নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-৪

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব – ৪

-“স.. সরি! আমি কফিটা রেখে যাচ্ছি!”
কথাটা বলে রেহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ইনায়া ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রেহান তড়িঘড়ি করে কথা শেষ করে বিছানায় বসে কফির মগটা হাতে নিয়ে কি যেন ভেবে মলিন হাসলো।

ইনায়াকে প্রথম যেদিন দেখেছিল স্পষ্ট মনে আছে সেদিন। চঞ্চলতায় ভরপুর এক তরুনিকে দেখেছিল ইনায়ার মাঝে। যদিও আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। ইনায়া হয়তো রেহানকে চিনতে পারেনি। সত্যি বলতে রেহান তা চায়ও না!
সেদিন মার্কেট থেকে বের হতেই নিজের কালো শার্টে আইসক্রিম নামক খাদ্যটিকে লেপ্টে থাকতে দেখে বেশ বিরক্তি নিয়েই সামনে দাড়ানো আঁখিজোড়ায় চোখ রাখলো রেহান। মেয়েটা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজের ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু বের করে রেহানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মূদু কন্ঠে সরি বলেই দৌড়ে চলে গেল। মেয়েটির যাওয়ার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ রেহান। ফোনে মেসেজ আসতেই ফোনটা বের করে স্ক্রিনে ভেসে থাকা মেয়েটার ছবিতে চোখ বুলালো ও। সাথে কিছু টেক্সট। তৎক্ষনাৎ চোখ মুখ শক্ত করে তাকলো রেহান। ইনায়া এখনও তার আশেপাশের অবস্থা সম্পর্কে অবগত না। নিজের বান্ধবীদের সাথে বেশ হাসিখুশি হয়েই কথা বলছিল। তার মুখের হাসি দেখে কেউ একজন যে রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল তাতে কোন ধ্যান নেই ইনায়ার।

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে টনক নড়লো রেহানের। রেহানের দাদী এসে রেহানের পাশে এসে বসলো।
-“কিছু কিছু জিনিস নিয়ে মাথা না ঘামানোই আমাদের জন্য উত্তম। যা হওয়ার হয়ে গেছে! ছয় মাস হল হাবিব মারা গেছে! সব কিছু ভুলে ইনায়াকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু কর।”

-“চাইলেই কি সব ভুলে থাকা যায়! আমার কাজ তো এখনো শেষ হয়নি!”

রেহানের কথা শুনে ওর দাদাী জেরিন বেগম বেশ ক্রোধান্বিত চোখে রেহানের দিকে তাকালো।
-“সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। অনেক সময় নষ্ট করেছ নিজের। আর না! ধৈর্য রাখ।”

রেহান জেরিন বেগমের চোখের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,
-“সবাই এখনো আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। আমার মা আমার দিকে ঘৃণার চোখে তাকায়! আসলেই কি সব ঠিক হয়ে গেছে!”
রেহানের কথা শুনে জেরিন বেগম আর কিছু বললো না। রেহানের কাধে একবার হাত রেখে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইনায়ার কথা ভাবতেই মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রেহানের। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই ঘুমে তলিয়ে গেল ও। কাল রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি। মাথাটাও ধরে আসছে।

ইনায়া এক দৃষ্টিতে গ্যারেজে থাকা কালো গাড়িটার দিকে আছে। নাজনীন ইনায়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ভাবী এখানে কি করছো?”
ইনায়া নাজনীনের কথার কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
-“গাড়িটা কার?”
-“গাড়িটা রেহান ভাইয়ার। মেরামতে ছিল এতদিন!
ইনায়ার চোখ এখনো গাড়িটার দিকে। বিশেষ করে হেডলাইটের দিকে। পুরো গাড়ি কালো হলেও হেডলাইটের চারদিকে হালকা নীল রঙের।ওর মনের মধ্যে চলছে হাজারো চিন্তা। আজ সকালে যা হলো তাও মাথা থেকে যাচ্ছে না। একবার নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয় যে এই রকম গাড়ি তো আরও অনেক আছে। এটা সেই গাড়ি নাও হতে পারে। কিন্তু সকালের ব্যাপারটাও ফেলে দেয়ার মতো মনে হচ্ছে না। রেহান ওকে বিয়ে কেন করলো! ঐখানে আর দাড়িয়ে না থেকে বাড়ির ভেতর চলে এল ইনায়া। নাজনীনের আর কোন কথা ইনায়ার কানে যায়নি। আজকে রেহানের সাথে কথা বলতেই হবে ওকে।

ঘুমের মধ্যে রেহানের মনে কেউ একজন পানি ছুড়ে মেরেছে ওর উপর। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। রাগী চোখে সাইডে তাকিয়ে দেখে ইনায়া বালতি হাতে রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রেহান একবার চোখ কচলে আবার ইনায়ার দিকে তাকালো। বিশ্বাস হচ্ছে না যেন ওর!

-“কে আপনি?”
ইনায়ার প্রশ্ন বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো রেহানের। একেতো কাঁচা ঘুমটা ভেঙে চুরমার তার উপর এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে বিছানার ওপর আধশোয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থেকে হুট করে বিছানা থেকে উঠে ইনায়ার গালে হাতে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলতে লাগলো,
-“আমি সত্যি জানি না আমার এই মুহুর্তে কী অনুভূতি হওয়া উচিত! রাগ হওয়া উচিত কারণ বিয়ের দুই মাস পরও আমার বউ আমাকে চিনতে পারছে না নাকি খুশির হওয়া উচিত কারণ তার চোখে ভয় ছাড়াও অন্য কোন অনুভূতি দেখছি আমি!”
ইনায়ার কপালের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে ইনায়ার চোখে তাকায় রেহান। ইনায়া সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিশ্বাসও যেন নিচ্ছে না মেয়েটা। রেহানের চোখ ইনায়ার অনবরত কাঁপতে থাকা ঠোঁটে পড়লো। একবিন্দু অশ্রু ইনায়ার চোখ থেকে ঠোঁটের পাশে গড়িয়ে পড়ার আগেই রেহান হাত দিয়ে তা মুছে ইনায়ার থেকে দূরে সরে গেল।

চোখ খুলে সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে ইনায়া ধপ করে ওখানেই বসে পড়লো। রেহানকে অবিশ্বাস করার কোন ইচ্ছেই ওর মনে নেই। কিন্তু পারছে না বিশ্বাস করতে! হঠাৎ গলায় তিব্র ব্যাথা অনুভব করে ইনায়া। ধীরে ধীরে গলার যন্ত্রণার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শ্বাস আটকে আসতে। গলায় হাত রেখে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেও কোন লাভ হচ্ছে না। বারবার কানে সেই কুৎসিত হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে এখনি হয়তো কেউ ওর দিকে ধেয়ে আসবে!
ইনায়া কোথায় কোন পরিবেশে আছে এসবের কোন খেয়ালই ওর মাথায় নেই। ইনায়াকে এভাবে দেখে রেহান ওকে ধরার চেষ্টা করতেই ইনায়া আচমকা রেহানকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের দিকে পিছিয়ে যায়। মনে হচ্ছে যেন দেয়ালেই মিশে যেতে চাচ্ছে। ইনায়াকে এই অবস্হায় দেখে রেহানের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ তাও নিজেকে সামলে ইনায়ার দিকে কিছুটা আগাতেই ইনায়া দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
-“একদম আমার কাছে আসবি না!”
ইনায়ার কথা শুনে রেহান ওখানেই বসে পড়লো। আর আগালো না। ইনায়া এখনো একই কথা চিৎকার করে বলছে। রেহান এক দৃষ্টিতে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। জান্নাত হয়তো ঠিকই বলছিলো। রেহানের এত দেরি করা উচিত হচ্ছে না। ইনায়ার মানসিক অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যাচ্ছে!
ইনায়ার চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে সেই রুমে এসে হাজির। রেহানের মা ইয়াসমিন এসেই ইনায়াকে গিয়ে জরিয়ে ধরলো। ইনায়া ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ইয়াসমিন রেহানের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। ইনায়া জ্ঞান হারাতেই রেহান ওকে খাটে শুইয়ে দেয়। বাড়ির সকলে ওর দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি ছুড়লেও রেহান কিছু না বলে ইনায়ার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে ফোন বের করে রুমের বাইরে চলে গেল।

ডাক্তার ইনায়াকে দেখে যেতেই রেহানের বাবা রিয়াদ খান রেহানকে নিজের ঘরে আসতে বলে চলে গেল। রেহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের বাবার ঘরের দিকে গেল।
-“এতদিন জানতাম আমার ছেলে একটা ধর্ষিতা মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসেছে। এখন তো দেখছি মেয়ে পাগলও। আমার মাথায় ঢুকছে না এমন একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করতে গেলি?”

রেহান চোখমুখ শক্ত করে বললো,
-“ইনায়া পাগল না!”
রিয়াদ রক্তচক্ষু নিয়ে রেহানের দিকে তাকিয়ে আছে। রেহানের তাতে কোন ভাবান্তর নেই।
-“পাগল না তো কী? এসব নষ্টা পাগল মেয়েকে পাগলাগারদেই মানায়! কারও বাড়ির বউ হিসেবে না!”

-“আপনার যা ইচ্ছে হয় আমাকে বলেন আমি একটা টু শব্দও করবো না কিন্তু ইনায়ার ব্যাপারে না!”
রেহান জোরগলায় কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইনায়ার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। রেহান কি যেন মনে করে ইনায়াকে কোলে নিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রেহানের দাদী বারবার থামতে বললেও রেহান শোনেনি। গাড়িতে বসেই ইনায়ার মাথা নিজের কাঁধে রেখে ওর সিটবেল্টটা ধরতেই দেখে ইনায়া পিটপিট করে চোখ খুলছে। রেহান তৎক্ষনাৎ ইনায়ার থেকে দূরে সরে যায়। ইনায়া উঠেই রেহানের কাঁধে নিজের মাথা দেখে হুট করে মাথা উঠাতে গিয়েও মাথা চেপে ধরে ও। তাও রেহানের থেকে কিছুটা দূরে সরে বলে,
-“আমরা চলে যাচ্ছি?”
ইনায়ার দুর্বল ধীর কন্ঠ শুনে ওর দিকে তাকায় রেহান। এখনো কন্ঠে ভয়ের আভাস লেগে আছে। রেহান ইনায়ার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে চোখ রাখে। ইনায়ার ওকে ভয় পাওয়াটা ওর আর সহ্য হচ্ছে না। রেহান চায় ইনায়া ওকে ভরসা করুক, বিশ্বাস করুক! পুরো রাস্তা দুইজন চুপচাপ ছিল। বাসায় পৌঁছাতেই ইনায়া রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। রেহান নিজের রুমে গিয়েই ফোনটা হাতে নিল।

-“ঠিকই বলেছিলি জান্নাত। আসলেই দেরি করা উচিত হয়নি!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here