দেশলাই – ২০ পর্ব
দু’জন আবার হাঁটতে শুরু করে। বাঁ পাশে বড় বড় পাথরের খন্ড দেখা যাচ্ছে। গাছগাছালির আড়াল থেকে কানে ভেসে আসছে পাখির সুমধুর কলরব।
গাইড তাদের থেকে খানিকটা দূরে চলে গেছে। পেছনে একদল ছেলে-মেয়ে হৈ-হুল্লোড় করে পানিতে চপচপ শব্দ তুলে এদিকে আসছে।
ইলি নাক টানছে। চোখের পানি মুছছে।
দু’জনেই পিঠের দিকে হাত নিয়ে পেঁচিয়ে ধরে সাবধানে হাঁটছে।
ইলি মাথা তুলে রাফসানের মুখের দিকে তাকায়,
– ‘আমি তো একসময় ভাবতাম তুমি আমাকে পছন্দ করো। তারপর ভুল প্রমাণ করে ইন্তিশার সাথে জড়িয়ে গেলে। এখন আবার আমার কাছে মনে হয় তুমি আমাকে পছন্দ করো। সেটাও কি ভুল রাফসান ভাই?’
রাফসান অবাক চোখে তাকায়। দু’টি চোখের মিলন হয়। কোনো জবাব না দিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।
ইলি কোমর থেকে হাত পেটে নিয়ে চিমটি কেটে বলে, ‘কি হলো, চুপচাপ কেন?’
– ‘এমনিতেই।’
ইলি আবার প্রশ্ন করে,
– ‘কোনো পুরুষ না-কি পছন্দ করলে মেয়েরা বুঝতে পারে?’
– ‘হয়তো।’
– ‘আমার কাছে তো মনে হয় তুমি আমাকে পছন্দ করো, তাহলে এতো দ্বিধা কেন?’
রাফসান কোনো জবাব দেয় না। ইলি আবার বলে,
– ‘পছন্দ করলে তোমার যখন বিয়ের কথা চলছিল একবারও ফুপুকে দিয়ে আমাকে আলাপ দিতে পারতে না?’
– ‘আমরা তো জানি তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।’
– ‘আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো প্লিজ।’
– ‘পড়ে যাবো। আর আস্তে কথা বলো। পেছনে মানুষ।’
– ‘আচ্ছা ফিসফিস করে বলছি। সত্যি করে বলো তো তুমি কি অবাক হচ্ছ না আমি আজ হঠাৎ এগুলো বলায়?’
– ‘না।’
– ‘কেন?
– ‘আমি আগে থেকেই জানি তুই আমার ওপর দূর্বল।’
ইলি মাথা তুলে তাকায়, ‘কীভাবে জানো?’
– ‘শুধু মেয়েরা না। যেকোনো মানুষ তার ওপর দূর্বলদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝে ফেলতে পারে। আর তোর সকল পাগলামিতেই গভীর ভালোবাসা, মমতা আমি টের পাই।’
ইলি মাথা খানিকটা ওর দিকে হেলে দিয়ে বলল,
– ‘তাই? তাহলে আমাকে রেখে ইন্তিশার সাথে প্রেম করেছিলে কেন?’
– ‘তখন এতোকিছু বুঝতাম না-কি?’
– ‘এখন বুঝো?’
– ‘হুম।’
– ‘রোবটের মতো শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছ কেন?’
রাফসান হেঁসে ফেললো,
– ‘তাহলে কীভাবে কথা বলবো?’
– ‘মানে কেমন করে যেন কথা বলছো, ভাল্লাগে না।’
– ‘তোর যা ইচ্ছা বল। আমি এখান থেকে যাবার পর যা বলার বলবো, ঠিকাছে?’
– ‘পরে বকবে না-কি আবার?’
– ‘না।’
– ‘তুমি নিজেকে এতো সামলে রাখো কীভাবে? আগে তো পারতে না। এখন এমন কেন?’
– ‘বড়ো হয়েছি না? এখন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ভাবতে হয়।’
– ‘আচ্ছা তুমিই বলো তো। আমার কোনো ভাই-বোন নেই। শুধু মা-বাবা৷ এখন হৃদকে বিয়ে করে ইংল্যান্ড গিয়ে আমার কি হবে? দুনিয়ায় কি টাকাপয়সাই সব? আমি দেশে বিয়ে করলে মা-বাবাকে দেখতে পারতাম, তাই না? প্রয়োজনে পড়ালেখা শেষ করে জব নিতাম। এখন তো মেয়েরা কত কিছুই করছে।’
– ‘তা পারতি। কিন্তু স্বামী সংসারের জন্য ঠিকই মা-বাবাকে দেখবাল করা সহজ হতো না।’
– ‘অবশ্যই হতো, আমি যাকে সব সময় মন থেকে বিয়ে করতে চাইছি তাকে পেলে সবই হতো।’
কথাটি বলতে বলতে ইলির গলা ধরে আসে।
রাফসান কিছু বলতে পারে না। তার বুক শিরশির করে। পা যেন অসাড় হয়ে আসে। ইলির প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, পাগলামিগুলো, এতো যত্ন নেয়া, এতো খেয়াল রাখা, চোখভর্তি ভালোবাসা, তার প্রতি সীমাহীন মায়া। সমস্তকিছু ক’দিন থেকে বুকের ভেতর আলতো করে স্পর্শ করছে। উষ্ণ ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত তাকে গলিয়ে দিচ্ছে। ইলির মতো মেয়েকেও কীভাবে এড়িয়ে চলতে হয় সে পুরোপুরি জানে না। এতো ভালোবাসা কীভাবে অবহেলা করে ঠেলে সরিয়ে হেঁটে চলে যেতে হয় তাও জানে না। এতো ক্ষমতা তার আছে কি-না কে জানে! তবুও তো তার নিজেকে সামলে নিতে হয়। কতটুকু সামলাতে পারে। কতটুকু বা ভবিষ্যতে পারবে তাও জানে না। কিন্তু যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই। সেটায় সজ্ঞানে জড়াতে চায় না সে৷ ইলিও যে এতোদিন নিজেকে বেশ সামলাচ্ছিল সে টের পায়। কিন্তু আজ হঠাৎ ইলির কি হলো? এতো আবেগি হয়ে পড়লো কেন? নানান কথা ভেবে রাফসান আনমনে হাঁটছে। সেটাও ইলি বুঝে ফেলে।
– ‘কি এতো ভাবছো তুমি? সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করতে পারো না?’
– ‘না।’
– ‘কেন? তোমার না সবচেয়ে আপন মানুষ এখন আমি?’
– ‘হুম।’
– ‘তাহলে বলো না। কি ভাবছো এতো।’
‘এদিক দিয়া উঠতে হইব’ তাদের আলাপচারিতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে গাইড আঙুল দিয়ে ছোট্ট পাহাড় দেখিয়ে কথাটি বললো।
– ‘আচ্ছা মামা। আসছি, আপনি উঠেন।’
ইলি বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে পেটে খোঁচা দিয়ে তাড়া দেয়, ‘বলো।’
– ‘পরে বলবো সব। খালার বাড়ির পাশে পাহাড় আছে না? সেখানে একবার বসে গল্প করবো, ঠিকাছে?’
– ‘আচ্ছা।’
দু’জন কয়েক কদম চুপচাপ গেল৷ ইলি আবার বললো, ‘আজ দিনটি আমার জন্য অনেক স্পেশাল।’
রাফসান অবাক চোখে তাকায়, ‘কি বলিস? আমার কাছে লাগছে তোর অনেক কষ্ট হচ্ছে। একটুও উপভোগ করছিস না।’
– ‘তা ঠিক। কিন্তু তোমার কাছ থেকে তো কোনোদিন এতো গুরুত্ব পাইনি। আজ রাগ করায় তুমি অনেকবার রাগ ভাঙাতে চাইলে। হাসাতে চাইলে। নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল।’
– ‘তাই?’
– ‘হুম।’
– ‘তুই জানিস, তোকে মুখভার মানায় না? তোর চঞ্চলতা, বাড়াবাড়ি করা ভালো লাগে।’
– ‘কচু ভালো লাগে তোমার। এসবের জন্য আমাকে তুমি কতভাবে অপমান করেছো তা জানো?’
– ‘কি বলিস। কখন?’
– ‘আমি মুরব্বিয়ানা করি। বুঝদার। বকবক করি। এগুলো তুমি কেন বলো? এই বাড়াবাড়ি আর চঞ্চলতার জন্য।’
রাফসান আরেকটু বুকের সঙ্গে ওর কাঁধ চেপে মুখের দিকে তাকায়, – ‘ইশ, তুই এগুলো এতো খেয়াল করে কষ্ট পাস? আমি তো এমনিতেই বলে ফেলি।’
– ‘হুম, আমিও মাঝে মাঝে বলি। বাট শেষে নিজেই কষ্ট পাই।’
– ‘যেমন, কি বলেছিলি।’
পরে বলছি গাইড দাঁড়িয়ে আছে।
– ‘হুম, এখন পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে।’
পর্যটক উঠার জন্য পাহাড় কেটে কেটে সিঁড়ি বানিয়ে রাখা। ইলি সেদিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,
– ‘আল্লাহ এখন এদিকে উঠতে হবে।’
– ‘হ্যাঁ, পারবি না?’
– ‘পারতে তো হবে।’
পেছনের লোকগুলো তাদের কাছাকাছি চলে এসেছে দেখে রাফসান গাইডকে ডেকে বললো, ‘মামা এরা চলে যাক আগে। আমরা আসছি। আপনি উঠে যান।’
ইলি ভেজা কামিজ একটু ঝেড়েমুছে খোঁপাটাও আবার ভালো করে বেঁধে নেয়।
লোকগুলো গল্প করতে করতে চলে যাবার পর রাফসান আচমকা ইলিকে পাঁজাকোলা করে কোলে নেয়। আঁতকে উঠে সে। ঘটনাটি বুঝতে পেরে নিষেধ করে বললো,
– ‘ছাড়ো তো, এতটা পথ উঠতে পারবে না। কষ্ট হবে তোমার।’
– ‘নড়াচড়া করবি না, পড়ে যাবো।’
রাফসান দুই কদম উপরে উঠে যায়। ইলি বুঝতে পারে আর নিষেধ দিয়ে কাজ হবে না। তাছাড়া তার ভালো লাগছে। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে মুখের দিকে গভীরভাবে তাকায়। রাফসান এক কদম উপরে উঠলেই মৃদু ঝাঁকুনিতে ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ি কপালে লাগে।
– ‘এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমার হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে।’
– ‘আচ্ছা আর তাকাচ্ছি না।’ কথাটি বলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে মুখ ডুবিয়ে দেয় গলায়। এখন হাঁটার ঝাঁকুনিতে নাকে-মুখে দাড়ির খোঁচা লাগছে। ইলি গলাতে নাক-ঠোঁট ঘষে চোখবুঁজে ফেলে। বারংবার মনে মনে প্রার্থনা করে, ‘আল্লাহ পথ যেনো এতো তাড়াতাড়ি শেষ না হয়।’
কিন্তু রাফসানের হাঁপানো কানে লাগায় চোখ মেলে তাকায়। অর্ধেকটা পথ এখনও বাকী।
– ‘নামাও তো রাফসান ভাই।’
– ‘কেন?’
– ‘এতো কেন কেন করো না তো। নামাও বলছি নামাও।’
রাফসান আস্তে করে সামনের সিঁড়িতে দাঁড় করায়।
– ‘ইশ, হাঁপিয়ে গেছো।’
– ‘হাঁপাবো না? খেয়ে খেয়ে শুধু মোটা হয়েছিস।’
– ‘আমি বলছি না-কি কোলে নিতে?’
– ‘সিঁড়ি দেখেই আল্লাহ করে উঠলি তো কি করবো?’
ইলি ফিক করে হাসে।
– ‘আবার হাসছিস, চল যাই।’
ইলি আগেই উপরে উঠে যায়। রাফসান হাঁপাতে হাপাতে এসেছে। ঘামে কপাল চিকচিক করছে। চুল কয়েকটা সামনে এসে পড়েছে। ইলি গাইডকে বললো,
– ‘মামা হাঁটেন আমরা আসছি।’
তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। ওড়নাটা খুলে মুখ মুছে দিতে এগুতেই রাফসান বাঁধা দেয়, – ‘লাগবে না।’
ইলি কাতর গলায় বলে, ‘প্লিজ আজ এতো ফর্মালিটি না। দেই না একটু মুছে।’
রাফসান আর না করতে পারে না। ইলি ওড়নার আঁচল দিয়ে পরম ভালোবাসায় কপাল, মুখ, গলার ঘাম মুছে দিতে দিতে একটা ঘোরের ভেতর চলে যায়। রাফসান মুখে কাঠিন্যের ভান সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে। ইলি আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠে।
রাফসান আঁতকে উঠে। কি করবে ভেবে পায় না।
– ‘কি হলো ইলি?’
ইলি কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নায়। রাফসান পিঠে হাত রাখে, ‘কি হয়েছি ইলি? কেন পাগলামি করছিস?’
ইলি কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়, ‘আমি কি তোমাকে আর পাবো না রাফসান ভাই? কোনোভাবেই কি আর পাওয়ার সুযোগ নেই? আমি তো জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো। তবুও এমন হলো কেন?’
– ‘কিছুই হয়নি ইলি। হৃদকে বিয়ে করলে সুখেই থাকবি। আমার তো নিজেরই টিকে থাকা দায়।’
– ‘আমার হৃদকে বিয়ে করতে ইচ্ছা করে না।’
– ‘তাহলে তখন নিষেধ করতে পারতি।’
– ‘তখন তুমি ইন্তিশার সাথে রিলেশনে ছিলে। তাই মেনেছি।’
– ‘আর আমি যখন বিয়ে করলাম তখনও তো বলতে পারতি। তখন তো কিছুই বলিসনি?’
– ‘তুমি তখন এমন ছিলে না। আমার সাথেও মিশতে না। আমি সাহস পাইনি।’
– ‘এখন কি করে সাহস হলো?’
– ‘জানি না।’
– ‘আচ্ছা এখন ছাড়। কেউ চলে আসবে।’
– ‘তাহলে তুমি একবার নিজ থেকে জড়িয়ে ধরো।’
– ‘কি বলিস এসব?’
– ‘কিচ্ছু হবে না বলছি না? আমি বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে দেবো হৃদকে বিয়ে করবো না, যা হয় হবে।’
রাফসান মুচকি হেঁসে বলে, ‘পাগলামি করসি না ছাড়। কেউ আসবে।’
– ‘আসুক। তুমি হাত নিয়ে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, তাহলে ছেড়ে দেবো।’
রাফসান চারদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পিঠের দিকে হাত নিয়ে ধরে। তার পুরো শরীরে উষ্ণতা ছড়িয়ে যায়। ইলি মাথা তুলে একবার রাফসানের মুখটা দেখে নেয়। আবার গলায় নাক ডুবিয়ে ফুফিয়ে-ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘প্লিজ আমাকে তুমি নির্লজ্জ বেহায়া ভেবো না রাফসান ভাই। আমি কি করবো। সেই ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি। তোমাকে পেলে আর কিচ্ছু চাই না৷ প্লিজ তুমি একটা কিছু করো।’
রাফসান দ্বিধাদ্বন্দে কি করবে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কেবল সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘পরে দেখা যাবে ইলি৷ এতো ভেঙে পরিস না৷ আমি তো আছি। এখন ছাড়।’
ইলি মাথা তুলে তাকায়। আঁজলা করে ওর মুখটা ধরে। তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার আজও কবর গলির সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে রাফসান ভাই। তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক লেগে গেল। আমি আঁচল দিয়ে মুছে দিলাম। তোমার এগুলো কেন মনে নাই বলো তো?’
– ‘ইলি, চল এখন আমরা যাই।’
ইলি নিজের চোখমুখ মুছে নেয়,
– ‘হুম বুঝতে পারছি। তোমার বিরক্ত লাগছে আমার কথাবার্তা।’
– ‘আমি বলছি বিরক্ত লাগছে?’
– ‘বলতে হয় না বুঝা যায়।’
রাফসান লাঠি হাতে নিয়ে বলে, – ‘চল তো যাই।’
খানিকদূরে গিয়ে গাইডকে পায় তারা। পাহাড়ি সুরু পথে হাঁটতে থাকে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে ঝর্ণার পানির গর্জন। তবুও ইলির মন খারাপ। সুরু রাস্তা হওয়ায় দু’জন পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটা যাচ্ছে না। সে পিছু পিছু ম্লান মুখে হাঁটছে।
– ‘আস্তে আস্তে যাও তো রাফসান ভাই। আমাকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছ।’
রাফসান মুচকি হেঁসে ঘুরে তাকায়,
– ‘আচ্ছা তুই সামনে যা। আমি পিছু পিছু আসি।’
– ‘না।
– ‘কেন?’
কান দাও বলি। রাফসান কাছে এসে মাথা নুইয়ে কান পাতে। ইলি ফিসফিস করে বলে, ‘আমি সামনে চলে গেলে তোমাকে দেখা যায় না।’
রাফসান হেঁসে ফেলে। ইলির গালে হাত দিয়ে বলে, ‘তুই কত অসাধারণ মেয়ে জানিস?’
ইলি রসিকতা করে মাথা নাড়িয়ে বলে,
– ‘না।’
– ‘আগেও অবশ্য সুন্দর ছিলি। কিন্তু ইন্ডিয়া থেকে এসে তোকে অন্য রকম সুন্দর দেখলাম।’
ইলি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
– ‘কিন্তু ওইদিন তো বলেছিলে আমি চাকরানীর মতো দেখতে।’
– ‘মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম। সারারাত এর কারণে আমার ঘুম আসেনি।’
– ‘সত্যি?’
– ‘হ্যাঁ, তুই সকালে যাওয়ার পর বুঝলাম রাগ করিসনি।’
ইলি মুখে হাত দিয়ে হেঁসে ফেললো। একটা পাখি মাথার উপর দিয়ে ডেকে ডেকে চলে গেল।
– ‘হাসছিস কেন?’
– ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি রাগ করে চলে গেছো। তাই সকালে নিজে নুডলস বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
– ‘তাই? তুই না বললি মামী পাঠিয়েছে।’
– ‘এমনিতেই বলেছিলাম।’
– ‘আচ্ছা চল, যাই।’
– ‘হুম। আর শোন। চুল, দাড়ি কাটায় তোমাকেও অনেকটা আগের মতো সুন্দর লাগছে। আমার সাথে থাকলে পুরোপুরো ঠিক হয়ে যাবে।’
রাফসান মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে,
– ‘আমাকে পিছনে দে৷ সামনে যা।’
– ‘ওমা কেন?’
– ‘এমনিতেই।’
– ‘আগে বলো তুমিও কি আমাকে দেখে দেখে হাঁটতে চাও?’
– ‘না।’
– ‘তাইলে দরকার নাই।’
– ‘আচ্ছা হ্যাঁ।’
ইলি ফিক করে হাসে। তারপর সামনে গিয়ে হাঁটতে থাকে।
পাহাড় পেরিয়ে ছোট্ট একটা রাস্তা। বাম পাশে ঝিরিপথ দেখা যাচ্ছে। সামনে খানিকটা পথ এগুতেই দেখা গেল মানুষের ভীড়। গাইড তাদেরকে দাঁড় করিয়ে সামনে থেকে এসে জানায়, একটু অপেক্ষা করতে হবে। রাস্তায় ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা ফ্লাগ মিটিং করছে।
দেশলাই – ২১ পর্ব
এখান থেকে ঝর্ণার পানির আছড়ে পড়া কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ফ্লাগ মিটিং শেষ হবার অপেক্ষায়। কিন্তু ইলির ভালো লাগছে না। গাইডকে বললো,
– ‘মামা ডাক দিয়েন আমরা এদিকে আছি। চলো রাফসান ভাই।’
দু’জন আবার রাস্তা থেকে উল্টো পথে হেঁটে পাহাড়ে চলে যায়। কিন্তু সেখানে বসার কোনো স্থান নেই, চারপাশে গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়। খানিক এগিয়ে বাঁ দিকে দেখা গেল কয়েকটি শিমুল গাছের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিলা। ইলি সেদিকে দেখিয়ে বললো,
– ‘চলো টিলায় গিয়ে বসি।’
– ‘গাইড যদি এসে খুঁজে না পায়?’
– ‘আমরা এখান থেকে খেয়াল রাখবো চলো।’
রাফসান আগে টিলায় উঠে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে তুলে। ইলি টিলায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। এখান থেকে ঝিরিপথ এবং মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। গাছের ফাঁকফোকর গলে সূর্যের আলো ভেঙে ভেঙে এসে টিলায় আছড়ে পড়ছে। রাফসান সবুজ ঘাসে দুই পা সামনে দিয়ে বসা। ইলি আলগোছে তার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে দুই পায়ের মাঝখানে বসে পড়ে। খোঁপা করা চুলের ধাক্কা লাগে রাফসানের নাকে।
একটু ভান ধরে ‘উফ’ করে আর্তনাদ করে সে।
– ‘অযথা উফ করো না তো। এতটুকুতেই কেউ ব্যাথা পায় না-কি?’
রাফসান কোনো কথা না বলে দুষ্টামি করে খোঁপা খুলে দেয়।
– ‘এটা কি হলো, খোঁপা খুললে কেন?’
– ‘বারবার আমার নাকে-মুখে লাগবে তাই।’
– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। তোমার দুই হাত এদিকে দাও।’
রাফসান হাত বাড়াতেই ইলি দু’দিক থেকে নিজেকে পেঁচিয়ে ওর দুই হাত নিজের পেটের ওপর রেখে প্রশ্ন করে, ‘ইন্তিশার কি পরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?
– ‘হঠাৎ করে ইন্তিশার কথা কেন?’
– ‘তুমি ইন্ডিয়া থেকে এলে মাত্র দুই রাত হলো। আর কখন জিজ্ঞেস করবো?’
– ‘আমি ইন্ডিয়া যাবার আগে করতে পারতি।’
– ‘ইন্তিশার সাথে ব্রেকাপের পর ইন্ডিয়া যাবার আগপর্যন্ত তুমি স্বাভাবিক ছিলে না। মেয়েদের যা-তা গালাগালি করতে। তখন আমি এগুলো জিজ্ঞেস করবো?’
– ‘স্বাভাবিক না হলে কি মুরব্বিরা মিলে আমাকে বিয়ে দিতেন?’
– ‘আরে না, তখন তুমি একটু স্বাভাবিক হয়েছিলে। সবাই ভাবলো বিয়ে-সংসার হলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা বলো, ইন্তিশার পরে কি হলো?’
– ‘কি আর হবে। আমার সঙ্গে ব্রেকাপ করার জন্য বিয়ের নাটক করেছিল। তাছাড়া মা-বাবা বুঝতে পেরে মোবাইল কেড়ে নিয়েছেন এগুলোও ওর নিজের বানানো কথা ছিল।’
– ‘মাইগড৷ তারপর?’
– ‘তারপর খুব বেশি কিছু জানি না। জানার ইচ্ছেও ছিল না। শুধু সুলতানার কাছ থেকে জেনেছি ইন্তিশার বিয়ে হয়নি। অন্য রিলেশনে আছে। এরপর সুলতানাও ঠিকঠাক ফোন রিসিভ করতো না আমার। আমিও ওই গ্রামে আর যাইনি।’
– ‘এখন আর মনে পড়ে না ইন্তিশার কথা?’
– ‘ইন্ডিয়া গিয়ে অনেকটাই ভুলে গেছি। তবে এখনও মনে পড়ে, বাট কষ্ট লাগে না।’
– ‘তোমার মনে আছে আমি বলেছিলাম ইন্তিশা ভালো মেয়ে না?’
– ‘হুম মনে আছে।’
– ‘আমাকেও ইন্তিশার মতো ভাবছো না তো আবার?’
– ‘না।’
– ‘কেন?’
– ‘জানি না।’
– ‘হুম, বিশ্বাস রাখতে পারো। আমি এবার বাড়িতে গিয়েই মা’কে জানিয়ে দেবো হৃদকে বিয়ে করবো না।’
রাফসান মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে, ‘মাইর দেবো। পাগলামি করিস না।’
ইলি ঘুরে মুখামুখি হয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভান করছো কেন? তুমি আমাকে মনে মনে চাও না বলো?’
রাফসান কি বলবে ভেবে পায় না৷ তার সত্যিই ইলিকে আজকাল ভীষণ ভালো লাগছে। ওর চোখ দু’টো যেন মায়ায় ভরা নদী। তাকালেই বুক শিরশির করে। তাই মনের বিরুদ্ধে ‘না’ শব্দটি বেরুচ্ছে না৷ তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মুচকি হেঁসে বলে, ‘পাকনামি না করে বসতো আগের মতো।’
ইলি কি মনে করে আবার বসে। রাফসানের হাত টেনে এনে পেটে রেখে ওর হাতের ওপর নিজের হাত রাখে৷ তারপর মাথা হেলে দিয়ে বলে,
– ‘জানো? ইন্তিশার সাথে তোমার রিলেশনের কথা শোনার পর কত কেঁদেছি আমি? আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগতো মেয়েটি ভালো না মনে হলে।’
রাফসান তার থুতনি ইলির কাঁধে রেখে হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে ইলিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ‘এগুলো ভুলে যা ইলি। শুধু শুধু কষ্ট পাবি।’
ইলি খানিকটা ঘুরে মুখের দিকে তাকায়,
– ‘কেন? তুমি বিয়ে করতে চাও না আমায়?’
– ‘সে তো চাই। তোকে পাওয়া আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার৷ কিন্তু আমি তো জানি এ সম্ভব নয়। তাই মনের কথা মনে চাপা রেখেই চলতে হবে।’
– ‘এতো বুঝি না৷ তুমি আমাকে পছন্দ না করলে বইলো। তাহলে আর কিছুই বলবো না। বাট তুমি আর আমি চাইলে বিয়ে ঠিকই হবে। আচ্ছা তুমি ভেবে দেখেছো আমরা দু’জনের বিয়ে হলে কত দারুণ হবে? হৃদের সাথে তো একদমই ইচ্ছা হয় না আমার।’
– ‘ওর সাথে বিয়ে হলেই দেখিস সব ঠিক হয়ে গেছে।’
– ‘কচু ঠিক হবে।’
– ‘এ ছাড়া আর উপায় নেই ইলি। হৃদকে মেনে নে।’
– ‘উপায় আছে জনাব। আমি বাড়িতে গিয়ে হৃদকে বিয়ে না করার কথা জানিয়ে দেবো৷ বাট তোমার কথা কিছুই জানাবো না। এরপর আমি পড়ালেখা শেষ করে জব নেব। তুমিও তোমার চাচাদের বলে মধুশ্বরী বাজারে কোনো ব্যবসা দিয়ে দাও। এরপর আমরা সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করে নেবো।’
– ‘বাব্বাহ, এতোকিছু ভেবে বসে আছিস?’
– ‘বিয়ের জন্য পাগল হয়ে আছি দেখে নির্লজ্জ ভাবছো না তো আবার?’
– ‘ভাবছিই তো।’
ইলি মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে মুখটা দেখে বলে,
– ‘নির্লজ্জ ভাবছো না। উল্টো তোমার ভালো লাগছে।’
– ‘উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। তুই অন্তর্যামী হয়ে গেছিস না-কি?’
– ‘অন্তর্যামী না অনুমান করতে পারি।’
– ‘বকবক করিস না চল যাই।’
– ‘এখানে আমার এতো ভালো লাগছে। তুমি চলে যেতে চাও কেন?’
– ‘এমনিই।’
– ‘শোনো, এখানে তো পানির জন্য এভাবে ড্রেস পরে এসেছি। কাল লাউয়াছড়া যাবো শাড়ি পরে। ওইদিনের সন্ধ্যার মতো।’
– ‘আচ্ছা, তারপর ছবি তুলে হৃদকে পাঠাবি।’
– ‘ধুরো। তুমি এখন এমন হয়ে গেলে কেন?’
– ‘কেমন?’
– ‘রোবট মানব।’
রাফসান হেঁসে বললো, ‘তাই না-কি? কেন মনে হলো?’
– ‘বলবো না।’
– ‘তোকে শাড়ি পরলে অবশ্যই বেশি সুন্দর লাগবে। তবে সব সময়ই সুন্দর লাগে।’
– ‘তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে সব কষ্টতেও সুখ লাগতো রাফসান ভাই।’
– ‘কিরে শুধু শুধু বিয়ে বিয়ে করছিস কেন?’
– ‘কেন করছি বলবো?’
– ‘কেন?’
ইলি খানিকটা মাথা তুলে চারদিকে তাকায়, তারপর চোখের পলকে রাফসানকে ধাক্কা দিয়ে সবুজ ঘাসে ফেলে ওর ওপরে উঠে বুকে মাথা রেখে চোখবুঁজে৷
– ‘এটা কি হলো ইলি?’
– ‘শুধু বিয়ে বিয়ে করছি কেন প্রাক্টিক্যালি দেখালাম। বিয়ে ছাড়া তো বুকে মাথা রেখে ঘুমানো যাবে না।’
– ‘দেখানো তো শেষ এবার উঠ।’
– ‘আচ্ছা উঠছি। তুমি শুয়ে থাকো৷ কোনো দুষ্টামি করবো না।’
রাফসান আধশোয়া হয়ে বসে বলে, ‘আমি শুয়ে থাকবো কেন?’
ইলি আসন পেতে পাশে বসে বললো,
– ‘আমার কোলে মাথা তুলতে পারো।’
– ‘না লাগবে না।’
– ‘প্লিজ আসো না। গাইড হঠাৎ ডাক দেবে।’
– ‘কি বলিস এগুলো?’
– ‘বলছি না মাথা রাখতে?’
রাফসান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর আমতা-আমতা করে মাথা রেখে বলে,
– ‘তুই হঠাৎ এমন হলি কেন?’
– ‘এতো প্রশ্ন করো না তো।’
ইলি পরম ভালোবাসায় রাফসানের ঘন কালো চুলে আঙুল ডোবায়। এক হাতে দাড়িগুলো খানিক ছুঁয়ে দেয়। রাফসান তাকিয়ে আছে সোজা মুখের দিকে। ইলির বোধহয় একটু অস্বস্তি লাগলো। হাত দিয়ে রাফসানের চোখ দু’টো বন্ধ করে বলে,
– ‘চোখবুঁজে থাকো।’
রাফসান সত্যি সত্যি চোখবুঁজে। ইলি মাথায়, মুখে হাত বুলাচ্ছে। খানিক্ষণ যেতেই রাফসান চোখ মেলে বলে,
– ‘আমার তো ঘুম পাচ্ছে।’
– ‘তাই?’
– ‘হুম।’
– ‘তাহলে ঘুমাও। আমি ডেকে দেবো।’
রাফসান বেখেয়ালি হয়ে পাশ ফিরে ইলির কোমর জড়িয়ে চোখবুঁজে। ইলির পুরো শরীর কেঁপে উঠে। রাফসানের নাক ডুবে গেছে পেটে। কোল জুড়ে উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পড়ছে। ইলির হার্ট বিট বেড়ে গেছে। নিজেই শুনতে পাচ্ছে নিজের ধুকপুকানি। মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলে,
– ‘রাফসান ভাই উঠো তো।’
– ‘কিরে কি হলো?’
– ‘কিছু না। উঠো চলে যাই।’
রাফসান দাঁত কটমট করে তাকিয়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘তোর হঠাৎ কি হয় বুঝি না ইলি।’
ইলি কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুরো শরীর যেন কাঁপছে।
– ‘কিরে চল। তোর আবার কি হলো?’
– ‘কিছু না। চলো যাই।’
দু’জন টিলা থেকে নেমে আবার হাঁটতে শুরু করে।
—- চলবে —
লেখা: MD Jobrul Islam
— চলবে —
লেখা: MD Jobrul Islam