#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব- ৫
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা এক গুচ্ছ গোলাপ দেখে খানিকটা অবাক হলো ইনায়া। রেহান! ও ছাড়া তো আর কেউ নেই বাসায়।
-“তোমার জন্য আনিনি। এত অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
আকস্মিক কন্ঠ কানে এতেই পিছনে ফিরে দেখে বারান্দার দরজার একদিকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেহান। ইনায়া খেয়াল করেনি এতক্ষণ যাবৎ কেউ এখানে ছিল। শান্ত চোখে রেহানের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল ইনায়া। একদম ভালো লাগছে না ওর! মনের মধ্যে ভয়, আশঙ্কা, দ্বিধা, সন্দেহ সব যেন একসাথে বাসা বেঁধেছে। ইনায়া ফুলগুলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখেই রুম থেকে বের হচ্ছিল।
-“জিজ্ঞেস করবে না কার জন্য এনেছি?”
-“জিজ্ঞেস করলেই কি আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাবো?”
নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা বলে একবার রেহানের দিকে তাকালো ইনায়া। ইনায়া যে কিছু একটা নিয়ে আপসেট সেটা রেহানের বুঝতে অসুবিধা হলো না। বারান্দার দরজা থেকে সরে এসে বিছানায় বসে পড়লো রেহান। শান্ত চাহনিতে ইনায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি জানতে চাও তুমি?”
-“আপনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন তাই না!”
ইনায়ার করা প্রশ্নে মৃদু হাসলো রেহান। যেন ইনায়া বোকার মতো কোন প্রশ্ন করেছে।
-“আমি নিজে তোমার জন্য তোমার চাচার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আই হোপ এতে তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছো।”
ইনায়া ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলটাতে বসে পড়লো। এবার রেহানের দিকে না তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-“আপনি আমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলেন?”
রেহান ইনায়ার মুখে প্রশ্নটা শুনে কিছু বললো না। চুপচাপ এক দৃষ্টিতে ইনায়ার দ্বিধাভরা চোখে তাকিয়ে ছিল।
বারান্দা ভেদ করে এক ফালি রোদ এসে ইনায়ার চোখে মুখে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে ওর তারপরও চোখ পিটপিট করে হলেও সেদিকে তাকিয়ে আছে। যেন কড়া রোদে তাকিয়ে থাকা ওর কাছে রেহানের চোখে তাকিয়ে কথা বলার থেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের মনে হচ্ছে! রেহানের মাথায় কথাটা আসতেই চেহারায় এক কাঠিন্য ভাব ফুটে উঠলো। অনেকক্ষণ যাবৎ রেহান কোন কথা না বলায় ইনায়ার চোখ বিছানায় বসে থাকা মানুষটার দিকে গেল। সামনের দিকে কেমন কটমট করে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলায় ইনায়ার তেমন একটা ভয় লাগেনি কিন্তু এখন সেটা মনে হচ্ছে না। ও কি কোন ভুল প্রশ্ন করলো?
তখনই ওদের কানে কলিং বেলের আওয়াজ ভেসে এলো। মুহূর্তেই রেহান নিজেই উঠে গেল আর যাওয়ার আগে বেশ শব্দ করেই দরজাটা আটকে দিল। হঠাৎ এমন জোড়ালো আওয়াজ কানে আসায় খানিকটা কেঁপে উঠলো ইনায়া।
একবার ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা গোলাপগুলোর দিকে নজর দিল। সবচেয়ে প্রিয় ফুল ছিল ওর। ছিল! এখন কেন যেন সেরকম অনুভূতি মনে জাগ্রত হয় না। রক্তিম রঙের ফুলগুলো কেন যেন ফিকে মনে হচ্ছে ওর কাছে। আশেপাশের সবকিছু শুধু বিষাদময়! ইনায়া আর ফুলগুলো ধরলো না। কি দরকার অন্য কারও জিনিসে হাত দেয়ার। ওর মস্তিষ্কে এখনো সেই কালো গাড়ির স্মৃতি ঘুরছে। রেহানকে এই বিষয়ে প্রশ্নটা করতেও পারলো না।
________________
রেহান দরজা খুলতেই হুরমুর করে পাঁচ কি ছয় বছরের এক বাচ্চা মেয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো আর সাথে আরেকজন মেয়ে। দেখে রেহানের বয়সেরই মনে হচ্ছে। বাচ্চাটা হুট করে রেহানের কোলে চড়ে বসলো।
-“মামু তুমি বউকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ তাই না!”
বাচ্চাটার পাকা পাকা কথা শুনে হঠাৎ হেসে উঠলো রেহান। ইনায়া মনোযোগ সহকারে রেহানের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। একটু আগেই যে রাগ দেখিয়ে বের হলো তার ছিটেফোঁটাও এখন রেহানের মুখে নেই।
-“আমি আমার মারিয়া মামণিকে কি করে ভুলতে পারি!”
-“হয়েছে! আর ঢং করতে হবে না! মারিয়া নিচে নেমে এসো! তোমার নতুন মামীর সাথে কথা বলবে না!”
-“জান্নাত, বকিস না তো ওকে। আমারই দোষ, একবারও খবর নেই নি! সরি মামণি!”
মারিয়া রেহানের কোল থেকে নেমে ইনায়ার দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে তাকাতে দেখে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল ইনায়া। বুঝলো না মেয়েটা ওর উপর এত রেগে আছে কেন। বাচ্চাদের ইনায়া এমনিও ভিষণ পছন্দ করে। কিন্তু মারিয়াকে দেখে যতটুকু বুঝলো ও ইনায়াকে মোটেও পছন্দ করে না।
__________________
ছোফায় বসে টুকটাক গল্প করছিল তিনজন। ইনায়া চা এনে জান্নাতকে দিতেই জান্নাত মৃদু হেসে ইনায়াকে ওর পাশে বসালো। জান্নাত সম্পর্কে রেহানের জমজ বোন। রেহানের দুই মিনিট আগে ওর জন্ম।
সত্যি বলতে এবারও অবাক না হয়ে পারলো না ইনায়া। নাজনীন, জান্নাত সবার ব্যাপারেই ও বেশ পড়ে জানতে পারলো। ওতো সেদিন মনে করেছিল রেহানের হয়তো একটাই বোন! ওর শ্বাশুড়িও বলেছিল নাজনীন রেহানের একমাত্র ছোট বোন। হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু ইনায়ার দাদী শ্বাশুড়ি কেন যেন তাকে চুপ করিয়ে দিল। যদিও কথাটা একদিক দিয়ে ভুলও ছিল না। জান্নাত এমনিও রেহানের ছোট বোন না।
কিছুই জানে না ও রেহানের ব্যাপারে। ও বাড়ির কেউই প্রয়োজন ছাড়া ওর সাথে কথা বলেনি। যদিও ইনায়ার শাশুড়ী আর দাদী শ্বাশুরী টুকটাক কথা বলে। কিন্তু তাও প্রয়োজনে। ওর স্পষ্ট মনে আছে বারান্দায় রেহান জান্নাত নামের কারো সাথে কথা বলছিল। ইনায়া কি না কি মনে করেছিল! নিজের কাছেও এখন অদ্ভুত লাগছে। আর ও নিজেও তো কখনো রেহানের পরিবার সম্পর্কে জানতে চায়নি!
বেশ হাসিখুশি আর বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। যদিও জান্নাতের মেয়ে মারিয়া কেন যেন মুখ ফুলিয়ে আছে। ইনায়া তাকাতেই মুখ ভেঙচিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয় আর সাথে সাথে জান্নাতের ঝাড়ি খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রেহান এসে ফুলগুলো মারিয়ার সামনে ধরতেই ওর চোখটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ছো মেরে ফুলগুলো নিয়ে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানালো মারিয়া।
ফুলগুলো হাতে নিয়েই মারিয়া বায়না ধরলো ও ছাদে যাবে। সে কি জেদ ওর! রেহানও যেন হার মেনে যায় এই পিচ্চির কাছে। পরে জান্নাতও বললো ওদের সবারই যাওয়া উচিত। ইনায়ারও হয়তো ভালো লাগবে। ইনায়া খেয়াল করলো জান্নাত বেশ সুন্দর আর গোছালোভাবে কথা বলে৷ সকাল থেকে মনটা কেমন বিষিয়ে ছিল। এখন নিজেকে কিছুটা হালকা মনে হচ্ছে। এতদিন পর কোন মানুষের সাথে মন খুলে কথা বললো ইনায়া। স্বভাবতই ওর অস্বাভাবিক আচরণে প্রায় সবাইকেই ওর প্রতি বিরক্ত হতে দেখতো ইনায়া। কিন্তু জান্নাতের মধ্যে কোন বিরক্তবোধ অনাগ্রহ কিছুই পেল না ইনায়া।
ছাদে যেতেই আবারও অদ্ভুত কিছুর সম্মুখীন হলো ইনায়া। ছাদের একপাশে খেলছে মারিয়া আর সেদিকেই ফোনে কথা বলছে রেহান। কিছুক্ষণ পর জান্নাতের ফোনে কল এতেই জান্নাতও ইনায়ার থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল। রোদটা আগের থেকে অনেকটাই কমে গেছে। বিকেলের তাজা হাওয়া গায়ে লাগতেই বেশ ভালো লাগছিল ওর। কিন্তু হঠাৎই একটা কথা কানে এতেই মুহূর্তেই সেই হাসি উবে গেল।
চলবে…