অনুভূতি,পর্ব-১

“অনুভূতি ”
সূচনা পর্ব
মিশু মনি
.
১.
– “আপনার রেইনকোট টা দিবেন প্লিজ? আমার বৃষ্টি সহ্য হয়না”
একেবারেই নিঃসংকোচ আবেদন! চমকে ফিরে তাকালো মেঘালয়। মেয়েটাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। একজন অচেনা অজানা লোকের কাছে এভাবে কিছু চাওয়া যায় সেটা একদম ধারণার বাইরে ছিলো।
বিস্ময় কাটিয়ে মেঘালয় বলল, “সরি, বুঝলাম না।”
– “আমার বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে।”
– “তো?”
মেয়েটি করুণ গলায় বললো, “দশটার মধ্যেই ডিউটি তে পৌছতে হবে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বোধহয় পৌছতে পারবো না।”
মেঘালয় স্পষ্ট ভাষায় বলল, “আজ না হয় একটু দেড়িতে যাবেন।”
মেয়েটি আরো করুণ গলায় বলল, “আসলে রেগুলার দশটার মধ্যেই পৌছাতে পারলে মাস শেষে একটা বোনাস পাবো। সেজন্যই।”
মেঘালয় একটু ভেবে বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু আমার কোট তো আপনার গায়ে হবেনা মেয়বি।”
– “উপায় তো নেই। প্লিজ দিন না। মানবতার খাতিরে এই উপকার টা করা উচিৎ।”
মেঘালয়ের হাসি পেলো। হাসি চেপে রেখে গা থেকে রেইনকোট টা খুলতে খুলতে বলল, “তাহলে একটু মানবতা দেখানোই উচিৎ। এই নিন।”
মেয়েটি রেইনকোট টা হাতে নিয়ে এখানেই গায়ে পড়ে ফেললো। ছোটখাটো এই পুঁচকে মেয়েটাকে এতবড় সাইজের রেইনকোটের ভিতরে একদম এলিয়েন এলিয়েন লাগছে। তবুও বেশ কিউট কিউট ভাব চলে এসেছে। রেইনকোট টা পড়েই জোরে একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামলো।
মেঘালয় বেশ অবাক হলো। আরে রেইনকোট তো নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা কি একেবারেই দিয়ে দেয়া হবে? মোটেও না।
মেঘালয় চেঁচিয়ে ডাকলো, “এইযে শুনুন।”
মেয়েটি পিছন ফিরে তাকাতেই মেঘালয় বলল,”আমার কোট টা অবশ্যই ফেরতযোগ্য। কোথায় গেলে পাবো?”
মেয়েটি ঝটপট উত্তর দিলো “কৃষি মার্কেটে ইভা সুপার শপে গেলেই আমাকে পাবেন।”
কথাটা বলেই আর এক মুহুর্ত ও দাঁড়াল না। হনহন করে হেঁটে চলে গেলো। মেঘালয় অবাক হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো বিল্ডিং এর নিচে। মেয়েটি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেঘালয় আসামাত্র ই নিঃসংকোচে রেইনকোট টা চেয়ে বসলো। কিজানি সঠিক ঠিকানা দিয়েছে নাকি ভূল! তবে কারো উপকার যদি হয় তো হোক না।
২.
দুপুরে বাসায় ফেরার সময় কৃষিমার্কেটের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো মেঘালয়। ভাবলো ইভা সুপার শপে গিয়ে দেখা যাক মেয়েটিকে পাওয়া যায় কিনা। দেখে তো বেশ সৎ ই মনেহয়েছিলো।
ভিতরে ঢুকে একটু সামনে যেতেই দেখলো মেয়েটি একটা গোলাপি রঙের টি শার্ট পড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে কাস্টমারের সাথে কথা বলছে। তারমানে সে এখানেই চাকরী করে। যাই হোক, ভূল ঠিকানা অন্তত দেয় নি। মেঘালয় একটু কাছে যেতেই মেয়েটি মিষ্টি করে হাসলো। তারপর বললো, “ওয়েলকাম স্যার।”
মেঘালয় কণ্ঠটা শুনেই একটু ভড়কে গেলো। একদম অফিসিয়াল হয়ে গেছে গলার স্বরটা। আর অনেক স্পষ্ট উচ্চারণ ও। অথচ সকালবেলা এরকম ছিলোনা।
পাশের কাস্টমার টি চলে যেতেই মেয়েটি বললো, “আপনার রেইনকোট টা এখানে দিতে পারবো না। একটু কষ্ট করতে হবে আপনাকে।”
মেঘালয় বাঁকা ঠোটে হেসে বলল, “আবার বৃষ্টি আসবে নাকি?”
– “না মানে এখানে কোট টা আপনাকে দিলে বস দেখে ফেলবে। আর তখন আমাকে জিজ্ঞেস করবেন আপনি আমার রিলেটিভ কিনা। আমি কোনোকরম জেরার সম্মুখীন হতে চাইছি না।।”
– “ওহ আচ্ছা। তা আমাকে এখন আপনার বাসায় যেতে হবে নাকি?”
– “না, আপনি একটু পাশের রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে বসুন কষ্ট করে। আমি দুই মিনিটের মধ্যেই লাঞ্চের জন্য বেরোবো। তখন আপনাকে দিয়ে দিবো।”
মেঘালয় হেসে বলল, “বাহ! জিনিয়াস তো। ওকে, আমি ওয়েট করছি রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে।”
– “ধন্যবাদ স্যার।”
– “স্যার স্যার করাটা কি আপনার মুদ্রাদোষ নাকি? একটু আগেও একজন কে স্যার স্যার বলছিলেন।”
– “আসলে সম্মান প্রদর্শনের জন্য বলা হয় আরকি।”
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে বলল, “বেশ ভালো। তো দোকানদার ম্যাডাম, আমি তো আপনাকে রেইনকোট টা দিয়ে উপকার করেছি। সেই সুবাদে একটু ছাড় দিয়ে একটা কিছু বিক্রি করা যায়না?”
মেয়েটি মৃদ্যু হেসে বলল, “আমার রিলেটিভ হলে আমি কথা বলিয়ে একটু ছাড় দিয়ে দিতে পারতাম। আর রেগুলার কাস্টমার দের জন্য একটু ছাড় দেয়া যায়। আপনি আমার রিলেটিভ সেটা তো কিছুতেই বলা যাবেনা। বললেই বস জেরা করবেন।”
– “কেন জেরা করবেন?”
– “আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, আপনার সাথে আমার কেমন আত্মীয়তা সেটা জানতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক।”
মেঘালয় বেশ অবাক হয়ে বলল, “আমি বিখ্যাত ব্যক্তি আপনাকে কে বলেছে?”
– “আসলে আপনার রেইনকোটে একটা আরোহী আরোহী গন্ধ পাচ্ছিলাম।”
মেঘালয় হেসে বলল, “সিরিয়াসলি?”
মেয়েটিও মিষ্টি করে হেসে জবাব দিলো, “আসলে আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছিলো। ট্রেকার ও পর্বতারোহী মেঘালয়ের মত দেখতে আপনি। তাই গুগলে এটা দিয়ে সার্চ দিয়েই পেয়ে গেলাম। ছবি দেখে তো আমি একদম অবাক! একজন পর্বতারোহী’র কোট আমার গায়ে! উফফ নিজেকেও মুহুর্তের জন্য আরোহী মনে হচ্ছিলো।”
মেয়েটি খুব উৎফুল্ল হয়ে কথাগুলো বললো। মেঘালয়ের বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে। ও অবাক হয়েই বলল, “বেশ তো। এবার তাহলে কিছু বিশেষ ছাড় দিয়ে বেঁচুন।”
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, “আচ্ছা কিছু নিন। আমি কথা বলে কমাচ্ছি। বলুন কি নেবেন?”
মেঘালয় একটু ভেবে বললো, “এমন একটা বডি স্প্রে দিন যেটা দিয়ে বের হলে মেয়েরা হুরহুর করে কাছে আসবে।”
মেয়েটি হেসে বলল, “ওকে স্যার।”
এরপর দ্রুত গিয়ে হাতে করে তিনটা বডি স্প্রে এনে দিয়ে বলল, “স্যার কোনটা নেবেন? তিনটাই ভালো।”
– “কোনটা ভালো হবে বেশি?”
– “আপনি নিশ্চয় ই ব্যবহার করেছেন আগে। আপনার জানার কথা।”
মেঘালয় হাসি দিয়ে একটা স্প্রে তুলে নিয়ে বলল, “ওকে তাহলে বাইরে ওয়েট করছি।”
– “আচ্ছা বসকে বলছি আপনাকে একটু ছাড় দিয়ে দিতে।”
– “থ্যাংকস। আগে রেগুলার কাস্টমার হই, তারপর সুবিধা ভোগ করবো। আমি বিধা কারণে সুবিধা নেইনা। এনিওয়ে, রেইনকোট টা নিয়ে আসুন।”
কথাটা বলেই মেঘালয় বিল পরিশোধ করে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। মেয়েটিও কয়েক মুহুর্ত অবাক চোখে চেয়ে থেকে লাঞ্চের কথা বলে রেইনকোট নিয়ে পাশের রেস্টুরেন্ট এ চলে এলো।
মেঘালয় একটা টেবিলে বসে আছে। মেয়েটি এসেই বললো, “এই নিন আপনার কোট। অসংখ্য ধন্যবাদ।”
– “স্বাগতম। বসুন একসাথে নাস্তা করি।”
– “সরি, আসলে বস হঠাৎ এখানে এসে দেখে ফেললে আমার সমস্যা হবে। উনি আমাকে প্রশ্ন করবেন।”
– “বসকে এত ভয় পান কেন?”
– “চাকরী হারানোর জন্য।”
– “চাকরী গেলে যাবে। তাই বলে এত ভয় পেতে হবে। আবারো আরেকটা চাকরী পেয়ে যাবেন।”
মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এই শহরে চাকরী পাওয়াটা সোনার হরিণের মত। আর এটাই আমার পরিবারের একমাত্র ইনকাম সোর্স। তাই হারাতে চাইনা।”
কথাটা শুনেই মেঘালয়ের কেমন যেন অনুভূত হলো। মনে মনে ভাবলো, এটা পরিবারের একমাত্র ইনকাম সোর্স? কতই আর বেতন দেয়, বড়জোর সাত আট হাজার। তাতেই সংসার চলে? কথাটা খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু প্রশ্নটা কেন যেন করতে পারলো না। মুখে এসে আটকে যাচ্ছে। মেয়েটি গিয়ে পাশের টেবিলে বসে পড়লো। টিফিন বক্স খুলে খাবার খেতে শুরু করলো। মেয়েটার বয়স অল্প, সতের হবে হয়ত। কত ফুটফুটে আর চঞ্চল একটা মেয়ে, উজ্জল শ্যামলা বর্ণের মেয়েটিকে দেখলেই মায়া লাগছে। এরকম ফুটফুটে একটা মেয়ে কিনা চাকরী হারানোর ভয়ে সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে? দেখতেই খারাপ লাগে।
মেঘালয় উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো, “চাকরী পার্ট টাইম নাকি ফুল টাইম?”
– “ফুল টাইম। ১২ ঘন্টা ডিউটি।”
কথাটা শুনে আরো মনটা কেমন করে উঠলো। মেয়েটা নিতান্তই বাচ্চা বাচ্চা। এরকম পুঁচকে একটা মেয়ে কিনা মাত্র সাত হাজার টাকার জন্য সকাল থেকে রাত অব্দি ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে? কাস্টমার দের কাছে প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য নানান কথা বলতে হয়, আবার বসের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হয়! এইটুকুন একটা মেয়ে। কেমন যেন মায়া লাগছে মেয়েটির জন্য।
মেঘালয় খেয়াল করে দেখলো মেয়েটি মোটা চালের ভাতের সাথে ভর্তা টাইপের কিছু একটা আর ছোট্ট এক পিস ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাচ্ছে। বোধহয় একটা ডিম ভেজে তিন ভাগ করা হয়েছে। এত পরিশ্রম করে এরকম স্বল্প বেতন পেয়ে, এইসব খেয়েও তার মুখে হাসি! হায়রে দুনিয়া!
মেঘালয়ের অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু কিছুই বললো না। মেঘালয় নিজেও অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। তাই কাউকে একটু খারাপ অবস্থায় দেখলে মায়া লাগে তার জন্য। কেমন যেন ব্যথা অনুভূত হয়। মেয়েটিকে দেখে আরো বেশী হচ্ছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে,যার এখন বন্ধু বান্ধব নিয়ে এনজয় করার বয়স। ওর বয়সী মেয়েরা পিজ্জা হাটে পিজ্জা খেতে খেতে মুখ বাঁকা করে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়,হৈ চৈ করে কলেজে যায় আর এই মেয়ে কিনা এরকম ভর্তা ভাত খেয়ে ১২ ঘন্টা ডিউটি করছে! খুবই চিনচিন করে উঠলো ভিতর টা। মেয়েটির জন্য কিছু করতে পারলে বেশ হতো। মেঘালয়ের অনেক পরিচিত জায়গা আছে, কোথাও একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিতে পারলে বোধহয় অনেক উপকার হবে মেয়েটার। অবশ্য সে যদি করতে চায় আরকি!
মেঘালয় বলল, “এই মেয়ে,”
মেয়েটি মুখ তুলে তাকালো। মেঘালয় মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল, “সরি নাম জানিনা আপনার।”
– “জি আমার নাম মিশু।”
– “আচ্ছা মিশু, আপনার পড়াশোনা কতদূর?”
– “উচ্চ মাধ্যমিকের ডিঙি টপকেছি, এখন অনার্সে ভর্তি হবার পালা।”
– “আচ্ছা থ্যাংকস।”
– “ভাত খাবেন?”
– “না, আপনি ই খান।”
মেঘালয় হেসে রেইনকোট টা নিয়ে বেড়িয়ে আসলো। আসার সময় মেয়েটির ব্যাপারে কত সন্দেহ ছিলো। অথচ এখন তার অসহায় অবস্থা দেখে খুব ইচ্ছে করছে কিছু করার। মানব মন এত বিচিত্র! মিশু নামের মেয়েটি সবসময় হাসিতে উৎফুল্ল অথচ তার মুখ দেখেই মেঘালয় বুঝে গেছে ওর ভিতরের অবস্থা। কেন যেন মেঘালয়ের অনুভূতি গুলো খুবই তীব্র, অন্যের কষ্ট দেখে সেটা নিজের ভেতরে অনুভব করতে পারে।
বাসায় ফিরে রেইনকোট টা মেলে দিতেই এক ধরণের গন্ধ নাকে লাগলো এসে। মিষ্টি পারফিউমের সুগন্ধ! নিশ্চয় ই মিশুর গায়ের। কথাটা মনে পড়তেই মেঘালয় ফোন হাতে নিয়ে দুয়েকজন লোকের সাথে যোগাযোগ করলো কোথাও কোনো কাজের সুযোগ আছে কিনা। তারপর ফ্রেশ হতে গেলো।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here