#দ্বিতীয়_জীবন (অন্তিম পর্ব)
আদিলের মৃত্যুর পর তিন্নি পুরো ভেঙ্গে পরেছিল। সারাদিন রুমে থাকত। কারো সাথে তেমন কথা বলত না। ওর জন্য সবচেয়ে কঠিন যে বিষয়টা ছিল, সেটা শুভকে ফেস করা। তাই বাবা মাকে বলল তাকে এই বাসা থেকে নিয়ে যেতে। কিন্তু চলে গেলেই কি হলো? মন বলে কিছু একটা তো আছে। তিন্নির কেবল মনে হতে লাগল ওর আজকের এই অবস্থার জন্য ও নিজেই দায়ী। তার কোনভাবেই আদিলকে বিয়ে করা উচিৎ হয়নি। তার মনে ত আশঙ্কা ছিল যে শুভ এমন কিছু করতে পারে। তাহলে কেন সে বিয়েতে রাজী হয়েছিল। শুভর হায় লেগেছে ওর জীবনে। তাই ওর এতো সুন্দর হাসিখুশি জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। আদিল অকালে এভাবে চলে গেল, ওকে একা রেখে।
তিনমাস পর
শুভ দেশে ফিরে এসেছে। এখানেই ব্যবসার চেষ্টা করছে। কি কি নতুন প্রোজেক্ট ের আইডিয়া নিয়ে বন্ধুদের সাথে বসছে। রাহেলা বেগম অবশ্য আপত্তি করেছিলেন এই বলে
-আজকাল এসব ব্যবসার কোন ভরসা নেই। চাকরী বাকরি দেখ। আর আমি সারাদিন বাসায় একা থাকি। তোর বাসায় আসা যাওয়ার কোনো টাইম টেবল নেই। মাঝেমাঝে দুইতিন দিনের জন্য উধাও হয়ে যাস। এখন তিন্নিও নেই যে ওর সাথে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করব।
-কেন রানু খালা আছে না?
-রানু? তুই আর মানুষ পেলি না। ওর সিরিয়াল দেখা থেকে ফুরসত মিললেই তো আমার সাথে গল্প করবে।
রানু রাহেলা বেগমের গ্রামের মেয়ে। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করেছে। ছেলের বিয়ের পর বনিবনা হয় না ছেলের বউয়ের সাথে। সেসময় আদিল মারা গেল। তিন্নিও ওর বাবার বাসায় থাকে। নিজে থেকেই একদিন প্রস্তাব দিল রাহেলা বেগমের কাছে এসে থাকার। আর রাহেলা বেগমও আনন্দের সাথে লুফে নিলেন সেই প্রস্তাব।
-তাহলে তিন্নিকে আনার ব্যবস্থা কর।
রাহেলা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন
-তিন্নির উপর কি আমার আর সেই অধিকার আছেরে বাবা? আর এই অবস্থায় ওর বাবা মায়ের কাছে থাকায় ভালো। এখানে এলে আদিলের কথা মনে পরবে।
শুভ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল
-অধিকার যদি না থাকে, তবে অধিকার সৃষ্টি কর।
রাহেলা বেগম চোখের জলে আড়াল করে বললেন
-চাইলেই কি সব সম্ভব?
-কেন সম্ভব না মা?
-কি করে?
-সে উপায় তোমার আছে।
-তুই কি বলতে চাইছিস?
-মা, আমি তিন্নিকে বিয়ে করতে চাই। ওর ইদ্দতকালীন সময়ও পার হয়ে গেছে। তুমি ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বল।
রাহেলা বেগম এবার আনন্দে কেঁদে ফেললেন। চোখের জলে না মুছেই ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন
-তুই আজ আমাকে কি খুশী উপহার দিয়েছিস সেটা তুই নিজেও জানিস না বাবা। আমি এই শুক্রবার তিন্নিদের বাসায় যাব।
রাহেলা বেগম পরদিন তিন্নির মাকে ফোন করে জানালেন উনারা শুক্রবার আসবেন। তিন্নির মা একটু অবাক হলেন। কারণ এভাবে বলে কয়ে উনি এখন আসেন না। আসার আগে একবার কল করে জেনে নেন উনারা বাসায় আছেন কিনা। কিন্তু দুইদিন আগে এভাবে জানানো কেন?
তিন্নিকে বলতেই তিন্নি ভাবলেশ ভাবে বলল
-আমি কি জানি?
রাহেলা বেগমের মনে আনন্দের ফোয়ারা বইছে। উনি এই দুইদিন তিন্নির জন্য ইচ্ছে মতো শপিং করলেন। আর অধীর আগ্রহে শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তিন্নির বাবা মায়ের কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করতেই উনারা খুব খুশী হলেন। তিন্নির বাবা বললেন
-আমাদের কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? তিন্নি এবং বাচ্চা ওদের নিজের পরিবাবের কাছেই ফিরে যাবে।
তিন্নির মা গিয়ে তিন্নিকে বললেন
-জানিস রাহেলা আপা শুভর সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
তিন্নির মনের ভেতর কেন যেন কয়দিন ধরে এই সম্ভাবনাটাই উঁকি দিয়েছিল সে মা কে জিজ্ঞেস করল
-শুভ এসেছে?
-না, সে তো আসেনি।
-মা শোন, এই বিয়ে আমি করতে পারব না। কারো দয়ার আমার প্রয়োজন নেই।
তিন্নির মা আর এই অবস্থায় মেয়েকে ঘাটালেন না। তিনি রাহেলা বেগমকে আস্তে করে তিন্নির এই আপত্তির কথা জানালেন। রাহেলা বেগমের বুঝতে বাকি রইল না, শুভর উপর তিন্নির এখনো প্রচন্ড অভিমান রয়েছে। তিনি তিন্নির মাকে বললেন তিন্নিকে কিছুটা সময় দেয়ার জন্য।
শুভ তার ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে ছিল। রাতে বাসায় ফিরে মায়ের কাছে সব জানতে পারল। পরদিন শুভ তিন্নির সাথে দেখা করার জন্য তিন্নির বাবার বাসায় গেল। এইবার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন বাঁধা আর মানবে না। একবার হারিয়েছে তিন্নিকে আর হারাতে রাজী নয়।
কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে শুভ সরাসরি তিন্নির রুমে চলে গেল। তিন্নিকে দেখে একটা বড় রকমের ধাক্কা খেল, কি মেয়ে কি হয়ে গিয়েছে। বুক ফেটে মনে হয় কান্না বের হয়ে যাবে, তারপরও নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল
-কিরে খুব দেমাগ হয়েছে মনে হয় তোর?
শুভর কন্ঠ পেয়ে চমকে গেল তিন্নি। কিছু বলতে পারলনা কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। শুভ আবার বলল
-কিরে দেমাগ বাড়ার সাথে সাথে কি কানেও কম শুনিস নাকি?
তিন্নি এবার সম্বিত ফিরে পেল, শুভ কোন প্রসঙ্গে ওকে এই কথা বলেছে ওর বুঝতে কষ্ট হল না। খুব শান্ত ভাবেই বলল
-কানে কম শুনি না। আর যেটা বলছিস সেটা দেমাগ না আত্মসম্মান।
শুভ একটু রাগের সাথে বলল
– এসব আত্মসম্মান নিজের কাছে রাখ। অন্য কারো সাথে দেখাবি আমার সাথে দেখাতে আসলে তোর খবর আছে।
তিন্নি আর না পেরে কান্না করে দিল। শুভ কাছে এসে বলল
-আর না করিস না। আমি সত্যি তোকে অনেক ভালবাসি। প্রথমে বুঝতে পারি নি, যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমার চেয়ে ভাল তোকে কেউ বাসবে না এটা সবসময় মনে রাখবি।
শুভর পরিবর্তনগুলো তিন্নির বেশ চোখে পরছে। আগে অনেক বলেও যাকে কোনোদিন বাসায় আনা যেতো না, আজ নিজ থেকেই কাউকে কিছু না বলে সরাসরি বাসায় এসে উপস্থিত। গতকাল অবশ্য তিন্নির একটু অভিমান হয়েছিল। ও ভেবেছিল শুভ আসবে রাহেলা বেগমের সাথে। শুভ না আসায় কেন যেন ওর কষ্ট হয়েছিল ভীষণ।
ওর যা বয়স আজ হোক কাল হোক ওর বাবা মা বিয়ের কথা বলবেই। কার না কার সাথে বিয়ে হবে, ওরা ওর বাচ্চাকে মেনে নিবে কিনা? সে অনেক হ্যাপা। আর এখানে বাচ্চা তার নিজের মানুষজনদের কাছেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা মায়ের সাথে নিজের দাদির কাছে থাকবে।
তিন্নিকে চুপ থাকতে দেখে শুভ জিজ্ঞেস করল
-কি এতো ভাবছিস? তুই আমাকে ভালোবাসিস না? আচ্ছা যা ভালোবাসতে হবে না। পছন্দ করিস না?
তিন্নি এবার একটু কঠোরভাবেই জিজ্ঞেস করল
-এই কয় মাস আমার খবর নিসনি কেন?
-ইচ্ছে করেই নিইনি। রোজগারের ধান্দা করছিলাম। তা না হলে তোকে খাওয়াব কি? আর নেইনি বললে ভুল মার কাছ থেকে তো তোর সব আপডেট পেতাম।
-তার মানে তোর সব কিছু আগে থেকে প্ল্যান করা ছিল।
-জি ম্যাডাম। আমি যখন স্কটল্যান্ডে ফিরে যাই তখন সব কিছু মনে মনে সেট করে ফেলি।
তিন্নির আর কঠোর থাকতে পারল না। শুভ কে হ্যাঁ বলে দিল। জীবনের যে বাঁকে তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে আর বেশী কঠোর হতে পারল না। এখন নিজের চেয়ে সামনে যে আসছে তার চিন্তা বেশী। শুভকে বিয়ে করলে অন্তত নতুন অতিথি ভাল থাকবে। এই নতুন অতিথির জন্য হলেও না হোক ওর দ্বিতীয় জীবনের শুরু।
সমাপ্তি