#দূর_আলাপন
পর্ব-৭
অদ্রিজা আহসান
_______________
সেদিন অপরাহ্নে আকাশে ভীষণ মেঘ করে হঠাৎ শুরু হওয়া শ্রাবণের সেই ধারা বর্ষন চলল অবিরত দু’দিন। এই ঘোর বর্ষার মাঝেই মারুফ সাহেব নিনাদকে বললেন শিউলি ফুআম্মা ও আফরিনকে নিয়ে আসতে। নিনাদ দুঃখ প্রকাশ করে জানাল এ সপ্তাহের শেষে তার ভিসা ইন্টারভিউ। কিছুটা পড়াশোনা আর প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে। তাই চাইলেও আসতে পারছে না সে। শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন শহরে নতুন। নিনাদ না এলে তাদের আসার প্রশ্নই ওঠে না।
মারুফ সাহেব দাওয়াতের দিন পেছালেন অবশেষে। আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার অর্থাৎ নিনাদ আমেরিকা যাওয়ার ঠিক পনেরো দিন আগে তিনি আসতে বললেন তাদেরকে। তিহা আর ছোটন ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। রওশানও আসবে সেদিন। তাদের মা-ছেলেতে খুশি যেন আর ধরে না।
কিন্তু দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল সবার আগ্রহ ফুরিয়ে আসতে লাগল তত। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর চলে যাবে নিনাদ। এরপর দীর্ঘ এক বছরের জন্য বিচ্ছেদ ও অপেক্ষা। এই এক বছর সময়টা যেন সামান্য ক’টা দিন হয়েও বড় বেশি মনে হতে লাগল সকলের কাছে। বহু আগে থেকেই এক বছরের সমস্ত রসদ জোগারজন্তের ব্যাপার তিহা নিয়মিত তাড়া দিতে লাগল নিনাদ কে। রওশানও খানিক পর পর কল করে এই-সেই উপদেশ দিতে লাগল। কিভাবে চলতে হবে, কোনটা করা যাবে, কোনটা করা যাবে না সেসব নিয়ে জ্ঞান দিতে লাগল দিনরাত।
রাতদিন নিনাদকে নিয়ে তিহা, রওশানের এই ক্রমাগত আদিখ্যেতা দেখে বিরক্তিতে তিতিক্ষার গা জ্বলতে থাকে।
-‘বিদেশ তো যাচ্ছে না, যেন রকেটে চড়ে মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে এলিয়েন খুঁজতে। ন্যাকামি দেখে মাথা ধরে গেল আমার। অসহ্য!’ সেসব দেখে মুখ ভেঙচিয়ে একথাই বলে তিতিক্ষা।
________________
-‘তিতিক্ষা, একবার এদিকে আয় জলদি।’
ড্রয়িংরুমের ফুলদানিতে জারভেরা ফুলগুলো রেখে তিতিক্ষা দ্রুত পায়ে বুবুর কাছে এল।
‘উঠোনের কোণের লেবু গাছটা থেকে লেবু পাতা ছিড়ে নিয়ে আয় দুটো। ‘
বোনের কথা শেষ হওয়া মাত্রই আজ্ঞা পালনে আবার সে ছুটল বাইরেই পানে। পেছন থেকে তিহা চেচিয়ে বলল,’দেখিস, সাবধানে যাস। পা পিছলে পরিস না যেন। বৃষ্টি পড়ে উঠোনের মাটি স্যাতঁস্যাঁতে হয়ে আছে ভীষণ। ‘ সেকথা তিতিক্ষার কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা বোঝা গেল না। সে উড়ে চলে গেল ।
কথা শেষ করে তিহা রান্নায় মন দিল। সকালে সে এসে ঢুকেছিল রান্নাঘরে। তারপর আর একবারও এখান থেকে বেরোনোর সুযোগ হয়নি। নিনাদ আসবে, তৃপ্তি করে একটু খাবে, তাতেই তার প্রাণ জুরাবে। কেউ না জানুক, সে জানে। নিনাদকে সে কতটা ভালোভাসে। কোনদিন নিজের আপন ছোট ভাই ছাড়া আর কিছু ভাবেনি নিনাদকে। নিনাদের খুশি তাই সবার আগে। সেটুকু হলে তার আর কি চাই !
হঠাৎ অস্ফুট একটা চিৎকারে তিহার ভাবনা ছুটে গেল। বাইরে থেকেই আসছে আওয়াজ টা। খানিকক্ষণ আগে তিতিক্ষাই না গেল সেদিকে!
তিহা বাইরে এসে দেখল তিতিক্ষা মাঝ উঠোনে বসে আছে একহাত বা-পায়ে চেপে ধরে। ব্যাথায় তার মুখ ফ্যাকাসে সাদা বর্ণ দেখাচ্ছে। তিহা কাছে এসে ভীত স্বরে বলল, ‘কি হল তোর? এভাবে বসে আছিস কেন?’
তিতিক্ষা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘পা মচকে গেছে।’
-‘হায় আল্লাহ! কিভাবে? এত করে বললাম বাইরে কাঁদা মাটি। সাবধানে হাঁটতে…। এখন আমি কি করি! আব্বাও তো বাড়ি নেই। ‘
তিহা বোনের কাছে বসে পড়ল,’বেশি মচকে গেছে?’
-‘জানি না, কিন্তু…. ‘
-‘খুব ব্যাথা করছে?’
তিতিক্ষা ফোপাঁতে ফোপাঁতে ওপর নিচ মাথা নাড়লো।
-‘আমার সাথে উঠে ঘরে যেতে পারবি না? একটু চেষ্টা করে দেখ।’
অনেকক্ষণের চেষ্টায় বোনের সাহায্য নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে তিতিক্ষা ঘরে এল। পায়ে বরফ লাগিয়ে, তিহা অস্থির হয়ে বারবার কল করতে লাগল মারুফ সাহেব কে। রান্না করতে এসে কিছু জিনিস নেই দেখে সে নিজেই বাজারে পাঠিয়েছিল বাবাকে। এখনো ফেরার নাম নেই। ফোনকলও রিসিভ করলেন না তিনি। তিহা ভীষণ অস্থির হয়ে এবার তার স্বভাবমত একটা কাজ করে বসল। বিপদে পড়লেই যা সে সবসময় করে। বাবাকে ফোনে না পেয়ে সে কল করল নিনাদকে।
নিনাদ ধানমন্ডিতে এসেছিল ছাত্র পড়াতে। তাকে পরিস্থিতি জানিয়ে দ্রুত ডাক্তার নিয়ে আসতে বলল তিহা। আধঘন্টা পর একটি ছেলেকে সাথে নিয়ে চিন্তিত মুখে নিনাদ এসে হাজির হল। তিহা দরজা খুলতেই শুষ্ক কণ্ঠে তাকে জিগ্যেস করল,’পা বেশি মচকে গেছে নাকি?’
পাশের ছেলেটিকে দেখে তিহার ততক্ষণে মেজাজ বিগড়ে গেছে। ভীষণ ফর্সা, লম্বা মত, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া ছেলেটি নিতান্তই বাচ্চা। এই বাচ্চা ছেলে কি চিকিৎসা করবে তার বোনের!
নিনাদকে ভেতরে টেনে এনে তিহা বিরক্তি মেশানো স্বরে ফিসফিস করে বলল,’কোথ থেকে এই বাচ্চা ছেলেকে ধরে এনেছিস তুই? এ করবে চিকিৎসা? ‘
নিনাদ রাগী স্বরে উত্তর করল,’তোর ‘কোলের আবু’ বোনের চিকিৎসার জন্য তো শহরের সব ডাক্তার লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে না? আমি যাব আর ধরে ধরে নিয়ে চলে আসব!
এ আমার পরিচিত ছোট ভাই। এদিকেই থাকে, ইন্টার্ন ডাক্তার। এঁকে নিয়ে গিয়ে দেখালে দেখা, নইলে বিদাই করে দেই।’
তিহার গলায় স্বর কোমল হল একটু । ‘আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ দেখাচ্ছিস কেন! ওকে নিয়ে আয় ভেতরে। কিন্তু তিতিক্ষা কে তো জানিস, সব বিষয়ে কেমন গোঁড়ামি ওর। ডাক্তার দেখে এখন আবার কি বলে কে জানে!’
ডাক্তার আসছে শুনে তিতিক্ষা হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। ছেলে বেলা থেকেই ডাক্তারে তার ভীষণ ভয়। কান্নার শব্দ শুনে তিহা দৌড়ে এল ঘরে। নিনাদও আসছিল পেছনে। তিতিক্ষা রাগে, যন্ত্রণায় ফোসফাস করতে করতে বলল,’ডাক্তার ছাড়া আর কেউ যেন না আসে ঘরে। ‘
সেই ছেলেটিকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে নিনাদ তাই বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
চিকিৎসা করতে এসে সেই তরুণ ডাক্তার ছেলেটি দেখল রোগীর গোঁড়ামি সত্যিই আকাশচুম্বী!
অযথাই সে ফ্যাচফ্যাচ করছে ভীষণ। অবস্থা দেখে সে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে দিয়ে, আগামী তিনদিন বেড রেস্টে থাকতে বলে নিজের পথ দেখল তাড়াতাড়ি।
ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে এসে নিনাদ ফ্যাকাসে মুখে বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তিহার হঠাৎ সেদিক খেয়াল হতেই ছুটে গেল নিনাদের কাছে। ইতস্তত করে বলল,’ তুই কি রাগ করেছিস তিতিক্ষার কথায়? জানিসই তো ও এমন। ঘাড় তেড়া। তুইও এসব কথা ধরলে কি চলে! ‘
নিনাদ সেকথার উত্তর দিল না। গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি এখন যাই।’
তিহা ব্যাস্ত হয়ে বলল-‘আচ্ছা যা, দুপুর তো হয়েই এল। দেরি করিস না আর। ফুআম্মা আর আফরিনকে নিয়ে চলে আসিস তাড়াতাড়ি।’
-‘আজ থাক। এমনিতেই তিতিক্ষার পা মচকে গেছে। একটা বিপদ হল এর মাঝে আবার…… ‘
তিহা একটু অবাক হয়ে চাইল বন্ধুর দিকে। নিনাদকে এই প্রথম সে শুনল তিতিক্ষার নাম ধরে ডাকতে। নাহয় সবসময় সে ছোট গিন্নি বা আর কিছু বলে ডাকে তাকে। সে ব্যাস্ত কণ্ঠে বলল, ‘মাথা খারাপ হয়েছে তোর? তিতিক্ষার পা মচকেছে তো কি হয়েছে? পা মচকানোর সাথে এর কি সম্পর্ক? বেশি কথা না বলে ওদের নিয়ে আয় জলদি। বাবা কত আয়েস করে ফুআম্মাকে দাওয়াত দিয়েছেন…’
নিনাদ চলে গেল। দুপুরে শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন কে নিয়ে এল। তিতিক্ষার অবস্থা দেখে শিউলি ফুআম্মা বারবার আফসোস করতে লাগলেন। আফরিন তো তিতিক্ষার পাশেই বসে রইল তখন থেকে। সেখানে বসে কত কথাই না বলতে লাগল সে। সব কথাই ঘুরে ফিরে নিনাদে এসে থামে। তিতিক্ষা নিরব হয়ে সব শোনে শুধু। কিছুই সে বলে না।
খাবার-দাবার শেষে বিকেলের দিকে বাড়িটা যেন একটু ঝিমিয়ে পড়ল। আফরিন ছোটনকে নিয়ে ছাদে উঠে গেল। মারুফ সাহেব নিজের ঘরে ভাতঘুম দিতে গেলেন। নিনাদও বাইরে গেল। তিহাকে বলে গেল ফিরে আসবে খানিক পরই। শিউলি ফুআম্মা এসে তিতিক্ষার পাশে বসলেন তখন। তিতিক্ষা অসুস্থ, সব কাজ তাই তিহার একার ঘাড়ে। তাছাড়া সন্ধ্যায় রওশান আসবে। তার জন্য গুছিয়ে রাখতে হবে সব খাবার-দাবার। তিহা তাই রান্নাঘরেই ছিল। শিউলি ফুআম্মা তিতিক্ষা কে বললেন, ‘তোমার আপায় গেল কই, একটা কথা ছিল তুমাগো দুই বইনের সাথে। ‘
তিতিক্ষা নম্র ভাবে হেসে বলল,’ আপু তো রান্নাঘরে। আসবে বোধহয় এক্ষুনি। ‘
শিউলি ফুআম্মা কিছু অস্থির হয়ে বললেন,’ এহন কেউ নাই। কথাটা বলার সুযোগ আছিল। তোমার আপায় তো দেরি করতাসে। আপ্পিনি না আবার নাইমা আসে ছাদ থাইকা।’
তারপর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন তিনি। তিহা তখনো আসল না দেখে এবার বললেন, ‘আইচ্ছা, থাউক। আগে তুমারেই কই। পরে যদি আর সুযোগ না পাই। তখন তুমিই কইয়ো তুমার আপারে বুঝায়া। কেমন? ‘
তিতিক্ষা মাথা নেড়ে ইতস্তত হাসল। শিউলি ফুআম্মা নিচু স্বরে বলতে শুরু করলেন,’তুমরার দুই বইনেরে তো নিনাদ খুব মানে। তাই তুমরার কাছেই দুঃখের কথা কই বুঝলা।
পোলাডা বিদেশ যাইতাসে। বিদেশের বাতাস গায়ে লাগলে পুলাপানের স্বভাব বিগড়ায়া যায়। তাই পোলাডারে না করছিলাম দূর দেশে যাইতে। কিন্তু কথা শুনল না। তাই ভাবছি বিদেশ যাওনের আগেই ওর বিয়াডা দিমু। একবার শিকল দিয়া শক্ত কইরা বানতে পারলে আর সহজে ছুটত না। বুঝলা না?
তাই আপ্পিনিরেও আনলাম সাথে। আমি ছাড়া তো তার আর কোনো কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ নাই তারার । তাই ভাবছিলাম এইহানেই ওগো বিয়াডা দিয়া দিমু।
আজকালকার পুলাপানের কি যে স্বভাব। পোলার মনে যে কি চলে, বুঝা মুশকিল। খালি গাইগুই করে। বিয়ার কথা কিছু কইলেই খালি হাসে।
এহন তুমরাই আমার ভরসা। তুমরার সব কথাই হে শুনে। তুমরা ওরে বুঝায়া রাজি করাও। আমার এই উপকার টা তুমরা করো।’
তিতিক্ষা কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বসে রইল। শিউলি ফুআম্মার গুরুত্বপূর্ণ কথা তাকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে।
সে কিছু বলছে না দেখে তিনি আবার বললেন,’কি কউ মায়া, করবা তো তুমরা আমার এই উপকার টা?’
তিতিক্ষা সম্বিত ফিরে পেয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি আপুকে বলব নিনাদ ভাইকে বোঝাতে। আপুর কথা উনি ফেলতে পারবেন না। বিদেশ যাওয়ার আগেই বিয়েতে মত দেবেন।’
শিউলি ফুআম্মা প্রসন্ন মুখে হাসলেন। তিতিক্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি বড় ভালা মাইয়া গো।’
চলবে…….।