দ্বিরাগমন পর্ব ১১

#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১১

সুলতানা আপা বললো,
“মুনার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। আজকে রিপোর্ট এসেছে। ক্যান্সারের থার্ড স্টেজে গিয়ে ধরা পরেছে যে তার ব্লাড ক্যান্সার। ডাক্তার সময় বেধে দিয়েছে মুনাকে। তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে আজকেই। কোর্টে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। সপ্তাহের মধ্যেই মুনাকে দেশে পাঠিয়ে দিবে তারা।”

আমি কথাটা শুনে নির্বাক হয়ে গেলাম। কোনোকিছু বলার সাহস পেলাম না। হতবাক আর বাকশূন্যতা আমাকে প্রগাঢ় ভাবে আচ্ছন্ন করে বসলো।

আইসিইউ থেকে আমার মেয়েটাকে এনে দিলো রাত এগারোটার দিকে। সালমান এসে শাসিয়ে গেলো, এই মেয়েটাকে নিয়ে তার ঘরে যাওয়া যাবে না। আমার পাশে সুলতানা আপা ছিলো। শাশুড়ি কল করে সুলতানা আপাকে বলে দিলেন, আমি যাতের তাদের বাসায় আর না যাই। সুলতানা আপা আমার সামনে কান্না করতে করতে বললো,
“বোন রে, তোর ছেলে হবে না এইটা আমি আগেই জানতাম। তারানা তোর রিপোর্ট সালমানের আগেই জেনেছে। কিন্তু সে তোকে জানায়নি। ডাক্তারকে বলে এসেছে, তোর পেটে যে বাচ্চা বেড়ে উঠছে সেটা যে ছেলে না মেয়ে এইটা যেনো সালমানের সামনে গোপন রাখে।”
আমি সুলতানা আপার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
“আমার এই কয়েকমাস সুস্থ থাকাটা উচিত ছিলো। এজন্য তোমরা আমাকে জানাওনি।”
তারপর আমি আমার ছোট মেয়েটাকে কুলে নিয়ে সুলতানা আপার কুলে দিয়ে বললাম,
“এই বাচ্চাটা আজ পৃথিবীর মুখ দেখেছে শুধুমাত্র তোমার আর তারানা আপার জন্য। যদি তোমরা কৌশলে এই জিনিসটা গোপন না রাখতে, তাহলে হয়তোবা তারানা আপার মেয়ের মতো, আমার মেয়েটাও পৃথিবীর মুখ দেখতে পারতো না।”

সুলতানা আপা আমাকে জড়িয়ে ধরলো তখন। আমার মেয়েটা কান্না করে উঠলো। সুলতানা আপা মেয়েটাকে আমার কুলে তুলে দিলো। মেয়েটাকে কুলে নিতেই আমার মনটা শান্ত হয়ে গেলো। এক অপার তৃপ্তি যেনো আমাকে ভর করতে লাগলো।

গভীর রাত। হসপিটালের বেডে আমি শুয়ে আছি। বাচ্চাটা নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে। ভয় পাচ্ছি ভীষণ, বাচ্চাটাকে নিয়ে সেই বাসায় উঠবো কীভাবে? সালমান আমার সাথে কেমন আচরণ করবে?
অন্যদিকে মুনার কথা ভাবলেই আমি কেমন জানি হয়ে উঠি। মেয়েটার জীবনে এতো দুঃখ আসুক সেটা কখনোই চাইনি।
পরেরদিন ডাক্তার আমাদের ছেড়ে দিলো। সুলতানা আপা একের পর এক কল দিলো সালমানকে। সালমান কল রিসিভ করলো না। শাশুড়ি দুপুরে কল দিয়ে আমাকে বললেন,
“বাজা হয়ে থাকতি, মেয়ে জন্মানোর কী দরকার ছিলো?”
আমি সেদিন অদ্ভুত সাহসী হয়ে গেলাম। শাশুড়িকে বলে বসলাম,
“আমার কাছে ছেলে মেয়ের কোনো তফাত নাই।”
কথাটা শুনে শাশুড়ি হুংকারের সুরে বললেন
“মেয়ে নিয়ে আমার ঘরে জায়গা হবে না।”
বিকালে গাড়ির ড্রাইভারকে করে টাকা পাঠালো সালমান। সুলতানা আপা আমাকে রুমে রেখে হসপিটালের বিল মিটিয়ে আসলো। গাড়ির ড্রাইভারকে কেভিনে ডেকে এনে কাপড়-চোপড় গাড়িতে তুলতে বললে গাড়ির ড্রাইভার কাছুমাছু হয়ে সুলতানা আপাকে বললো,
“ভাবি আমি নিচে নিয়ে দিতে পারবো তবে গাড়িতে তুলতে পারবো না।”
কথাটা শুনে আমি অবাক হলাম। সুলতানা আপা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
“স্যার নিষেধ করেছেন।”
“নিষেধ করেছেন? গাড়ি সাথে নিয়ে আসো নাই?”
“সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“আপনি যেতে পারবেন স্যার বলে দিয়েছেন। তবে ছোট ভাবি আর তার বাচ্চা যাতে গাড়িতে না উঠেন আমাকে সাফ নিষেধ করে বলে দিয়েছেন। আর গাড়িতে তো সিসি ক্যামেরা আছেন আপনি জানেন। নাহলে আমি বলতাম, উঠে বসেন বাসায় যাবার রাস্তায় নামিয়ে দেবো।”
সুলতানা আপা ড্রাইভারের সামনে কিছু বললেন না। ড্রাইভারকে বললেন,
“তুমি চলে যাও।”
“জি আচ্ছা ভাবী। আসসালামুয়ালাইকুম।”
ড্রাইভার তারপর এসে আমার মেয়ে বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে আদর করলো। আমার বুকটা কেমন জানি চেত করে উঠলো। এই প্রথম কোনো পুরুষ মানুষ আমার মেয়ের গালে আদর করে হাত দিয়েছে। অথচ তার বাবা এখনও আছেন, সুস্থ আছেন, সেই বাবাই তার মেয়েকে দেখলো না!

ড্রাইভার চলে গেলো। আমার চোখের কোণে জল জমা দেখে সুলতানা আপা বললেন,
“কান্না করে কোনো লাভ আছে রে বোন? আয় আমরা বাসায় যাই। দেখি কী হয়?”
“দেখি কী হয়? এইটাই?”
“হ্যাঁ রে বোন। আয়।”
“আমি যাবো কোথায় আপা?”
“কই আবার? বাসায়।”
“না আমি সেখানে যাবো না।”
“কেনো?”
“তারা আমাকে মেনে নিবে না। তুমি সেটা ভালো করেই জানো।”
“এখন ঘরে যেতে হবে। পরের বিষয় পরে দেখা যাবে।”

সুলতানা আপা আমাকে নিয়ে বাসায় গেলো। বাসায় ঢুকতেই দেখলাম, ড্রইংরুমে সালমান বসা। তার পাশে আমার শাশুড়ি শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“দাঁড়াও!”
আমি অবাক হলাম। সালমান তার সামনে রাখা পানদান পা দিয়ে ঠেলে নিচে ফেলে দিলো। সালমানকে শাশুড়ি বললেন,
“শান্ত হ বাবা।”
তারপর সুলতানা আপাকে ভেতরে আসতে বললেন শাশুড়ি। সুলতানা আপা আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে, কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সালমান উঠে এসেই সুলতানা আপার গালে থাপ্পড় দিলো একটা। শাশুড়ি পেছন থেকে সুলতানা আপার চুলে হেচকি টান দিয়ে ধরলেন। সামনা বললো,
“তুই জানতি যে মেয়ে হবে। তাইনা?”
আমি অবাক হলাম, এই খবর সালমান জানলো কীভাবে। সালমান সুলতানা আপাকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“তুই জানতি, তাইনা? তার পরও তুই গোপন করলি। এর কারণ কী খানকি? তুই আমার ঘরের বউ না?”
শাশুড়ি যুক্ত করলো সালমানের সাথে। রাগের মুখে বললো,
“তুই বিশ্বাসঘাতক হবি এইটা কখনো ধারণাও করতে পারিনি।”
সুলতানা আপা কান্না করতে কর‍তে বললো,
“আমি এর কিচ্ছু জানি না। আমি কিছুই করিনি।”

এবার সালমান কেমন জানি হিংস্র হয়ে উঠলো।।মোবাইলের ভিডিও অন করে দেখিয়ে বললো,
“এই দেখ, ডাক্তারকে পিঠিয়ে এসেছি সে মিথ্যা কথা বললো কেনো! কেনো সে ভুল রিপোর্ট জানালো। ডাক্তার বললো, আমার আরেক বউ এসে নাকি বাঁচা মরার দোহাই দিয়ে গিয়েছে এজন্যই সে আমার মেয়ে হবে এইটা জানায়নি।”

আমি স্পষ্ট দেখলান, ডাক্তারের ঠোঁটের কোণা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ডাক্তার কেমন জানি নাস্তেনাবুদ হয়ে আচ্ছেন সালমানের জেরায়।

সালমান আবার থাপ্পড় দিলো সুলতানা আপার গালে। সুলতানা আপাকে বললো,
“মিথ্যাবাদী এখনও মিথ্যা বলছিস?”
সুলতানা আপা কান্না করতে কর‍তে বললো
“আমি বাচ্চাটাকে বাঁচায়ে চেয়েছি। এই বাঁচানোর জন্য আমি গোপন রেখেছি।”

শাশুড়ি বললেন,
“তুই কখনো বাচ্চা পেটে ধরেছিলি?”
সুলতানা আপা মাথা নিচের দিকে দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
তারপর শাশুড়ি সুলতানা আপার পেট বরাবর হাত দিয়ে আঘাত করে বললেন,
“পেটে মেয়ে ধরা অপরাধ। এইটা তুই বুঝবি না।”

আমি দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম।আমার হাতে আমার সদ্য জন্মানো মেয়ে। সালমান আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললো,
“তোকেও তালাক, তুই চলে যা।”
সুলতানা আপা সালমানের পায়ে পড়ে গেলো। একবার সালমান তো আরেকবার শাশুড়ির পা ধরে বলতে লাগলো,
“আমার মেয়েটাকে আমার থেকে আলাদা করো না। দোহাই লাগে তোমাদের।”
সালমান হাসলো। শাশুড়ি বললেন,
“মা থেকে মাসির দরদ বেশি হয় জানতাম কিন্তু এখন দেখছি মার চেয়ে সতীনের দরদ বেশি।”
আমি দরজা থেকে জোরে সুলতানা আপাকে বললাম,
“তুমি আমার জন্য তাদের পায়ে পড়ছো কেনো?”
সালমান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুই চলে যা। বেহায়ার মতো এখানে থাকিস না।”

এমন সময় সালমানের মোবাইলে কল আসলো। সালমান চিল্লিয়ে বললো,
“মুনার কল দেয়ার আর সময় হয়ে উঠে না। শাশুড়িকে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে সালমান বললো,
“কথা বলো।”
শাশুড়ি বললেন,
“আমার হাতে মরিচ গুড়া লাগানো। তুই স্পিকারে দে।”
স্পিকারে দিতেই অপাশ থেকে মুনা শাশুড়িকে বললো,
“আমি আর বাঁচবো না মা। ভাবিদের আর নির্যাতন করো না। দেশে আসছি আমি আগামী পর্শু সন্ধায়। আমার দিন শেষ হতে চললো। আমার ক্যান্সার হয়েছে। তোমার জামাই ডিভোর্স দিয়েছে এইমাত্র। ”

শাশুড়ি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সুলতানা আপা শাশুড়িকে ধরলো গিয়ে। আর আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সালমানে সেই কথাটা,

“তুই চলে যা, বেহায়ার মতো থাকিস না”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here