নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব ৮

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#পর্ব_8

১৪.
পড়াশোনা আমার সব তুঙ্গে উঠল। যতোই ভাবি এই লোকটা থেকে দুরে থাকব, কিছুতেই লোকটাকে আর মনে করব না ঠিক সেই সময়টাতেই তিনি এসে আবার আমার জীবনে হানা দেয় আর নিজের উপস্থিতির জানান দিয়ে যায়। কিন্তু ধরা দিয়েও যেন আর ধরা দেয় না। আমি তাকে ধরতে পারি না। ধরে রাখতে পারি না আমার জীবনে। খুব কাছে এসেও আমাকে ফাকি দিয়ে আবারও দুরে চলে যায়। শত শত মাইল দুরে, আগেও থেকেও অনেক দুরে।আমার ধরা ছোয়ার একেবারে বাইরে শুধু তার অস্তিত্ব টুকু থেকে যায় আমার জীবনে।

রাতে যে আর ঘুম হবে না জানি তাই অযথা আর রুমে বসে থাকলাম না। ফোনটা তো তখনই বন্ধ করে দিয়েছি। ঘর থেকে বেড়িয়ে চুপি চুপি ছাদে আসলাম। আজ আকাশে বিশাল বড় একটা চাঁদ উঠেছে। তারায় তারায় আকাশটা ভরা। সেই তারাদের মধ্যে আমি আমার বাবা মাকে খুঁজতে শুরু করলাম।

ছোট বেলায় যখন খুব বেশী মন খারাপ হত তখন আমি এমন ভাবেই ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলতাম। নিজের সব অভিযোগ গুলো আকাশকে বলতাম। কারণ আমার অভিযোগ গুলো বলার মতো কেউ ছিল না তাই আকাশের কাছে গচ্ছিত রাখতাম।

আর তখনই আশ্চর্য ভাবে আবিষ্কার করি আমি কথা বলার সময় যেন দুটো তারা আমার কথার রেসপন্স করে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে কোন প্রশ্ন করলে তারা দুটো মিটমিট করে জ্বলে আর নেভায়। আর তাদের সেই মিটমিটে আলোয় আমি যেন আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়, শত শত ব্যথার মলম হয়ে কাজ করত সেটা।
মুহূর্তের মধ্যে মন ভাল করার টনিক ছিল সেই তারা দুটো। তখন অনেক ছোট ছিলাম তাই মাথার মধ্যে রূপকথার গল্পরা ঘুরত আর আমি রুপকথার গল্পের মতো ভাবতাম এরাই বুঝি আমার বাবা মা, মৃত্যুর পর উনারা এমন তারা হয়ে গেছে। তাই আমার কথায় তারা অমন করে উত্তর দেয়।

একটু বড় হওয়ার পর আমার ভুল ধারনাটা ভেঙ্গেছিল কিন্তু অতিরিক্ত মন খারাপে আজও তাদের সাথে কথা বলেই আমার মন ভাল হয়। আকাশে সেই তারা দুটি দেখলে আমার মনে হয় আমার বাবা মা সবসময় আমার পাশে আছে। ওই দুর আকাশ থেকে ওরা আমাকে দেখছে। একজন বাবা মা হারা অনাথ মেয়ের জন্য এই অনুভুতিটাই অনেক সেটা যাদের বাবা মা নেই তারাই বুঝবে।

সারা রাত তারাদের সাথে কথা বলে সকালের দিকে ঘরে আসলাম। এখনও সবাই ঘুমাচ্ছে। আমিও চুপিচুপি এসে শুয়ে পড়লাম। সারা রাত না ঘুমানোর ফলে ঘুমও আসল খুব তাড়াতাড়ি। আর মনে মনে ভাবলাম এই ঘুম যেন আজ বিকেলের আগে না ভাঙ্গে। আমি আজ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাব। যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় তাই উঠে দুটো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলাম। এখন আর কেউ ডাকলেও আমার ঘুম ভাঙ্গবে না।

১৫.
সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গলো কারও চেঁচামেচির আওয়াজে। সেটাকে অবশ্য সকাল বলা যায় না। দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটা টংটং করে বেজে স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সকাল পেরিয়েছে অনেক আগেই। ঘুম ঘুম ভাবটা আমার তখনও কাটে নি। বেড থেকে উঠে কোন রকমে টলতে টলতে ওয়াশ রুমের দিকে গোলাম। পিছনে তখন তানজি অবাক চোখে আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে থাকল।

ওয়াসরুম থেকে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দেখলাম তানজি মুখ কালো করে বসে আছে আর সংযুক্তা তার ঘাড়ে হাত রেখে ওকে কিছু বোঝাচ্ছে। আমাকে দেখে সংযুক্তা আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকাল। আমি ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। আমার ঘুম এখনও পুরোপুরি কাটে নি হয়তো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার জন্য এমনটা হয়েছে। আরও বেশ কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিলে বেশ ভাল হতো।

সংযুক্ততা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, তোর কি হয়েছে বলতো?

আমি ভারী অবাক হওয়ার ভান করে ওর দিকে তাকালাম। আমার আবার কি হবে? কিন্তু ওই বেটির কি হয়েছে এমন করে বসে কেন? একটু আগে চেঁচামেচি করছিল কেন?

– জানি না তো কিছু বলছে না। তুই একটু জিজ্ঞাসা করে দেখবি?

আমার শরীর মোটেও সায় দিচ্ছে না তবুও পা উঠিয়ে এগিয়ে গেলাম তানজির দিকে। আমার দিকে একবার চোখে তুলে চেয়ে তানজি যেন কেমন কেপে উঠল। ওর হাতদুটো দিয়ে সজোরে আমার হাত ধরে অকুতি স্বরে বলে উঠল আমার না অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে তুই আমাকে হেল্প করবি?

ওর পাশে বসে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, কথা না পেঁচিয়ে যা বলবি সোজাসুজি বল

– আমি তোকে এখন কিছুই বলতে পারব না কিন্তু তোকে আমার সাথে যেতে হবে না হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

– তখন থেকে কি ক্ষতি, কিসের সর্বনাশের কথা বলছিস বল তো।
– বললাম তো এখন কিছু বলতে পারব না আমি। প্লিজ তোরা আমাকে হেল্প কর। আমাকে একজনের সাথে দেখা করতে যেতে হবে কিন্তু একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। প্লিজ কাম উইথ মি,,,

তানজিকে এতো ভয় পেতে দেখে বুঝলাম ঘটনা সুবিধার নয় না হলে এতো ভয় পেত না ও। এমনি তে তানজি বেশ সাহসী মেয়ে। সংযুক্ততাও আমাদের সাথে যেতে রাজি হল।

কিন্তু আমার নিজের আবস্থা খুব একটা ভাল নয়। কাল রাত থেকে পেটে কিছুই পড়ে নি তার সাথে কাল সারা রাত কান্না করার ফলে চোখ দুটো প্রচন্ড জ্বালা করছে। আর দুটো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফল এখন পাচ্ছি চোখ থেকে ঘুম কিছুতেই কাটছে না, নিজেকে অধো ঘুমে আধো জাগরনে আবিষ্কার করছি। কিন্তু আমি এর মধ্যেও রেডি হয়ে নিলাম।

চোখ জ্বালা করার জন্য গাড়িতে পুরোটা সময় আমি চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম তাই কোথায় যাচ্ছি খেয়াল করি নি। কিন্তু কিছু সময় পর নিজেকে একটা সরু গলিতে আবিষ্কার করলাম। এখানে মানুষের আনাগোনা খুব একটা নেই বললেই চলে। যায়গাটা বেশ নির্জন। আমি তানজির হাত খামচে ধরে ওর দিকে তাকালাম।
তানজি চোখ দিয়ে ইশারা করে আমাকে চুপ থাকতে বলল। আমি আর সংযুক্ততা খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম তানজির সাথে। কিছুদুর যেতেই এক যায়গায় কিছু মানুষের জটলা দেখে আমি আর সংযুক্ততা থমকে দাড়ালাম। তানজি আমার হাতটা ধরে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে এগুতেই দেখলাম এটা একটা কাজি অফিস।

আজ এতো বছর এই শহরে আছি কিন্তু এদিকটাই এর আগে কখনও আসা হয় নি তাই এমন নির্জন জায়গায় এমনটা কাজি অফিসের সন্ধানও আমার জানা ছিল না। কিন্তু তানজি হঠাৎ এখানে কেন এলো সেটাই বুঝছি না। কিন্তু তানজি আমার কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা কাজি অফিসের ভিতরে ঢুকে গেল।

অফিসের ভিতরে একজন কাজি বসে আছে। তবে বিভিন্ন কাগজপত্র দেখতে তিনি ব্যস্ত। আর টেবিলের অপর পাশে বেশ কয়েটা ছেলে দাড়িয়ে আছে তার মধ্যে বেশ হাসি মুখ নিয়ে সবার সামনে দাড়িয়ে আছে বিহঙ্গ। তাকে দেখে আমার মনটা ভরে গেল। কি সুন্দর হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে, তার হাসিটা বেশ সুন্দর। ও হাসলে পুরো মুখটা একসাথে হাসে, ওর চোখ, ঠোঁট, কপাল, ভ্রু জুগল এমনি মুখের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দাড়ি গুলো পর্যন্ত হাসে।

বিহঙ্গ হাসতে হাসতেই আমার দিকে তাকাল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল, মুখটা দেখে মনে হল শত শত মোমবাতির আলো যেন ধপ করে নিভে গেল। যে চোখগুলো একটু আগে হাসছিল সেগুলোই যেন মুহূর্তের মধ্যে লাল বর্ণ ধারন করেছে। মুখটাও বেশ থমথমে।

তবে আমি এটা বুঝতে পারছি না যে এখানে কার বিয়ে হবে। আচ্ছা বিহঙ্গ তো বলেছিল ও আমার কোন ফ্রেন্ড কে ভালবাসে আর এবার তাকে বিয়ে করবে। তাহলে কি সে তানজি? বিহঙ্গ কি তাহলে তানজিকে ভালবাসে?

মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখ ফেটে আবার পানি আসতে চাইল কিন্তু আমি বাধা দিলাম এখন কাঁদলে হবে না এখন আমাকে শক্ত থাকতে হবে। আমি বিহঙ্গের দিকে আর একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

কাজি বেশ তাড়া দিচ্ছে। তার আরও অনেকগুলো বিয়ে পড়াতে হবে। ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে একজন বলল, আপনি শুরু করুন চাচা আমরা সবাই তৈরী।
কাজি তার কাজ শুরু করলেন। বিহঙ্গ এখন হাসছে না তবে ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। কাজি আগে মেয়ের বিয়ে পড়াবে। আমি আসতে করে একটু পেছনে যেতে চাইলাম কিন্তু তানজি আমাকে যেতে না দিয়ে সেখানেই শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে থাকল। তানজির মুখটাও বেশ থমথমে আর মুখ করে করে দাড়িয়ে আছে। আমি মাথা নিচু করে আছি। কিন্তু হঠাৎ কাজির মুখে মেয়ের নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম।

চকিতে ফিরে তাকালাম বিহঙ্গের দিকে। বিহঙ্গ তখন বিষাদময় একটা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে কাজি তাড়া দিচ্ছে কিন্তু তাতে আমাদের দুজনেরই কোন হেলদোল নেই। আমরা দুজন তাকিয়ে আছি একে অপরের চোখের দিকে। হয়তো দুজনেই চোখের ভাষা পড়তে চাইছি দুজনের,,,,
হয়তো খুজছি দুজনের মনের মধ্যে জমা হওয়া হাজার হাজার প্রশ্নের উত্তর,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here