নিবেদিতা (পঞ্চম পর্ব)

0
506

নিবেদিতা (পঞ্চম পর্ব)

দীনবন্ধু বাবুর বসতবাড়িটি এলাহাবাদে। দিন পাঁচেক আগে সপরিবারে কাশী গিয়েছিলেন শ্যালকের একমাত্র মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে, এবারে ফিরতি যাত্রা করছেন। দীনবন্ধু বাবু প্রকৃতই দীনবন্ধু! তাঁর ঠাকুর্দা যে বেছে বেছে যথার্থ নামখানাই রেখেছিলেন নাতির জন্যে- পরিচিত অর্ধপরিচিত এবং অপরিচিত সকলেই এ কথা বলাবলি করে। শেষ আশ্রয়টুকু হারাতে না হারাতেই একেবারে তাঁর হাতে এসে পড়েছিল- এ নিবেদিতার ভাগ্য কি দীনবন্ধুর নামের জোর তা নিয়ে সংশয় করা যেতে পারে! মেয়েটি প্রকৃতই অসহায়া জানবার পর তিনি আর দ্বিধা করেননি, নিজের সাথে করে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন মনস্থির করে ফেলেন।

মেয়েছেলেরা সঙ্গে আছে বলে একটা আলাদা কামরা ভাড়া করা হয়েছিল। নিবেদিতাকে নিয়ে দীনবাবু সেখানে যেতেই সুলেখার মুখ আষাড়ের মেঘের মতো থমথমে হয়ে গেল। স্বামীর দীন-বান্ধব স্বভাবের কথা সুলেখা ঠিক জানেন। এই আপদটি যে এবারে অন্দরমহলে ঢুকতে চলেছে- সেটি বুঝতে তার দু’মুহূর্তও লাগে না।

‘কী গো মা? বাবা তো মনে হচ্ছে একে বাড়ি নিয়ে উঠাবে একেবারে?’- ললিতাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করে।

সুলেখাদেবী অবশ্য ততক্ষণে উপযুক্ত বুদ্ধিটি বের করে ফেলেছেন।

‘নিক না, ক্ষতি কোথায়? ঠিকে ঝি’টাকে বাড়ি যেয়েই বিদেয় করে দেব। এই দুম্মুল্যের দিনে বিনে পয়সার বাঁধা ঝি পাওয়াটা কি কম ভাগ্য নাকি রে?’

দীনবন্ধুর পুত্রবধূ চারু হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল সেই অপরিচিতা রোরুদ্যমতীটির দিকে। শাশুড়ির কথা শুনে বিরক্তি আর উষ্মার মিশ্র অনুভূতি মনটাকে তিক্ত করে দিল। এরা মা-মেয়ে পারেও বটে! নতুন নতুন যখন ওদের বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিল, তখন শ্বশুরমশাইয়ের মতন অমন সদা সজ্জন লোকটির ঘরে কী করে এই চতুরা, স্বার্থান্বেষী ননদিনীটির জন্ম হলো, সেটি ভেবে ভেবে বড় বিস্মিত হয়েছিল চারু। দু’দিন বাদে শাশুড়ির স্বরূপটি টের পেতে সে বিস্ময় কাটতে অবশ্য সময় লাগেনি। যত ভাল সার-ই দেওয়া হোক, মাকাল গাছে তো আর মধুমঞ্জরী ধরবে না!

দীনবন্ধু নিবেদিতাকে এনে পরিবারটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চারুর পাঁচ বছরের মেয়েটা আধোঘুম, আধো জাগরণ থেকে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বলল- ‘তোমার নাম কী গো বাছা?’

নিবেদিতার প্রতি টেঁপির সেটিই প্রথম সম্ভাষণ। তারপর, ঘোষাল বাড়ির আশ্রয়ে এবং দীনবন্ধু ও চারুর প্রশ্রয়ে নিবেদিতার জীবনের তিনটি বছর কেটে গেছে নিস্তরঙ্গ নদীর মতন। পাঁচ বছরের টেঁপি পা দিয়েছে আটে। ঘোষাল বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অব্দি সমস্ত দায় দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে কাশীর উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বেরুনো নিবেদিতা থিতু হয়েছে এলাহাবাদে।

ওদিকে, প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে, বেনারসের আনাচ-কানাচ জুড়ে একখানা তৃষিত, আকুল হৃদয় খুঁজে মরছে তাকে!

মাতা-পুত্রের কাশীবাসের বছরখানেক গত হয়েছে। ইতোমধ্যে শশীর নামযশ এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে দূর-দূরান্তের রোগীরাও কেবল তাঁকে একনজর দেখাতে আসছে। অবশ্য, বিখ্যাত এলাকার প্রখ্যাত ডাক্তারবাবুর কাছে যে কেবল রুগীরাই আসছে তা নয়! লোকমুখে সুদর্শন, সুপাত্র ডাক্তারটির বিবরণ শুনে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের আনাগোনারও ধুম লেগে গেছে ছয় নং চিত্তপুর লেনের বাড়িটিতে। কখনও সন্দেশ-রাবড়ির বাক্স, কখনও ক্ষেতের আলুটা, মূলোটা কিংবা পূজো পার্বণে শাড়িটা, ধুতিটা- এরূপ নানাবিধ উপহারসামগ্রী এমন হারে আসছে বাড়িতে, ঝি চাকরকে দিয়েও কূলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। শশী এসব দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বলে- ‘কাশী দর্শন করতে এসে ঠাকুরের বদলে লোকেদের বাড়ি বাড়ি প্রসাদ বিলিয়ে বেড়ায় যারা, তাদের আমি ভরসা করি না, মা!’

ওদিকে, লোকেদের ক্রমাগত করাঘাতে কাননবালার ধৈর্যের দুয়ার ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে। সত্যিই তো, এমন চাঁদপানা, সুস্থ, সবল, ডাক্তারবাবু ছেলেটি তাঁর, একটিবার ‘বিয়ে করব’ বললে মেয়ের বাপেরা হত্যে দিয়ে বাড়ির সামনে পড়ে রইবে। অথচ, কবে কাকে দেখেছিল এক ঝলক, কোথায় হারিয়ে গেছে সে তারপর… ছেলে নাকি তার জন্য এখনও হাভাতে হয়ে বসে আছে! এ কেমন দুর্মতি! এত পড়ালেখার ছেলে, সে যে অসম্ভবের পেছনে ছুটে ছুটে বৃথাই কাহিল হয়ে মরছে, এটুকুও বুঝছে না বুঝি? সে প্রশ্নই বারেবারে ছেলেকে শুধান কাননবালা-

‘হাঁ রে বাপ, তুই এখনও তাকে খুঁজচিস? এত মানুষের সমুদ্দুরে ঐ একফোঁটা মেয়েকে কোন অসম্ভবের ভরসাতে খুঁজে মরচিস?’

প্রথম প্রথম এ প্রশ্নের উত্তর আসত না কোনো। শেষে একদিন মা খুব করে চেপে ধরলেন পরে কেবল একটি বাক্যে উত্তর করেছিল শশী-

‘যে ভরসার লোকে সাগর চষে মুক্তো খুঁজে বেড়ায়, মাটি খুঁড়ে হীরে- সেই ভরসায় মা!’

‘ঝুটো বলে যাদের ফেলে দিচ্ছিস, তাদের মধ্যে আসল হীরে নেই- তাই কে কইলো তোকে?’

মায়ের প্রশ্নে থমকে গিয়েছিল শশী। এই পর্যন্ত কম করে হলেও পনেরটি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে সে, কিচ্ছুটি না দেখে শুনেই। দীর্ঘ অদর্শনে নাকি মুখ ভুলে যায় লোকে। অথচ, কবে, কোন শরৎ বিকেলে তাকে দেখেছিল, ঝিকিমিকি রোদকে তুচ্ছ করে দেওয়া সেই অদ্ভুত, মোহময় মুখখানা- কই? আজও তো এতটুকু ক্ষীণ হয়নি স্মৃতিপট থেকে! ঐ একটিমাত্র মুখের ‘পরে দৃকপাত করতে গিয়ে জগতের বাকি মুখগুলি সব কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে বরং!

‘আর একটিবার মা’র কথাটি শোন বাপ! ভবতোষবাবুর সেই বোনঝিটি, ওকে একটিবার নিজে যেয়ে দেখে আয়। এবারে যদি না মেলে তো, এই মা কথা দিচ্চি, আর কোনোদিন জ্বালাতে আসব না তোকে।’- ছেলের থমকানো মুখ মায়ের চোখ এড়ায় না। সুযোগ বুঝে প্রস্তাবটি রাখতেও দেরি হয় না তাই।

শশী চুপ করে রয় অনেকক্ষণ। তারপর কিজানি কী ভেবে, ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে-

‘বেশ তবে! রাখছি তোমার কথা। এই শেষবার তো?’

কাননবালা সানন্দে সম্মতি দেন। তিনি নিশ্চিত জানেন, এই প্রস্তাবটি লাগবেই লাগবে! হিমালয় থেকে দু’সপ্তাহ আগে জটাধারী লালমোহন গুরুজী এসেছেন এখানে। শশীর কুষ্ঠিবিচার করে এমনটিই বলেছেন তিনি।

বস্তুত, এই ভবতোষ বাবুটির সঙ্গে কাননবালার পরিচয় হয়েছিল এই গুরুজীর আসরেই। লোকমুখে নবাগত লালমোহন গুরুজীর প্রশংসা বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। সেদিন বিশ্বনাথের ঘাটে তুলসী ঠাকুরনীও যখন বলে বসলেন, এই বাবাটি নাকি প্রজাপতির বিশেষ আশীর্বাদ ধন্য- কাননবালার আর তর সইল না। ছেলের কুষ্ঠি বগলদাবা করেই ছুটলেন গুরুজীর কাছে। পুরো তিরিশটি টাকা প্রণামী নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে শশীর কুষ্ঠিবিচার করে বাবা লালমোহন বললেন- ‘আজকেই তার সঙ্গে দেখা হবে তোর।’

কাননবালা চমকে উঠলেন।

‘তার সঙ্গে! কার সঙ্গে?’

‘যার দ্বারাতে তোর পুত্রের উপযুক্ত কনেটিকে খুঁজে পাবি।’

‘উপযুক্ত কনে! নিবেদিতা? তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে?’- একটা অসম্ভব আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল মায়ের মনে।

‘নিবেদিতা নয় তো…পষ্ট দেখচি তার নামটি… ললিতা!’- গুরুজী চোখ কুঁচকান। কুষ্ঠির পাতাটাকে নাকের একেবারে ডগায় নিয়ে ধরেন, যেন দুর্বোধ্য পাঠোদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক ফাঁকে অদূরে দাঁড়ানো ভবতোষের সঙ্গে চোখে চোখে বোধহয় কিছু কথাবার্তাও সেরে নেন।

‘ললিতা!’

ততক্ষণে হাঁ বোধক ঘাড় নেড়েছেন ভবতোষ ঘোষাল। অর্থাৎ, ললিতা নামটিই সঠিক। প্রজাপতির স্নেহধন্য লালমোহনের বাক্যস্ফূর্তি ঘটতে তাই দেরি হয় না।

‘হাঁ! ললিতেই বটে! ললাটলিখনে এই নামটিই তো দেখতে পাচ্চি। ও মেয়ের সাথে তোর যোগসূত্রটি যে ঘটাবে, সে এখানেই আছে। নামখানা বড় দুর্বোধ্য… ঘোষালদের কেউ হবে।’

ছেলের এমন অদ্ভুতুড়ে ললাটলিখন স্বচক্ষে পড়ে দেখতে বড় ইচ্ছে করে কাননবালার। কুষ্ঠিটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আনাচ-কানাচ আতিপাতি করে দেখেন। বৌয়ের নামখানাও নাকি লেখা আছে! ললিতা…

কানন খুঁজে পান না কিছুই। ওরকম দিব্য চোখ থাকলে তো কথাই ছিল না! সকলে কি আর প্রজাপতির প্রত্যক্ষ আশীর্বাদপুষ্ট হয়? ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ান কাননবালা, গুরুজীর সামনের জায়গাটা থেকে সরে কোণার দেয়ালের দিকে যেয়ে দাঁড়াবেন বলে মনস্থির করেন।

গুরুজীকে প্রণাম করে দু’কদম যেতে না যেতেই পেছন থেকে অচেনা কারো ডাক কানে এল-

‘এই ছাতাখানা কি আপনার?’

সফেদ ধুতি-আচকান পরিহিত স্মিতহাস্য লোকটি এগিয়ে আসেন, হাতে একটি বেগুনী রঙের ছাতা।

কাননবালা চকিতে একবার মিলিয়ে নেন। নাহ! তাঁর নয়। হবে হয়ত অন্য কারো!

‘নমস্কার! আমি ভবতোষ, ভবতোষ ঘোষাল। এই ছাতাটা কুড়িয়ে পেলুম, আপনিই বসে ছিলেন কিনা ওখানটায়…’

“আজকেই তার সঙ্গে দেখা হবে তোর!… যোগসূত্রটি ঘোষালদের কেউ হবে…”- গুরুজীর কথাগুলি কাননবালার বুকের ভেতর ছলাৎ করে বেজে ওঠে।

১০

ছলাৎ করে উঠেছিল নিবেদিতার বুকের ভেতরেও, চারু যখন এসে খবরটা দিল।

‘ললির তো বিয়ের কথা পাকা হচ্ছে, কাল বাদে পরশু ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে ওকে!’

দিন দু’য়েক ধরে ঘরবাড়ি গোছগাছের তোড়জোর দেখে যে প্রশ্নটি নিবেদিতার মনে উদ্রেক হয়েছিল, অবশেষে তার উত্তর মিলল। সুরেশদার বাড়ি থেকে তবে দেখতে আসছে ললিতাদিকে!

‘তোর হাতে এটা কী রে? রান্না চড়াসনি দেখলাম এখনও, ভাবলাম শরীর খারাপ লাগছে নাকি-‘

হাতে ধরা কুশন বালিশের ওয়্যারটা মেলে ধরে নিবেদিতা। আকাশী নীল রঙের কাপড়ে ম্যাজেন্টা-হলুদ কতগুলি ফুল তুলছে সুতোয় গেঁথে।

‘ভাল হচ্ছে? চারুদি?’

‘খুব সুন্দর হচ্ছে! কিন্তু, কাজ ফেলে এই নিয়ে বসেছিস দেখলে মাতৃদেবী বকবেন না আবার?

‘মাসীই তো বলে গেলেন। কুশনে পরাবেন, কালকের মধ্যে শেষ করে দিতে বললেন…’

‘ওহ! বুঝেছি! ঐ পরশু আসছে যে, তাদের জন্যে!’- চারু সমঝদারের মতো মাথা দোলায়। তারপর চোখ বড় বড় করে বলে, ‘জানিস তো, ছেলেটি নাকি কাশীর খুব নামকরা ডাক্তার! এক্কেবারে ঝুট-ঝামেলা ছাড়া সংসার! এক মা ছাড়া আর কেউ নেই। ললিমাগীটার কপাল দেখ! আমরাই যতসব উচ্ছুটে কপাল নিয়ে জন্মেছি!’

‘ডাক্তার?’- নিবেদিতা চমকে ওঠে। সুঁচের সরু মাথাটা টুপ করে আঙুলে ঢুকে যায় সেই ফাঁকে। ‘তবে যে শুনেছিলেম, সুরেশদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে…’

‘আহা! ঐ সুরেশটাকে কে বিয়ে করছে! ওটাকে গাধা পেয়ে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো হয়েছে কেবল। বিয়ে তো করছে শশীভূষণ চাটুয্যেকে। বললুম না তোকে? কাশীর নামকরা ডাক্তার! সুরেশ, ফুরেশ ওঁর কাছে পাত্তা পাবে নাকি? শুনেছি ভবামামু বহু কায়দা কসরত করে মাছকে জালে খেলিয়েছেন, এবারে শুধু টুপ করে বড়শি গিলিয়ে ডাঙায় তুলবার পালা। তা মা-মেয়ে দু’জনে মিলে সেটি পারবেন বৈকি! পেটে পেটে বুদ্ধি তো আর কম নয়! কীরে মুখপুড়ি, শুনছিসনে নাকি আমার কথা? অমন হুতুম পেঁচার মতন মুখ করে চেয়ে আছিস যে বড়?’


আর তিন পর্ব মতো হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here