দ্বিরাগমন পর্ব ৪০+৪১+৪২ ও শেষ

#দ্বিরাগমন
#লেখা: Midhad Ahmed
#_৪০

নুসরাত আসিফকে বললো,
“আমাকে বাসায় চলে যেতে হবে এক্ষুণি”
“কেন জান?”
“বাসায় আজকে মেহমান আসবে তো তাই”
“আরেকটু থাকো না প্লিজ?”
“না জান, আজক চলে যেতে হবে”
“ড্রপ করে দেই?”
“না থাকুক। যদি কেউ দেখে ফেলে আমাদের”
“দেখে ফেললে কী?”
“কিছু না”

নুসরাত উঠে চলে গেলো। আসিফ বাইকে উঠে বসতেই আসিফের মোবাইলে সিন্থিয়ার কল এসে ঢুকলো। আসিফ কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে সিন্থিয়া বললো,
“কোথায়?”
“বাইরে”
“বাসায় যাওনি?”
“কেনো? বাসায় কী?”

সিন্থিয়া অবাক হলো। অবাক মুখে জিজ্ঞেস করল,
“বাসায় কী মানে?”
“মানে কী? বুঝলাম না। বাসায় গিয়ে কী করবো আমি?”
“বাসায় না মেহমান…”
“অহ সরি সরি সরি। ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি বাইরে সালাদ কিনতে আসছিলাম তো। ওই মেহমানদের জন্যই।”
“সত্যি তো?”
“আরে জান মিথ্যা হবে কেন?”
“জানি না আমি”
“উহু! সন্দেহ করছো আমাকে? আচ্ছা ভিডিও কল দেও আমি দেখাই তোমাকে আমার হাতে টমেটো, শসা, গাজর এসব আছে।”
“না ভিডিও কল দেওয়া লাগবে না”
“না না প্লিজ। দেউ। দেখাই তোমাকে। তাহলে অন্তত বিশ্বাস হবে।”
“না লাগবে না। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি”

মনে মনে আসিফ হাসলো। কী বোকাই না সিন্থিয়া। অথচ আসিফের হাতে সালাদের কিছুই নেই। সে জানে সিন্থিয়াকে ইমোশনাল কথাবার্তা বললে সে গলে যায়। হাতে কিছু নেই তবুও ভিডিও কল করার কথা বলাতে সিন্থিয়া বিশ্বাস করে বসেছে। আসিফ সিন্থিয়াকে বলল,
“জান একটা কথা বলার ছিল”
“কী কথা?”
“রাখবা তো?”
“উহু! বলো না”
“বিড়ি কেনার টাকা নাই। বাইকের তেলের টাকাও নাই”
“অহ আচ্ছা। আমি বিকাশ করছি”
“এই এই জান শুনো শুনো, একটু বেশি দিও কেমন?”
“আচ্ছা”
“লাভ ইউ জান”
“হয়েছে হয়েছে। দেখে শুনে বাসায় যাও”

আসিফ বাসায় গিয়ে দেখলো তার বিকাশ একাউন্টে চার হাজার টাকা এসেছে। মনেমনে খুশি হলো সে। আর ভাবলো, এরকম একটা বড়লোক গার্লফ্রেন্ড থাকলে লাইফে আর কী লাগে! এরকম যখন তখন সিন্থিয়ার কাছ থেকে টাকা আনা যায় অনায়াসেই। কোন সমস্যা হয় না।
বাসায় এসে তারপর আসিফ বাথরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। গামছা পরে শাওয়ার শেষ করে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসিফ রুমের দরজা লক করলো। কাপড় পরবে এমন সময় মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো আবার। সিন্থিয়া কল করেছে। আসিফ বিরক্তির সুর নিয়ে বললো,
“ধুর আবার কোন অকাজে কল করেছে জানি না। সারাদিনে দুইটা ডেট শেষে শাওয়ার করে ফ্রেশ হয়ে আসলাম বাসায়। দুই দুইটা মেয়ের সাথে ডেট শেষে শরীরে আন এনার্জিও থাকে না কথা বলার আর এই মেয়েটা বারবার কল করে ডিস্টার্ব করে”

আসিফ কল উঠালো। সিন্থিয়া বলল,
“এই একটা কথা বলার ছিলো।”
“হ্যাঁ সুইটহার্ট বলো কী বলার ছিলো”
“সিগারেট খাবা না”
“কেন?”
“খাবা না মানে খাবা না। ওকে?”
“আচ্ছা জান খাবো না। হয়েছে?”
“হুম হয়েছে। কী করছো এখন?”
“গামছা পরে বসে আছি। শাওয়ার করেছি মাত্র। ভিডিও কল দেই। দেখবা?”
“ধুর কী বলছো আজেবাজে এসব”
“আজেবাজে কই বললাম? দেই কল”
“না রাখো। রাতে কথা হবে”
“আচ্ছা জান। ওকে।”

সিন্থিয়া কল রাখলো। আসিফ চেইঞ্জ করে ফ্যান ছেড়ে একটা সিগারেট ধরালো। মনের সুখে টান দিতে লাগলো সিগারেটে। এক একটা টানের শেষে নিজেকে স্বাধীন কল্পরাজ্যের একজন রাজা রাজা ভাব, এমনটা মনে হতে থাকলো তার নিজের কাছে।

এদিকে সত্য অসুস্থ। প্রেগন্যান্ট। গাইনি বিভাগীয় প্রধানের কাছে সুলতানা আর আলভি মিলে সত্যকে নিয়ে গেলো। খবরটা পেয়ে সুলতানার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আলভি কিছুটা লজ্জা পেলো। সুলতানা গাড়িতে বসে আলভির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আমার পুচকে ছেলেটা এখন বাপ হবে।”

আলভি মুচকি হাসলো শুধু। বাসায় এসেই সুলতানা সালমানকে ডেকে বলল,
“তুমি এখন দাদা, নানা দুইটাই হবে। বুঝেছো!”

সালমানের চোখ বেয়ে পানি ঝরে গেলো। রুমে সত্যকে আলভি বিছানায় বসিয়ে রেখে নিজে মাটিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“জানি না এই অনুভূতি কেমন হয়। তবুও এটা জানি আমার জীবনের বা আমাদের জীবনের অন্যতম একটা অধ্যায় তোমার গর্ভে বড় হতে চলেছে”

সত্যের চোখ বেয়ে জল নেমে আসলো। আলভি জল দেখে অবাক হলো। সত্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? কান্না করছো যে!”
“আজ আমার বাবা মা একসাথে নেই। আমি বাবাকে বাবা হিসেবে মেনে নিতে পারলাম না আর মা বাবাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারলো না। আমার থেকে অভাগা, একা আর কেউ আছে বলো?”
“তুমি এভাবে ভাবছো কেন সত্য?”
“ভুল ভাবছি?”
“সত্য ভাবছো? ”
“জানি না”

আলভি তারপর জড়িয়ে ধরলো সত্যকে। সত্যের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“কষ্ট নিও না। সব ঠিক হয়ে যাবে”

সেদিন রাতে আলভি গভীরভাবে চিন্তা করলো, কীভাবে সত্যের বাবা মাকে এক করা যায়!
#দ্বিরাগমন
#লেখা: Midhad Ahmed
#পর্ব_৪১

“হেলো মা বলছেন?”
“হ্যাঁ। কেমন আছো আলভি?”
“ভালো। সত্য কেমন আছে?”
“একটা খবর জানানোর ছিলো”
“কী খবর?”
“শুনলে আপনি নিজে খুব খুশি হবেন।”
“কী খবর বাবা? বলো”
“একটা কথা রাখবেন আগে?”
“আমি আসলে তোমার কোন কথার মানে বুঝতে পারছি না আলভি। কী সুখবর? কী কথা রাখতে হবে?”
“না আগে বলেন আমার কথাটা আপনি রাখবেন। তাহলে আপনাকে আমি সুখবরটা বলবো”
“আচ্ছা বলো। রাখবো”
“আগে কোনটা বলবো মা? সুখবর নাকি আমাকে ওয়াদা দেয়া কথাটার কথা?”
“ওয়াদা দিলাম কোথায়?”
” না এইযে বললেন, আমায় দেয়া কথাটা রাখবেন। সেটাতো একপ্রকার ওয়াদা না?”

ওপাশ থেকে নুপুর একগাল হাসলো। হেসে হেসে মেয়ে জামাইকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা তুমি ঠিক আছো তো?”
“কেন মা? ঠিক না থাকার কারণ আছে কিছু?”
“না তেমন কোন কারণ নাই। তবে কেমন জানি মনে হচ্ছে আজকে। বিষয়টা কী?”
“না বিষয়টা হলো সুখবর আমি আপনাকে শুনাবো। তারপর আপনি আমার কথাটা মানে আমাকে দেওয়া ওয়াদাটা রাখবেন”
“আচ্ছা বাবা বলো”
“আপনি নানি হতে চলেছেন”
“কী? কী বললা তুমি?”
“হ্যাঁ। যা শুনেছেন তাই। সত্য ইজ নাও প্রেগন্যান্ট ”
“আলহামদুলিল্লাহ। বাবা তুমি সত্যকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসো”
“আমাদের বিয়ের কয় বছর হয়েছে মা?”
“চার বছর”
“সত্য কি ঢাকায় গিয়েছে একবারও?”

নুপুর চুপ করে গেলো। জবাব দেয়ার কোন কিছু খুঁজে পেলো না। নুপুরের চোখ বেয়ে জল নেমে আসলো। আলভি এপাশ থেকে ডাক দিলো,

“মা”
“মা”
শুনছেন…?
“হ্যাঁ বাবা বলো”
“আমাকে আমার কথা রাখার ওয়াদা দিয়েছিলেন না আপনি?”
“হ্যাঁ”
“এখন যে খবর আপনাকে আমি শুনালাম সেই খবরটা কি আনন্দের খবর না?”
“বাবা আমার জীবন তো এখানেই স্বার্থক। আমার মেয়ে সুখী হয়েছে। আমার মেয়ের বাচ্চা দুনিয়ার মুখ দেখবলবে বলে আসার জায়গান জানাচ্ছে। আমার আর কী চাই?”
“এখন আমার কথা রাখতে হবে আপনাকে। আপনাকে চট্টগ্রাম আসতেই হবে”

এমন সময় সত্য রুমে ঢুকলো। আলভিকে জিজ্ঞেস করলো,

“কাকে চট্টগ্রাম আসতে হবে? কাকে?”
“না কাওকে না”
“কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?”

আলভি মোবাইল লুকাতে যাবে সত্য মোবাইল হাতে নিল। মায়ের নাম্বার দেখে সত্য বলতে লাগল
“অহ আচ্ছা, বহুবছর আগের সব সমস্যা মিটমাট করতে লেগেছো? তা হবে না। এগুলো সম্ভব না। আমি বাবাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। আর মা কখনো বাবাকে ক্ষমা করতে পারবে না। যতক্ষণ না বাবাকে মা ক্ষমা না করে আমি অন্তত ততোদিন বাবাকে মেনে নিতে পারবো না। কখনোই না।”

“কিন্তু সত্য…”
“প্লিজ! আমাকে বুঝাতে এসো না আলভি। আমি বাচ্চা মেয়ে না”
“বুঝার চেষ্টা করো…”
“কী বুঝব আমি? বাবা আমাকে জন্মের পর মেয়ে বলে মেনে নেননি। আমার মা আমাকে কষ্ট করে বড় করেছেন। মায়ের অভিমান ভরা মন এখনও খা খা করছে। এসব ভুলবো আমি? এসব ভুলে যাবো? তুমি বলছো আমাকে ভুলে যেতে?”

আলভি জবাব দিলো না। কল কাটা হয়নি ভুলে ভুলে। নুপুর সব কথা শুনতে পায়। নুপুরের চোখ বেয়ে জল নামে। মুখ ফেটে কান্না করতে ইচ্ছে হয়। তবুও নিজেকে চাপা আর্তনাদে চেপে রাখে। কোন কথা বলে না। দরজার বাইরে দিয়ে সুলতানা যাচ্ছিলো। সালমানকে ডেকে এনে সব শুনায় সুলতানা। সালমান সহ্য করতে পারে না। সালমান অস্থির হয়ে যায় এসব শুনে। সুলতানা সালমানকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সত্য আর আলভি সালমান আর সুলতানার রুম থেকে চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। সুলতানা চিৎকার দিয়ে ডাকে,

“আলভি…
“আলভি….
“আলভি….
“সত্য তাড়াতাড়ি আয়….

আলভি সত্য তাড়াতাড়ি তাদের রুমে গেলো। গিয়ে দেখে সালমান কেমন জানি করছে। সুলতানা পাশে বসে কান্না করছে। সত্য হাতের পালস রেট দেখে আলভিকে বলল,
“তাড়াতাড়ি আমাদের হসপিটালের এম্বুলেন্স কে কল করো। আর এয়ার এম্বুলেন্স এর জন্য হসপিটালের এমডিকে ইনফোর্ম করো। ওনার হার্ট স্ট্রোক হয়েছে। অবস্থা ভালো না”
“কিন্তু…”
“না কোন কিন্তু না। এয়ার এম্বুলেন্স রেডি করতে করতে আমরা ওনাকে নিয়ে হসপিটালে চলে যেতে হবে। অক্সিজেন সাপ্লাই কম। অক্সিজেন দিতে হবে জলদি জলদি”

সত্য এমন সময় খেয়াল করলো সালমান তার হাত চেপে ধরেছে। ফেলফেল চোখে তাকিয়ে আছে সত্যের দিকে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না

সত্য সেদিকে খেয়াল করল না। আলভি বললো,
“ঢাকায় নিতে হবে”
“হ্যাঁ। তাইতো এয়ার এম্বুলেন্স বলছি”
“তুমি তো…”
“আমি কী? অসুস্থ? সমস্যা নাই। আমি যা বলছি তাড়াতাড়ি করো আলভি। প্লিজ”

সালমান আরও শক্ত করে চেপে ধরলো সত্যের হাত। সুলতানা কান্না করছে। আলভি এম্বুলেন্স কল দিলো। এমডিকে বললো, এয়ার এম্বুলেন্স রেডি করতে
#দ্বিরাগমন
#লেখা: Midhad Ahmed
#পর্ব_৪২
#শেষ_পর্বের_আগের_পর্ব

রাত এগারোটা বেজে এগারো মিনিট। সালমানকে আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুলতানা সত্যকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। সত্য জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। আলভি সত্যের মাকে কল দিলো। নুপুর কল রিসিভ করতেই আলভি বলল,

“মা আপনি হেলথ কেয়ার হসপিটালে চলে আসেন এক্ষুণি”
“কেনো? কী হয়েছে? সত্যের কী হয়েছে? সত্য কোথায়?”
“না মা। সত্যের কিছু হয়নি”
“তাহলে কার কী হয়েছে? কী হয়েছে আলভি?”
“বাবা অসুস্থ।”

ওপাশ থেকে ধপাশ করে কীসের শব্দ এলো। আলভি এপাশ থেকে দুইবার ডাক দিলো মা মা বলে। কোন উত্তর আসলো না ওপাশ থেকে। আলভি ভয় পেয়ে গেলো। ওপাশে কী হলো সে আন্দাজ করতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ড পর ওপাশ থেকে একটা মেয়েকন্ঠ ভেসে এলো। সে বলছে,

“কী হয়েছে মা? মাটিতে বসে আছো কেনো? মা? কথা বলো। কী হয়েছে তোমার?”

আলভি বুঝতে পারলো শাশুড়ি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গিয়েছেন। আলভি কল কেটে আবার কল দিলো। এবার কল ধরলো সিন্থিয়া। আলভি বললো,

“আমি সত্যের হাজবেন্ড। আমি একটু আগে মাকে কল দিয়েছিলাম। মা কোথায়?”
“মা মাটিতে বসে কান্না করছেন। আমি কোনকিছু বুঝে উঠতে পারছি না। কী হয়েছে মায়ের?”
“বাবা হসপিটালে ভর্তি। অসুস্থ। মাকে এই খবরটা দিয়েছিলাম। তুমি কি মাকে নিয়ে হেলথ কেয়ার হসপিটালে আসতে পারবে?”
“হ্যাঁ। আমি কল রাখছি”

এই বলে সিন্থিয়া কল রেখে দিলো। নুপুরকে ধরে বিছানায় তুললো। নুপুরের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। অবসন্নতার ছোপ মুখে। এদিকে সত্য নিথর পাথর হয়ে চেয়ারে বসে আছে। পাশে বসা সুলতানার চোখ বেয়ে কান্না পড়ছে। কী হবে কেউ জানে না।

কিছুক্ষণের মাথায় সিন্থিয়া নুপুরকে সাথে করে হেলথ কেয়ার হসপিটালে চলে আসলো।

নুপুরকে দরজার সামনে দেখতে পেয়ে সত্য দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সুলতানা সত্যের পেছনে পেছন গিয়ে নুপুরের সামনে দাঁড়ালো। নুপুর সুলতানাকে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। নুপুরের কান্না দেখে আশেপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে গেলো। সবাই চাওয়াচাওয়ি করছে তাদের দিকে। নার্স একজন এসে আলভিকে বলল,

“হসপিটালে আরও রোগী আছেন। অন্যরা হাইপার হয়ে যাবে এভাবে এগুলো দেখে”
“আই এম সরি”
“না না। সরি না। আপনি কাইন্ডলি তাদেরকে কান্না থামাতে বলেন। কিচ্ছু হবে না ওনার”
“হ্যাঁ বলছি”

নার্সের কথায় আলভি গিয়ে সুলতানাকে ধরলো। চেয়ারে এনে বসালো। সত্য নুপুরকে ধরে এনে বসালো চেয়ারে। নুপুর সত্যকে জিজ্ঞেস করল

“কী এমন হয়েছে রে মা?”
সত্য জবাব দিলো না। জড়িয়ে ধরলো মাকে। সুলতানা আলভিকে বলল,
“বাবা আমাকে পানি এনে দে”

আলভি পানি এনে দেয়ার আগেই সিন্থিয়া তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে সুলতানার হাতে দিলো। এই প্রথম সুলতানা তাকালো সিন্থিয়ার দিকে। নুপুর ইশারায় বলল,
“তারানার মেয়ে”

সুলতানা পানির বোতল না নিয়ে সিন্থিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর নার্স এসে বলল,

“আইসিইউর 303 নাম্বার বেডে আপনাদের রোগী?”
আলভি বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ।”

সুলতানা পাশ থেকে বলল,
“কী হয়েছে? কী হয়েছে রোগীর?”

নার্স আলভিকে ইশারায় সামনে আসতে বলল। আলভি হাঁটা শুরু করলে সুলতানাও আলভির পেছন পেছন যেতে শুরু করে। সত্য পথ আগলে হাতে ধরে বসে সুলতানার। সুলতানা বলল,
“কী হয়েছে? আমাকে যেতে দে। আমাকে যেতে দে”
“না। এখানে বসো”

আলভি সামনে চলে গেলো। নুপুর চেয়ারে বসে বিলাপ করছে এক নাগাড়ে। আর মুখ দিয়ে বলছে,
“কিচ্ছু ঠিক নেই। কিচ্ছু না। কোন ঠিক নেই”

সুলতানা এসে নুপুরের পাশে বসে বলল,
“কী হয়েছে? কী ঠিক নেই?”
নুপুর আবারও জড়িয়ে ধরলো সুলতানাকে। সিন্থিয়া আর সত্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে শুধু। সিন্থিয়ার চোখ দিয়ে এবার টপটপ করে পানি ঝরছে। সিন্থিয়া গিয়ে নুপুরের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“মা কান্না করো না। প্লিজ। তোমার প্রেসার হাই হয়ে যাবে”

এই প্রথম সত্য সিন্থিয়াকে নতুন রূপে আবিষ্কার করলো। নুপুর সিন্থিয়ার নিজের মা না হলেও, মুখ ভরে নুপুরকে যে মা ডাকছে সিন্থিয়া সেটা সত্য অনুভব করলো গভীর ভাবে।

নার্স আলভিকে বলল,
“রোগীর অবস্থা ভালো নেই। ওনাকে বেডে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। আমাদের হাতে আর কোনকিছু করার নেই”
“মানে? হুয়াট আর ইউ সেয়িং?”
“উই আর সরি!”
#দ্বিরাগমন
#মিদহাদ_আহমেদ
#পর্বঃ৪৩_অন্তিম

সালমান মারা গেলো। নিস্তব্ধতা ভর করে বসলো গোটা পরিবেশে। সন্ধ্যার আজান হলো ঠিক এমন সময়ে। আজানের সাথে কান্নার শব্দ, ভারী করে তুললো গোটা পরিবেশকে। নুপুর জ্ঞান হারালো। নার্স নুপুরকে এডমিট করতে বললো হসপিটালে। আলভি নিজেকে সামাল দিলো। শক্ত করে রাখল। নুপুরকে স্যালাইন পুশ করা হলো। সিন্থিয়া কান্না করছে সুলতানা ধরে। সুলতানার আকাশ-পাতাল ভারী করা কান্না ভারাক্রান্ত মনে সবার চোখে জল চলে আসলো। সত্য চুপিচুপি কেভিনে গেলো। সালমানের হাতে নিজের হাত চেপে ধরলো। অল্প শব্দে বলল,
“বাবা”
“বাবা দেখো তোমার মেয়ে এসেছে”
“বাবা”
“বাবা বলে ডেকেছি তো! দেখবে না?”
“বাবা অইযে বলেছিলে না তোমাকে বাবা বলে ডাকবো, ডাকছিতো এখন। বাবা কী হলো? কথা বলো। তোমার সত্য তার বাবাকে বাবা বলে ডাকেনি কখনও! রাগ করেছো বুঝি? বাবা? ও বাবা?”

আলভি রুমে ঢুকল। সত্যকে জড়িয়ে ধরলো আলভি। সত্য আলভির কলারে চেপে ধরে আলভিকে জিজ্ঞেস করল,
“আলভি বাবা কথা বলছে না কেন? আলভি?”
“আর কখনো বাবা কথা বলবে না।”

একথা বলেই আলভি সত্যকে ধরে কান্না শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ পর আলভি নিজেকে সামাল দিল। সত্য প্রেগন্যান্ট। তাকে মানসিক স্থির রাখতে হবে। নার্স এসে বলল,
“রুম নাম্বার ৮০৩ তে যিনি আছেন, ওনার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ওনি সত্য সত্য বলে ডাকছেন। সত্য কে?”

আলভি পেছন ফিরে তাকালো। আলভি হাত ধরলো সত্যের। সত্যকে নিয়ে নুপুরের রুমে ঢুকল। নুপুরের জ্ঞান ফিরেছে। সত্য কাছে যেতেই নুপুর হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। সত্যও মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো।

লাশ পরেরদিন দাফন করা হলো চট্টগ্রামে। একসাথে সাদা শাড়ি পরলো নুপুর আর সুলতানা। লাশ নিয়ে যাবার আগে, অপলক ভাবে সুলতানা আর সত্য সালমানের লাশের পাশে বসা ছিলো। চট্টগ্রামের মানুষজন আশেপাশে যারা থাকতো তারা নুপুরকে চিনতো না। এই অবস্থা দেখে তারা অবাক হয়। কেউকেউ কানাঘুষা করতে থাকে। নুপুর একবার চিৎকার করে উঠে বলে,
“সালমান আমার স্বামী! আমি সালমানের ছোট বউ। আমি স্বীকার করছি।”

কয়েকদিন স্থবিরতা চেপে ধরলো গোটা পরিবারে। নুপুর আর সিন্থিয়া চট্টগ্রামেই আছে। এর মধ্যে সিন্থিয়া আসিফ আর নুসরাতের একটা স্ক্যান্ডাল খুঁজে পায়। সিন্থিয়া ও আসিফের ব্রেকাপ হয়ে যায়।

(কেটে গেলো দশটা বছর।)

“মা আমি স্কুলে যাবো না”
“কেনো বাবা? উঠ তাড়াতাড়ি”
“না যাবো না যাবো না যাবো না”
“মানে? কেন যাবা না বাবা? আমার ভালো ছেলে না তুমি?”
“না আমি আজকে নানুর বাসায় যাবো। নানুর বাসায় যাবো।”
“উহু! যাবো তো। না করেছি আমি?”
“না। আমি আজকে স্কুলে যাবো না।”

আলভি এসে পেছন থেকে সত্যকে বলল,
“ছেলে যাবে না বলছে যাক না। সমস্যা কী?”
সত্য চোখ বড়বড় করে আলভির দিকে তাকালো। তারপর জিসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই ছেলে বাবার মতো হবা না”
“হবো। আমি আমার বাবার মতো হবো”
“মানে?”
আলভি গিয়ে জিসানকে ধরে বললো,
“মানে আমার জিসান তার বাপ আলভির মতো হবে”

পেছন থেকে বিছানায় বসে বসে তানিশা আধগলায় বলল,
“আমি আমাল আব্বুল মতো অববো”

আলভি বিছানায় গিয়ে ছোট্ট তানিশাকে কুলে নিলো। ভেংচি কেটে সত্যকে বললো,
“দেখলা? আমার জিসান আর তানিশা দুইটাই আমার মতো হতে চায়। তাদের বাবার মতো”

“ধুত্তুরি ছাই। পেটে ধরলাম আমি আর এখন ছেলে মেয়ে বাপের মতো হতে চায়। বুঝিনা বাপু”

“বুঝবে না বুঝবে না। রেডি হয়ে নাও আমি শাশুড়ির রান্না করা পোলাও খাবো। আমার লোভ আর সইছে না”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। শাশুড়িও পেয়েছো এমন!”

দুপুরে সত্য,আলভি,জিসান আর তানিশা সবাই নুপুরের বাসায় চলে গেলো। একটু পরেই হুজুর আসবেন। আজকে সালমানের নবম মৃত্যুবার্ষিকী। তারানা তানিশাকে কোলে নিলো। তানিশা আধগলায় তারানাকে বললো,
“আচ্ছা নানি, আমার নানি কয়জন?”
সুলতানা হাসলো। একগাল হেসে তানিশাকে নিজের কোলে নিয়ে বলল,
“তিনজন”
তারানা বলল,
“না না। আমি, আমি তোর নানি।”
“তাহলে ওই বুড়িটা কে?”
“কোন বুড়ি?”
“অইযে রান্নাঘরে হাড়িতে টুংটুং করছেন যিনি”

রান্নাঘরে নুপুর ছিলো। শব্দ করে বললো,
“এই, কে আমাকে বুড়ি বলে?”

এইটা শুনেই তানিশা দৌড় দিলো। নুপুর খাবার রুমে আসতে না আসতে তানিশা গিয়ে সুলতানার শাড়ির আচল ধরে বসলো। আচল ধরে লুকিয়ে বলল,
“নানি নানি, ওই বুড়ি নানি আমাকে ধরতে এসেছে”

সত্য চোখ রাঙালো। নুপুর ঝাপটে ধরলো তানিশাকে। কলিংবেল বেজে উঠলো। তারানা আলভিকে বলল,
“হুজুর এসেছেন মনে হয়, বাবা দরজাটা খুলে যাও”

আলভি দরজা খুলতেই দেখল দরজার বাইরে সিন্থিয়া আর তার জামাই দাঁড়ানো। সাথে তাদের পাঁচ বছরের ছেলে দিগন্ত। সিন্থিয়া হাসি এনে আলভিকে বলল,
“বাহ! দুলাভাই দেখি আগে আগে চলে এসেছো”
“হ্যাঁ। শালীকে বরণ করবো তো তাই”
“আচ্ছা আচ্ছা। চলেন ভেতরে”

সিন্থিয়ার হাজব্যান্ড আর আলভি দুজনে বসে ড্রইংরুমে গল্প করতে বসলো। সিন্থিয়া এসেই রান্নাঘরে গেলো। ব্যাগ থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি বের করে নুপুরকে পরিয়ে দিয়ে বলল
“মা এইটা তোমার জামাই এনেছে আমেরিকা থেকে। তোমার জন্য”
“এসবের কী দরকার ছিলো মা?”
“দরকার ছিলো। বড় মা কোথায়?”

পেছন থেকে সুলতানা বলল,
“এইযে আমি এখানে”
সিন্থিয়া জড়িয়ে ধরলো সুলতানাকে। আরেকটা ডায়মন্ড আংটি বের করে পরিয়ে দিল সুলতানাকে। তারপর নিজের মা তারানাকে জড়িয়ে ধরলো সিন্থিয়া। মায়ের জন্যও একই আংটি আছে এইটা বলে পরিয়ে দিল। তারানা বলল,
“বাহ রে, আমার একার জন্য?”
“কেন? তোমাদের তিনজনের জন্যই তো আনলাম”
“আর আমার তানিশা? আমার নাতনি?”

সিন্থিয়া এক গাল হাসলো। হেসে হেসে বলল
“খালা তার বোনজির জন্য যা এনেছে তা এনেছে। তোমার ভাবতে হবে না”

তানিশা এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সিন্থিয়াকে বলল,
“আমার জন্য কী এনেছো মনি?”
“অলে বাবালে! বাবু তোমার জন্য এই ব্রেসলেটটা এনেছি খালামনি। এদিকে আসো। এদিকে আসো”
“কী সুন্দল এইটা”
“ওলে বাবুটা আমার”

হুজুর আসলেন কিছুক্ষণ পর। দোয়া করলেন। চলে গেলেন। সন্ধ্যায় সিন্থিয়াও চলে গেলো। আলভির সকালে মেডিকেলে ডিউটি আছে। সেও চলে গেল। সত্য রইলো। রাতে মায়ের সাথে বিছানায় শুয়ে আছে সত্য। নুপুর সত্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“জীবন কত ব্যতিক্রম তাই নারে মা?”
“হ্যাঁ। ”
“কখনো চিন্তা করতে পেরেছিলাম তোর দাদা দাদি (সিলেটে যাদের কাছে সত্য-নুপুর ২৫ বছর ছিল) এক্সিডেন্টে মারা যাবে? আজ তারা নেই চার বছর হতে চললো”
“হ্যাঁ মা। জীবন কত সহজে বদলে যায়”
“তারপর সিন্থিয়ার বিয়ে হলো। তারানার সাজা কমলো। আমার সেই আগের জীবন আবার আগের মতো ফিরে এল। এখন এই একলা একা ঘরে থাকতে ভালো লাগে নারে”
“কেনো মা?”
“কোথাও কোথাও যেনো কী একটা নেই।”

সত্য মাকে জড়িয়ে ধরলো। নুপুরের চোখের কোণে জল জমেছে। নুপুর সত্যকে বললো,
“দ্বিরাগমনে তুই আসিস নি। একেবারে চলে আয় না মায়ের কাছে?”
সত্য জবাব দিলো না মায়ের কথার। শব্দ ছাড়া শুনলো শুধু। এর ঠিক সতেরো বছর পর, আজ আবার তানিশার দ্বিরাগমন হতে চলেছে। যে বাড়িতে মায়ের দ্বিরাগমন হয়নি, নুপুরের মেয়ের দ্বিরাগমন হয়নি, সেই একই বাড়িতে আজ নুপুরের নাতনি ও সত্যের মেয়ের দ্বিরাগমন হতে চলেছে।

সত্যের চুলে পাক ধরেছে। গায়ে সাদা শাড়ি উঠেছে। তানিশার গায়ে লাল বেনারসি। নুপুর, সুলতানা, তারানা তিনজনের বয়স হয়েছে। সুলতানা হুইল চেয়ারে বসা। তানিশা দ্বিরাগমনে এসে সত্যকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে কর‍তে বলল
“আজ বাবাকে ভীষণ মনে হচ্ছে মা”
সত্য নিজেকে সামলে নিয়েছে। মেয়ের দ্বিরাগমনের দিনে কান্না করলে চলবে না।
যুগ পালটায়, সম্পর্কে নতুন মোড় আসে। কেউ বুড়ো হয়, কেউবা চিরতরে চলে যায়। বেড়াজালে আবদ্ধতায় সম্পর্ক তার আপন গতিতে চলে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, এমনই এক দিনে ইন্টার পড়ুয়া এক ছাত্রী সালমানের পাঁচ নাম্বার বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিলো। জীবন পালটায়। আজ আবার এই বাড়িতে নুপুরের নাতনির দ্বিরাগমন হচ্ছে।

_________________সমাপ্ত_________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here