#দেয়াল
পর্ব – ১০
শেষ পর্ব
লেখকঃ Ramim_Istiaq
.
হঠাৎ করেই বাড়িটা হইচইয়ে মেতে উঠলো। সাউন্ড বক্সের সাউন্ডটা আরো বেড়ে গেলো, সবাই দৌড়ে গেলো গেটের সামনে।
ছেলেপক্ষের লোক চলে এসেছে।
কামরুল সাহেব এতটাও অবুঝ নয়, তিন্নিও যে রামিমকে চায় সেটা তার অজানা নয় তবুও সে কিছু বলছেনা এখন আর সময় নেই।
বিয়েটা হতেই হবে নইলে যে মান সম্মান কিছু থাকবেনা তার।
ওদিকে মানতে কষ্ট হলেও সত্যি তিন্নি কাঁদছেনা মেকআপ নষ্ট হবার ভয়ে।
তার কাঁন্না পাচ্ছে ভিষন তবুও কাঁদছেনা এত সুন্দর করে সেজেছে সে, সব নষ্ট হয়ে যাবে যে।
আসলেই মেয়ে মানুষকে বোঝা কঠিন।
রামিম শেষবারের মতো তিন্নির রুমে আসে।
চোখের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নেয় তিন্নি।
– তিন্নি।
– বল।
– চল পালাই, কেউ মেনে নিবেনা আমাদের। আমি জানি তুইও আমাকে ভালোবাসিস কেনো এমন করছিস?
– রামিম আমি তোকে ভালোবাসিনা, এই পরিবারে শুধু আমি আব্বুকেই ভালোবাসি তার কথা অমান্য করতে পারবোনা আমি।
– তিন্নি আমি….
কথাটা শেষ করতে দেয়না তিন্নি রামিমকে বের হয়ে যেতে বলে।
অসহায়ের মতো রামিম তাকায় তিন্নির দিকে।
আজ সে ব্যর্থ।কারোর কাছেই মুল্য নেই রামিমের ভালোবাসার।
না বুঝলো কামরুল সাহেব, না বুঝলো তিন্নি তবে থেকে কি হবে?
পৃথিবীতে তার আপন বলতে পরিবারের লোকগুলাই তারা সবাই আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেউ কি বুঝছেনা রামিমের অনেক কষ্ট হচ্ছে?
দরজার পাশে দাড়িয়ে কামরুল সাহেব তাদের কথোপকথন শুনেন।
তবুও সে তার সিদ্ধান্তে অটল। দুইটা মানুষ যে ভিতরে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল সেই তার শুধু বাইরেটা ঝলমল করছে সেটাই দেখছেন তিনি।
বিয়ের কাজ চলছে।
আশেপাশে অনেক মানুষ কিন্তু তিন্নির চোখজোড়া একজনকেই খুজে চলেছে।
কিন্তু রামিম তো নেই। সে তো এতটাও শক্ত নয়, সে নিজের চোখে দেখতে পারবেনা তিন্নির বিয়ে। মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসে যে রামিম।
রামিম কোথায় তা কেউ জানেনা, স্বয়ং লেখকও জানেনা।
এসময় কামরুল সাহেবের মনে কি চলছে কে জানে।
তবে তিন্নির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, সে বারবার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক।
কোথাও রামিম নেই। কাজি সাহেব এসেছেন বিয়ে পড়াতে।
বারবার বলছেন কবুল বলতে সেদিকে তিন্নির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরনো স্মৃতিগুলো।
মনে পড়ে যায় রামিমের কথাগুলো। উঠে দাড়ায় তিন্নি। বিয়েটা করছেনা সে।
কামরুল সাহেবের সামনে গিয়ে বলে,
– বাবা আমি বিয়েটা করতে পারলাম না এর চাইতে যে মরে যাওয়াও ভালো।
।
কামরুল সাহেব কিছু বলেনা তবে সে নিজেও জানেনা কেনো জানি তার ঠোঁটের কোনে অস্ফুট একটা হাসি চলে আসে।
তিন্নি দৌড়ায় রামিমের রুমে।
বাইরে থেকে দরজা নক করে তিন্নি,
দরজা খুলেনা, ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায় তবে ঘরে রামিম নেই।
বিছানার ওপর পড়ে আছে একটা চিরকুট।
তিন্নি বিছানায় বসে চিরকুটটা হাতে নেয়।
ওদিকে বাড়ির হইচই থেমে গেছে, ছেলেপক্ষের লোকজন রাগ করে নানান কথা বলে চলে যাচ্ছে,যাবেই না বা কেনো? এত কিছুর পর মেয়ে বললো বিয়ে করবেনা।
হঠাৎ তিন্নির বুক কেঁপে উঠে। হাত থেকে কাগজটা পড়ে যায় দরজার পাশে এসে দাড়ায় কামরুল সাহেব। তিনি আপাতত কোনো কথা বলছেন না তবে বুঝতে পারছেন সবই। তিনি খুশি কারন অনেক ভাবার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন রামিম আর তিন্নি দুজন দুজনের পরিপূরক। এরা একে অপরকে ছাড়া কেউ ভালে থাকতে পারবেনা।
কি আসে যায় সমাজ কি বললো তাতে?
বাঁচবেই আর কয়দিন, ছেলেমেয়ের মুখে যদি হাসি নাই দেখতে পেলো তবে কিসের ভালো থাকা এই পৃথিবীতে?
তিন্নি থ মেরে বসে আছে, কোনো কথা বলছেনা।
কামরুল সাহেব চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন।
‘ প্রিয় বাবা, আশা করি ভালো আছো। অবশ্য তোমার ভালো থাকার জন্যই আমি চলে যাচ্ছি। আমি জানি এতক্ষণে তিন্নির বিয়েটা হয়ে গেছে। তুমি এবার খুশিতো বাবা? জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত তোমার কোনো কথা ফেলিনি আমি। তবে তুমি কখনো আমাকে আদর করোনি। সারাটাজিবন আমাকে অবজ্ঞা করে গেছো।মনে আছে তোমার? তুমি তিন্নিকে কোলে করে নিয়ে স্কুলে যেতে আমি পাশে তোমার শার্টের কোনায় চোখ মুছতাম।
তোমার হাতের আঙুল ধরেও কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
বাবা মনে পড়ে কি?
তুমি রোজ খাবার টেবিলে বসে তিন্নিকে খাইয়ে দিতে। জানো আমারও খুব ইচ্ছা হতো তোমার হাতে খাবো কিন্তু সেটাও কোনোদিন হয়ে উঠেনি আমি অসহায়ের মতো শুধু চেয়ে দেখতাম তখন এতকিছু বুঝতাম না তবে এটুকু বুঝতাম তোমার আমাকে পছন্দ না।
তুমি রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় তিন্নির জন্য চকলেট আনতে কই কোনোদিন তো আমাকে চকলেট দাওনি। কখনো তো অফিস থেকে ফিরে আমাকে কোলে তুলে একটা চুমু খাওনি। সবসময় তিন্নিকেই আদর করেছো।
আমি ওর আশেপাশে থাকতাম যাতে আমাকেও একটু আদর করো।
কি দোষ ছিলো আমার বাবা? কেনো এমন করতে?
তারপর একটু বড় হলাম বুঝতে শিখলাম তোমার আমাকে পছন্দ নয়।
আমি তোমার থেকে দুরে থাকতাম।
তখনো কষ্ট হতো কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি আজ বললাম কারন এটাই শেষ কথা।
বাবা এতকিছুর পরও না আমি তোমাকে ভালোবাসতাম তাই তিন্নির ব্যাপারটা বলেছিলাম তোমাকে। ভেবেছিলাম হয়তো এই ইচ্ছাটা পুরন করবে।
আর তিন্নি তোর হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে যাইহোক তোকে অনেকটা ভালোবাসতাম মনে পড়ে একদিন স্কুল থেকে আসার সময় তোর পায়ে কাটা বিঁধেছিল?
আমি সেদিন নিজের পা ব্লেড দিয়ে কেটে তোর সাথে খুঁড়িয়ে হেটেছিলাম।
তোর কাছে কাছে থাকতাম সবসময় কারন তোকে আমি ভালোবাসতাম, কখনো বলা হয়নি তবে বাসতাম।
তুই আর বাবা দুজনের কাছেই গিয়েছি আমি।
কেউ বুঝিসনি আমার কষ্টটা। তুইও স্বার্থপরের মতো একা করে ফেললি আমাকে।
যাই হোক ভালো থাকিস সুস্থ থাকিস আর পারলে পাগলটাকে ভুলিস না।
আমি কোথায় যাচ্ছি জানিনা হয়তো এটাই এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন।
তবে এটুকু বলতে পারি আমি মরে গেলে আমার লাশটাও ওই কামরুল সাহেব দেখতে পাবেননা তার কাছে মান সম্মানটাই সবার আগে।
আম্মুকে দেখে রাখিস আর টুনিকে পড়ালেখা করাবি ওকে উকিল বানাবি।
আমার শেষ আবদারটা রাখিস।
জানি এখন আর ভালোবাসি বলার অধিকারটা নেই তবুও বললাম ভালোবাসি।
আপাতত পরিবেশে শান্ত। কামরুল সাহেব আজ কাঁদবেন বেশ আয়োজন করেই কাঁদবেন।
তিন্নি মেয়েটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
নাজনীন বেগম শব্দ করে কান্না করছেন, এ বাড়িতে আর কোনোদিন সুখ আসবেনা।
বাড়িটা আজ মরে গেলো।
রামিম চলে গেছে দুবছর হলো।
তিন্নি এখনো দরজার পাশে বসে থাকে রামিম ফিরবে বলে।
সত্যি কি ফিরবে?
ছেলেটাকে হারিয়ে কামরুল সাহেব ভালো থাকতে পারেনি। মেয়েটারও এই অবস্থা দেখে তিনি আর নিতে পারেন না তারও ইচ্ছা হয় মাঝেমাঝে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে।
এই পরিবারটাকে নিজ হাতে হত্যা করেছেন তিনি।
তিন্নি রোজ কল্পনায় ভাবে রামিম আসবে, এসে দরজায় নক করবে সে খুলে দিতেই তিন্নিকে জড়িয়ে ধরবে রামিম।
রাত হলে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমানোর অপরাধে কান মলে দিবে। খাবার টেবিলে বসে পাঁ ছোঁয়াছুঁয়ির প্রতিযোগিতা হবে। বিকেল হলে ছাদে বসে আড্ডা দেওয়া হবে আর একটা মেয়ে হবে তাদের নাম হবে সুকর্না।
মেয়েটাকে নিয়ে প্রথম রামিম যাবে জিরু বাবার কাছে। তিন্নি কিছুটা রাগ করবে তবে আবার রাগ কমে যাবে মেয়েটার হাসিতে।
রাত হলে মেয়েটাকে পাশে রেখে মেয়ের বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে তিন্নি।
এরকম শত কল্পনায় তার দিন কাটে।
রামিম আসবে, অবশ্যই একদিন আসবে।
সত্যিই কি আসবে? নাকি দেয়াল ভাঙতে না পেরে দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে রামিম?
হয়তো রামিম আসবে হয়তো না।
এই গল্পের সমাপ্তি স্বয়ং লেখকও জানেনা।
কিছু গল্প চলতে থাকুক এভাবেই আমি কে সমাপ্তি লিখার?