দুপাতার পদ্ম পর্ব -১৬-২০

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১৬
#Writer_Fatema_Khan

আয়াতের মামার বাড়িতে তার মামারা দুই ভাই একসাথে থাকে। অনেক বড় একটা টিনের ঘর। নিচের ফ্লোর পাকা তবে পাশের দেয়াল আর উপরের ছাদ টিনের তৈরি। বড় মামার এক মেয়ে এক ছেলে বিথী আর বিহান। বিহান নিজের ব্যবসা দেখে আর বিথী ইন্টার পাশ করলো এবার। আর ছোট মামার এক ছেলে রিয়ান ক্লাস এইটে পড়ে৷ আয়াতের একটাই খালা, তিনিও এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। তার আবার দুই মেয়ে আনিকা আর কনিকা। আনিকা এবার অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে আর কনিকা ক্লাস সিক্সে। মামা মামি সবার সাথে কুশল বিনিময় করে তাদের সবাইকে ঘর দেওয়া হয়। মেহের আর মাহি বিথীর সাথে থাকবে, আনিকা, কনিকা আর কাসফি একঘরে আর আয়াত থাকবে বিহান আর রিয়ানের সাথে। গ্রামে আসতেই মেহেরের খুব ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। গ্রামের মানুষ এখনো কত উদার, কেমন তারা আসতেই জড়িয়ে ধরেছে আয়াতের মামীরা। সবার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে মেহেররা আসবে বলে। মেহের আলতোভাবে হাসলো। তারপর ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে মাহিকে ফ্রেশ করিয়ে দিল। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো মেহের দুপুর ২টা বাজে। তারপর নিজের কাপড় বের করে কলপাড়ে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
“এই তপ্ত দুপুরে গোসল না করলেই না৷ মাকে বলে গোসলে চলে যাই।”
মাহিকে কোলে করে মায়ের কাছে দিয়ে বললো,
“মা মামীরা খাবারের জন্য ডাকলে তোমরা খেতে চলে যেও আর মাহিকে আগে কিছু খাইয়ে দিও। আমার অনেক খারাপ লাগছে আমার গোসল করা দরকার। আমি না হয় গোসল সেড়ে একেবারে খাব।”
“ঠিক আছে।”
তারপর মেহের কলপাড়ে চলে গেলো৷ সুন্দর একটা গোসলখানা। চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরাও করা আর দরজায় টিনের দরজা তার সাথে একটা কাপড়ের পর্দা। চারপাশে টিন থাকলেও উপরে খোলা। পরিস্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে কলপাড় থেকে। কলপাড়ে থাকা একটা রশির উপর কাপড় রেখে গোসল করে নিল মেহের। গোসল সেড়ে চুল মুছতে মুছতে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সবার খাওয়া ইতোমধ্যে শেষ বিধায় আয়াতের বড় মামী বিথীকে দিয়ে মেহেরের খাবার ঘরেই পাঠিয়ে দিল। বিথী মেহেরের পাশে বসে আর বলে,
“আপু মা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে তুমি খেয়ে নাও। অনেক বেলা হয়ে গেছে নিশ্চই খিদে পেয়েছে। এই নাও আমি বেড়ে দিচ্ছি।”
“বাকিরা সবাই খেয়েছে?”
“হুম, সবাই খেয়ে নিয়েছে। শুধু তুমি বাকি আছো, খেয়ে নাও আপু।”
আর বাক্যব্যয় না করে মেহের খাবার খেয়ে নিল। খাওয়া শেষ করে মেহের বাড়ির বাইরে বের হলো। বরাবরই মেহেরের গ্রামের বাড়ি পছন্দের তালিকায়। ছোট বেলা থেকেই শহরে থাকার কারণে গ্রামে তেমন আসাও হয় না। গ্রামের বাড়িতে তাদের কোনো আত্মীয়ও নেই যে গ্রামে এসে থাকবে। আয়াতের মামার বাড়িতে এসেছিল তাও আয়াত দেশের বাইরে যাওয়ার অনেক আগে।
“আচ্ছা বিথী বাকিরা কই?”
“সবাই মনে হয় যার যার ঘরে ঘুমাচ্ছে।”
“হুম সেটাই হবে, সকালে উঠেছে সবাই তাই হয়তো ক্লান্ত। আমি আবার গাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই এখন গোসলের পর অনেকটাই ফ্রেশ লাগছে। এখন একটু বাড়িটা ঘুরে আসি৷”
“আচ্ছা যাও। কিন্তু একা যেতে পারবে তো?”
“চিন্তা করো না, আমি পারব।”
বিথী ঘরে গিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে বসে পরলো। মেহের ভেজা চুল খুলে বাড়ির বাইরের রাস্তা দিয়ে হাটা শুরু করলো। কিছুদূর যেতেই তার নজরে এলো আয়াতের ছোট মামা বাড়ির সামনে থাকা টঙের দোকানে বসে চা খাচ্ছেন। মেহের সেদিকেই এগিয়ে গেলো৷ মেহের দৃষ্টিগোচর হতেই আয়াতের মামা এগিয়ে এলেন৷
“কি হলো আম্মু, তুমি বিশ্রাম না নিয়ে এখানে কি করছো!”
খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন তিনি। মেহের হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে বললো,
“ভাবলাম অনেকদিন পর গ্রামে আসলাম তাই একটু ঘুরে দেখি। আর আজ তেমন সূর্যের তাপও নেই তাই হাটাই যায়।”
“তা ঠিক। চলো আম্মু তুমি আমার সাথে আসো।”
দুইজনেই সামনে এগিয়ে গেলো। টুকটাক কথা হচ্ছে দুইজনের মধ্যে। মাঝে মাঝে হেসে উঠছে মেহের। দূর থেকে তার এই মিষ্টি হাসির দিকে তাকিয়ে আছে একজন। কারণ মেহেরের এই প্রাণখোলা হাসি তার কাছে অমবস্যার চাঁদের মতোই৷
“মেহের।”
“জি মামা।”
“ওই মাঠের দিকে চলো, ওইখানে বিহান, আয়াত আর রিয়ান আছে৷ ওরা ওইখানে ক্রিকেট খেলছে।”
মেহের কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো মাঠের দিকে। তবে কাউকেই তার নজরে এলো না। তবুও মাথা নেড়ে সায় জানালো সে। মাঠের কাছে আসতেই তাদের তিনজনকেই দেখতে পেলো মেহের।
“আশ্চর্য তো! এই ছেলে সেই সকাল থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে গ্রামে এলো কোথায় একটু রেস্ট নিবে তা না খেলতে চলে এসেছে৷”
আয়াত বল করায় ব্যস্ত, তাই এদিকে তার নজর নেই। এতক্ষণ সে মেহেরের দিকেই তাকিয়ে ছিল যার দরুন তার একটা ক্যাচ মিস গেলো। তাই এবার পুরো মনোযোগ খেলায় দিচ্ছে সে। মেহের শুনতে পেলো আর মাত্র ১০রান লাগবে অন্য টিম জেতার জন্য। আর এটাই নাকি লাস্ট অভার। মেহেরও খেলা দেখায় মনোযোগ দিল। তবে তারা কায়দা করতে পারলো না বেশি একটা। আয়াতের প্রথম বলেই আউট হয়ে গেলো। তারপরের বলে ছয়, আর মাত্র চার রান হলেই অপর পক্ষ জিতে যাবে। বাকি তিন বলে কোনো রান না দিলে শেষ বলে চার মেরে জিতে গেলো অপর পক্ষ। মেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো৷ আয়াত নিজের মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর একপলক মেহেরের দিকে তাকিয়ে আচমকা হেসে দিলো। মেহের আয়াতের দিকেই তাকিয়ে ছিলো, আচমকা আয়াতের তাকিয়ে হেসে দেওয়া তার বোধগম্য হলো না।
“হেরে গিয়ে এই ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়। না হলে কেউ হেরে এভাবে হাসে নাকি!”
“আপু।”
কারো ডাকে পাশে তাকিয়ে দেখে কনিকা দাঁড়িয়ে আছে। কনিকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“আরে তুমিও আছো এখানে!”
“শুধু আমি না আনিকা আপুও আছে। আপু তো স্পেশালি আয়াত ভাইয়ার খেলা দেখার জন্য এসেছে। শুনেছি ভাইয়া নাকি অনেক ভালো খেলে। কিন্তু শেষে এসে কি হলো একটা ক্যাচ ছেড়ে দিল আবার চার আর ছয় দিয়ে জেতা ম্যাচটাই হেরে গেলো।”
“ওহ।”
মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও বারবার মেহেরের মনে একটাই প্রশ্ন,
“স্পেশালি আয়াতের খেলা দেখতে আসার মানে কি?”
“কি ভাবছো আপু?”
“না তেমন কিছু না।”
“আপু চলো ওই দিকটায়। ওইখানেই সবাই আছে।”
আয়াতের মামা বলে উঠলো,
“হ্যাঁ কনিকা মেহেরকে নিয়ে যা তোদের সাথে আর আমি একটু কাজে যাই। আর হ্যাঁ মেহেরে কাল কিন্তু খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে। মামা তোমাকে কিছু দেখাব।”
মাথা নেড়ে সায় জানায়৷ আয়াতের মামা সেখান থেকে চলে যায়। মেহের কনিকার সাথে যায়। ওইখানে আয়াতসহ আনিকা বিহান আর রিয়ান আছে৷ আনিকা আর আয়াত খুব হেসে কথা বলছিলো। মেহের আর কনিকা যেতেই সবাই মেহেরকে বললো কখন এসেছে? আয়াত তাদের বলে একটু দূরে গিয়ে সবার জন্য ফুচকার অর্ডার দিলো। কিছুক্ষণ পর একটা পিচ্চি এসে সবার হাতে এক প্লেট ফুচকা দিয়ে গেলো। কিন্তু নিজের জন্য নিলো না। আয়াত নিজের জন্য ফুচকা নেয় নি বলে আনিকা নিজের প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে আয়াতের মুখের কাছে নিয়ে ধরলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়াত আনিকার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে ফুচকা মুখে তুলে নিলো। আনিকার এতটা কাছে আসা মেহেরের ভালো না লাগলেও আয়াত যে আনিকার হাতে না খেয়ে নিজের হাতে নিয়ে খেয়েছে এতে মেহের একটু হাসলো। আয়াত এগিয়ে গেলো মেহেরের কাছে। মেহেরের পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ঝুকে ফিসিফিসিয়ে বললো,
“আমার খেলা শেষ হওয়ার পর আসলে কি এমন ক্ষতি হতো তোমার? তোমাকে সামনে দেখলে যে আমি তোমার চোখে হারিয়ে যাই আর এই খেলায় হারাতো সামান্য জিনিস। এভাবে সব জায়গায় আমাকে না হারালে হয় না? আর তোমার হাত ছাড়া আমি অন্য কারো হাতে খাব না নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”
বলেই মেহেরের প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে মুখে পুরে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“সবার জন্য চা দিবে একটু পর। খেয়ে সবাই বাড়িতে চলে যাবি। আমি আর বিহান পরে বাড়িতে আসব। বিহান চল।”
মেহের যেনো জমে গেছে আয়াতের কথায়,
“কি বলে গেলো এই ছেলে!”

চলবে,,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১৭
#Writer_Fatema_Khan

আনিকার দিকেই নিবদ্ধ মেহেরের দৃষ্টি। আড়চোখে বারবার আনিকাকে দেখে যাচ্ছে মেহের। আয়াত আর বিহান যাওয়ার পর থেকে যে আয়াতের কত কথা বলছে এই মেয়েটা। মনে হয় আয়াত মেহেরদের সাথে নয় ছোট বেলা থেকেই আনিকাদের সাথেই ছিল।
“এই আনিকা বারবার আয়াতকে নিয়েই কেনো কথা বলছে, আর আয়াতের সম্পর্কে এই আনিকা কতকিছুই না জানে? আর আমি কিনা এসব জানিই না। তবে গ্রামের বাড়ি যখন আয়াত আসছিল তখনের কথা তাই হয়তো আমি জানি না।”
মনে মনে নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিচ্ছে মেহের। কিন্তু তার মনে তো হিংসার ফুল্কি জ্বলে উঠছে আয়াতকে নিয়ে।
“এই মেহের আপু তাড়াতাড়ি তোমার প্লেট খালি করো, আমাদের আবার ফিরতে হবে তো।”
হাতের কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে কনিকা মেহেরকে খেতে বললো। আনিকা মেহেরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,
“আর আপু তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”
“এইতো ভালো।”
“মা বললো তুমি নাকি অফিস জয়েন করেছো?”
“হুম বছরখানেকের মতো অফিস জয়েন করেছি।”
“জানো তো আমারও ইচ্ছা পড়ালেখা কমপ্লিট করে আমিও নিজের পায়ে নিজে দাড়াবো।”
“এটা তো খুব ভালো চিন্তা আনিকা।”
“ধন্যবাদ আপু৷ আচ্ছা আপু তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও বাড়ির দিকে পা বাড়াতে হবে আমাদের।”
“আনিকা কত সুন্দর করে কথা বলে, কি সুন্দর হাসি! নির্দ্বিধায় মনের কথা বলে যাচ্ছে৷ গায়ের রঙ কত উজ্জ্বল, আবার ঘন কালো লম্বা স্ট্রেইট চুল। হাসলে বা গালে কি সুন্দর টোল পরে। যতটুকু বুঝলাম আয়াতকে পছন্দও করে। দুইজনের বয়সও ঠিক আছে। মানাবে খুব দুইজনকে।”
ফুচকা খেতে ভাবে মেহের এসব৷ তারপর তারা বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তায় টুকটাক কথা হয় তাদের। বাড়িতে এসে সবাই ঘরে চলে যায়। মেহের মাহিকে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে ঘরে যায়। মাহি ঘুম থেকে উঠেছে নাকি অনেকক্ষণ হলো কিছু খাইয়ে দিবে মেহের। তাহলে অনেকটা সময় খেলবে। মাহিকে খাইয়ে মেহের বাইরে বেড়িয়ে যায় উঠোনে। রিয়ান এক প্রকার দৌড়ে আসে মেহেরের কাছে।
“মেহের আপু মাহিকে আমার কাছে দাও। আমি ওকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলি।”
“ঠিক আছে।”
রিয়ান মাহিকে কোলে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। বিথী ঘর থেকে বের হয়ে বলে,
“মেহের আপু তুমি এখানে একা দাঁড়িয়ে কেনো, আমার সাথে এসো সবাই পাকের ঘরে পিঠা বানাচ্ছে।”
“তাই!”
“হুম সবাই ওইখানেই আছে চলো।”
মেহের বিথীর পেছনে রান্নাঘরের দিকে গেলো। সবাই মোরা পেতে বসে আছে। আয়াতের দুই মামী পিঠা বানাতে ব্যস্ত আর বাকিরা গল্প করতে৷ তবে সবার হাতেই একটা করে পিঠা৷ খাচ্ছে আর গল্প করছে। মেহের সামনে এগিয়ে একটা মোরায় গিয়ে বসলো৷ মেহেরকে দেখে আয়াতের বড় মামী একটা প্লেটে করে পিঠা এগিয়ে দেয়।
“এই নাও মেহের একটা গরম পিঠা খেয়ে নাও ভালো লাগবে। ঠান্ডা হলে তখন আর এই স্বাদটা পাবে না।”
মেহের হাত বারিয়ে বড় মামীর কাছ থেকে পিঠা নিয়ে নেয়৷ আর খাওয়া শুরু করে।
“খুব ভালো খেতে মামী।”
“আরেকটা দিব?”
“ধন্যবাদ, তবে আর খেতে পারব না।”

সন্ধ্যার পর আয়াত আর বিহান ফিরেছে বাড়িতে৷ দুইজনেই ঘেমে একাকার৷ বিহান নিজের কাপড় নিয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে চলে গেলো গোসলে। আয়াত তার মাকে ডেকে বললো,
“মা আমার কাপড় দাও তো গোসল করবো। পুরো শরীর ভিজে গেছে এভাবে থাকা যাবে না।”
আয়াতের মা মেহেরের মা আয়াতের খালা আর দুই মামী বসে কথা বলছিলেন৷ এরা যেনো পুরোনো বান্ধুবিদের খুঁজে পেয়েছে এভাবেই আড্ডা দিচ্ছে সারাদিন৷ পাশে মেহের, আনিকা, কাসফি আর কনিকাও ছিল৷ রিয়ান দাঁড়িয়ে মাহিকে নিয়ে খেলছে। এই বাচ্চা ছেলেটা বরাবরই বাচ্চা খুব পছন্দ করে। আয়াতের মা ভ্রু কুচকে ফেলে ছেলের ডাকে। এখন আবার গেলে আড্ডা মিস হয়ে যাবে৷ তিনি মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মেহের মা তুই গিয়ে আয়াতের ব্যাগ থেকে ওর কাপড় দিয়ে আয় না।”
মেহেরের যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও সবার সামনে তো মানা করা যায় না। তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি দিয়ে আসছি আয়াতকে তুমি কথা বলো।”
মেহের আয়াত যে ঘরে থাকবে ওই ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
আয়াতের বড় মামী বললো,
“আচ্ছা আপা আপনারা কি মেহেরের আবার বিয়ে দেওয়ার কথা কিছু ভেবেছেন? মানে মেয়েটা দেখতে মাশাল্লাহ এই বয়সে এমন কিছু ঘটে যাবে কে ই বা ভেবেছে। কিন্তু এভাবে বাসায় রেখে দিলে তো হবে না ভবিষ্যৎ তো পুরাই রয়ে গেছে৷ তাই বললাম আর কি।”
“আমরা যে ভাবি নি এমনটা নয় ভাবি। আমরা মেহেরের মনের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যখন মেহের প্রস্তুত থাকবে নতুন সম্পর্কে যাওয়ার জন্য তখনই ওর বিয়ের ব্যাপারে ভাববো।”
“কত চঞ্চল মেয়েটা এখন একদম চুপচাপ থাকে। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে না। সত্যি মানুষের জীবন মুহূর্তে পালটে যায়৷”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আয়াতের মামী। তারপর প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথা শুরু করলেন তারা৷ এসব শুনে মেহেরের মায়ের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তিনি ভাবতে লাগলেন,
“সত্যি তো মেয়েটা কবে নিজের ভালো বুঝবে, আয়াত তো সারাক্ষণ তার খেয়াল রাখতেই ব্যস্ত থাকে। মেয়েটা যদি ছেলেটাকে একটু বুঝতো আর নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিত কতই না ভালো হত।”
মেহেরের মায়ের চিন্তা বুঝতে পেরে তার কোলের উপর রাখা হাতের উপর হাত রেখে আয়াতের মা মুচকি হাসি দিলেন। যার মানে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু মায়ের মন তো আর সান্ত্বনা মানে না।

ঘরে ঢুকে আয়াতের ব্যাগ থেকে আয়াতের ব্যবহার করা টাওয়েল, ট্রাউজার আর একটা টি-শার্ট নিয়ে নিল। পেছনে ফিরতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে খাটের উপর পরে গেলো৷ খাটের উপর কাপড় হাতের ভাজে ভরে কোলে নিয়ে বসে আছে। মায়ের দেরি দেখে আয়াত নিজেই কাপড় আনতে ঘরে আসে৷ কিন্তু আয়াত ঘুনাক্ষরেও ভাবে নি মেহের এখানে থাকবে আর তাকে দেখে এভাবে ভয় পেয়ে যাবে৷
“তুমি ঠিক আছো তো, লেগেছে কোথাও?”
আয়াত অস্থির হয়ে হাটুর উপর ভর দিয়ে বসে জিজ্ঞেস করতে লাগলো৷ আজ সকাল থেকে আয়াত একের পর এক কথা বলে মেহেরকে বারবার লজ্জায় ফেলছে তাই সে কোনো উত্তর দিতে সক্ষম হলো না৷ একবার তার সামনে থাকা অস্থির মানুষটার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললো৷ হাতে থাকা কাপড়গুলো আয়াতের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়৷ সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়৷ এই ছেলের লাগাম ছাড়া কথা আবার কখন শুরু হয়ে যায় তাই সে তাড়াতাড়ি চলে আসে৷ আয়াত মেহেরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
“এই মেহেরের আবার কি হলো?”
হাতের কাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় আয়াত।
“ইস না আসলেও পারতাম, তাহলে মেহের নিজে গিয়ে কাপড় দিয়ে আসতো আমাকে।”
আয়াত উঠে দাঁড়ায়৷ তারপর বিহানের সাথে পুকুরে গোসলে চলে যায়। অনেকক্ষণ গোসল করার পর তারা ঘরে চলে আসে৷ রাতের খাবার সবাই একসাথে খেয়ে যার যার ঘরে চলে যায়৷ তবে মুরব্বিরা সবাই বাড়ির উঠোনে বসে গল্প গুজব করছে৷ আয়াত ঘরে গিয়েই ঘুমের দেশে পারি দেয়৷ সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বিছানায় লাগানোর সাথে সাথেই চোখে ঘুমেরা ভর করে নিয়েছে৷ রাতে কারো সাথে তেমন একটা কথা হয়নি আয়াতের। রিয়ান এখনো মেহেরের কাছেই বসে আছে মাহিকে কোলে নিয়ে৷ এই ছেলেটা সারাদিন মাহির সাথেই ঘুরঘুর করেছে। মেহের রিয়ানের মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলে,
“তোমার কি ঘুম আসছে না রিয়ান! আর কত খেলবে মাহিকে নিয়ে?”
“মেহের আপু জানো তো আমার না বাচ্চাদের খুব ভালো লাগে। আমিতো ভেবেছি আমার যখন বিয়ে হবে আমি আর আমার বউ অনেকগুলো বাচ্চা নিব। সার বাড়ি আমার বাচ্চা কাচ্চা দিয়ে ঘিরে থাকবে।”
ক্লাস এইটে পড়ুয়া রিয়ানের কথা শুনে মেহেরের দম ফাটানো শব্দের হাসিতে যেনো পুরো বাড়ি কাপিয়ে তুলছে৷ মেহের আর বিথীর ঘরের পাশের ঘরটায় আয়াত ঘুমিয়ে আছে৷ হাসির শব্দে আয়াত মাথার নিচে থাকা বালিশ টেনে মাথার উপর দিয়ে বলে,
“এই মেয়েটা আমাকে ঘুমাতেও দিবে না। এই মেয়েটা এভাবে হাসলে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব আমি কেন বুঝে না।”
বলেই মুখে হাসির রেখা টেনে আবার ঘুমিয়ে পরলো আয়াত৷

চলবে,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১৮
#Writer_Fatema_Khan

ফজরের নামাজ শেষে মাত্র শুয়েছিল মেহের৷ সাথে সাথে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।
“এত সকাল বেলা কে হতে পারে?”
মেহেরের ভাবনার মাঝেই আবার দরজায় কড়া নাড়া শুরু হলো। মেহের পাশে তাকিয়ে দেখে বিথী আর মাহি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে৷ হবু বরের সাথে অর্ধেক রাত অবদি কথা বলছিল বিথী তাই তার ঘুম ভাঙছে না। মেহের ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিল৷ সামনে কাসফি আর কনিকাকে দেখে ভূত দেখার মতো কিছু দেখে ফেললো মনে হয়। কাসফি তাও এত সকালে ঘুম থেকে উঠে পরেছে৷ কাসফির কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখতে লাগলো জ্বর আছে কিনা।
“এই আপু কি করছো এসব?”
“দেখছি আমাদের কাসফির জ্বর এলো কিনা, যে মেয়েকে জোর করে কেউ ঘুম থেকে উঠাতে পারে না সেই মেয়ে কিনা এত ভোরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে!”
“আচ্ছা আপু ফাজলামি ছাড়ো তো। এখন আমাদের সাথে চলো।”
“কোথায় যাব এত ভোরে?”
কনিকা বললো,
“মামা তো বললো তোমাকে নাকি কাল বলে রেখেছে সকাল সকাল তোমাকে কিছু দেখাবে।”
“ওহ হ্যাঁ, মনে আছে। তা কি দেখাবে?”
“তুমি চলো তো আমাদের সাথে।”
“এক মিনিট দাড়া ওড়না টা নিয়ে নেই।”
মেহের ঘরের ভেতর ঢুকে মাহি আর বিথীর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে ওড়না ভালো মত মাথায় আর গায়ে জড়িয়ে নিল। শহরে শীতের আভাস না থাকলেও সকাল সকাল ভালোই ঠান্ডা পরছে৷ চারপাশে হালকা কুয়াশাও দেখা দিচ্ছে৷ মেহের কাসফি আর কনিকার সাথে বেড়িয়ে গেলো৷ বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে গেলো তারা তিনজন। কিছুটা দূর যেতেই কাসফি আর কনিকা ছুটে রাস্তার পাশে থাকা বড় পুকুরের কাছে চলে গেলো৷ মেহের আস্তে আস্তে এইদিকে যেতে থাকে৷ অনেক মানুষের সমাগম দেখা যাচ্ছে৷ এত সকালে একমাত্র গ্রামেই এত মানুষ দেখা যায়। শহরে এত সকালে মানুষ ঘুমে বিভোর থাকে৷ কিছুটা এগিয়ে পুকুরের সামনে দাঁড়ালো মেহের। পাশেই আনিকা, কনিকা আর কাসফি। আনিকা মেহেরকে দেখে মন মুগ্ধকর একটা হাসি দিয়ে বললো,
“এসেছো তুমি, আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
মেহের সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সামনে তাকালো। পুকুরে মাছ ধরছে গ্রামের ছেলেরা৷ পুকুরটা আয়াতের মামাদের। পুকুরে রিয়ানও আছে৷ তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বিহান আর আয়াতও মাছ ধরায় যোগ দিয়েছে৷ আয়াতের পরনে একটা লুংগি গায়ে কিছুই নেই। তবে এরা তিন ভাই মাছ ধরছে কম কাদা মাখামাখি করছে বেশি। জেলেরা মাছ ধরাতে ব্যস্ত সাথে উপর থেকে আয়াতের বড় মামা আর ছোট মামা বলে যাচ্ছেন কোন মাছ রাখবেন আর কোন মাছ আবার পানিতে ছেড়ে দিবেন৷ সেখানে আনিকার বাবা আর মেহেরের বাবা আর চাচাও উপস্থিত ছিলেন৷ মেহের এক দৃষ্টিতে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে৷ এই প্রথম আয়াতকে এমন ভাবে দেখলো মেহের। আয়াত বরাবরই পরিপাটি ছেলে, নিজের সবকিছু একদম পারফেক্ট রাখে সবসময়। কিন্তু আজ ছেলেটা বড্ড অগোছালো বড্ড চঞ্চল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আয়াতের বড় মামা মাছ ধরা বন্ধ করতে বললেন৷ জেলেরা সবাই নিজেদের জাল নিয়ে উঠে আসলো আর মাছ আয়াতের মামার কাছে দিয়ে গেলো। কয়েকজন লোক মিলে মাছগুলো বাড়িতে নিয়ে গেলো। আয়াত, বিহান আর রিয়ান পুকুরে সাঁতার কাটছিল৷ মেহেররা এখনো পুকুরের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কারো গলার শব্দে পেছনে তাকায় সবাই। বড় মামা দাঁড়িয়ে আছেন।
“কিরে তোরা সব এখানে কেন, বাড়িতে যা দেখ গিয়ে কত মাছ পাঠিয়েছি বাড়িতে৷ আমার একটু বাজারে কাজ আছে ওইখানেই যাব, তোরা বাড়ি যা।”
বলেই উনি হাটা ধরলেন। মেহেররাও বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। তাদের পেছনে আয়াত, বিহান আর রিয়ানও আসছে। তাদের গায়ে সব কাদামাটি। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আয়াত মেহেরের কাছে গিয়ে বললো,
“আমার কাপড়গুলো তুমি বা কাউকে দিয়ে একটু বাড়ির ভেতরের পুকুরের ঘাটে পাঠিয়ে দিও। এই অবস্থায় তো আর ঘরের ভেতর যেতে পারব না৷”
আয়াত আর কথা না বাড়িয়ে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলো। মেহের আয়াত যে ঘরে থাকে সেই ঘরে গিয়ে ওর কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে এলো। দরজার সামনেই আনিকা দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা কাচুমাচু করতে করতে মেহেরের হাত থেকে কাপড় নিয়ে বললো,
“আমিই দিয়ে আসছি আয়াত ভাইয়াকে কাপড়, তুমি বরং সবার সাথে কথা বলো।”
মেহের আর কথা বাড়ালো না হাসিমুখে দরজা ছেড়ে উঠোনের দিকে যেতে লাগলো। আনিকা খুশিতে পুকুরের ঘাটে চলে গেলো। মেহের উঠোনে গিয়ে দেখলো মেহেরের মা, চাচী, আয়াতের বড় আর ছোট মামী, খালা সবাই মিলে মাছ কাটায় ব্যস্ত। ছোট বড় অনেক মাছ ধরা পরেছে জালে। এত মাছ যে সবাই মিলেও অনেক সময় লেগে যাবে কাটতে। মেহের পাশেই দাঁড়িয়ে দেখছিল। পাশেই হাই তুলতে তুলতে বিথী এসে দাড়ালো। মেহের বিথীকে দেখে মুচকি হাসলো।
“আমিও ঠিক এভাবেই রাত জেগে আবিরের সাথে কথা বলতাম বিয়ের আগে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সবকিছুই মরিচিকা। সবকিছুই বাচ্চামো ছিল, না হলে কি আর মানুষ চিনতে ভুল করি।”
নিজেই নিজের উপর হাসছিল তাও তাচ্ছিল্যের হাসি। মেহেরকে এভাবে হাসতে দেখে বিথী বললো,
“কি হলো আপু তুমি এভাবে হাসছো কেনো, কিছু কি ভাবছো? আমাকেও বলনা কি নিয়ে হাসছো! আর তোমরা নাকি সকালে মাছ ধরা দেখতে গিয়েছিলে আমাকে নেও নি কেনো?”
“তুমি তো রাতভর জেগে ছিলে তাই তোমার আরামের ঘুম আমি নষ্ট করতে চাই নি। তাই সকালে ডাকি নি।”
বিথী যেনো কিছুটা লজ্জা পেলো তা বিথীর লাল হওয়া গাল দেখেই বুঝা যাচ্ছে। হয়তো তাদের ভালোবাসার কোনো কথা মনে পরে গেছে৷ মেহের বিথীর লজ্জা মাখা মুখ দেখে নিজের অতীতে ডুব দিল।
“আমিও তো কত শত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। ছোট্ট কাসফি পাশে পরে পরে ঘুমাতো। কাসফির যেনো ঘুম না ভাঙে সেই দিকে খেয়াল রেখে বারান্দায় গিয়ে বসে বসে কথা বলতাম৷ আবিরের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে ভোর হয়ে যেত সেই খেয়ালই থাকত না। আজানের শব্দে ফোন রাখতাম দুইজনেই৷ তারপর নামাজ পড়ে তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য দোয়া করতাম। আর সে দোয়াও একদিন পূরণ হলো।”
মেহেরের ভাবনার মাঝেই কাসফি এসে মেহেরের হাত টেনে ধরে। মেহের চমকে যায় কাসফির হঠাৎ এসে হাত ধরাতে। মেহের আশ্চর্যজনক ভাবে কাসফির দিকে তাকালো। কাসফি মেহেরকে আর বিথীকে তার সাথে টেনে নিয়ে বললো,
“আপু চলনা আমার সাথে একটা মজার জিনিস দেখাব।”
আর বাক্যব্যয় না করে মেহের আর বিথী কাসফির সাথে গেলো। বাড়ির ভেতরেই ছোট একটা পুকুর৷ এটাতে বাড়ির মহিলা পুরুষ তাদের কাজ করে থাকে। আর গোসলের জন্য আলাদা কলপাড় তো আছেই। তাদেরকে নিয়ে কাসফি সেই পুকুর ঘাটেই গেলো৷ সেখানে আয়াত, বিহান আর রিয়ান সাতার কাটছে৷ আর আনিকা আয়াতের কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই কনিকা হাতে তালি দিচ্ছিলো তাদের সাঁতার দেখে৷ মেহেররাও যোগ দিল তাদের সাথে। মেয়েরা সবাই ঘাটে বসে আছে৷ আয়াতের মামা পুকুরের উপর বসার জন্য পাকা করে দিয়েছে। সেখানেই সবাই বসে আছে৷ মেহের যে এসেছে সেদিকে আয়াত এখনো খেয়াল করেনি৷ সে নিজ আনন্দে সাঁতার কেটে যাচ্ছে৷ গোসল শেষে তারা উপরে উঠে আসলে আনিকা এগিয়ে গিয়ে আয়াতকে তার কাপড় দেয়৷ বিহান বিথীকে বললো,
“বিথী আমার কাপড় গুলো ওইখানে একটু নিচে নিয়ে আয়৷”
বিথী হাসি মুখেই বিহানকে কাপড় এগিয়ে দিল। রিয়ান মুখ বাকিয়ে বললো,
“বাব্বাহ! সবাই সবাইকে দিল আর বলিনি বলে কেউ আমার কাপড় এগিয়ে দিল না।”
বলেই উপরে উঠে নিজের কাপড় নিয়ে চেঞ্জ করতে লাগলো৷ সবাই তার কথা শুনে হেসে উঠলো। বিহান বললো,
“তুই এত হিংসুটে কেন রে?”
মেহের রিয়ানকে কাছে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে বললো,
“রিয়ান একদম হিংসুটে নয় ভাইয়া, ও তো অনেক লক্ষী আর আদুরে ছেলে।”
বলেই রিয়ানের হাত থেকে গামছা নিয়ে মেহের রিয়ানের চুল মুছে দিল। আয়াত মেহেরের দিকে তাকিয়ে ছিল যতক্ষন সে ঘাটে ছিল৷ ছেলেরা চলে গেলেও মেয়েরা ঘাটে বসে অনেকক্ষণ যাবত গল্পে মজে থাকল। কখন যে বেলা ১০টা পেরিয়ে গেছে কারো কোনো খেয়ালই নেই। তারা সবাই বিভিন্ন কথা বলাতে ব্যস্ত। তবে সবচেয়ে বেশি বকবক করছিল কাসফি আর কনিকা৷ এরা নিজেদের স্কুলের কথা বলছিল আর বাকিরা টুকটাক কথা বলছিল৷ আয়াতের মা এসে সবাইকে খাবার ঘরে যেতে বললো। সকালের খাবার এখনো কেউ খায় নি৷ সবাই মাছ নিয়ে এতক্ষণ ব্যস্ত থাকায় সকালের খাবারের দিকে নজর দিতে পারেনি। মেয়েরা সবাই আয়াতের মায়ের কথামতো খাবার ঘরে খাবার খেতে গেলো৷ তবে অবাক করার বিষয় হলো সকালের নাস্তার বদলে দুই ধরনের ছোট মাছ গরম ভাত সাথে ডাল আর টাকি মাছের ভর্তা করা হয়েছে। সবাই এত মজার খাবার দেখে তাড়াতাড়ি খেতে বসে পরলো৷ সবাই খেতে আসলেও আয়াত আর বিহানকে দেখা গেলো না৷ মেহের বিষয়টি খেয়াল করেও কিছুই বললো না৷ তবে আনিকা জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“খালামনি আয়াত ভাইয়া আর বিহান ভাইয়া খাবে না? ওনারা তো এলো না।”
আয়াতের মা মুচকি হেসে উত্তর দিল,
“ওরা খেয়ে বেড়িয়ে গেছে৷ কি নাকি কাজ আছে এদের। আমি বুঝি না বাপু বোনের বিয়েতে এসে এদের কাজের শেষ নেই।”
খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার ঘরে চলে গেলো৷ মেহের নিজের ঘরে যায় নি বেশি একটা। সারাদিন মা, চাচী আর মামীদের সাথেই ছিল৷ ওনারা কত শত গল্প গুজব করে কাজ করে। এত কাজ করছে তাতে তাদের কোনো ক্লান্তি নেই যেন। আর দুইদিন পরেই শুরু হবে বিথীর বিয়ের আয়োজন। প্রথমে গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউ ভাত সবকিছু নিয়েই আলাপ হচ্ছিল সবার মাঝে। তবে মেহের খেয়াল করলো আজ সারাদিন আয়াতকে একবারের জন্যও বাড়ির ধারে কাছে দেখা গেলো না। বিহান দুপুরের দিকে এসে খেয়ে গেছে কিন্তু আয়াত আসে নি৷ দুপুর গড়িয়ে রাত হয়ে এলো আয়াত এখনো ঘরে ফিরে নি। মেহের চিন্তা করলেও কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি৷ কারণ সে জানে তার মা বা চাচীকে জিজ্ঞেস করলেই তারা আবার আকাশ পাতাল চিন্তা করে খুশি হয়ে উঠবেন। এই বুঝি মেহের আয়াতকে মেনে নিয়েছে৷ তাই মেহের আর যেচে কিছুই জানতে চায় নি। রাতে মাহিকে খাইয়ে নিজেও রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসে শুয়ে পরলো। বিথী আসলো তার কিছু সময় পর৷ মাহি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পরেছে৷ বিথী আস্তে আস্তে কথা বলায় ব্যস্ত। মেহের সেদিকে কান দিল না। কারো ব্যক্তিগত জীবনে সে একদম হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তাদের ব্যক্তিগত কথা তারা নিজেরাই বলুক সে এগুলোতে কান দিতে চায় না। রাত তখন ১২টা বাজতে চললো মেহেরের চোখে আজ ঘুম নেই। আসলে সে আয়াতের জন্য চিন্তা করছে।
“আয়াত বাড়িতে এসেছে নাকি আসেনি কে জানে? ভালো লাগছে না কিছু, কই গেলো আয়াত? সারাদিন তার দেখা নেই ভালো আছে তো সে?”
এত ভাবনার মাঝেই বিথীর ডাকে তার দিকে তাকালো মেহের৷
“কি হয়েছে আপু? তুমি এখনো ঘুমাও নি যে কিছু কি হয়েছে তোমার?”
” না সেরকম কিছুই না ঘুম আসছিল না আমার তাই জেগে আছি৷ তুমি ঘুমিয়ে পর আমিও ঘুমিয়ে যাব এখন।”
বিথীর কথা শেষ তাই সে বালিশের কাছে মোবাইল রেখে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো৷ মেহের মোবাইল চেক করে দেখলো রাত ১টা বাজতে চললো। হঠাৎ মেহেরের ফোনে একটা মেসেজ আসলো।

চলবে,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_১৯
#Writer_Fatema_Khan

বিথীর কথা শেষ তাই সে বালিশের কাছে মোবাইল রেখে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো৷ মেহের মোবাইল চেক করে দেখলো রাত ১টা বাজতে চললো। হঠাৎ মেহেরের ফোনে একটা মেসেজ আসলো। হঠাৎ মোবাইলে এত রাতে মেসেজ আসাতে মেহের চমকে উঠে। উপরে আয়াতের নাম উঠে আছে৷ কি আছে মেসেজে লেখা দেখার জন্য মেহের নামের উপর ক্লিক করার আগেই আয়াতের কল আসে মেহেরের ফোনে৷ এত রাতে আয়াতের কল দেখে মেহের বিছানা থেকে উঠে বসে। বিথীর দিকে এক নজর তাকায়৷ না সে ঘুমাচ্ছে৷ কলটা রিসিভ করে মেহের। মেহের হ্যালো বলার আগেই ওই পাশ থেকে আয়াত বলে উঠলো,
“সারাদিন তোমায় একবারের জন্যও চোখের দেখা দেখি নি। একবার বাইরে আসবে?”
মেহের যেনো আশ্চর্যের শেষ সীমানায়। কি বলে এই ছেলে! একটা দম নিয়ে মেহের বললো,
“এত রাতে আসা সম্ভব না। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
“মানা করো না প্লিজ, আমি পুকুর ঘাটের কাছে অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি এসো।”
বলেই কল কেটে দিল আয়াত৷ মেহের আবার হ্যালো বলতেই বুঝতে পারলো আয়াত লাইন কেটে দিয়েছে৷ মেহের চিন্তায় বিভোর।
“এত রাতে কি যাওয়া ঠিক হবে, কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ ভাববে আমাদের। কিন্তু আয়াত যে অপেক্ষা করছে৷ এখন কি করব আমি? কিছুই ভালো লাগছে না। তবে এত রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। কেউ উঠবে বলে মনে হয় না। আয়াত কি বলতে চায় সেই কথা কিছুক্ষণ শুনেই চলে আসব।”
যেই ভাবনা সেই কাজ৷ আরেকবার বিথীর দিকে তাকিয়ে মাহির গাছে কাঁথা টেনে দিয়ে দিল। খাটের উপর রাখা ওড়না মাথায় আর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে বের হলো মেহের৷ বাড়ির সদর দরজা খোলা তবে চাপিয়ে দেওয়া। টিনের ঘর হলেও ভেতরেই টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। তাই কেউ উঠলেও বাইরে বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই মেহের ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দরজার খিল লাগিয়ে দিল। আস্তে আস্তে পুকুর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলেও বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে তার৷ তবে তা অবশ্যই ভয়ে। কারণ কেউ দেখে না নেয় সেই ভয় গ্রাস করে আছে মেহেরকে। কারণ এর আগেও অনেকবার রাত করে আয়াত আর মেহেরের কথা হয়েছে৷ কিন্তু আয়াত এমন পাগলামি কেন করছে তা মেহেরের মাথায় আসছে না। পুকুরের কাছে এসে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পায় মেহের৷ অবয়ব টা যে আয়াতের তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না মেহেরের। এগিয়ে গিয়ে আয়াতের পাশে দাঁড়ায়। আয়াত পাশে কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে পাশে তাকায়। মেহেরকে নিজের পাশে দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে আবার পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। দুইজনেই কিছুক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করে। নিরবতা ভেঙে মেহের বলে, “কিছু কি বলবেন? এত রাতে ডাকার কোনো মানেই হয় না। কেউ দেখে ফেললে খুব খারাপ ভাববে আমাদের। আর এটা শহর নয় যে এত রাতে দুইটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে দেখা করা যাবে। তাও আবার বাইরে। এতটা ছেলেমানুষী ঠিক নয়।”
আয়াত আবার মেহেরের দিকে তাকালো। মেহেরের এক হাত আরেক হাতের ভাজে ছিল। হাতের দিকে তাকিয়ে আয়াত মেহেরের হাত ধরে নিচে নামাতে লাগলো।
“আয়াত আপনি পাগল হলেন নাকি, নিচে নামছেন কেন? আমার কিন্তু ভয় করছে।”
“এই মেয়ে তুমি কি ভূতে ভয় পাও নাকি! এমন বাঘিনী রূপ নিয়ে সারাদিন ঘুরো মনে তো হয় দুনিয়ার সব বোঝা তোমার মাথার উপর। সব টেনশন তোমার একার। আর এখন কিনা ভয় করছে। তা ভয় কি ভূতকে করছে নাকি আমাকে?”
মেহের আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ আয়াতের সাথে নিচে নেমে এলো। পুকুর ঘাটের নিচে এসে আয়াত পুকুরে পা ভিজিয়ে বসে পরলো। সাথে মেহেরকেও বসালো। তবে মেহের পা উপরেই রেখে দিল। এত রাতে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আড্ডা দেওয়ার মতো মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না তার। সে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে কেউ না জেগে যায়। আয়াত মেহেরের অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলে,
“ভয় নেই এত রাতে কেউ আসবে না।”
“কিভাবে ভয় না পাই কেউ উঠে গেলে মা বাবা চাচা চাচীর মান সম্মান কিছুই থাকবে না।”
আয়াত মেহেরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“কেউ আসবে না সত্যি।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আয়াত আবার বললো,
“আজ পরিবেশটা কত সুন্দর না! আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে সাথে আকাশ ভরা তার৷ থালার ন্যায় গোল চাঁদটা পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে কি দারুণ লাগছে৷ এমন একটা রাত কবে থেকে পার করার ইচ্ছে ছিল মনের মানুষের সাথে। সারারাত তার হাতে হাত রেখে দুজন মনের সব কথা বলব। ক্লান্ত হয়ে সে আমার কাধে মাথা রেখে চাঁদ দেখায় ব্যস্ত থাকবে। তার মনের সকল অনুভূতি সে আমার সামনে তুলে ধরবে, আমার মনের যত কথা আমি তাকে বলব৷”
“সারাদিন কোথায় ছিলেন?”
আয়াত মেহেরের অনেকটা কাছে এসে,
“কেন, মিস করছিলে বুঝি?”
“না মিস করতে যাব কেন? সারাদিন বাড়িতে দেখি নি তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনার ভালো না লাগলে আর কখনোই জিজ্ঞেস করব না।”
“বিহানের সাথে ছিলাম। ওর অফিসে। ওর বিজনেস সম্পর্কে বললো অনেক কিছু। ওর সাথেই কাটিয়েছি মূলত সারাদিন। তারপর তো আর যাওয়া হবে না বিথীর বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।”
“ওহ। কিন্তু বিহান ভাই তো দুপুরে খেতে এসেছিল আপনি তো আসেন নি।”
হাসলো আয়াত। মেহের আয়াতের হাসি দেখে মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলো।
“এত কেন প্রশ্ন করিস কে জানে?”
“সকালে তোমাকে কাপড় আনতে বলেছিলাম আনিকাকে দিয়ে কেন পাঠালে? আমার এতটুকু কাজ কি তুমি করতে পারতে না?”
“আনিকা নিজেই বললো সে নিয়ে দিয়ে আসবে, তাই আর আমি যাই নি।”
“আমিতো ভেবেছি তুমি আসবে। তোমার জায়গায় আনিকাকে দেখে সকাল থেকে যে ফ্রেশনেস টা ছিল সেটাও দূর হয়ে গেছে। তাই নিজের মন ঠিক করার জন্য সাঁতার কাটি অনেকক্ষণ। তবে কাসফি আর কনিকার জন্য অবশেষে তুমি আসলে।”
হালকা শীতল হাওয়া বইছে। বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি। মেহেরের মনটা এখন অনেকটাই হালকা৷ ভয় কিছুটা কমেছে৷ মনে হচ্ছে কেউ এত রাতে আসবে না। নিজেকে ফুরফুরে লাগছে৷ মৃদু বাতাসে মেহেরের মাথার ওড়না কিছুটা সরে গেছে। সামনের ছোট ছোট চুলগুলো চোখে মুখের সামনে চলে আসছে। মেহের সেগুলো সরানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ করছে না৷ আনমনেই নিজের দুই পা পানিতে ভিজিয়ে নিল৷ ঠান্ডা পানি পায়ে লাগতেই হালকা কেঁপে উঠে মেহের।
“ইস কি ঠান্ডা পানি! কিভাবে পা রেখেছেন এতক্ষণ?”
“ভালো লাগছে আমার। তোমার ঠান্ডা লাগলে তুমি ভিজিও না। পরে জ্বর এসে যাবে।”
“না আমারও ভালো লাগছে।”
মেহের পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি নিয়ে আছে। আয়াত তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মেহের আয়াতের দিকে তাকালে দুই জনের চোখাচোখি হয়ে যায়৷ মেহের তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়৷ আয়াত নিজের হাত এগিয়ে নিয়ে মেহেরের মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে কানের পিছে গুজে দেয়।
“তোমার চুল বরাবরের মতোই আমাকে বিরক্ত করে৷ আমার সাথে তোমার চুলের কি শত্রুতা বলবে একটু? আমিতো ভেবেই কুল পাই না তোমার সাথে সাথে তোমার এই চুলও আমার থেকে তোমাকে লুকিয়ে রাখে৷ মন ভরে একটু দেখতেও দেয় না। এমনিতে তো দেখার সুযোগ পাই না আমি। না এখানে না শহরে। এখন নিজে একটু সুযোগ করে নিয়েছি সেটাতেও এই চুলের যন্ত্রণা।”
“আমাদের ঘরে যাওয়া উচিত অনেক রাত হয়ে গেছে।”
“আরেকটু থাক না আমার সাথে। তোমার কি আমার কাছে থাকতে ভালো লাগে না? আমার তো মন ই ভরে না।”

চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২০
#Writer_Fatema_Khan

“ভালোবাসি!”
মেহের তাকিয়ে ছিল আয়াতের মুখপানে। তার দিকে চেয়েই বললো,
“ভালোবাসি বলা যতটা সহজ, শেষ অবদি টিকিয়ে রাখা ততই কঠিন। নতুন কারো আগমনে সহজেই বদলে যায়।”
“আমার ভালোবাসা বছরের কোনো ঋতু নয় যে তা দুই মাস অন্তর অন্তর ঝতু বদলে যাওয়ার মতোই বদলে যাবে। মন থেকে ভালোবাসা সহজে শেষ হবার নয়। আর আমার ভালোবাসা যখন এত বছর এতটা দূরে থেকেও কোনো যোগাযোগ না রেখেও টিকে আছে তাহলে তা সহজে বদলে যাবে এটা ভাবাও ভুল।”
“হুহ! এসব কথার কথা। এসবে এখন আর বিশ্বাস হয় না।”
“একটা গল্প শুনবে, বেশি না ছোট্ট একটা গল্প।”
“শুনতে আপত্তি নেই।”
আয়াত মৃদু হাসলো।
“মাধ্যমিক পাশ করে সবেমাত্র কলেজে পা দিয়েছিল ছেলেটি। কিশোর থেকে যৌবনের দিকে পা বাড়ানো ছেলেটির আশেপাশে মেয়ের কমতি ছিল না। সহজেই যে কাউকে মন দেওয়া যেত। তবে তার মন আটকে গেছিলো এক গম্ভীর মেয়েকে হঠাৎ করে এতটা চঞ্চলা হয়ে উঠতে দেখে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। সাধারণ সকল কলেজ ভার্সিটিতেই এই দিনটি উদযাপন করা হয়। তবে ছেলেটির এসবে আগ্রহ বরাবরই কম ছিল। তাই সে কলেজ যায় নি। ছাদে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ চারপাশে বাতাস শুরু হলো। এ যেনো ঝড়ের আগমন। কিন্তু এই ঝড় যে ছেলেটির জীবনেও ঝড় বয়ে আনবে কে জানত। আজ পহেলা বৈশাখ, আর এই দিনে বৃষ্টি হবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু এই বৃষ্টি তার বুকে ঝড় তুলে আনবে সে যদি জানত তাহলে তৎক্ষণাৎ ছাদ থেকে নিচে চলে আসত! সিড়িতে নজর দিতেই চোখ যায় দ্রুত ছুটে আসা এক তরুণীর দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে এক তরুণী সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে। গায়ে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, হাতে লাল কাচের চুড়ি আর মাথায় লাল আর সাদা ফুলের গাজরা। তরুণীটি একবার যেনো তাকালো তার দিকে, কাজল মাখা চোখ দুটি বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেপ্টে গেছে। আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটি৷ কারণ খোলা লম্বা লতানো চুলগুলো রমনীর সৌন্দর্য ঢাকতে ব্যস্ত। যা ছেলেটিকে খুবই বিরক্ত করতে সক্ষম। কিন্তু সেই রমনীকে না দেখেই ছেলেটি বলতে পারে এই তরুণী তার স্বপ্নে আসা সেই প্রেয়সী। এই বৃষ্টিতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও যেনো তার কথা ভালো করে বুঝা যাবে না, কিন্তু ছাদে থাকা রমনীর নুপুরের শব্দ যেন তার বুকে গিয়ে লাগছে৷ দু’মিনিটের জন্য চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় ছেলেটি।
“মেহের কাপড় নিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে আয়, তুই তো পুরাই ভিজে যাবি রে মা।”
কারো ডাকে হুশ আসে ছেলেটার। চোখ খুলে সামনে তাকায় সে। ছেলেটা যেনো সবকিছু গুলিয়ে ফেলে এ কি ভাবছিল সে! এ তো তারই বড় চাচার মেয়ে মেহের। যে কিনা এবার অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে। সে তো তার ভার্সিটির অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, তাহলে কি বাসায় এসেই ছাদে এসেছে? তার ব্যাপারে এসব কি করে ভাবতে পারে! অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় ছেলেটা। এক মুহূর্তের জন্য আর ছাদে অবস্থান না করে ছেলেটা নিচে চলে যায়।”
“তারপর।”
“ছেলেটার রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য তো ওই কয়েক মিনিটই যথেষ্ট ছিল। রাতে খেতে গিয়েও ছেলেটা মেয়ের দিকে তাকাতে পারে নি। তবে কয়েকবার আড় চোখে দেখেছে। মেয়েটা আজ বড্ড খুশি খুশি। যে মেয়েটা এতটা গম্ভীর থাকে সেই মেয়েটা এতটা খুশি খুশি লাগছে ব্যাপারটাই ভালো লাগার মতো। তবুও ছেলেটা কোনমতে খেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো৷ ছেলেটার আর রাতে ঘুম হলো না। জানো তো মেহের তরুণীটি তুমিই ছিলে আর ছেলেটা আমি৷ ওইদিনই প্রথম আমি তোমার প্রেমে পরেছিলাম। জানিনা কি করে, কি ভাবে! কিন্তু ওই এক মুহূর্তেই আমি প্রেমে পরেছিলাম। জানি না তুমি কখনো বুঝবে কিনা আমার ভালোবাসা তোমার জন্য ঠিক কতটা সত্যি, কিন্তু আমি ভালোবেসেই যাব তোমাকে। তোমাকে কখনো নিজের করে পাব সেটা এখন ভাবি না, তবে দেশে আসার পর ভেবেছি তোমাকে পাবার একটা সুযোগ তো আমার পাওয়ার দরকার তাই না। সেই প্রচেষ্টায় আছি, আর শেষ পর্যন্ত থাকব। তবে তোমার বিচ্ছেদের কথা শোনার পর কষ্ট লেগেছে। ওই সময় ভেবেছি ছুটে আসি তোমার কাছে, তোমার সব কষ্ট আমার হোক, তুমি সুখে থাক। কিন্তু আমি পারি নি ছুটে আসতে তোমার কাছে, আমি যে বাধা ছিলাম। কি বলব তোমাকে ভালোবাসি। আমি যে ভীষণ ভয় পাই তোমাকে হারিয়ে না ফেলি। সেজন্য সাহস হয় নি কখনো। তবে এখন আর ভয় করে না।”
“কেনো?”
“আমার মনে হয় শেষটা বোধহয় আমারই জিত হবে।”
“আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, তবে এতটাও না।”
“সেসব জানি না, কিন্তু এতটুকু জানি আমি আশেপাশে থাকলে সেই তরুণীর চোখে মুখে আমি আবার সেই আগের চঞ্চলতা দেখতে পাই। সে আমাকে দেখে লজ্জা পায়। যেটা আগে কখনোই ছিল না। তাই এতটুকু আত্মবিশ্বাস জোগাড় করে নিয়েছি নিজের ভেতর।”
মেহের চুপ করে পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা মুখে নেই। আয়াত মেহেরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“সত্যি ভালোবাসি, নিজের থেকেও বেশি। তুমি আমার জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। যা ভুলার নয়। তুমি না হও আমার তবুও ভালোবাসা রয়ে যাবে আজীবন। তোমার এই হাতে হাত রেখে সমুদ্র দেখা বাকি আছে, পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় বসে প্রকৃতি দেখা বাকি আছে, মেঘের আনাগোনা দেখা বাকি আছে। সব হবে একদিন দেখে নিও।”
“আমি আসি আয়াত মাহি ঘরে বিথীর সাথে একা আছে। ও উঠে গেলে বিথীও জেগে যাবে আর জেনে যাবে আমি ঘরে নেই। আর সবাই জেনে যাবে আমি আপনার সাথেই আছি।”
“কেনো আমার সাথে তোমার বুঝি নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না?”
“আমি এমনটা কখন বললাম আয়াত? আমিতো কেউ দেখলে আমাদের দুইজনকেই খারাপ ভাববে সাথে আমাদের পরিবারকেও দুই কথা বলতে পিছ পা হবে না। ভুলে যাবেন না এটা একটা গ্রাম। এখানে সন্ধ্যার পর একটা ছেলে আর মেয়ে একা দেখা করাও দৃষ্টিকটু দেখায়।”
“আচ্ছা যাও।”
মেহের উঠে গেলো। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে আয়াতের ডাকে আবার থেমে গেলো।
“মেহের।”
মেহের পিছনে ফিরে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত পানি থেকে পা উঠিয়ে জুতা পরে উপরে উঠতে লাগলো৷ মেহেরের বরাবর এসে দাড়ালো৷ মেহের প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে আয়াতের দিকে।
“কিছু বলবেন?”
আয়াত কোনো কথা না বলে আচমকাই মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো। মেহের এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মেহেরের যেনো শ্বাস রোধ হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠেছে৷
“ভোরের স্নিগ্ধতা ফুরিয়ে তা তোমার মুখশ্রীতে এসে ভর করেছিল, তা যদি তুমি জানতে তাহলে ভোরে আমার সামনে এমন অগোছালো হয়ে আসতে না। রাতের জোৎস্না তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে তোমাকে দেখে। কারণ তা যে তোমার সৌন্দর্য দেখে লজ্জা পেয়েছে। জোৎস্না দেখতে এসে তোমাকেই দেখে রাত কেটে গেলো। যাও ঘরে যাও আর কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান দিবে, গ্রামের সবাই ঘুম থেকে উঠে যাবে। এর আগেই ঘরে চলে যাও। আমি চাই না আমার সাথে তোমাকে একা দেখে খারাপ ভাবুক। তবে এমন একটা দিন আসবে যেদিন তুমি আমার সাথে এক ঘরে থাকলেও কেউ খারাপ বলার সাহস পাবে না। সেদিন বেশি দূরে নয়, তা খুব শীঘ্রই আমাদের জীবনে আসবে।”
আয়াত মেহেরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। মেহেরের যেনো শ্বাস ফিরে এলো। আরেকটু হলেই শ্বাসকষ্টে মারা যেত। কোনোদিকে না তাকিয়ে মেহের এক ছুটে ঘরের দিকে চলে গেলো। দরজার কাছে এসে মেহের আরেকবার পুকুর পাড়ের দিকে তাকালো৷ এক হাত পকেটে গুজে মেহেরের দিকেই তাকিয়ে আছে আয়াত। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে নিজের ঘরে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিল মেহের। মেহের ঘরে ঢুকার কিছু মুহূর্ত পরেই আয়াত ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো৷ আজানের শব্দে বিথীর ঘুম ভেঙে গেলো। মেহেরকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বিথী বললো,
“কি হলো আপু এভাবে বসে আছো কেনো, নামাজ পড়বে বুঝি?”
মেহের হঠাৎ বিথীর কথা শুনে ভড়কে যায়। তবে কি বিথী কি তাকে দেখে নিয়েছে এই ভয়ে। পর মুহূর্তে বিথীর ঘুম জড়ানো চোখ মুখ দেখে বুঝলো মাত্রই ঘুম ভেঙেছে তার। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
“হুম নামাজ পড়ব, তুমি পড়বে না উঠে পর।”
“উঠছি আপু। জানো আজ না আমার কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।”
“কেনো?”
“আজ আমার গায়ে হলুদ। এক রাতের ব্যবধানে আমি কাঙ্খিত মানুষটির আপন হয়ে যাব আবার একটা রাতের ব্যবধানে আমি আমার পরিবার ছেড়ে চলে যাব।”
“টেনশন নিও না সব মেয়ের জীবনেই এমন একটা দিন আসে। আর সবাইকে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য একটা পরিবারকে আপন করে নিতে হয়।”
“আচ্ছা আপু তুমি কি নিজের জীবনটাকে আবার গুছিয়ে নিতে পারো না? নিশ্চয় তোমার জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোমার সকল দুঃখ ভুলতে সাহায্য করবে।”
মেহের বিথীর কথা শুনে রাতে বলা আয়াতের প্রতিটি কথা কানে বাজতে লাগলো।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here