোট্ট চারাগাছ এনেছে। সেটাই তার বারান্দায় রাখছে৷
“আরে আপু তুমি কখন এলে? এই দেখো আয়াত ভাইয়া আজ স্কুল থেকে আসার পথে আমাকে কি কিনে দিয়েছে, একটা গোলাপ গাছের চারা। কি সুন্দর না! একটা ছোট কলিও আছে। ভাইয়া বলেছে দুই একদিনের মাঝেই কলিটা ফুল হয়ে যাবে। আর যত্ন করলে এই গাছে আরও অনেক ফুল ফুটবে।”
মেহের কাসফির কাছে গিয়ে বসে দেখলো কাসফি খুব যত্নে গাছটাকে এক কোণায় রেখে দিয়েছে৷ মেহের কাসফির মাথায় হাত রেখে বললো,
“খুব সুন্দর গাছটা। এখন উঠে চল আমার সাথে তোর জন্য গরম গরম নুডলস বানিয়েছি। হাত ধুয়ে খেয়ে নিবি। আর তোর ফুল গাছ খুব পছন্দ নাকি? কই আমাকে তো কখনো বলিস নি?”
কাসফি উঠে দাঁড়ায় আর ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,
“তোমায় কি করে বলি একটু বলবা, যেই রাগী মুড নিয়ে সারাদিন থাকো কিছু বলতেও ভয় করে। তাই আগে ডেইলি তোমার সাথে বাসায় আসলেও কিছুই বলা হত না।”
কাসফি ওয়াশরুমের ভেতর গিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পরলো। মেহেরও তার পাশেই বসলো। মেহের চায়ের কাপে চুমুক দিলো বার কয়েক। আর কাসফি খুশি মনে নুডলস খেতে লাগলো। মেহের কাসফির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমি কি খুব রাগ দেখাই তোর সাথে?”
“রাগ দেখাও বলি নি তো রাগ রাগ মুড নিয়ে সবসময় থাকো। তুমিতো আমাকে বকও না। কিন্তু এদিকে আয়াত ভাইয়া আমাকে বকাবকি করে কিন্তু রাগী মুডে থাকে না। সবসময় হাসাতে থাকে।”
“ওহ।”
“আপু তুমি কি রাগ করলে?”
“কই নাতো রাগ করবো কেনো!”
“আর আমিতো আয়াত ভাইয়ার কাছেও গাছের কথা বলি নি, যে কিনে দিতে। কিন্তু ভাইয়া নিজে থেকেই আমাকে নার্সারি নিয়ে গেছিলো তারপর আমি খুব খুশি হয়ে যাই। তারপর ভাইয়া এই গাছটা কিনে দিয়েছে। তারপর বলেছে এটা যদি যত্ন করে বড় করতে পারি তাহলে আরও কয়েকটা কিনে দিবে৷ ভাবতে পারো আপু আমারও একটা বাগান বারান্দা হবে৷ আমিতো সেই এক্সাইটেড। জানো তো আমি আমার গোলাপের চারার খুব যত্ন করব যাতে ভাইয়া আরও কয়েকটা কিনে দেয়। আর তুমি রাগ করো না আমি তোমাদের দুইজনকেই খুব ভালোবাসি।”
মেহের কথা না বাড়িয়ে চায়ে দ্রুত চুমুক দিতে লাগলো৷ চা শেষ করে কাসফিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর না গ্রামে যাওয়ার আগে এক্সাম হয়েছিল, ওইটার রেজাল্ট দিয়েছে কি?”
কাসফির মুখটা ছোট হয়ে গেলো, মুহূর্তেই হাসি মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। মেহের কাসফির দিকেই তাকিয়ে ছিল।
“আজ তোদের স্কুলের ক্লাস টিচার কল দিয়েছিল আমাকে। তোর রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে। আগেও যে ভালো ছিল তা নয়, তবে এবার তুলনামূলক অনেক খারাপ হয়েছে৷ তুই নিনেই জানিস তোর রেজাল্টের কি অবস্থা আমাকে আর বলতে হবে না। বাসায় এসে কাউকে বলেছিস তোর রেজাল্ট দিয়েছে?”
“ইয়ে মানে না আপু। সবাই খুব বকবে।”
“বকার ভয়ে বাসায় তোর রেজাল্টের কথা বলবি না, এটা কেমন কথা। আর রেজাল্ট খারাপ হলো কেনো আমাকে বল, তোকে সবকিছু আগে আগে এনে দেওয়া হচ্ছে। টিচারের গাইড হতে শুরু করে বই। কোনটার কমতি নেই। তাহলে খারাও কেন হলো৷ একটু মনোযোগ দে পড়ায়। আমাদের সবার অনেক আশা তোকে নিয়ে। আমি চাই না তোকে বকা দিতে, তবুও তোর এই অবস্থা দেখে বলতে হচ্ছে। আর শোন আয়াতকে ফলো করিস সব ব্যাপারে। আয়াত কি করে না করে ওকে ফলো করে চলিস ভালো কথা, কিন্তু ওর যেই দিকগুলো বেশি ভালো সেদিক গুলো অনুসরণ করলে বেশি খুশি আমি হব। ও কখনো স্কুল কলেজে খারাপ রেজাল্ট করেনি, তোর মতো বাসায় রেজাল্ট লুকিয়ে বেড়ায় নি।”
“আপু আমি সত্যি খুব ভালো করে পড়ব। তুমি প্লিজ কাউকে বলো না।”
“ঠিক আছে।”
বলেই ট্রে হাতে নিয়ে মেহের কাসফির ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো৷ আয়াত নিচে মোবাইল হাতে নিয়ে নামতে নামতে দেখলো কাসফি মন খারাপ করে নিচে বসে আছে। আয়াতের খটকা লাগলো কিছুটা। যে কিনা স্কুল থেকে আসার পর এত খুশি ছিল গাছের চারা পেয়ে তার এখন মন খারাপ। আয়াত ঘরের মধ্যে ঢুকে কাসফির মাথায় চাটা মেরে বিছানায় শুয়ে বললো,
“কিরে পিচ্চি মন খারাপ কেনো, কেউ বকেছে?”
কাসফি আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বকেছে আবার বকেনি এই ধরনের আর কি।”
“দুইটা আবার একসাথে কি করে হয়!”
“এসব তুমি মেহের আপু থেমে শিখে নিও। সে তো এসবে এক্সপার্ট।”
আয়াত কাসফির কথা শুনে জোরে হেসে বললো,
“মানে মেহের বকেছে। কিন্তু কেন?”
কাসফি চুপ করে বসে আছে। কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কাসফিকে চুপ থাকতে দেখে আয়াত কাসফির সামনে বসে বললো,
“তারমানে তুই কিছু করেছিস। কিন্তু হঠাৎ আবার কি করলি যে মেহের তোকে বকলো।”
“জানো ভাইয়া অফিস থেকে এসে আমার জন্য নুডলস বানিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসেছে। তারপর আমাকে আদর করে খাওয়ালো, আমার চারাগাছের প্রশংসা করলো বললো অনেক সুন্দর। এসব বলার পর, আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পর নিজের আসল রূপে ফিরে এলো।”
“আসল রূপে ফিরে এলো মানে?”
হাসতে হাসতে বললো আয়াত।
“আসল রূপ মানে রাগী রাগী মুডে ফিরে এলো।”
“সব বুঝলাম কিন্তু হঠাৎ এমন কি হলো যে মেহের তার রাগী মুডে ফিরে এলো?”
“তুমি আবার বকবে নাতো আমাকে?”
“একদম না। আমি তোর ওই মেহের আপুর মতো নির্দয় নাকি যে রাগ দেখাব।”
“গ্রামে যাওয়ার আগে আমার একটা এক্সাম হয়েছে না, ওইটার পরশু রেজাল্ট দিয়েছে। কিন্তু আমি কাউকে বলি নি। আজ মনে হয় আমাদের ক্লাস টিচার আপুকে কল দিয়ে বলে দিয়েছে তাই তো এত খাইয়ে দাইয়ে রাগ দেখিয়ে শাষিয়ে গেলো৷”
“তোর কথা শুনে আমার খালি হাসি পাচ্ছে৷ তবে এটা বুঝা হয়ে গেছে পিচ্চির রেজাল্ট ভালো হয়নি। আমি ঠিক বলছি তো?”
“আমি কি করব ভাইয়া তুমিই বলো আমার যদি পড়ায় মন না বসে।”
“আমার কাছে তোর জন্য একটা বড়সড় অফার আছে।”
“কি অফার!”
“যদি তুই এবারের এক্সামে ৭০% নাম্বারও তুলিস তাহলে তোকে আমি একটা বিড়াল কিনে দিব। আর সেটা রেজাল্ট যেদিন দিবে সেদিনই।”
কাসফির চোখ মুখে হাসি ফুটে ওঠে বিড়ালের কথা শুনে। সে উৎফুল্ল হয়ে বলে,
“সত্যি ভাইয়া তুমি আমাকে একটা বিড়াল এনে দিবে!”
“হুম, তবে ৭০% নাম্বার আসার পর। এর কম আসলে তো দিব না। এখন যা সন্ধ্যা হয়ে আসছে পড়ার প্রস্তুতি নে।”
“আচ্ছা ভাইয়া, এবার দেইখো সত্যি সত্যি আমি ৭০% এর উপর নাম্বার আনব। আমাদের সব ফ্রেন্ডদের কিছু না কিছু পেট আছে। কারো বিড়াল, কারো বা পাখি। অনেক কিছু। শুধু আমারই নেই। এবার আমি নাম্বার বেশি পেলে আমারও একটা বিড়াল হবে।”
“হুম। সেটাই। এবার যা পড়তে বস।”
তারপর আয়াত নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। নিচে এসে দেখে মেহের মাহিকে নিয়ে বসে আছে আর মেয়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মাহি তার মায়ের সাথে কথা মিলিয়ে মিলিয়ে কথা বলছে আবার মাঝে মাঝে জবাব দিচ্ছে৷ আয়াত বসার ঘরে তার মাকে আর চাচীকেও দেখতে পেলো। তাদের মাঝে গিয়ে বসে বলে,
“মা আমার একটু আসতে দেরি হবে। আর বন্ধুদের সাথেই খেয়ে আসব। তাই তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করে থেকো না। আর বাসার চাবি তো আমার কাছেই আছে তাই জেগে থাকার দরকার নেই। আমি নিজেই লক খুলে আসতে পারব৷ দেরি হলে টেনশন নিও না।”
“তবুও বাবা তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করিস।”
“তাড়াতাড়ি আসতে পারব না বলেই তো বলে যাচ্ছি তাই না মা। তোমরা খালি চিন্তা করো।”
বলেই আয়াত মেহেরের দিকে তাকালো। মেহেরও তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আয়াত মাহির কাছে গিয়ে কোলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
রাত প্রায় দেড়টার উপরে বাজে। আয়াতের এখনো আসার নাম নেই। সে দেরি করে আসবে বলেই গেছে তাই বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে হয়তো। মেহের নিজের ঘরেই বসে একটা বই পড়ছিল। কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক রাত হয়ে গেছে কিন্তু আয়াত এখনো আসেনি। চিন্তা করতে মানা করলেও তার চিন্তা হচ্ছে৷ আরও ঘন্টা খানেক পর বাইকের শব্দ শুনে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো মেহের। আয়াত এসেছে। আয়াত নিজেই বাসার লক খুলে ভেতরে ঢুকে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মেহের পেছন থেকে ডেকে উঠে,
“এত রাত অবদি কোনো ভদ্র ঘরের ছেলেরা বাইরে থাকতে নেই। বাবা আর চাচা শুনলে ব্যাপারটা নিয়ে খুব মন খারাপ করবেন। এভাবে আর রাত বিরাতে বাসায় আসবেন না। চেষ্টা করবেন আরও তাড়াতাড়ি আসার।”
মেহেরের কথা শুনে আয়াত পেছনে ফিরে তাকালো মেহেরের দিকে।
চলবে,,,,
[আসসালামু আলাইকুম। আমি সত্যি গল্প দিতে অনেক লেইট করি, তার জন্য প্রথমেই বলছি আমি গল্প দেরি করে দেওয়ার জন্য খুবই দুঃখিত। আসলে আমি নিজের ব্যস্ততা আর সাথে কিছুটা অসুস্থ থাকার কারণে রেগুলার লেখতে পারি না। তবুও আমি চেষ্টা করি রেগুলার লেখার। কিন্তু সময় হয়ে উঠে না। একটা পর্ব লেখতে কম হলেও এক ঘন্টা লাগে, তাই হয়তো লেখা হয় না রেগুলার। তবে খুব শীঘ্রই এই গল্পটা শেষ করে দিব। আর নতুন গল্প আসতে হয়তো একটু দেরি হবে। নিজে ফ্রি হয়ে তারপর লেখা শুরু করব। তাই কেউ রাগ করে থাকবেন না আমার উপর। আর গল্প কেমন হলো তা অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ।]#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২২
#Writer_Fatema_Khan
মেহেরের কথায় আয়াত পেছনে ফিরে তাকায়। মেহের আয়াতের চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়াত এগিয়ে গিয়ে মেহেরের সামনে তাকায়৷ মেহের আয়াতকে এগিয়ে আসতে দেখে বলে,
“আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে এখন ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পরুন। আমারও খুব ঘুম আসছে, আমার ঘুমানো দরকার।”
“এতক্ষণ ঘুম আসেনি বুঝি?”
“আমি তো এতক্ষণ বই পড়ছিলাম। হঠাৎ বাইকের শব্দ শুনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি আপনি মাত্র এসেছেন। আমিতো ভাবিতেই পারছিনা আপনি এত রাত অবদি বাইরে ছিলেন!”
“আমি তো এমন অনেক কিছুই করতে জানি যা তোমার চিন্তা ভাবনার বাইরে।”
“কিহ!”
“কিছুনা। আমি জানি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে না। আমি এটাও জানি তুমি বারবার ঘড়িতে সময়ও দেখছিলে না। তুমি মাত্র বাইকের শব্দ শুনেই আমাকে শাসাতে এসেছ।”
“আমি আপনাকে কখন শাসালাম? আমি তো শুধু বাবা আর চাচার কথা বললাম। এটাকে কেউ শাসানো বলে?”
আচ্ছা আমার কথা বাদ দাও, কাসফিকে বকেছ কেনো? পিচ্চিটার মন খারাপ হয়ে গেছিলো। কত কষ্টে মন ঠিক করতে হয়েছে। এভাবে কেউ পড়ায় মন বসায় নাকি?”
“তো কিভাবে মন বসাতে হয় পড়ায়?”
“ব্যবসা তুমি করো এসব তো তোমার বেশি জানার কথা। আমি তো সামান্য লেকচারার।”
“মানে?”
“ব্যবসায়ে তোমরা যেমন ক্লাইন্টের সাথে ডিল করো, ঠিক তেমনি আমার আর কাসফির মাঝেও একটা ডিল হয়েছে।”
“কি ধরনের ডিল?”
“সেটা আমার আর কাসফির ব্যাপার। তোমার না জানলেও চলবে।”
“আমাকে বলুন কি ডিল হয়েছে আপনাদের দুইজনের।”
“সে যেটাই হোক। কাসফি যদি নেক্সট এক্সামে ভালো রেজাল্ট করে তাহলেই তো হলো তাই না। আর আমার বিশ্বাস আছে এবার কাসফি ভালো রেজাল্ট করবে।”
“এতটা কনফিডেন্ট তাও আবার কাসফির উপর। যে কিনা পড়েই না।”
আয়াত মেহেরের দিকে এগিয়ে এসে কিছুটা ঝুকে কানের কাছে মুখ এনে বলে,
“কাসফি ভালো রেজাল্ট করবে। এখন কথা হলো কাসফি যদি ভালো রেজাল্ট করে দেখায় সে তো তার পুরস্কার পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি যে তার পেছনে আছি এটা আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো। তাহলে আমি কি পাব?”
“মানে?”
“মানে খুব সোজা। কাসফি আমার থেকে কিছু পেলে আমি তার বোন থেকে কিছু পাওনা হই। তাই কাসফি ভালো রেজাল্ট করলে কাসফির রাগী মুড নিয়ে থাকা বোন আমাকে কিছু দিবে।”
“আমি কি দিব!”
কাপা গলায় বললো মেহের।
“কাসফি বললো তুমি নাকি রাগী মুডে থাকো সবসময়, আবার বকাঝকা করো। তা আমি কাছে আসলে রাগী মুড আর বকাবকি থেকে কাপাকাপি শুরু হয়ে যায় কেনো? আর সময় হলে আমার পাওনা আমি নিজেই নিয়ে নিব। আর তুমি তা দিতে বাধ্য হবে।”
আয়াত গটগট করে সিড়ি বেয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলো। মেহের নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে আয়নার দিকে তাকালো৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে আর গাল দুটি রক্তিমা বর্ণ ধারণ করেছে। মেহের নিজের গালে হাত রেখে ভাবে,
“তার গাল দুটি এত লাল হলো কি করে, লজ্জায় নাকি রাগে? রাগ তো অনুভব হচ্ছে না। তবে কি লজ্জায়। আয়াতের কথায় আমার লজ্জা পায়। আমিও কোনো কোন দিক দিয়ে আয়াতের উপর দুর্বল হয়ে পরছি নাতো?”
এসব ভাবনার মাঝেই মেহেরের মোবাইলে কল আসলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আয়াতের নাম্বার। রিসিভ করলে ওপাশ থেকে বলে,
“এতটা প্রেশার দিও না মাথায়। একটু ঘুমাও না হলে সকালে অফিস যাবে কি করে। আর একটা কথা। তুমি যা ভাবছো সেটাই সত্যি। এখন তুমি হয়তো ভাবছো আমি কি করে জানি, আমি জানি কারণ তোমার ওই রক্তিম আভাযুক্ত গাল দুটি দেখে। যা দেখার পর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি৷ মেহের ঘুমিয়ে পরো আর প্লিজ আমাকেও একটু ঘুমাতে দেও। তুমি কেন আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছ বলতে পারো? ভালোবাসি মেহের খুব ভালোবাসি। তুমি কেন এতটা দূরে দূরে থাক, আগে তো সামনে দেখা হলেও পেতাম। চোখের পিপাসা তো মিটে যেত। আর এখন তুমি এত লুকিয়ে বেড়াও যে চোখের পিপাসাও মেটানো দায় হয়ে পরেছে। আমি জানি তুমি আব শুনতে পারছো কিন্তু ওই যে তোমার মুখে এখন কোনো কথা ফুটবে না। আমি সত্যি তোমাকে এত রাতে আশা করি নি। আমি ভেবেছি তুমি ঘুমিয়ে পরেছ। ধন্যবাদ তোমাকে। ধন্যবাদ কেন দিলাম জানো, তুমি অপেক্ষা করে ছিলে বলে না। তুমি গ্রাম থেকে আসার এই আজকেই আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলেছ। সামনাসামনি তোমাকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মন ভরে দেখেছি। আচ্ছা শুভ রাত্রি আমার প্রেয়সী। আজ সত্যি খুব ভালো ঘুম হবে, তবে সেটা আমার একার। তোমার তো ঘুম উড়ে গেছে সেটা আমিও জানি। তবুও বলছি ঘুমিয়ে পরো প্রেয়সী।”
ফোন কাটার পর মেহের জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। এতক্ষণ যেনো শ্বাস আটকে বসে কথা শুনছিল আয়াতের। কল কাটতেই শ্বাস আবার নেওয়া শুরু করেছে। তবে আয়াতের সবগুলো কথাই সত্যি। মেহের নিজেও জানে সে আয়াতের প্রতি দূর্বল হয়ে পরছে। আবার আজ রাতে যে তার ঘুম হবে না এটাও সে নিশ্চিত। তবুও ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে পরলো৷ এপাশ ওপাশ করতে করতে ভোর হয়ে গেলো। আজানের শব্দ কানে আসছে মেহেরের। তবে চোখে তার এক ফোটাও ঘুম নেই। আজ আর ঘুম আসবে না ভেবে শোয়া থেকে উঠে ওজু করতে চলে গেলো৷ নিজের নামাজ আদায় করে ঘরে বসেই কোরআন শরিফ পড়ছিল মেহের। নিজের মনকে শান্ত করার জন্য নামাজ আর কোরআন পাঠের তুলনা হয় না।
অক্টোবরের মাঝামাঝি চলছে। এই সময় গ্রামে হালকা শীত পরলেও শহরে শীতের দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া দুর্লভ। তার উপর অসময়ে যদি হয় বৃষ্টি। বৃষ্টি এমন একটা জিনিস যা মানুষের অপছন্দের তালিকায় জায়গা পায় না৷ সবারই বৃষ্টি পছন্দ। তবে কাজের চাপে হয়তো অনেকের ভেজা হয় না সহজে৷ মেহের গাড়ি নিজে চালিয়ে যাচ্ছে, উদ্দেশ্য আয়াতের অফিস। তবে নিজে ইচ্ছায় যাচ্ছে না সে, যথাসম্ভব আয়াতের থেকে লুকিয়ে চলে সে। আয়াতের প্রতি তার দিন দিন দূর্বল হয়ে পরা এটা সে নিজেও অস্বীকার করতে পারে না। দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, এদিকে আয়াত না নিজের বাইক নিয়েছে না নিয়েছে ছাতা। তাই আয়াতের মা মেহেরকে কল করে বলে দিয়েছে আসার সময় আয়াতকে নিয়ে আসতে বাসায়। মেহের চেয়েও মানা করতে পারে নি, তাই এককথায় বাধ্য হয়েই আয়াতের ভার্সিটির পথে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি এসে থামল গেইটের সামনে। আয়াতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
“এই আয়াত কই, ওর তো ক্লাস শেষ হওয়ার কথা অনেক আগেই। আর চাচী তো বললো মা আয়াতকে কল করে বলে দিয়েছে যে আমি আসব। তাহলে এখনো কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন?”
এসব ভাবতে ভাবতেই মেহের ছাতা নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। মেহেরের ধারণা আয়াত যেহেতু ছাতা আনে নি তাই ভেতরেই আছে এখনো। আর যা বৃষ্টি পরছে ভেতর থেকে বের হলেই পুরো ভিজে যাবে। এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতে ভার্সিটির গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। বৃষ্টির কারণে তেমন একটা টিচার চোখে পরছে না, তবে বেশ কিছু স্টুডেন্ট দেখা যাচ্ছে। কেউ ভেতরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখায় মগ্ন, কেউ বা ছাতা নিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষারত, কেউ বা আড্ডায় মেতেছে এক কোণায়। মেহের আস্তে আস্তে হেঁটে মাঠের মাঝে এসে গেছে। মাঠের মাঝে বেশকিছু স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। সবার মাথায় মোটামুটি ছাতা রাখা তাই ভালো করে বুঝা যাচ্ছে না ওখানে হচ্ছে টা কি। কি হচ্ছে দেখার জন্য মেহের এগিয়ে গেলো ভিড়ের দিকে। সবাই কেমন নিজেদের ভেতর হাসাহাসি আর কানাকানি করছে। মেহেরের মন কু ডাকছে আয়াতের আবার কিছু হলো না তো? মেহের ভিড়ের কাছে গিয়ে একটু ঠেলেই সামনে এগিয়ে গেলো। ওইখানে এমন কিছু দেখবে তা মেহেরের কল্পনারও বাইরে ছিল৷ মেহের কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সামনে চলমান মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। সবার হাসাহাসিতে আবার হুশ ফিরে এলো মেহেরের। মেহের একবার চোখ নামিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে বললো,
“আয়াত।”
মেহেরের কণ্ঠস্বর আচমকাই শুনে আয়াত পাশে তাকিয়ে দেখে মেহের তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়াত যেনো মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলবে সে মেহেরকে। নিরবতা ভেঙে মেহের আবার বললো,
“আয়াত আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। আপনি আসুন।”
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৩
#Writer_Fatema_Khan
মেহেরের কণ্ঠস্বর আচমকাই শুনে আয়াত পাশে তাকিয়ে দেখে মেহের তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়াত যেনো মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলবে সে মেহেরকে। নিরবতা ভেঙে মেহের আবার বললো,
“আয়াত আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। আপনি আসুন।”
মেহের আর পেছনে না তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টির মাত্রা যেনো আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো৷ আয়াত পুরাই স্তব্ধ মেহেরকে দেখে। এমন একটা পরিস্থিতিতে পরতে হবে তাও এত স্টুডেন্ট এর সামনে। তার চেয়ে বড় কথা মেহেরের সামনে। আয়াত নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে এখনো তাকে জড়িয়ে ধরে আছে আরশি নামক এক স্টুডেন্ট। যে কিনা কিছুক্ষণ আগেই আয়াতকে প্রপোজ করেছে। এমন বৃষ্টির মাঝেই হঠাৎ করে যে আরশি আয়াতকে জড়িয়ে ধরবে তা কস্মিনকালেও চিন্তা করে নি আয়াত। সে তো মেহেরের আসার অপেক্ষা করছিল। এসব ভেবেই আরশির দিকে রেগে তাকায় আয়াত। আর এম ঝাটকায় নিজের কাছ থেকে দূরে সদিয়ে দেয় আর বলে,
“আরশি তুমি খুব ভালো স্টুডেন্ট এটা সবাই জানে। তারমানে এই না যে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারো৷ আর আমি তো শিক্ষক হই। এই ভার্সিটিতে আমার একটা সম্মান আছে যার তুমি একটুও মূল্যয়ান করোনি। উলটা আমাকে ভালোবাসায় পাঠ পড়াতে এসেছো। নেক্সট টাইম এমন কিছু করতে দেখলে তোমার বিরুদ্ধে আমি স্টেপ নিতে বাধ্য হব।”
“কিন্তু স্যার আমি যে মন থেকে আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি।”
“এই মন থেকে আমাকে মুছে আবার পড়ায় মনোযোগ দাও, এতে তোমার নিজেরই লাভ হবে। আর আমার পেছনে ঘুরে নিজেকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছু পাবে বলে মনে হয় না। সো আমার স্টুডেন্ট তুমি এটা আমাকে ভুলতে বাধ্য করো না। আশা করি নিজের শিক্ষককে সঠিক সম্মানটুকু দিবে।”
“স্যার আমার একটা কথা শুনুন।”
“আর কিছু শোনা বা বলার নেই।”
আর কিছু বলতে না দিয়ে আয়াত সামনে গেইটের দিকে এগিয়ে গেলো। আয়াতের কথা শুনে ফুফিয়ে কাদতে থাকে। অনেকটা বিরক্ত হয়েই মাঠ ত্যাগ করে আয়াত। গাড়ির কাছে এসেই দেখে মেহের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছে। আয়াত আর কিছুই না ভেবে গাড়িতে উঠে বসলো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মেহের চোখ খুললো। পাশে না তাকিয়েই বুঝতে পারল আয়াত এসেছে। কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিছুটা যাওয়ার পর আয়াত মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মেহের গাড়ি থামাও।”
মেহের কিছু না বলেই গাড়ি চালাতে লাগলো। আয়াত স্টিয়ারিং এর উপর মেহেরের হাতের উপর হাত রাখলো। সাথে সাথে মেহের গাড়ি থামালো। মেহের আয়াতের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো বাসায় যাবেন না বুঝি, নাকি অনেক কাজ এখনো বাকি আছে?”
“মেহের তুমি যা ভাবছো আসলে তেমন কিছুই নয়। আসলে আরশি আমাকে এভাবে সবার সামনে জড়িয়ে ধরবে তা আমার চিন্তার বাইরে ছিলো। আর ওই সময় তুমিও সেখানে উপস্থিত হবে সেটাও আমার ধারণায় ছিলো না। আমিতো তোমার জন্যই বাইরে আসছিলাম হঠাৎ করে আরশি কোথা থেকে এসে আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার কথা বলবে আমি সত্যি বুঝতে পারি নি। আমি নিজেও অনেকটা অবাক হয়েছি ওর মতো ভালো স্টুডেন্ট এমন একটা কাজ কি করে করতে পারে!”
“আমি ওই সময় মাঠে গিয়ে উপস্থিত হয়ে বুঝি আপনার প্রেমে বেঘাত ঘটালাম?”
“তুমি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছো মেহের।”
“আর আমাকেই বা এত কৈফিয়ত দেওয়ার কি আছে আপনার?”
“আমি তোমাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে না, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো তাই ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করছি মাত্র। কিন্তু তুমিতো আমার কথাই বুঝতে চাইছো না। কেনো বুঝো না তুমি আমাকে ভুল বুঝলে আমার খুব কষ্ট হয়।”
“স্টিয়ারিং এর উপর থেকে হাত সরান। আমার বাসায় যেতে হবে। আর আপনি নিজেও ভিজে গেছেন এখন বাসায় না গেলে আপনার জ্বর আসবে। আর জ্বর আসলে কাল ভার্সিটি আসবেন কি করে? আর না আসলে আরশির সাথেও দেখা হবে না।”
আয়াত আর কিছু না বলে মেহেরের হাতের উপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। মেহের আয়াতের হাত সরানো দেখে তাচ্ছিল্য পূর্ণ হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো৷ বাসায় পৌঁছেই আয়াত গাড়ি থেকে নেমে বার কয়েক কলিংবেল বাজাতে থাকলো। আয়াতের মা রান্নাঘরে ছিলেন সবার জন্য বিকেলের নাশতা বানাচ্ছিলেন, তাই রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে আরও কয়েকবার কলিং বেল বাজালো। তিনি দরজা খুলে আয়াতকে কাক ভেজা দেখে বললেন,
“কিরে বাবা ভিজলি কি করে, মেহের তো তোকে আনতে যাবে বললো। ওর বুঝি দেরি হয়ে গেছে যেতে যেতে?”
“না মা মেহেরের দেরি হয় নি, আমারই বড্ড তাড়া ছিল তাই ভিজে গেছি৷”
আয়াতের কথা না বুঝতে পেরে তিনি আরও কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আয়াত ভেতরে চলে গেলো। মেহেরকে ছাতা নিয়ে আসতে দেখে তিনি বললেন,
“হে রে মেহের এই আয়াতের আবার কি হলো?”
“জানি না চাচী। আমি ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।”
তিনিও আর কথা না বাড়িয়ে দরজা আটকে রান্নাঘরের দিকে গেলেন৷ বিকেলে সবাইকে চা আর নাশতার জন্য ডাকা হলো। সবাই নিচে উপস্থিত থাকলেও আয়াত আসেনি। মেহের বারবার আড়চোখে সিড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তার আসার নাম নেই। ট্রে করে গরম গরম চা এনে রাখলেন মেহেরের মা আর তার পেছনে আয়াতের মাও এসে বসলেন সোফায়৷ আয়াতের বাবা আয়াতকে না দেখে প্রশ্ন করলেন,
“আয়াত বাসায় নেই বুঝি আয়াতের মা?”
“আসলে কি বলো তো ছেলেটা দিন দিন একদম কারো কথা শুনে না। নিজের মর্জি অনুযায়ী চলে। এই বৃষ্টি দিয়ে তোকে ভিজতে কে বলেছে, মেহের তো যাবেই শুনেছে তবুও ভিজলো। আর এখন নিচে না থেকে সোজা ছাদের ঘরটাতে চলে গেছে। এত্ত বেপরোয়া হলে চলে নাকি বলো”
“শুনলে আয়াতের মা ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে তাই এমন করছে। বিয়ে দিয়ে দিলেই বেপরোয়া গিরী বের হয়ে যাবে।”
মেহেরের বাবার কথার প্রতিত্তোরে মেহেরের মা বললেন,
“তোমার মেয়েকে বুঝাও তাহলেই হয়। ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে কে জানে? ছেলেটা সারাদিন ওর থেকে দূরে দূরে থাকে যাতে করে ওর বাসায় কোনো অসুবিধা না হয়। ও কি বুঝে এসব।”
মায়ের এমন কথায় মেহের কি বলবে বুঝতে পারে না৷ তবে চাপা রাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো৷ নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে নিজেই ভাবতে লাগলো,
“আমি কি বলেছি তোমাদের ছেলেকে আমার জন্য বাসা থেকে দূরে থাকতে, আর না আমি কাউকে কষ্ট দিচ্ছি? তাহলে মা তুমি কি করে এ কথা বলতে পারো, এদিকে তোমাদের ছেলে যে আরেক জনকে মন দিয়ে বসে আছে সেই খবর কি জানো তোমরা? জানো না, আর না সেই খবর রাখার চেষ্টা করো। সবাই আমাকেই কেনো টেনে আনে সব সময়। আমিতো বলিনি আয়াতকে আমাকে ভালোবাসতে, আর আমাকে ভালোবাসলে আজ কি ছিলো এটা, পুরো ভার্সিটির সামনে একটা মেয়ের সাথে এমন অবস্থায়। আমি ভাবতেও পারছি না ওই ঘটনা। বারবারই চোখের সামনে ভেসে উঠছে।”
রাতে খাবার টেবিলেও আয়াতে খেতে আসে নি। বৃষ্টি কমে গেছে অনেক আগেই। আয়াতের মা ছাদে গিয়েছিলেন আরও আগে আয়াতকে ডাকতে। কিন্তু আয়াত দরজা পর্যন্ত খোলে নি। শুধু ভেতর থেকে বলেছে তার ভালো লাগছে না খিদে নেই খাবে না। সবাই যার যার খাবার খেয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেলো। খাবার টেবিলের সামনে আয়াতের মা, মেহেরের মা আর মেহের সব গুছাচ্ছে৷ মেহেরের মা বললেন,
“আমেন তুই কাজ কর বোন একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে আয়াতকে খাইয়ে দিস। ছেলেটা সেই সকালে খেয়ে গেছে দুপুরে কিছু খেয়েছে নাকি খায়নি সেটাও জানি না আমরা। আর বিকেল থেকেও কিছুই পেটে পরেনি৷ এভাবে না খেয়ে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে৷ তাই কিছু খাইয়ে দিস৷”
“আমিও তাই ভাবছি ভাবি।”
মেহেরের মা আয়াতের মায়ের সাথে টেবিল গুছিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন৷ একটা প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে নিলেন আমেনা বেগম। মেহের এগিয়ে গিয়ে বললো,
“চাচী তুমি নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পরো আমি না হয় আয়াতের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি। আর মাহি তো এখন কাসফির সাথেই আছে। ততক্ষণে আমি আয়াতের খাবারটা নিয়ে আয়াতের কাছে যাই।”
প্রশস্ত হাসলেন আমেনা বেগম। নিজের মনে এ কথা ভাবলেও মেহেরকে তিনি বলেন নি। কারণ মেহেরকে তিনি কোনো ব্যাপারে জোর করতে চান না৷ কারণ আয়াত বলেছে মেহেরকে কোনো ব্যাপারে জোর না করতে। সে নিজে থেকেই যদি আয়াতের জন্য কিছু করতে চায় তাহলে ঠিক আছে কিন্তু মা চাচীর কথায় আয়াতের কাছাকাছি আসাটা আয়াত নিজেও পছন্দ করবে না। তাই নিজের ইচ্ছাগুলো নিজের মনেই চেপে রাখেন তিনি। তবে আজ মেহের নিজে থেকে আয়াতের খাবার নিয়ে আয়াতকে খাইয়ে দিতে চাইছে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে। তিনি মেহেরের হাতে প্লেটটা দিয়ে বললেন,
“খাওয়ার পর প্লেটটা নিয়ে আসিস৷ রেখে আসলে নাও খেতে পারে।”
“ঠিম আছে।”
তারপর আয়াতের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দরজার সামনে এসে কয়েকবার কড়া নাড়লো মেহের৷ কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। আরও দুইবার কড়া নাড়তেই আয়াত বললো,
“মা আমার খিদে নেই। আমাকে ঘুমাতে দাও।”
মেহের এবার বললো,
“আয়াত আমি এসেছি দরজাটা খুলুন।”
চলবে,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৪
#Writer_Fatema_Khan
আয়াতের ঘরের দরজার সামনে এসে কয়েকবার কড়া নাড়লো মেহের৷ কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। আরও দুইবার কড়া নাড়তেই আয়াত বললো,
“মা আমার খিদে নেই। আমাকে ঘুমাতে দাও।”
মেহের এবার বললো,
“আয়াত আমি এসেছি দরজাটা খুলুন।”
মেহেরের গলার আওয়াজ শুনে আয়াত ঘরের দরজা খুলে দিলো। দরজা থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসলো। মেহের ভেতরে ঢুকে টেবিলের উপর খাবারের প্লেট টা রেখে আয়াতের উদ্দেশ্যে বললো,
“আজ বাসায় আসার পর নিচে আসেন নি কেনো? চাচী কয়বার করে ডেকে গেলো খাওয়ার জন্য। তবুও আসলেন না। এটা মোটেও ঠিক না। চাচী আপনার মা তার চিন্তা হয়। এখন এই নেন খাবার টুকু শেষ করেন জলদি।”
আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে চোখ বন্ধ করে নিচে তাকিয়ে আছে। মেহের এগিয়ে এসে বলে,
“কি হলো উঠুন, খেয়ে নিন আমাকে আবার নিচে যেতে হবে। চাচী নিজেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে এখনো বাইরে তাই চাচীকে বারণ করে আমিই আসলাম।”
প্লেট টা খাটের উপর রাখলো মেহের। আয়াত এখনো চোখ উপরে তুলে তাকায় নি। মেহের আয়াতের হাত ধরে উঠাতে চাইলে আতকে উঠে। চোখ বড় বড় করে আয়াতের কপালে গালে ছুয়ে দেখলো।
“একি আয়াত আপনার তো গায়ে প্রচন্ড জ্বর এসেছে। আর এই জ্বর নিয়ে আপনি কিনা ঘরের দরজা আটকে বসে আছেন।”
মেহের বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আয়াতের সামনে বসে প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা ভাত ধরে আয়াতের মুখের সামনে। আয়াত ভ্রু কুচকে মেহেরের দিকে তাকায়।
“আমার দিকে পরে তাকালেও হবে, এখন খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না আর সবচেয়ে বড় কথা আমার খিদেই নেই। তুমি নিচে যাও মেহে..”
আয়াতের কথা সম্পুর্ণ হওয়ার আগেই তার মুখে খাবার পুরে দিলো মেহের। না চাইতেও আয়াত খেয়ে নিলো। তবে সব খাবার শেষ করতে পারলো না। অল্প কিছু ভাত খেয়েই আর খেলো না আয়াত। মেহেরও আর জোর করে নি। হাত ধুয়ে এসে টেবিলের ড্রয়ারে ওষুধ খুজতে লাগলো। জ্বরের দরুন কিছু না খাওয়ার ফলে শরীর খুব দূর্বল হয়ে পরেছিল। এখন খাওয়ার ফলে কিছুটা ভালো লাগলেও অনেক জ্বর গায়ে। আয়াত চোখ তুলে মেহেরের দিকে তাকালো। বেশকিছু সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে অনেকটাই ভিজে গেছে মেহের।
“তুমি নিচে যাও মেহের তোমার কাপড় অনেকটাই ভিজে গেছে। আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি ঠিক আছি।”
“কি যে ঠিক আছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। চোখ অবদি ভালো করে খুলে রাখতে পারছেন না। এখন চুপ করে বসে থাকেন। আমি নিচে গিয়ে আমার ঘর থেকে ওষুধ নিয়ে আসছি।”
মেহের তাড়াতাড়ি নিচে চলে গেলো। নিজের ঘরে এসে ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আবার ছাদের দিকে হাটা ধরলো৷ আজ আকাশ নিকষ কালো। চাদের লাইট না জ্বললে হয়তো পরিবেশটা এখন অনেকটা ভূতুড়ে টাইপ হতো৷ মেহের প্লাস্টিকের ওষুধের বাক্সটা মাথার উপর দিয়ে আয়াতের ঘরে আবার ঢুকলো৷
“বৃষ্টি বেড়ে গেছে আবার, কেনো খামখা আবার ছাদে আসতে গেলে?”
“আপনার অবস্থা দেখেছেন, জ্বরে পুরাই কাবু হয়ে গেছেন। আবার বলছেন আমি খামখা এখানে এসেছি৷ তবে সাথে একটা ছাতা নিয়ে আসতে ভালো হতো৷ যাওয়ার সময় কাজে দিত। কি আর করার তাড়াহুড়োয় ছাতার কথা মাথাতেই আসে নি। যাক গে এই নিনি ওষুধ। খেয়ে ঘুমিয়ে পরেন তাড়াতাড়ি। তাহলে জ্বর সেড়ে যাবে।”
“তুমি আর আমি এক ঘরে একা আছি আর তুমি ভাবছো আমি ওষুধ খেয়েই ঘুমিয়ে যাব। ঘুমের ওষুধ খেলেও এখন ঘুম আসবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।”
আয়াতের এমন ঠোঁট কাটা কথাত অপ্রস্তুত হয়ে পরে মেহের। আর কথা না বাড়িয়ে ওষুধ গুলো আয়াতের হাতে দিয়ে এক গ্লাস পানি দিলো সে৷ আয়াতও আর কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলো। আয়াত উঠে দাঁড়ায় তারপর মেহেরের হাত ধরে খাটের উপর বসায়। চেয়ারের উপর থাকা টাওয়েলটা নিয়ে মেহেরের ভেজা চুলগুলো মুছে দেয় সে। মেহের কিছুই বলে না। মোছা শেষে আয়াত মেহেরের সামনে বসে পরে। মেহেরের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,
“তোমাকে ভেজা চুলে অপরূপা লাগছে৷ এতটা স্নিগ্ধ আর নিষ্পাপ লাগছে কেনো তুমি জানো? তোমাকে এভাবে দেখে আমার যে নিষিদ্ধ চাওয়া গুলো জাগ্রত হয়।”
মেহেরের কান গরম হয়ে গেলো আয়াতের কথায়। এমন লাগামহীন কথা এর আগে আয়াত তার সাথে কখনোই বলে নি।
“তোমার প্রতি যখনই এমন নিষিদ্ধ চাওয়া গুলো জাগ্রত হয়েছে ততবার আমি তোমার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। কারণ আমি তো জানি তুমি এসব একদম পছন্দ করো না। তাই আমিও এসবের ধারে কাছেই যাব না৷ এমনকি আজকেও না। তবে মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার গালে অনেক বড় একটা চুমু দেই। কিন্তু তুমি সারাদিন যেভাবে থাকো মনে হয় এখনই বুঝি কার উপর বোম ব্লাস্ট হবে। তাই এসব মাথায় আসলেও টুপ করে ফেলে দেই।”
আয়াতের কথা শুনে মেহেরের যেমন লজ্জা লাগছে, তেমনি অবাক হচ্ছে, সাথে অনেক হাসি পাচ্ছে৷ অন্য সময় হলে রাগ হত। কিন্তু এখন এযব আয়াত জ্বরের ঘোরে বলছে তা মেহের খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে৷ মেহেরের ভাবনার মাঝেই আয়াত মেহেরকে জড়িয়ে ধরে। মেহের কিছু বুঝে উঠার আগেই আচমকা জড়িয়ে ধরাতে মেহের আধশোয়া অবস্থা হয়ে যায়৷ আয়াতের ঠোঁট মেহেরের কানের কাছে। আয়াত মেহেরকে কি বলছে মেহের তা ভালো করে শুনছে।
“মেহের আমি সত্যি বলছি আরশির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ও আমাকে পছন্দ করে শুধুমাত্র। আর আজ এমন কিছু করবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। ভালোবাসা কি বুঝেছিই তো তোমার থেকে। সেখানে এতবছরে যখন কেউ জায়গা নিতে পারে নি, তাহলে আজ কি করে আরশি সেখানে জায়গা দখল করে নিবে৷ তুমি কি ভাবো আমি বুঝি না, তুমিও যে আমাকে ভালোবাসো৷ আমি সবকিছুই বুঝি তোমার মনে এখন কি চলে আর সেটা তুমি নিজেও জানো। কিন্তু মুখে স্বীকার করতে চাও না। না আমার কাছে আর না নিজের কাছে। তবে তোমার মনের কথা যদি আমিই বুঝতে না পারি তাহলে কেমন ভালোবাসি তোমাকে বলো৷ আজ তুমি কতটা কষ্ট পেয়েছো তা তোমার চোখে আমি দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আমারই ভা কি করার ছিলো, এমন একটা পরিস্থিতিতে নিজের পক্ষে কি ই বা বলতাম আমি। তবুও তো বলার চেষ্টা কম করি নি, কিন্তু সেই তুমি আমাকে ভুল বুঝলে। এতে যে আমি আরও বেশি কষ্ট পেয়েছি। তার খবর কি তুমি রাখো প্রেয়সী। তুমি আমার এতটা কাছে যে আমার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেনো লাগছে আমার। খুব ঘুম পাচ্ছে জানো তো।”
মেহের আয়াতের সব কথা মন দিয়ে শুনলো৷ মেহেরের নিজেরও খারাপ লাগছে আয়াতের ব্যাপারে সে একটু বেশিই করে ফেলেছে। আর তার জন্যই আয়াতের এত জ্বর এসেছে। মেহেরের ভাবনার মাঝেই মেহের কেপে উঠলো আয়াতের ছোয়ায়। আয়াত তার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে। তার শুকনো ঠোঁট জোড়া মেহেরের ঘাড়ে বিচরন করছে। মেহের সরে আসতে চাইলে আয়ার তাকে আরেকটু কাছাকাছি এনে জড়িয়ে ধরে। মেহেরের এবার অজানা ভয় কাজ করছে৷ এই মুহূর্তে আয়াত সুস্থ নয়, আর সে একটা ছেলের শক্তির কাছে খুবই সামান্য। ভয়ে আয়াতের বুকে হাত দিয়ে সরাতে যাবে এমন সময় আয়াত বললো,
“প্রেয়সী আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব খুব খুব ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে কখনো ভুল বুঝো না। তাহলে আমি যে সহ্য করতে পারি না। আমার সবকিছু এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় তোমার অবহেলায়। ভালোবাসি প্রেয়সী।”
চলবে,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৫
#Writer_Fatema_Khan
মাহিকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় মেহের। হাতে পানির বোতল৷ বোতলে পানি না থাকায় সেটাই পূর্ণ করতে নিচে আসতে হলো তাকে। পানি ভরে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে নিলেই শুনতে পায় তার মা আর বাবার কণ্ঠ। তার মায়ের কান্নামিশ্রিত কণ্ঠ শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আহা এত রাতে কান্না শুরু করে দিলে কেনো? আমার কি চিন্তা হয় না মেয়েটাকে নিয়ে? আমরা আর কতকাল আছি, আজ না হয় কাল বুড়ো বুড়ি আর থাকব না। কিন্তু মেহেরের কি হবে একা জীবন কি করে কাটাবে মাহিকে নিয়ে। কাসফিকে নিয়ে চিন্তা নেই আগে বড় হোক লেখাপড়া শেষ হলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তারপর বিয়ে দিতে পারলেই হলো। কিন্তু মেহের যে একরোখা আর গম্ভীর নিজের কথার হেরফের করে না। একবার তো তবুও মুখে বলেছিল সে আয়াতের সাথে বিয়েতে রাজি, কিন্তু তারপর না আয়াত কথা বাড়ালো আর না মেহের। আমরাই বা কি করে বলতে পারি বলো, ছেলেটা তো আমাদেরই। এখন হয়তো আবেগে ভাসছে তাই মেহেরকে বিয়ে করতে চাইছে, কিন্তু আবেগ কেটে গেলে যদি মেহেরকে মেনে না নেয় তখন আমার ভেঙে যাওয়া মেয়েটা যে পুরোপুরি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সাহস নিয়ে নিজের ভাইয়ের কাছেও বলতে পারি না।”
“তুমি শুধু শুধু আয়াতকে নিয়ে ভাবছো। আমেনা আমাকে বলেছে আয়াত মেহেরের উপর পুরোপুরি দুর্বল, শুধুমাত্র তোমার মেয়ের এমন দূরে দূরে থাকার কারণে আয়াত নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে যাতে তোমার মেয়ের কষ্ট না হয়। আয়াত চায় না মেহেরের সাথে জোর করে কিছু হোক। সে মেহেরকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায় নাকি জোর করে। এমন সোনার টুকরো ছেলে কই পাব আমরা বলো? আর একবার ভুল মানুষ জীবনে আসলে কি মানুষ বেচে থাকা ভুলে যায়, না তাকে এগিয়ে যেতে হয় বাচতে হয় নিজের জন্য। নিজের চিন্তা না করুক অন্তত মাহির চিন্তা তো তোমার মেয়ে করতেই পারে। এই বাচ্চাটা কি সারাজীবন তার বাবার স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াই বড় হবে, যখন জানবে তার মা চাইলেই তাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দিতে পারত তখন কি মাহি তার মাকে ক্ষমা করবে?”
“তুমি একটু ঘুমাও মেহেরের মা, এত চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি না হয় ঘুমাব আর তুমি যে মেয়ের চিন্তায় রাতভর ঘরে পায়চারি করো সেই বেলায়।”
“কি আর করার মেয়েটাকে একটু সুখে দেখতে চাই। মেয়েটা যে অল্প একটু সুখ পেয়েই দুঃখেরঅথৈ সাগরে পরে গেছে।”
“হয়েছে আর কথা বলো না, এমনিতেই ওইদিন মাথা ঘুরে পরে গেছিলে অফিস থেকে আসার সময়। ছোট ভাইয়া না বললে তো জানতেই পারতাম না। সে ই তো বললো তুমি টেনশন করো কি নিয়ে আর ব্লাড প্রেশারটাও নাকি হাই। ছোট ভাইয়াও সেদিন তোমার অসুস্থতা দেখে বললো মেহেরকে একটু বুঝাতে। তাদের তো কোনো আপত্তি নেই শুধু মেহের রাজি হলেই আয়াত আর মেহেরের চার হাত এক করে দিত তারা।”
“কিছু ভালো লাগছে না মেহেরের মা লাইট টা বন্ধ করে দাও তো, দেখি এই দুই চোখে ঘুম এসে ভর করে কিনা?”
ঘরের লাইট বন্ধ হতেই মেহের আস্তেধীরে উপরে উঠে এলো৷ ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটের উপর বসে পরে। গালে পরে থাকা নোনা পানি টুক মুছে নিলো সে।
“মা বাবা আমার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছে। আর আমি কিনা নিজের জেদ নিয়ে পরে আছি। যেখানে আমি নিজেও জানি আয়াতের প্রতি আমি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পরছি। আজ আয়াতের অসুস্থতার কারণ আমি, বাবা মায়ের চিন্তার কারণ আমি, সবার ভেতর যে দোটানা কাজ করছে তার কারণও আমি। আমি চাইলেই আমার মেয়েকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে পারি কিন্তু আমি কিনা এসব না ভেবে একজনকে নিয়েই পরে আছি। যে কিনা আরও অনেক আগেই এগিয়ে গেছে, নিজের জীবনে সুখে আছে। তাও যখন আমি তার জীবনে ছিলাম তখন থেকেই। আর আমি কিনা সেই ছেড়ে যাওয়া জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি৷ সবার প্রতি অন্যায় করছি। অন্তত বাবা মায়ের কষ্ট আমার সহ্য হবে না। এতটা স্বার্থপর নই আমি।”
মাহির পাশে শুয়ে পরলো মেহের। গায়ের উপর কাঁথা টেনে মাহিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো মেহের। আর কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতে লাগলো। জ্বরের ঘোরে আয়াত তার কতটা কাছাকাছি ছিলো৷ আয়াত মেহেরের কাছে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি কতই সহজভাবে করছিলো। করতে করতে হঠাৎ চুপ করে যায়৷ মেহের আয়াতের পিঠে হাত দিয়ে আয়াতকে ডাকতে ব্যস্ত। কিন্তু আয়াতের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জোরপূর্বক আয়াতকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে আয়াত ঘুমিয়ে পরেছে৷ জ্বরের জন্যই অনেকটা দূর্বল সে। তাই বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেছে৷ মেহের ধীরে বিছানায় শোয়ায় আয়াতকে। তারপর গায়ে হাত দিয়ে দেখে এখনো জ্বর কমে নি। তাই টেবিলের উপর থাকা একটা রুমাল আর বাটি নিয়ে পানি এনে অনেকক্ষণ জল পট্টি দিয়ে দেয়। তারপর একটা গামছা নিয়ে ভিজিয়ে আয়াতের হাত, গলা, মুখ আর পা মুছে দেয়। এখন শরীরের তাপমাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। আয়াতের গায়ের উপর পাতলা কাঁথাটা টেনে বুক অবদি দিয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে যায় মেহের৷ দরজা বাইরে থেকেই আটকে দেয় মেহের। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে যদি দরজা খুলে যায় তখন পানি এসে ঘরে প্রবেশ করবে তাই৷ আর এত রাতে আয়াতের ঘরে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শত হলেও আয়াত একজন ছেলে তার ঘরে রাত্রি যাপন করা মেহেরের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। তাই মেহেরের তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে এলো। ছাদ থেকে নেমেই আবার রান্নাঘরে গেলো এটো প্লেট বাটি নিয়ে। সেগুলো রান্নাঘরের বেসিনে ধুয়ে আবার উপরে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে কাসফি আর মাহি দুইজন খেলা করছে। মাহিকে কোলে তুলে নিয়ে কাসফিকে ঘুমিয়ে পরতে বলে কাসফির ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো মেহের। নিজের ঘরে এসে মাহিকে ঘুম পাড়িয়েই নিচে পানি আনতে গিয়ে মা বাবার কথা শুনে নেয় মেহের৷ এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে আসে তার। আজানের শব্দে ঘুম উড়ে যায় তার। নামাজ আদায় করে খাটের উপর বসে। সেই সময় আয়াতের কথা মাথায় আসতেই নিচে গিয়ে স্যুপ বানায় সে৷ একটা স্যুপের বাটিতে স্যুপ নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে যায় মেহের। ছাদে গিয়ে আয়াতের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সে। ঢুকেই আয়াতকে খাটের উপর মাথার চুল টেনে ধরে বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হয় মেহের।
“একি আপনি এত সকাল উঠে বসে আছেন কেনো, আপনার এত জ্বর ছিলো রাতে আরেকটু বিশ্রাম নেওয়ার দরকার ছিলো। তা না করে এত সকাল সকাল উঠে বসে আছেন।”
“বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে গেছে কে?”
“ঘুমিয়ে ছিলেন আপনি, আর বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো তাই আমি ভাবলাম বাইরে বন্ধ না করলে ভেতরে পানি আসবে তাই আমিই বন্ধ করে গেছি।”
আয়াত মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ায়। সামনে এসে বলে,
“কে বলেছিলো রাতে আমার ঘরে আসতে?”
“কেউ বলে নি। আমি শুনলাম আপনি বাসায় আসার পর থেকে কিছুই খান নি এমনকি নিচেও যান নি তাই আমি নিজে থেকেই খাবার নিয়ে এসেছিলাম।”
“আমার মতো চরিত্রহীনের জন্য এত দরদ না দেখালেও চলতো। যে কিনা বাসায় একজনকে ভালোবাসি বলে বলে মাথা খেয়ে ফেলে আর বাইরে গেলে অন্যজনের সাথে প্রেমলীলায় মেতে উঠে। তাই না মেহের।”
মেহেরের নত দৃষ্টি। আয়াতের চোখ রক্তিমা আবরণে ছেয়ে গেছে৷ সেই চোখের দিকে তাকাতে মেহের ভয় পাচ্ছে। আয়াত মেহেরের সাথে কখনোই এভাবে কথা বলে নি। শুধুমাত্র কাল মেহের তাকে বিশ্বাস করে নি বলেই আজ এভাবে কথা বলছে আয়াত। মেহের তবুও সাহস নিয়ে আয়াতকে পাশ কাটিয়ে খাটের উপর স্যুপের বাটি রেখে আয়াতের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আয়াতের কপাল আর গলায় হাত ছুইয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা। আয়াত বিরক্ত হয়ে মেহেরের হাত সরিয়ে দেয়।
“এখন জ্বর নেই আয়াত। আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন তারপর এসে গরম স্যুপটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে। আর আজ ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই। কাল পুরোপুরি সুস্থ হলেই যাবেন।”
“তোমার কথায় চলবে নাকি?”
“যদি বলি আমার কথাতেই চলবে, তাহলে কি শুনবেন না?”
মেহেরের এমন জবাবে আয়াত কি প্রতিত্তোর করবে তার জানা নেই। তাই সে হাত মুখ ধুতে চলে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে খাটের এক কোণায় বসে পরলো। স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। মেহের এক দৃষ্টিতে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আয়াত মেহেরের দিকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাকাচ্ছে না। স্যুপ শেষ করে বাটি টা আগের জায়গায় রেখে দেয় আয়াত৷ মেহের হাতে থাকা পানির গ্লাসটা আর তার সাথে কয়েকটা ওষুধ আয়াতের দিকে এগিয়ে দেয়। আয়াত সেগুলো নিয়ে খেয়ে নেয়। মেহের হাসি মুখে খাটের উপর থাকা স্যুপের বাটিটা নিয়ে টেবিলে রাখতে যায়। বাটি নেওয়ার সময় মেহেরের গলায় থাকা ওড়না কিছুটা সরে যায় আর আয়াতের নজর গিয়ে আটকায় মেহেরের গলার কাছে। আর সাথে সাথে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। মেহের টেবিলের কাছেই ছিলো আয়াত তার হাত ধরে তার দিকে ফেরালে মেহের ভয় পেয়ে যায়। হঠাৎ করে টান দেওয়ায় মেহের আয়াতের হাতের দুই পাশে থাকা টি-শার্টটা আকড়ে ধরে।
“কি হচ্ছে কি আয়াত?”
চলবে,,,,