#ধোয়ার-নেশা
#রোকসানা-রাহমান
পর্ব (১৬)
“” আপু আপনার পত্রীকন্যা নয়। আপনার সাথে আপুর যা হয়েছে তার জন্য সে লজ্জীত,অনুতপ্ত। অনুতপ্তের আগুনে আপু নিজেকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছে। আপুকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন!””
অন্ত্রীশার কথাই পালকের সবকিছু থমকে গিয়েছে। না সবকিছু থমকে যায়নি,শুধু সে থমকে গেছে,আর বাকিসব তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে,যদি অনিকশা তার পত্রীকন্যা না হয় তাহলে তার পত্রীকন্যা কে?
পালক রাগে ফুসতে ফুসতে অনিকশার নাম্বারে কল দিয়েছে,অপাশ থেকে রিসিভ হতেই পালক চিৎকার করে বললো,
“” আমি তোমাকে এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। রাইট নাউ!””
অনিকশা অরিদ্রাকে ঘুম পাড়িয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাড়িয়েছিলো। অরিদের সাথে সবসময় বিরক্ত হয়ে কথা বললেও সে জানে মনে মনে কখনো চাইনি অরিদ তার থেকে দুরে থাক। এতো সরলসোজা মানুষটার ভেতরে অসীম ভালোবাসা অনিকশাকে খুব টানে। এই জন্যই হয়তো অরিদকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবতে পারেনি। নাহলে এমন নিরামিষ বিবাহিত জীবনে থেকে কি লাভ? মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় ওর ভালোবাসার সমুদ্রে একটু গোসল করে নিতে। কিন্তু সে পারেনা।
অরিদের সাথে অনিকশার তিক্ত আচরনগুলো কতটা তিক্ততা বহন করে সেটাও জানে অনিকশা। হয়তো অরিদের জায়গায় অন্য কেউ হলে কবেই ওকে রেখে ছেড়ে অন্য কোনো নারীতে আসক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু অরিদ? ও অনিকশাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের নাম জানে নাকি সেটাও সন্দেহ আছে অনিকশার।
আজ সারাদিনে একবারও কথা হয়নি অরিদের সাথে। কল দেয়নি তা নয়। অন্ত্রীশার সাথে কথা হওয়ার পর থেকে মনটা কেমন আনচান আনচান করছিলো তাই কল রিসিভ করেনি অনিকশা। নিশ্চয় ছেলেটা মন খারাপ করে বসে আছে,হয়তো চোখগুলোও ভিজিয়ে ফেলেছে। এই মাঝরাতে অরিদকে কল দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলে ব্যাপারটা মন্দ হয়না।
অনিকশা ঠোটে হালকা হাসি নিয়েই রুমের দিকে পা বারিয়েছিলো,উদ্দেশ্য অরিদকে কল দেওয়া। কিন্তু রুমে পা ফেলতেই নিজের ফোন বেজে উঠে। অরিদের কল ভেবে ফোন হাতে নিতেই অনিকশা বেশ চমকিত,এত রাতে পালকের কল? কোনো প্রভলেম হয়নি তো? অন্ত্রীশা কোনো ঝামেলা করে বসেনি তো? নানা কুভাবনা অনিকশাকে ঘিরে নিতেই পালকের কলটা কেটে গিয়েছে। অন্ত্রীশা কল ব্যাক করবে নাকি দ্বিধায় ভুগতেই পালক পুনরায় কল দিয়ে বসে। অনিকশা সাথে সাথে কল রিসিভ করতেই পালক বলে উঠলো,
“” আমি তোমাকে এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই অনিকশা। রাইট নাউ!””
পালকের এমন উৎকন্ঠে অনিকশা কেঁপে উঠেছে। পালকের সাথে সে একটা বছর সময় কাটিয়েছে। এই একটা বছরে পালককে এমন কন্ঠে কথা বলতে দেখেনি অনিকশা। তবে কি সত্যি সত্যি অন্ত্রীশার সাথে পালকের কিছু হয়েছে? নাকি অন্যকিছু?
“” তুমি কি পাগল হয়ে গেছো পালক? এখন কয়টা বাজে খেয়াল আছে? এতো রাতে আমি তোমার কাছে কেন যাবো? তার উপর অরিদও বাসায় নেই। তুমি কি তোমার হিতাহিত বুদ্ধী খেয়ে ফেলেছো?””
“” কি খেয়েছি আর কি খাইনি সেটা তোমার না জানলেও হবে। তুমি আসবে নাকি তাই বলো।””
“” it’s not possible!””
পালকের মাথা কাজ করছেনা। মনে হচ্ছে মাথাটা খুলে নিয়ে আছার মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। এটা কি করে সম্ভব? অনিকশা যদি পত্রীকন্যা না হয় তাহলে পত্রীকন্যা কে? আজ এতো বছর ধরে যাকে পত্রীকন্যা ভেবে ভালোবেসে এসেছি অথচ এখন কিনা সে আমার পত্রীকন্যাই না? তারমানে এতোদিন আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবেসে এসেছি? অন্য একটা মেয়েকে দেখে চোখ জুড়িয়েছি? অন্য একটা মেয়ের হাসিতে হাসি মিলিয়েছি? অন্য একটা মেয়ের আবদার রেখেছি? অন্য একটা মেয়ের পায়ে পা মিলিয়ে চলেছি? অন্য একটা মেয়ের সাথে সারারাত প্রেমালাপ করেছি? উফ! এতো বড় ভুল আমি কি করে করলাম? আমি আমার পত্রীকন্যার ভালবাসা অন্যকে দিয়েছি। এতো বড় অবিচার আমি কি করে করেছি? আমার পত্রীকন্যা কি আমাকে কখনো ক্ষমা করবে? না,কখনোই করবেনা। আর করা উচিতও নয়। ছি! ছি!!
পালক নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,এই হাত দিয়ে আমি ওকে কতবার ছুয়েছি। ছি! আমি অপবিত্র করে ফেলেছি আমার পবিত্র ভালোবাসাকে। পালকের ইচ্ছে হচ্ছে,জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পত্রীকন্যাকে জানাতে,সে কলঙ্কিত হয়ে গেছে,ভুল করে একটা পরনারীকে সে ভালোবেসে কলঙ্কিত হয়ে গেছে। কিন্তু সেতো চাইনি এভাবে কলঙ্কিত হতে,সেতো চেয়েছিলো তার পত্রীকন্যার ভালোবাসায় কলঙ্কিত হতে!
পালক সারারাত বারান্দায় কাটিয়ে দিয়েছে। ফযরের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই পালকের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। একটু নাড়া দিয়ে উঠতেই নিজেকে বেলকনির মেঝেতে আবিষ্কার করে। তার জীবনের এতো গুলো নির্ঘুম রাতের মধ্যে এটি ছিলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট নির্ঘুম রাত।
“” এভাবে বাইরে গেলে,মানুষ আপনাকে পাগল বলে ক্ষেপাবে,ইটের টুকরোও নিক্ষেপ করতে পারে। একটু পরিপাটি হয়ে যান।””
অন্ত্রীশার কথায় পালক পেছনে তাকাতেই অন্ত্রীশাকে জায়নামাজ ভাজ করতে দেখতে পাচ্ছে। অন্ত্রীশা জায়নামাজটা রেখে বিড়বিড় করতে করতে পালকের কাছে এসে দাড়িয়েছে। পালকের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে বুকে তিনবার ফু দিয়ে দিয়েছে।
অন্ত্রীশা ঠোটে মিস্টি হাসি নিয়ে বললো,
“” আল্লাহ আপনাকে ধৈর্য্য দান করুক।””
পালক অন্ত্রীশার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চলে যেতে নিলে অন্ত্রীশা ডেকে উঠে,
“” শুনুন!””
“” হুম।””
“” যে ব্যক্তি নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত তাকে ক্ষমা করে দেওয়াই শ্রেয়। কেননা ১০০টা ভুলকারীর মধ্যে ১ জনকেই পাবেন যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে,অনুতপ্ত হয়। আর বাকি ৯৯জনই শাস্তি ভোগ করলেও নিজের ভুল বুঝার ক্ষমতা রাখেনা। আমি মনে করি, একজন অনুতপ্তকারীকে ক্ষমা না করে শাস্তি দেওয়া মহাপাপ। আমি জানি আপনি সেই মহাপাপীর অংশীদারী হবেননা।””
পালক আর অনিকশা দুজন দুজনার মুখোমুখি বসে আছে। রেষ্টুরেন্টটা তাদের খুবই পরিচিত। এখানের চিলি স্যুপটা অনিকশার খুব পছন্দের হওয়ায় প্রায়ই তাদের এখানে আসা হতো। তার উপর ভার্সিটিরও খুব কাছে হওয়ায় ক্লাস শেষেই এখানে দুজন নানান গল্পে মেতে উঠতো। ভাবতেই পালকের গা গুলিয়ে উঠছে। ইচ্ছে করছে এখনি গলায় আঙুল ঢুকিয়ে পেটের ভেতর থেকে সব স্যুপ বের করে ফেলতে। ছি! একটা পরনারীর হাতে আমি স্যুপ খেয়েছি! চিলি স্যুপের জায়গায় ওটা বিষ স্যুপ কেন হয়ে যায়নি,তার পত্রীকন্যার হাত ছাড়া অন্য নারীর হাতে খাওয়াতো তার কাছে বিষের সমতুল্য। শুধু নিজে বমি করলে হবেনা অনিকশাকেও বমি করাতে হবে। ওর পেটের সবগুলে স্যুপ তো সে নিজেই আয়েশ করে খায়িয়ে দিয়েছে। আঙুল কি আমারটা ডুকাবো নাকি ওরটা। ছি!ছি!! আমি আমার আঙুল কেন ওর গলায় ঢুকাতে যাবো? ও নিজের আঙুলটাই ব্যবহার করুক।
অনিকশাকে দেখে পালক যতটা না রেগে যাচ্ছে তার থেকেও বেশি ঘেমে যাচ্ছে অনিকশা। কি এমন বলবে পালক সেই ভাবনায় সেও সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ওতো রাতে আসা সম্ভব না ভেবে সকালে দেখা করতে রাজি হয়েছিলো অনিকশা।
পালকের সাইলেন্ট মুডটা অনিকশাকে যেন আরো বেশি ঘামিয়ে তুলছে। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম চোখের কর্নারের পাশ ঘেষে,গাল বেয়ে গলার দিকে নেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরের থাকা সব পানি আজ ঘাম হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। গলাটাও শুকিয়ে আসছে,তাহলে কি তার হঠাৎ করে পানিশুন্যতা দেখা দিচ্ছে???
“” পানিটা খেয়ে নাও।””
পালকের এগিয়ে দেওয়া গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিয়েছে অনিকশা। খালি পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখতে গিয়ে কিছুটা শব্দ হয়েছে। সামান্য শব্দটাও অনিকশার কাছে বোমা মারার মতো শব্দ মনে হয়েছে। অতি টেনশনে কি সে পানির গ্লাসকে বোম বানিয়ে ফেলেছে???
পালক সাদা ঝকঝকে খালি কাচের গ্লাসটাই পুনরায় পানি ভর্তি করে অনিকশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“” এখনো তো কিছু বললামই না,তাই এ অবস্থা? বলা শুরু করলে তো দেখছি তোমার পানির টাংকি শেষ করতেও এক মিনিট লাগবেনা।””
অনিকশা পানিভর্তি গ্লাসটা নিতে গিয়েও থেমে গিয়েছে। পালকের দিকে তাকাতেই ঘামগুলো ছোট ছোট বিন্দু থেকে বড় বড় বিন্দুতে রুপান্তর হতে শুরু করে দিয়েছে।
“” কি বলবে তুমি?””
“” পানিটা শেষ করো তারপর বলছি। নাহলে দেখা যাবে পানিশূন্যতায় তুৃমি অজ্ঞান!””
অনিকশা পানির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ক্ষীনস্বরে বললো,
“” আমি ঠিক আছি,পালক। তুমি বলো!””
“” তুমি কে?””
“” আমি কে মানে?””
“” তুমি কি আমার পত্রীকন্যা?””
পালকের মুখে পত্রীকন্যা নামটা শুনেই অনিকশার সবকিছু আউজাঝাউলা শুরু হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে তুফানের তীব্র প্রবলতায় ভয়েরা সাড়া দিচ্ছে। এই প্রথম পালকের মুখে এ নামটা শুনছে তা নয়। অসংখ্যবার শুনেছে সে। কিন্তু কখনোই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি অনিকশার! তবে কি পালক সব জেনে গিয়েছে? কিন্তু কিভাবে? এ ব্যাপারটা তো আমি ছাড়া আর কারো জানার কথা না। তাহলে কি অন্ত্রীশা? সেটা কিভাবে সম্ভব? আমি ওকে যা বলেছি তার মধ্যেতো আমি একবারও পত্রীকন্যাকে নিয়ে কিছু বলিনি। তাহলে? তাহলে কি ও আমার মনের ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড়ের শব্দ পেয়েছিলো? কিভাবে? বোন হয় বলে তাই? হতেও পারে,বোন হয়ে যদি বোনের মনের কথা পড়তে না পারে তাহলে কিসের বোন?
পালক কিছুটা চিৎকার করে বললো,
“” কি হলো বলছোনা কেন?””
পালকের প্রশ্নে অনিকশা কেঁপে উঠলেও ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। নিয়তি আজ তাকে সত্যের মুখোমুখি এনেছে। আজ সে বলবে,সব সত্যি বলবে। আর কারো জন্য না হোক তার অরিদের জন্য বলবে। এই এক অনুতপ্ততার জন্য অরিদকে আমি আর দুরে ঠেলে রাখতে পারবোনা। কিছুতেই না। ও যে অপেক্ষায় আছে আমার বুকে ওর জন্য বয়ে যাওয়া ভালোবাসার ঢেউ দেখার আশায়!
অনিকশার এই চুপ করে থাকাটা পালক আর সহ্য করতে পারছেনা। রাগে পুরো শরীর ফেটে যাচ্ছে। পালক উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করে বললো,
“” অনিকশা,তুমি কি কিছু বলবে নাকি আমি সব গুড়িয়ে ভেঙে ফেলবো!””
পালকের ঢিল মারা পানিভর্তি সাদা কাচের গ্লাসের টুকরো হয়ে যাওয়া শব্দে অনিকশা বাস্তবতায় ফিরে এসেছে।
অনিকশা আহত আর ভীত কন্ঠে বললো,
“” না,আমি তোমার পত্রীকন্যা নই!””
পালক দাড়িয়ে থেকেই অন্ত্রীশার দিকে ঝুকে এসে বললো,
“” তাহলে কে আমার পত্রীকন্যা??? কোথায় সে? I need her.””
“” আমি জানিনা,পালক। তোমার পত্রীকন্যা কে? কোথায় থাকে আমি কিছু জানিনা।””
পালক অনিকশার কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেনি। পুরো পাগলের মতো টেবিলে থাকা সবকিছু ফেলে দিয়েছে। নিজের চেয়ারটায় লাথি মেরে অনিকশার কাছে এসে বললো,
“” তুমি মিথ্যে বলছো অনিকশা। আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি জানো আমার পত্রীকন্যা কোথায়!””
পালকের পাগলামী দেখে অনিকশা কেঁদে ফেলেছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
“” আমার মেয়ের কসম,আমি জানিনা। আমি সত্যিই জানিনা তোমার পত্রীকন্যা কে!””
পালক আর অনিকশার কান্ডে রেষ্টুরেন্টে উপস্থিত সকলেই হতভম্ব। সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসেই উপভোগ করছে। এমন একটা ভাব যেন এ রকম ঘটনা প্রায়শই ঘটে। খুবই নরমাল ব্যাপার। কিন্তু সকলে উপভোগ করলেও বেশ বিরক্ত নিয়ে রেষ্টুরেন্টের ম্যানেজার এগিয়ে আসেন।
“” Any problem,sir?””
পালক অনিকশার কাছ থেকে সরে নিজের চেয়ারটাতে বসতে বসতে বললো,
“” No, আপনাদের ক্ষতিপুরনটা বিলের মধ্যে এড করে দিবেন,প্লিজ। And sorry for what happened! “”
ম্যানেজার এক আন্তরিকতার হাসি দিয়ে চলে গেলেই পালক অনিকশার দিকে তাকিয়েছে,
“” তাহলে তুমি আমার প্রপোজালে রাজী হয়েছিলে কেন?””
অনিকশা এতোটাই ভয় পেয়েছে যে তার কান্নার সাথে হিচকি উঠে গিয়েছে। পালকের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা। চোখ দিয়ে অনরবত পানি পড়ছে।
পালক ওয়েটারকে দিয়ে আরেকটা গ্লাস আনিয়ে নিয়েছে। গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে অনিকশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“” পানিটা খেয়ে স্বাভাবিক হও। আমি সবটা জানতে চাই। আর তোমাকে বলেই যেতে হবে।””
অনিকশা পানি দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে বললো,
“” সেসময়টাই ভার্সিটির প্রত্যেকটা মেয়ে তোমার উপর ফিদা। আর এই ফিদা বয়টি আমাকে হুট করে তাও পুরো ভার্সিটির সকলের সামনে আমাকে প্রপোস করেছে দেখে আমি এতোটাই খুশি হয়েছিলাম যে কিছু না ভেবেই এক্সেপ্ট করে ফেলি।””
“” একটা ছেলে তোমাকে প্রপোস করলো আর তুমি সাথে সাথে এক্সেপ্ট করে নিলে? সে কেন প্রপোস করেছে এটা জানার প্রয়োজনবোধ করলে না?””
“” তখন মাথায় এগুলো কাজ করছিলোনা।””
“” ওকে ফাইন। মানলাম তখন তুমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে সব গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছো। কিন্তু তারপর যখন তুমি আমার সাথে মিশেছিলে তখনোও কি বুঝতে পারোনি আমি তোমাকে পত্রীকন্যা ভেবে ভালোবাসছি?””
“” হুম,কিন্তু তখন তোমার ভালোবাসা,কেয়ারিং,দায়িত্ববোধ,তোমার ছোটখাটো দুষ্টুমিগুলোকে আমি অনেক উপভোগ করছিলাম। আমার এগুলোর প্রতি লোভ জন্মে গিয়েছিলো তাই বুঝেও না বুঝার ভান করেছি।””
পালক এবার একটু উচ্চস্বরে বললো,
“” অনিকশা তখন তুমি টিন এজের বাচ্চা ছিলেনা। যথেষ্ট মেচিউরড।””
“” সেজন্য আরো বলতে পারিনি। কারন,তখন তুমি রাতদিন ২৪ ঘন্টা আমাতে পাগল। এই অবস্থায় আমি তোমাকে হার্ট করতেও পারছিলাম না। ইনফেক্ট,আমি এটাও সিউর ছিলাম,তখন যদি আমি বলতাম আমি তোমার পত্রীকন্যা না তাহলে তুমি সেটা হেসে উড়িয়ে দিতে। কিন্তু যখন বুঝলাম,এতো দিনেও আমি তোমার মনে কিঞ্চিৎ পরিমান জায়গা করে নিতে পারিনি। তোমার পত্রীকন্যার দেখা না পেয়েও তোমার সর্বস্ব জুরে সেই বাস করছে,তখন মনে মনে গিলটি ফিল করি। আর সেই গিলটি থেকেই তোমার সাথে আমার খারাপ আচরন শুরু হয়। আসতে আসতে দুরত্ব! আমার কাছে মনে হয়েছিলো আগে নিজেকে তোমার থেকে সরিয়ে তারপর তোমাকে জানাবো,তুমি যাকে ভালোবাসো আমি সে নই।””
“” নিজেকে তো সরিয়ে নিয়েছিলেই তাহলে কেন জানাওনি?””
“” চেয়েছিলাম। আমি আতিশের সাথে দেখাও করেছি,ওর কাছেই শুনতে পারি তুমি সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছো,একটা বদ্ধঘরে নিজেকে বন্দী করে ফেলেছো,এমতাবস্থায় যদি তোমাকে সত্যিটা বলি তাহলে তোমার রিয়েকশন কি আসবে আমি বুঝতে পারছিলাম না,ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে যাই ঐ মুহুর্তে তোমাকে এই সব নিয়ে কিছু না বলাটাই ব্যাটার হবে মনে হয়েছিলো। ভেবেছিলাম,তুমি একটু স্বাভাবিক হলেই বলবো। তারকিছুদিন পরই জানতে পারি তুমি দেশের বাইরে।””
“” ওকে আমি তোমার সবকিছু মানলাম। ধরে নিলাম তুমি যা করেছো সব আমার জন্য কিন্তু যখন জানতে পারলে তোমার বোনকে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি,তখন কি তোমার মনে হয়নি, যে ছেলেটার মনে তুমি জায়গা করে নিতে পারোনি সেই ছেলেটার মনে অন্ত্রীশা কিভাবে জায়গা পাবে? তোমার কি এটাও মনে হয়নি আমি তোমার উপর জিদ ধরে অন্ত্রীশাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি? ওর উপর কি অত্যাচার চলতে পারে? তখনো কি তোমার মনে হয়নি তোমার আমাকে সব জানানো উচিত?””
“” মনে হয়েছিলো।””
“” তাহলে কেন জানাওনি?””
“” অন্ত্রীশার জন্য!””
“” অন্ত্রীশা?””
“” হুম,ও তোমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো। তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। তার উপর সবকিছু এতো দ্রুত হচ্ছিলো যে আমি কি করবো না করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন মনে হলো যা এতোদিন ধরে আড়ালেই ছিলো তা নাহয় আড়ালেই থাক। আমার বোনটার মন ভেঙে যাক এটা আমি চাইনি।””
“” অনিকশা তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? তোমার মনের সিদ্ধান্ত আমাদের চারটা জীবন আজ ধ্বংশের দিকে,চারজন নয়,পাঁচটা জীবন। আমার পত্রীকন্যাও এটার স্বীকার। আমি আজ বুঝতে পারছি,ও আমাকে আর কেন চিঠি লিখেনি। হয়তো ও আমার আড়াল ছিলো কিন্তু আমিতো ওর আড়ালে ছিলাম না। একটা মেয়ে হয়ে কি করে নিজের ভালেবাসার মানুষটির পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করবে? ও খুব কষ্ট পেয়েছে অনিকশা। আমার পত্রীকন্যা কষ্টের নদী নিয়ে অভিমান করে আছে আমার উপর। হয়তো ভেবেছে আমি ওকে ধোকা দিয়েছি!
পালক হুট করেই অনিকশার হাতদুটে আকড়ে ধরে ফেলেছে। হাতের উপর নিজের মাথা রেখে কান্নাজরিত কন্ঠে বললো,
“”তুমি এটা কি করলে অনিকশা? দুটো হৃদয় দিয়ে গড়ে উঠা,একটা আত্মাকে তুমি দুটুকরো করে ফেলেছো। এত বড় অন্যায়টা কেন করলে?””
অনিকশা শাওয়ার নিয়েই আয়নার সামনে দাড়িয়েছে। দুই হাতে দুটো শাড়ী,দুটোই জামদানী শাড়ী। কালার ভিন্ন,একটা টকটকে লাল কালার,এটা পড়েই অরিদকে বিয়ে করেছিলো সে,অপরটা বেগুনি কালার শাড়ী,যেটা অনেক পছন্দ করে অরিদ ওকে গিফট করেছিলো। এটা নিয়েই তো ওইদিন অরিদের সাথে ঝগড়া হয়েছিলো। মনে পড়তেই অনিকশা মুচকি হেসে উঠে।
কোনটা যে পড়বে বুঝতে পারছেনা। অনেক ভেবেচিন্তে লালটাই পড়ার কথা ভাবছে। নতুন জীবন শুরুটা নাহয় নতুনের মতোই হোক। যেটা পড়ে অরিদকে নিজের করে নিয়েছিলাম আজও নাহয় ওটা পরেই নিজের ভালোবাসায় রাঙাবো।গড়ে নিবো আমাদের লাল ভালোবাসা!
আয়নায় দাড়িয়ে কুচি গুজতে গিয়েই অনিকশার মনটা খারাপ হয়ে এসেছে। পেটটা অনেকটাই ফুলে আছে,শরীরের ফর্সা চামড়াগুলোও কেমন মরচে পড়ে গিয়েছে,আর মুখটা,ইশ! উজ্জ্বলতার কোনো আভাসও নেই। অরিদের কাছে নিজেকে সুন্দরী করতে এখন কত কি মাখতে হবে। এতোদিন নিজের অযত্নের ফল এখন পাচ্ছি। আজ যখন অরিদকে নিজের পুর্ন সৌন্দর্যটা দেখাতে চাচ্ছি,তখনি এমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো চেহারা? ধুর! অরিদ্রাটা যে কেন এত তাড়াতাড়ি এলো। আর কয়েক বছর পর এলে কি হতো? কেমন মুটিয়ে গিয়েছি আমি!
অনিকশা মন খারাপ নিয়েই নিজেকে সাজাচ্ছে। যদিও অরিদের সাতদিনের কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু অনিকশা জানে আজ যতই কাজ থাকুকনা কেন আজ সে আসবেই। আর এসেই যখন দেখবে তার বউটা হুট করেই পাল্টে গেছে তখন ওর মুখটা কেমন হবে? আর আমি যখন ওকে ভালোবাসি বলবো তখন? তখন তো ও খুশিতে পাগলই হয়ে যাবে,ইশ! কখন যে আসবে!
অনিকশাকে অবাক করে দিয়েই দরজায় নক পড়েছে। নিজের চুলে চিরুনিটা চালিয়েই দৌড়ে দরজার কাছে চলে গিয়েছে অনিকশা। এটা অরিদ ছাড়া অন্য কেউ না খুব ভালো করেই জানে ও। নিজের খুশি খুশি মুখটাকে আড়াল করে কিছুটা বিরক্তের ছাপ নিয়ে এসেছে মুখে। এতো সহজেই সব প্রকাশ পেলে মজা নাই,আগে একটু ভাব ধরতে হবে। ওকে বুঝতে দেওয়াও যাবেনা যে আমি জানি ও আসবে!
অনিকশা দরজা খুলেই কিছুটা বিরক্তের চাহনি দিয়েছে অরিদের উপর। কপালের সাথে ব্রু দুটোও কুচকিয়ে বললো,
“” তুমি এতোরাতে? তোমার না পরশুদিন আসার কথা? কাজ ফেলে চলে এসেছো তো? দাড়াও আমিও এখন সব গুছিয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে….. “”
অনিকশা কথা শেষ করার আগেই ওর বা গালে ঠাস জরে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে অরিদ। চোখ,মুখ লাল হয়ে গিয়েছে ওর। অনিকশাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে চিৎকার করতে করতে বললো,
“” বাপের বাড়ি যাবি নাকি পালকের কাছে যাবি সেটা তোর ব্যাপার। দাড়া আমি তোকে হ্যাল্প করছি!””
অরিদ রুমের সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। একটা লাগেজ বিছানায় ফেলে তাতে আশেপাশে যা পাচ্ছে সব ঢুকানো শুরু করে দিয়েছে!
চলবে