নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব শেষ

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#শেষ_পর্ব

বিহঙ্গ দ্রুত এসে আমার হাতটা চেপে ধরে আমার পাশে দাড়াল। কিন্তু আমি তখনও এদিক সেদিক তাকাতে ব্যস্ত। আসলে এখানে কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছি। সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর আমি হাবলার মতো সবার দিকে তাকাচ্ছি। পূর্বদিকের জানালাটায় বসে থাকা শালিক পাখিটাও যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছে কিচিরমিচির করে। দুরে কোথাও থেকে থেমে মাধবীলতার গন্ধ ভেসে আসছে। মুহূর্তেই আমার মনটা ভাল হয়ে গেল। এই এত কিছু যেন ভাল কিছুরই সংকেত বয়ে আনছে।

কাজি সাহেব আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বল মা তুমি কি রাজি আছ রাজি থাকলে আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল বল।
মনের ভেতরটা প্রচণ্ড ছটপট করছে। আমি আবার বিহঙ্গের দিকে ফিরে তাকালাম। বিহঙ্গের শীতল চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মন অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে গেল। বিহঙ্গ চোখের ইশারায় আমাকে হ্যা বলতে বলল। আমার কি হল জানি না, আমি কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে গেলাম। ওপাশের জারুল গাছ থেকে ভেসে আসা বাতাসে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল আমি সেদিকে তাকিয়েই এক নিশ্বাসে বলে ফেললাম সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত শব্দটি। তারপর একটা সিগনেচার। ব্যাস সব শেষ।

১৬.
কাজি অফিস থেকে বেড়িয়ে সবাই বলল, দুপুর হয়ে গেছে লাঞ্চ করবে। কোথা থেকে যেন একটা মাইক্রোবাস এসে দাড়াল আমাদের সামনে। বিহঙ্গ আমার হাত ধরেই এগিয়ে গেল সেদিকে। আমি বিহঙ্গের ধরা হাতটার দিকে তাকালাম। বিহঙ্গ আমার হাতটা ধরেছিল কবুল বলার আগেই। তারপর আর ছাড়ে নি। সারা জীবনের মতো বিহঙ্গের হাতটা আমার হয়ে গেল ভাবতেই খুব অবাক আর আনন্দ লাগছে কিন্তু কোনটাই আমি প্রকাশ করছি না আপাতত।

আমদের গাড়িটা এসে দাড়াল একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন বিকেলই বলা চলে তবে কারও দুপুরের খাবার খাওয়া হয় নি। আমরা সবাই গিয়ে একটা বড় টেবিল দেখে বলসলাম।
বিহঙ্গ আমার পাশেই বসেছে কিন্তু হাতটা এখন আর ধরে নেই। ওর হাতটা টেবিলের উপর রাখা, ও ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছে।
আমি ওর হাতটার দিকে তাকিয়ে আছি। এতটা সময় তো ধরেই রেখেছিল তবে এখন কেন ছেড়ে দিল। খুব রাগ হচ্ছে আমার, বারবার হাতটা ধরতে চাইছি কিন্তু এতো মানুষের সামনে সেটা সম্ভব নয়। অন্ততঃ আমি পারব না। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি।
সাথে সাথে মনে হল কেউ আমার হাতটা ধরেছে। বিহঙ্গের দিকে তাকাতে দেখলাম ও আমার হাতটা শক্ত করে আগলে ধরেছে ঠিকিই কিন্তু এখনও বন্ধুদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। আমার দিকে একবার ফিরে তাকানোরও যেন সময় নেই। কিন্তু না তাকিয়েই যেন আমার মনের সব কথা বুঝে যাচ্ছে অদ্ভুত কোন মায়ার টানে।
আমি ওর ধরে রাখা হাতের দিকে আবার মনোযোগ দিলাম। আচ্ছা ও বুঝল কি করে এই মুহূর্তে আমি ওর হাতটা খুব করে চাইছিলাম, চাইছিলাম খুব শক্ত করে ধরুক ও আমার হাতটা। আগলে রাখুক এই আমিটাকে।

খাবার টেবিলে চলে এসেছে। অনেক পদের খাবার অডার করা হয়েছিল। সবাই বেশ হইচই করে খাচ্ছে। কিন্তু আমার খেতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। আমি বারবার প্লেটে আঁকিবুকি করে চলেছি কিন্তু এতো সময়ে এক নলা খাবারও মুখে তুলি নি। কেন যেন খাবার গুলা মুখ বেয়ে পেটে যেতে চাইছে না। হয়তো মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আঁকিবুকি করে চলেছে তাই।

সংযুক্ততা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে খাচ্ছিস না কেন? খা! তোর বিয়ের খাবার তুই না খেলে চলে।
বলেই হেসে ফেলল। সেই হাসিতে যোগ দিল সবাই। মুহূর্তেই একটা হাসির রোল পড়ে গেল। রেস্টুরেন্টে বসা অন্য মানুষগুলো চোখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে তাতে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। আমি প্রথমে একটু অবাক হলেও এই মুহূর্তে প্রচুর লজ্জা লাগছে।

সবার হাসির মাঝেই বিহঙ্গ আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর আমার প্লেটটা একটু সামনে সরিয়ে রেখে নিজের প্লেট থেকে এক নলা ভাত নিয়ে আমার সামনে ধরল। এমনিতে প্রচুর লজ্জা লাগছে তার মধ্যে বিহঙ্গের এই হেন কাজে আমার লজ্জা আর ওদের হাসি দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে। লজ্জায় আমার নড়া চড়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।

তানজি পাশ থেকে টিপনি কেটে বলল, খা খা,, বরের হাতের খাবার নাকি খুব মিস্টি হয়। ইশ আমার বিয়েটা যে কবে হবে! বলে আফসোস করতে লাগল।

বিহঙ্গ হাত দিয়ে আমার মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে আনল তারপর আবার ভাত ধরল মুখের সামনে আমি সব লজ্জা ভুলে খেয়ে নিলাম। সবাই হাসতে হাসতে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। বিহঙ্গ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, খেতে খেতে এতো হাসলে গলায় খাবার আটকে যাবে, আগে খেয়ে নে।
তখনও সবাই হেসে চলেছে। বিহঙ্গ একসাথে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার নিজেকে পৃথিরীর সব চেয়ে সুখি মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

১৭.
বিহঙ্গ আর আমি এখন একটা বাসে বসে আছি। বাসটা এক পা দুই পা করে চলা শুরু করেছে। আমি বিহঙ্গের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি।
বিহঙ্গ একগাদা খাবার চিপস পানি আরও অনেক কিছু নিয়ে এসে কেবলই সিটে বসেছে। আমি বুঝলাম না একটু আগে এতো খাবার খাওয়ার পর আবারও এতো খাবার কে খাবে! ও আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেন আমার সাথে যেতে ভয় করে নাকি? বলেই ভ্রু কুচকে তাকাল আমার দিকে।

আমি বিহঙ্গের দিকে ফিরে তাকালাম কিন্তু কিছু বললাম না। মনে মনে বললাম, তোমার সাথে কখনও কোথাও যেতে আমার এতোটুকু ভয় করবে না বিহঙ্গ । কারন তুমি যদি আমার প্রাণটাও চাও তো আমি সেটা দিতেও দ্বিধা বোধ করব না তো ভয় কিসের? মেরেও যদি ফেল তুমি আমাকে তবুও আমার এটাই ভেবেই শান্তি হবে যে তোমার হাতেই মরেছি।

আমি চোখ ফিরিয়ে জানলার দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে তুলল। কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ফাস্ট হানিমুন।

আমি চকিতে ফিরে তাকালাম ওর দিকে। ওর মুখে এখনও সেই দুষ্টুমি হাসিটা বিরাজমান। আমি আবার লজ্জায় পড়ে গেলাম। মুখ ফিরিয়ে নিলাম জানলার দিকে।

ও আমার দিকে একটু চেপে বসল তারপর ওর এক হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে ওর দিকে ফেরাতে চেষ্টা করল কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ওর দিকে কিছুতেই ফিরব না। ওর দিকে তাকালে আরও লজ্জায় লজ্জায় আমাকে জর্জরিত করে ফেলবে। না সেই সুযোগ কিছুতেই দেওয়া যাবে না। আমি মুখ ঘুরিয়ে ওর বুকে মাথা রাখলাম।
ও আবার ফিসফিস করে বলল, সরি বউ আজকে আমাদের ফাস্ট বাসর হবে না। তবে কালকে আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই কিন্তু। বলে আবারও হাসল। আমি আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। এবার ও আমাকে জাপটে ধরল যেন বুকের সাথে পিসে ফেলবে আমাকে।

পরিশিষ্ট: ও কখন কিভাবে আমাকে ভালবেসেছিল তার কোন উত্তর আমি আজ পর্যন্ত পাই নি। হাজার বার জিজ্ঞাসা করলেও কোন উত্তর মেলে নি। তাতে কি এই প্রশ্নে উত্তর জানা আমার জন্য বিশেষ জরুরী নয়, সেটা না বলেও তো ও আমাকে ভালবেসে যাচ্ছে এটাই আমার কাছে বেশী জরুরী। কিন্তু আমাকে বিয়ে করার সিধান্ত নিয়ে ছিল সেদিন রাতেই আমার কান্না শুনে। আমার কান্না শুনেই ওর মনে হয়েছিল আর এক মুহূর্তও ও আমাকে দুরে রাখবে না আর তাই হুট করে এমন বিয়ের সিধান্ত। ও প্রচণ্ড খামখেয়ালী তবে বিচক্ষণ আর বুদ্ধিদীপ্তও বটে। মাঝে মাঝে ওকে জিজ্ঞাসা করি তোমার মনের কি পুরোটা আমি কি আজও দখল করতে পেরেছি নাকি এখনও কোন জায়গায় সংযুক্ততা বাস করে। ও আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। তারপর বেশ গম্ভীর হয়ে বলে, ” তুমি কি এটা নিয়ে আমাকে খোটা দিচ্ছি।” তার এই হেন উত্তর শুনে আমি হাসি, প্রাণ খুলে হাসি। আমার হাসিতে আকাশ বাতাস কাপে, কাপে ওঠে আমাদের এই ছোট্ট সুখের নীড়টিও। আর ও আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।
আমি আমার জীবনে এমন একজন মানুষকে পেয়ে খুব খুশি। এই মানুষটির সাথে এক জীবন কেন এমন দশটি জীবনও কাটিয়ে দেওয়া যায় নির্দ্বিধায়।

{বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ }

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here