টিউশনি করে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরতেই ভাবী ঘরে ঢুকলেন। হাতে সুন্দর কারুকার্য শোভিত শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-“তৈরি হয়ে থাকিস। আমেরিকান পার্টি আসবে তোকে দেখতে।”
কথাটি বলার সময় ভাবীর চোখজোড়া চকচক করে উঠলো।
মুহূর্তেই মেজাজ গরম হলো মিতালির। কন্ঠের ভীত মজবুত রেখে চটপটে জবাবে বলল,
-“আমাকে হাঁটের গরু পেয়েছো? খরিদদারকে দেখিয়ে দেখিয়ে দরদাম করবে! আমি স্পষ্টভাষায় বলে দিচ্ছি, আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাবো। খরচটা নিশ্চয়ই তোমরা দাওনা। তাই আপত্তি থাকার কথাও না।”
পিয়ালীর ঝকঝকে উজ্জ্বল চেহারার রং মুহূর্তেই বদলে গেলো। চোয়ালে কাঠিন্য ভর করতেই দাঁতে দাঁত চাপলো।
-“সেই তো, পড়ালেখা করবেন। যার নমুনা দেখতেছি। বলছি আমাদের ঘাড়ে বসে যে গিলছেন, সেই খবর কি আছে? আমাদের একেবারে রসাতলে ডুবিয়ে ছাড়ার পায়তারা।”
মিতালির ধপ করে জ্বলে ওঠা রাগটা নিভু নিভু হয়ে এলো। মনে মনে উপরওয়ালার কাছে বুঝি প্রশ্ন তুললো ‘কেনো আমায় ছেলে বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠালেনা?’
খাবারের খোঁটা শুনে যেতে হচ্ছে দুমাস যাবত। বাবা অসুস্থ হয়ে ঘরে ঢোকার পর থেকেই তার দিক থেকে কোনো টাকাকড়ি সংসারে আসছেনা। পুরো ভারটাই ভাইয়ের কাঁধে। বাবা-মা আর দু’বোনের খাবার খরচ চালাতে গিয়ে দিনের মধ্যে কতবার যে ভাই-ভাবী মনে করিয়ে দিচ্ছে ‘তোমরা আমাদের ঘাড়ে বোঝা’।
মিতালী খানিক ঠান্ডা হয়ে আসা গলায় বলল,
-“দেখো ভাবী! পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুধু আমার স্বপ্ন নয়, বাবার ও স্বপ্ন। তোমরা প্লিজ এভাবে আমাদের স্বপ্নের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িওনা।”
পিয়ালী নিজের কথায় অটল রইলো। এই চারজন মানুষের উপর তেজ খাটিয়ে বেশ মজা পায় সে।
-“এত কথা বুঝিনা আমি। তুই তৈরি থাকবি। কোনো টুঁশব্দ যেনো না হয়। বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে আমেরিকা চলে যাবি, ফূর্তি করবি, আমাদের কিছু সাহায্য করবি। সেটা তো ভালোলাগবেনা, ভালোলাগবে আমাদের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে রসিয়ে রসিয়ে খেতে।”
পিয়ালী চলে গেলো। মিতালি মেয়েটাও ভঙ্গুর নয়। সেও নিজের সিদ্ধান্তকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভেতরে ভেতরে দাবানল পুষে রাখছে। বিয়েতে সে কিছুতেই বসবেনা। এখনই তাদের কদর নেই। তাকে বাড়ি থেকে বিদায় করে মা-বাবা আর মাহাকেও ছন্নছাড়া করতে এদের সময় লাগবেনা। টাকার লালসা এতটাই প্রকট যে, এরা টাকার বিনিময়ে সব করতে রাজি। হয়তো আমেরিকান পার্টির কাছ থেকে মোটা অঙ্ক খতিয়ে নেওয়ার আশায় এতসব বন্দবস্ত। এই দু’মাসে তোতা পাখির মতো মেয়েটি আস্তে আস্তে কঠিন হলো। এখন আর আগের মতো যেখানে সেখানে বুলি উড়ে না। বাস্তবাদী সমাজটা একটু একটু করে চিনে যাচ্ছে।
সময় ক্ষণ গড়িয়ে টিন চালা বাড়ির সামনে এক চকচকে গাড়ি থামলো। চার জোড়া পা গাড়ির বাইরে পড়লো। আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের বেশ ভালোভাবেই মিশিয়ে নিয়েছে। অবশ্য বিদেশে বসবাসরত মানুষগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আধুনিকতা বাস করবে এটাই স্বাভাবিক।
পিয়ালী আর মাহবুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের আপ্যায়নে। নাস্তা পানির ব্যবস্থা করে পিয়ালী ছুটলো মিতালি তৈরি হয়েছে কিনা দেখতে। তার আর বেশ প্রয়োজন পড়লোনা। পরনের হালকা মলিন জামা পরে মিতালি নিজেই উপস্থিত হলো আগত মেহমানদের সামনে।
মাহবুব কটমট দৃষ্টিতে পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলো। পিয়ালী দ্রুততার সহিত মিতালীকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলো। মিতালী গেলোনা। দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পাত্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
-“আমি বিয়ে করতে চাইনা। আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনাদের আসতে বলা হয়েছে।”
একজন ভদ্রলোক মিতালীকে দেখে নারাজ কন্ঠে মাকে শুধালেন,
-“আগে থেকে জেনেশুনে আসবেনা? তাছাড়া দেখে মনে হচ্ছে উনার সাথে আমার এইজের একটা লম্বা দূরত্ব রয়েছে? আ’ম থার্টি ফাইভ প্লাস।
এত ছোট মেয়ে দেখবে জানলে আমি আসতামই না।”
মিতালী প্রসন্ন হলো ভদ্রলোকের কথায়। তার কথার ধরনে বুঝে গেলো ইনিই বোধহয় পাত্র। ভদ্রলোকের পরিবার নেহাত ভদ্র বলে কোনো ধরনের ঝামেলা করলেননা। ঝামেলা বিহীন বিদায় নিলেন।
তারা বিদায় তো নিলো, কিন্তু পরিবারের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়টা কে থামাবে?
বাবা অসুস্থ, তিনি কিছুই করতে পারবেননা। মা হাজারবার ভাই-ভাবির কথায় দ্বিমত করলেও তাদের অগ্নিমূর্তি রূপ মাকে থামিয়ে দিয়েছে।
পাত্রপক্ষ বিদায় নিতে না নিতেই তান্ডব শুরু হলো। মাহবুব প্রচন্ড চিল্লাপাল্লা করে শেষে মিতালীর গায়ে হাত তোলার জন্য প্রস্তত হলো।
মিতালীর বাবার কান্নামিশ্রিত ডাক,
-“রোজী, ও মিতালীর মা। আমাকে ধইরা উঠাও। আমার মাইয়্যারে মাই*রা ফালাইবো।”
রোজী বেগম স্বামীর ডাকে যাবেন নাকি মেয়েকে সামলাবেন? স্বামীর কাছে না গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মাহবুব নামক হিং*স্র কবল থেকে বুকের ছায়ায় ঢেকে নিলেন মেয়েকে। মাহবুব ক্ষি*প্র গতিতে মিতালীকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। ভেতর ঘর থেকে মতিন সাহেব হাঁক ছাড়লেন।
-“মাহবুব! খবরদার কইতাছি আমার মাইয়্যার গায়ে হাত দিবিনা। আমি ভালা থাকলে আইজ তোর কলিজায় পাঁড়া দিয়ে ধরতাম।”
বাবাকে ধমকে উঠলো মাহবুব। অত্যন্ত দু*র্বৃ*ত্ত ও উঁচু গলায় জবাব দিলো,
-“আপনে কথা কইবেননা। ভালা জায়গায় বিয়ে দিতে চাইলাম, সেটা কি আর ভালা লাগবো? ভালা লাগবো আমার ঘাড়ে বসে বসে খাইতে। সংসারে রোজগার তো আপনে করেননা। আমি করি, তাই আমি বুঝি সব।”
মতিন সাহেব ও কম জাননা। বৃদ্ধ বয়সে শরীরের জোর, কর্মক্ষমতা কমে এলোও কন্ঠের জোর কমলোনা। তিনি বললেন,
-“আমার মাইয়া পড়ালেখা করবো। তোর মতো গন্ডমূর্খ থাকবোনা। কম চেষ্টাতো করিনাই তোর পড়ালেখার লাইগা। কত জায়গায় ভর্তি করাইলাম, লাভ হইলোনা। মনে ভ*ন্ডা*মি থাকলে কি আর মাথায় বিদ্যা ধরে?
আমি নাহয় সেকেলে পড়ালেখা না জানা মূর্খ মানুষ। কিন্তু আমার মাইয়্যারা শিক্ষিত হইবো।”
গণ্ডমূর্খ বলায় নিজের বাবাকে বি*শ্রী ভাষায় গা*লি*গা*লা*জ করলো মাহবুব। অতঃপর বলল,
-“কেমন শিক্ষিত হইবো আমার জানা আছে। এগো গন্ডি ব্যাডা মাইনষের বিছানা পর্যন্তই।”
এবারে মেয়েকে নিয়ে খা*রা*প ভাষা উচ্চারণ করায় উত্তেজিত হয়ে পড়লেন মতিন সাহেব। তিনি ভুলে গেলেন, তিনি চলনশক্তি হীন মানুষ। দু’মাস আগেই অক্ষম হয়ে একেবারে ঘরে ঢুকেছেন। তবে থেকেই সংসারে অশান্তি বাড়লো।
মতিন সাহেব বিছানা থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে নিচে পড়ে গেলেন। শব্দ পেয়ে মিতালী মায়ের বুক থেকে উঠে দৌঁড়ে বাবাকে দেখতে গেলো। আ*ত*ঙ্কিত গলায় “মা” বলে ডাক দেওয়ার পূর্বেই রোজী বেগম উপস্থিত হলেন। মা মেয়ে মিলে বিছানায় তুললো মতিন সাহেবকে।
ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে বুকে টে*নে নেলেন মতিন সাহেব। অত্যন্ত দুঃখী গলায় বললেন,
-“আব্বা অক্ষম বইলা তোদের এত কষ্ট সহ্য করতে হইতেছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর, আব্বা যাতে আবার সুস্থ হইয়া যাই। নয়তো আমারে নিয়া গিয়া তোদের ঘাড় থেকে একটা বোঝা কমাইয়া দিক।”
রোজী বেগমের চোখেও পানি। মিতালীর ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলেও চোখে পানি আসতে দিলোনা। অল্প বয়সী মেয়ে হলেও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলো। আব্বা,মা তো অনেক আগেই ভে*ঙে*ছে*ন। মাহা ছোট মানুষ, আর বাকি রইলো সে। এখন সবাই ভেঙে পড়লে খুঁটি হয়ে দাঁড়াবে কে?
মিতালী আব্বাকে শান্তনা দিয়ে বলল,
-“আব্বা দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একদিন চাকরি করবো। তুমি, মা, মাহা সবাই মিলে কত আনন্দ করবো। তুমি এখন ম*রা*র কথা কেন বলো? তুমি নিজের মেয়েদের সুখ দেখে যেতে চাওনা? তাদের রোজগারে খেয়ে যেতে চাওনা?”
মতিন সাহেব হাসলেন। মনে মনে বোধহয় ভাবলেন “আমার সেদিনকার ছোট্ট মেয়েটা কত্ত বড় হইয়া গেছে।”
পরিবেশ আপাততের জন্য শান্ত হলো।
মিতালী মতিন সাহেবের দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। মাহবুবের মা মা*রা যাওয়ার পর কিছুদিন তার দাদি-ফুফু লালন-পালন করলেও পরক্ষণে মতিন সাহেবকে বিয়ের জন্য চাপ দিলেন। তারা কতকাল এই ছেলেকে লালন-পালন করবে? বছর তিনেক যাওয়ার পর মা বোনের পিড়াপিড়িতে মতিন সাহেবকে বিয়ের আসনে বসতে হয়। সব ঠিকঠাকই ছিলো। মাহবুবও রোজীকে আপন করে নিয়েছিলো, রোজী বেগমও মাহবুবকে নিজের গর্ভের সন্তানের মতো লালন-পালন করেছেন। বিপত্তি ঘটলো মাহবুবের বছর পনেরো বয়স হওয়ার পর। আশেপাশের মানুষ তার কানে বি*ষ ঢালতে শুরু করলো। রোজী বেগম কখনো ওর ভালো চাননা, সব নিজের সন্তানের জন্য করছে। এক সময় মতিন আর রোজী বেগম ওকে লা*থি মে*রে সংসার থেকে দূরে ছুঁ*ড়ে ফে*ল*বে। সেই থেকেই মাহবুবের মাঝে আস্তে আস্তে পরিবর্তন শুরু হয়। তার এমন অ*স*ভ্য ব্যবহারে গ্রামের মানুষ এখন আর তেমন কিছু বলেননা। তার বউয়ের ভা*ষাও অত্যন্ত বি*শ্রী। আশেপাশের কয়েকজন মহিলা তার শাশুড়ীর পক্ষে প্রতিবাদ করতে আসলে তাদের ও গা*লা*গা*ল করে। কথা দ্বারা মহিলাগুলোকে মাহবুবের বিছানা পর্যন্ত নিয়ে আসে। ইজ্জতের ভ*য়ে মানুষ এখন কিছুই বলেনা।
বিষাক্ত স্বাদের দিন গড়িয়ে ধরার বুকে আঁধার নামলো। বইপত্র গুছিয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মাহার পাশে শুয়ে পড়লো মিতালী।
আজ আর ঘুমেরা ধরা দিতে চাইছেনা।
এতদিন বাবার ভরসায় কোনো চাকরি-বাকরি করেনি। মূলত বাবাই না করে দিয়েছে। তাছাড়া এই অল্পবিস্তর পড়া দিয়ে চাকরি পাওয়া দুর্বোধ্য ব্যাপার। টিউশন দিয়ে নিজের পড়ার খরচ চালায়। এতদিনে বুঝলো ছোটখাটো একটা চাকরি তার দরকার। ম্যাথেমেটিকস নিয়ে ন্যাশনালে ২য় বর্ষে পড়ছে। দূর থেকে হুতুম পেঁচা ডেকে চলেছে করুন সুরে।
মন কেমন কু ডাকছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা অকল্যাণকর হবে। কিছু একটা হবে। প্রায় শেষরাতের দিকে চোখজোড়া মুদে আসলো।
পাখির কলতানে মিষ্টি ভোরে নতুন দিনের আগমন ঘটলেও দিনটি মিতালী আর তার পরিবারের জন্য মিষ্টি ছিলোনা। আটকে আসা নিশ্বাসে চোখের কোল ঘেষে দু’ফোঁটা জল গড়ালো। এটাই কি কপালে লিখা ছিলো? এতটা অপদস্ত হতে হলো?
#চলবে…….
#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব
()