নতুন ভোরের আগমন পর্ব -০৫

#পর্ব৫
#নতুন_ভোরের_আগমন
#অর্ষা_আওরাত

সূর্য এখন মাথার উপরে। দিনের অর্ধভাগ সময়ে এসে দাড়িয়েছে! বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছে মিজান ম্যানশনের মানুষজন। এর মধ্যেই ইনসিয়াকে সাজগোজ করিয়ে একটি সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। রিহান রেডি হয়ে বাকি মেহমানদের সাথে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে! ইনসিয়া শুধু বসে বসে দেখছে সবকিছু। কিছু পাড়া প্রতিবেশী ও এসেছে সবাই ইনসিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে যাচ্ছে। বেশ প্রসংশাও করছে। ইনসিয়া সবার সাথে কথা বলছিলো ঠিক এমন সময়ে একটি মেয়ে এসে উপস্থিত সবার সামনে এসে বললো,

–“কাকে এতো সুন্দরী, রূপবতী বলে প্রসংশা করছেন আন্টি? যার কিনা এক পা নেই যে কিনা পঙ্গু তাকে! যে কিনা এই মিজান ম্যানশন এর সবার থেকে তার পঙ্গুত্বের কথা লুকিয়ে রিহানকে বিয়ে করেছে তাকে এতো প্রসংশা করছেন! যে কিনা সবাইকে ঠকিয়েছে সবটা আড়াল করে তাকে? এই সুন্দর মুখশ্রীর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে মানুষকে মিথ্যা বলানোর স্বভাব। এবার দেখুন তো এই মেয়ে কি আদৌ রিহান বা এই ম্যানশন পরিবারের যোগ্য?”

এবার কোলাহল পূর্ন পরিবেশ টা যেনো এক নিমিষে স্তব্ধ হয় গেলো মেয়েটির কথা শুনে! উপস্থিত চেহারা গুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা এই বিষয়ে কিছুই জানতো না! একেবারে সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটির কথা শুনতে। এতোক্ষণ ধরে কথা গুলো বললো রিহানের বাবার বন্ধুর মেয়ে রিতা! রিতার সাথে রিহানের বিয়ের কথা চলছিলো কিন্তু মিজানুর রহমান এর ইনসিয়াকে পছন্দ করাতে রিহানও বিয়েতে অমত করেনি। রিতাকে রিযেক্ট করার প্রতিশোধই নিচ্ছে ইনসিয়াকে সবার সামনে অপমান করে! রিহান কোনো কিছু বলছে না নিরব দর্শকের মতন চেয়ে রয়েছে! সেই বা কি বলবে সে তো নিজেও কিছু জানতো না! আর পরিবারের বাকি সদস্যরা কিছু বলবে তো দূরের থাক তারা হতভম্ব হয়ে গেছে রিতার কথা শুনে। রিতার ইনসিয়াকে সবার সামনে এভাবে অপমান করায় মিজানুর রহমান এর খারাপ লাগছে! ওদিকে ইনসিয়া অপমানিত’র কারনে না চাইতেও অক্ষি জোড়া থেকে অশ্রু নির্গত হতে থাকলো। রিতা আবার বলে ওঠলো,

–“এবার তো শুনলেন সব সত্যিটা তাহলে এবার কি বলবেন আপনারা? রিহানের জন্য কি আদৌ এই পঙ্গু মেয়ে উপযুক্ত? রিহান পড়ালেখা শেষ করে একটা নামীদামী অফিসে চাকরি করছে। সে দেখতে যেমনি সব দিক দিয়ে পার্ফেক্ট ঠিক তেমনি কাজকর্মেও সব দিক দিয়ে পার্ফেক্ট। আর সেই রিহানের জন্যই কিনা এরকম একটা মেয়ে এসেছে ওর জীবনে বউ হয়ে তাও আবার ছলনা করে বিয়ে করে এসেছে, সবাইকে সবটা লুকিয়ে কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে।”

রিতার কথা শুনে উপস্থিত মেহমান সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি শুরু করে দিলো! সবার মুখেই একটা কথা রিহান কেনো এই মেয়েকে বিয়ে করলো আর মিজানুর রহমানই বা কেনো সবটা জেনে শুনে এরকম একটা মেয়েকে তার নিজের ছেলের জন্য বউ করে আনলো! সবার কথার আলোচনাই ইনসিয়ার কানে যাচ্ছে সে মাথা চুপ করে সবটা শুনতে লাগলো কোনো কিছু না বলে, হঠাৎ এক মহিলা এসে ইনসিয়ার লেহেঙ্গা পা থেকে উপরের দিকে টেনে দিলো! বলতে লাগলো,

–“এই মেয়ের তো দেখছি সত্যিই পা নেই! এক পায়ের জায়গায় স্টিলের পা বসানো রয়েছে! লম্বা করে শাড়ি পড়ে শাড়ির আড়ালে তার এই স্টিলের পা বসানো টাকে লুকিয়ে রেখেছে যাতে কেউ না দেখে! কি ধুরন্ধর মেয়ে রে বাবা! সেইজন্য তো আমরাও কেউ কিছু বুঝতে পারিনি এতোক্ষণ ওর সাথে কথা বলেও। সে ইচ্ছে করেই লম্বা করে শাড়ি পড়েছে যাতে তার স্টিলের পা টাকে দেখা না যায়। বলি তোমরা কেউ কি বিয়ের সময় ওর এই স্টিলের পা দেখোনি?”

এক এক করে এবার সবাই ওই প্রতিবেশী মহিলার কারনে ইনসিয়ার স্টিলের বসানো পা টাকে দেখতে পেয়ে গেলো! অপমানে আর ঘৃনায় ইনসিয়ার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়ছে! এর ভিতরেই হঠাৎ একজন বলতে লাগলো,

–“হ্যাঁ আমিতো রিহান ভাইয়ার বিয়েতে গিয়েছিলাম রিহান ভাইয়ার সাথে। তখন নতুন বউ দেখতে গিয়েছিলাম নতুন বউর ঘরে কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যখন বিয়ে পড়ানো হয়েছিলো ঠিক তখনোও এই আপুটা বড়ো করে ঘোমটা দিয়ে এরকম ভাবে লম্বা করে শাড়ি পড়েছিলো।”

এই বাচ্চা ছেলেটির কথা শুনো ইনসিয়ার নিজের বিয়ের দিনের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠলো,
____________________________
সেদিন রাএে ইনসিয়ার গায়ে হলুদ ছিলো ধুমধাম করে অনেকটা উৎসবের মতনই ইনসিয়ার গায়ে হলুদ হয়েছিলো! গায়ে হলুদের পরে সকালবেলা সব নিয়ম কানুন মেনে ইনসিয়াকে সাজানো হয়। সাজগোজ এর সময়ই মিজানুর রহমান ইনসিয়াদের বাড়িতে এসে পড়ে। তিনিই কাউকে ইনসিয়ার সাজের সময় কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। যখন ইনসিয়ার সাজগোজ শেষ হলো তারপর তিনি ইনসিয়ার বাবাকে বলে দিলেন যাতে ইনসিয়ার শাড়ি টা একটু নিচের দিকে টেনে লম্বা করে দেওয়া হয় যাতে কেউ ইনসিয়ার স্টিলের পা টাকে দেখতে না পায়! ইনসিয়ার বাবাও সরল মনে ইনসিয়ার মা’কে বলে ইনসিয়ার শাড়ি লম্বা করে ইনসিয়ার স্টিলের পা টাকে ঢেকে দিলো! ব্যস বিয়ে হয়ে গেলো! ইনসিয়ার স্টিলের পা ঢাকা পড়ে ছিলো ইনসিয়ার শাড়ির নিচে! তারপর যখন বিয়ে শেষে ইনসিয়াকে মিজান ম্যানশনে আনা হলো সবাই যখন নতুন বউ দেখতে ভীড় জমিয়েছিলো মিজানুর রহমান অতি সাবধানে রেখেছিলো ইনসিয়াকে যাতে ইনসিয়ার স্টিলের পা টাকে কেউ দেখতে না পায়। কিন্তু সবশেষে রাএে বেলা রিহান ঠিকই দেখে নিলো ইনসিয়ার স্টিলের পা! আর এখন রিতা সবার সামনে সেটা বলে দিলো!
____________________________

ছোট্ট ছেলেটির কথা শুনে রিতা আবারো বললো,

–“কি এবার জানলেন তো তাহলে কীভাবে এই চতুর মেয়েটি তার পঙ্গুত্বের কথা লুকিয়ে রিহানকে বিয়ে করেছে! আসলে এদের মতন মেয়েরা তো এভাবেই এরকম পার্ফেক্ট ছেলেগুলোকে টার্গেট করে।”

রিতার কথা শুনে ইনসিয়া আর সহ্য করতে পারছে না! কিন্তু সে যে রিহানকে তার শাশুড়ী মা’কে কথা দিয়েছে কোনো সিনক্রিয়েট করবে না তাই চুপ করে সবটা নির্বিকার ভাবে শুনে যাচ্ছে! মাথা নিচু করে কাঁদছে!

-“আরোও আছে শুনুন কাল রাএে****

ব্যস আর কিছু বলতে পারলো না রিতা তার আগেই মিজানুর রহমান মুখ খুললেন,

–“আপনারা এখানে উপস্থিত সবাই জেনে রাখুন এই পঙ্গু মেয়েটিই আমার ছেলের বউ! হ্যাঁ এই পঙ্গু মেয়ে যার কিনা একটি পা নেই পায়ের জায়গায় স্টিলের পা বসানো সেই মেয়েটিকেই আমি নিজে পছন্দ করেছি আমার ছেলের জন্য! ইনসিয়ার পরিবারকে আমি বলেছিলাম যে আমার পরিবার সবটা জানে কিন্তু আসল সত্যি হলো আমি আমার পরিবারকে কিছুই জানায়নি। এমনকি রিহানকেও পর্যন্ত না। কারন আমি জানতাম এই সত্যি জানলে ইনসিয়াকে কিছুতেই রিহান বিয়ে করতো না। তাই বাধ্য হয়ে আমি সত্যিটা লুকিয়েছি! আমিই শুরু থেকে বিয়ে পর্যন্ত এমনকি কাল ও এ বাড়িতে আসা পর্যন্ত কাউকে কিছু জানতে দিইনি। আমিই সবটা সবার থেকে আড়াল করেছি। ইনসিয়া বা ইনসিয়ার পরিবারের লোকেরা কেউ কিছু আড়াল করে নি বা কেউ কোনো প্রতারনাও করেনি। যদি সত্যিই কাউকে দোষ দিবেন তাহলে আমাকে দিন। আমিই সবটা করেছি, এবং যা করেছি সবটা আমার ছেলের ভালোর জন্যই করেছি! সুন্দরী খুঁজলে অনেক মেয়েকেই পাওয়া যাবে কিন্তু ইনসিয়ার মধ্যে যে সুন্দর মনটা আমি দেখেছি সেটা হাজার সুন্দরীর মধ্যেও নেই! ইনসিয়ার সেই সুন্দর মন আর সুন্দর চরিএের কাছে ওর এই স্টিলের পা কোনো বাধাই নয়। আশা করি সবাই সবটা জেনেছেন এবার আর কেউ ইনসিয়াকে কোনো রকম কোনো দোষ না দিয়ে বিয়ে বাড়িতে এসেছেন সেটা ইনজয় করুন। আর রিতা তোমার বাবা আসতে পারেনি বলে তুমি এসেছো কিন্তু তুমি যেই সিনক্রিয়েট তৈরী করলে সবার সামনে এটা আমি মোটেও আশা করিনি তোমার থেকে। তাই তুমি এখন এখান থেকে চলেই যাও।”

উপস্থিত কেউই আর কোনো কথা বললো না। যেখানে মিজানুর রহমানই সবটা করেছেন সেখানে আর কে কি বলবে! সবাই নিজেদের মতন ব্যস্ত হয়ে গেলো! ওদিকে রিতা মিজানুর রহমান এর কথা শুনে আর অপেক্ষা না করেই সাথে সাথে চলে গেলো ম্যানশন মহল থেকে! ইনসিয়া বসে বসে কাঁদছিলো ঠিক তখনি ইনসিয়ার……….

#চলবে?
বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here