নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব ৬

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#পর্ব_6

১১.
সকালে ক্লাস থেকে এসে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম বিহঙ্গ বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ দিয়েছে। আমি শুধু শেষের ম্যাসেজটা দেখলাম।
“আমি মনে হয় কাল রাতে তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম।”

কাল রাতের কথা মনে পড়তে মনে মনে কিছুটা হেসে নিলাম। রাতে কতো পাগলামী করছিল আর এখন তার কিছু মনে নেই। এই মদ বড় অদ্ভুত জিনিস কিছুটা সময়ের জন্য হলেও নিজের সব কিছু ভুলিয়ে দেয়, স্থান, কাল, পাত্র সব । তখন মনে আর কোন দুঃখ বাসা বাধতে পারে না। অন্ততঃ সে সময়টুকুর জন্য মনুষ মুক্ত হয়ে যায়, মুক্ত পাখির মতো আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারে, তার সে সময়ের কাজের জন্য কেও কৈফিয়ত চায়বে না। কিন্তু বাস্তবে ফিরে আসলে আবারও সেই আগের আমি হয়ে যেতে হবে। যে আমিকে একটা নিশ্বাস নিতেও বারবার ভাবতে হয় । আমি উত্তর দিলাম, মনে নেই।

প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লে আসল, না মনে আছে। বেশ কয়েকবার দিয়েছিলাম। কথাও হয়েছে,,
– মনে আছে কি বলেছিলে?
– না মানে!
– আমার কাছে রেকডিং আছে। দিব? শুনবা?
– তুমি রেকড করেছ কেন? একটা মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট করছ?
– আমি করি নাই আমার ফোনে অটোরেকড হয়। আর না করলে তো তুমি বিশ্বাস করতে না কাল রাতে তুমি কি কি বলেছ।
– আমার সব মনে আছে। আরে আমি তো মাতাল হয় নি, আমার সেন্স ছিল।
– হ্যা তাই তো আমাকে এভাবে তুই বলছিলা আর এতো এতো স্লাং ব্যবহার করেছ। আমি এতো স্লাং নিজের জীবনে শুনি নি।
– কি বলছ এসব? আমি আমি তোমাকে তুই বলেছি! সম্ভব নয় আমি মেয়েদের প্রচুর সম্মান করি।
– তাই তো কাল গালি দিলা।
– অসম্ভব
– তোমার মুখের ভাষা এতো খারাপ আল্লাহ। আর আমাকে গালি দেওয়ার সাহস তোমাকে কে দিল?
– আরে তুমি তো আমার আপনজন তোমাকে গালি দিতেই পারি। সেটা বিষয় না।
– আমি তোমার কোন জন্মের আপন জন লাগি? আমি তোমার কোন আপন জন হতে চাই না।
– আপনজন না তাহলে তো তোমাকে আমি গালি দিতেই পারি বাইরের মানুষকে আমি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারি! আপনজনদের তো আর বলি না। আমি আমার আজনজনদের প্রচুর রেসপেক্ট করি। আর তুমি নিশ্চই আমাকে গালি দিতে বাধ্য করেছ। হয়তো এমন কিছু করেছ যা আমার পছন্দ হয় নি তাই গালি দিয়েছি।
– আমাকে গালি দেওয়ার কারন হল আমি তোমার ফোন কেন ধরি না।
– হ্যা সে জন্য তো তোমাকে গালি দিবই, তোমাকে গালি দেব না তো কি মাথায় নিয়ে নাচব। দিনে এতোবার করে ফোন দেয় তুমি একবারও ধর না আমাকে কি তোমার মানুষ মনে হয় না।
– তাই বলে গালি দিবা এভাবে স্লাং ইউজ করবা।
– মদ খেলে সবাই এমন একটু আধটু করে।
– কাল ড্রিংক কেন করেছিলা?
– ফ্রেন্ডরা খাচ্ছিল আমাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।
– আমি তো ভাবলাম ছ্যাকা খেয়েছ তাই মদ খেয়ে টাল হয়েছিলা।

বিহঙ্গ কয়েকটা হাসির ইমোজি পাঠাল। তারপর লিখল, ছ্যাকা খাইছি বলে মদ খেয়ে টাল হওয়ার মতো পাবলিক আমি না।

– তা ঠিক আছে কিন্তু মদ খেয়ে আমাকেই কেন ফোন করলা?
– জানি না হয়তো তোমার নাম্বারটা প্রথমে ছিল তাই। আচ্ছা কি বলেছি বল তো?
– গত দুই দিন তুমি আমাকে ফোন দেও নি তাহলে আমার নাম্বার প্রথমে থাকবে কিভাবে?
– ফোন না দিয়েও যে নাম্বারটা কত বার আমি ডায়েল লিস্টে তুলি তা যদি তুমি জানতে। জানবে কিভাবে ফোন দিলেও তো তোমার দয়া না হলে ফোন ধর না।
– ধরব না। তোমাকে না বলেছি আমার কাছে তোমার সব প্রয়োজন শেষ আমাকে আর কল দিবা না।
– আচ্ছা সংযুক্তার বিষয়টা ছাড়াও তো আরও কিছু বলার থাকতে পারে আমার, পারে না? আমরা ফ্রেন্ড হিসেবে কথা বলতেই পারি?
– না পারি না
– কেন?
– পারি না ব্যাস।

বিহঙ্গ আর কোন ম্যাসেজ দিল না। আমিও ফোনটা রেখে কিছুটা সময় ঝিম ধরে বসে থাকলাম। আমি ওকে কিভাবে বলি যে তুমি যতবার ফোন কর ততবার আমার হৃদয়ের মধ্যে একটা শুক্ষ রক্তক্ষরন হয় সেটাও তো তুমি দেখ না, দেখতে চাও না।

ওর একটা ফোনকল আমার জীবনটাকে স্বাভাবিক ট্র্যাক থেকে বিছিন্ন করে দিতে যথেষ্ট এটা তো ও কোনদিনও বুঝবে না। ওর খুশির জন্য আমি নিজেকে বলি দিতে পারব না কখনও না। তাই আমার জীবনের আনাচে কানাচে কোথাও আমি তোমাকে দেখতে চাই না বিহঙ্গ, তুমি শুধু থাকবে আমার অন্তরের মধ্যে সারাটা জীবন। বাকী আমার জীবনে তোমার কোন অস্তিত্ব আমি রাখব না।

১২.
আমি আমার জীবনটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছি যেমনটা আগে ছিল। শুধু মাঝের কয়েকদিন হঠাৎ ঝড়ো হওয়ার মতো বিহঙ্গের আগমন আমার মনটাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে সামনের পথ চলার চেষ্টা করছি। যে আমার নয় তাকে যে আকড়ে ধরার দুঃসাহস আমি করতে পারি না। জীবন একটা উত্তাল সমুদ্র এখানে বাঁচতে গেলে নিজেকেই যুদ্ধ করতে হবে। জীবনে অনেকবার অন্যকে আকড়ে ধরতে গিয়ে আরও বেশী পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছি আমি। তাই আর নতুন করে মিথ্যে সপ্ন আমি দেখতে বড্ড ভয় পায়।

সকালে ক্লাস, বিকালে কয়েকটা বস্তির বাচ্চাদের পড়ানো আর ওদের সাথে সময় কাটানো। সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিলে নিজের পড়া নিয়ে বসে পড়া। মাঝে মাঝে রুমমেটেদের সাথে অল্প আড্ডা এই রুটিনেই চলছে আমার জীবন। বাইরের মানুষ আমাকে দেখলে হয়তো ভাবে আমার থেকে সুখি আর দুটি মানুষ নেয়। কিন্তু আফসোস ভিতরের রক্তক্ষরন কেউ দেখে না, দেখতে পায় না।

আর বিহঙ্গ ও আমার সব কিছু থেকে ব্লক। এইতো কয়েকদিন আগে, অনেক সাহস জুগিয়ে ওকে আমার সব কিছু থেকেই ব্লক করেছি। এখন ওর আর আমার সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় নেয়। এখন অল্প একটু শান্তি আছে যে, চাইলেও বিহঙ্গ হুটহাট এসে আমাকে আর কষ্ট দিতে পারবে না। আমার পুড়ে যাওয়া হৃদয়টাকেও আর পোড়াতে পারবে না।

সংযুক্তাও হোস্টেলে ফিরেছে বিয়ের পর। ওকে দেখলে ওর সুখি জীবন দেখলে বড্ড সপ্ন দেখতে মন চাই। কিন্তু কেন জানি না সব সপ্ন গুলোতে বিহঙ্গ এসে হাজির হয়। আর আমার সুখপ্ন গুলো আরও বেশী সুখি হতে গিয়ে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে। মনে হয় কি এমন হত সেদিন যদি বিহঙ্গ এসে ওই একই গল্প আমাকে শোনাত কিন্তু সংযুক্তার জায়গায় আমার নামটা থাকত।

আমি অনাথ। বাবা মাকে কখন হারিয়েছি তা আমি নিজেও জানি না। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই বড় খালার কাছে বড় হয়েছি। তারা আমাকে কখনও বুঝতে দেয় নি আমি তাদের মেয়ে না। কিন্তু এই সমাজ এটা মেনে নিতে পারে নি। সমাজ এমন অনাচার কিছুতেই মানতে পারে না তাই এই অনাচারের নিসপত্তি খুজে বের করে। সমাজের কিছু সহৃদয়বান ব্যক্তি আমাকে সেটা জানানোর জন্য ছিল উদগ্রীব।
আমি তখন খুব বড় ছিলাম না। সদ্য স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বয়স হয়তো পাঁচ। তারপর থেকেই আমার চাওয়া পাওয়া আর ইচ্ছে গুলোতে এক অদৃশ্য বাঁধ এসে গেল। সব স্বপ্নগুলো একটা একটা করে ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল, কারন সেগুলো সবই তো শুন্যে সাজিয়েছিলাম আমি। তারপর থেকে আমি আর পারি নি মুক্ত পাখির মতো উড়তে। আমি অনাথ, এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই এটা মেনে নিতে নিতে কবে যে আমি সব কিছু থেকে বিছিন্ন হয়ে একা হয়ে গেলাম জানি না।

তারপর থেকে এই পৃথিবীতে আমি আমার আর কোন ভাল লাগার জিনিসকে আকড়ে ধরতে পারি নি। আসলে ধরতে ভয় করত। হয়তো আবার কোন দিন শুনব যে জিনিসটা আমি আকড়ে ধরে বেঁচে আছি সেটা আদৌ আমার নয়। তখন হয়তো আর নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারব না। তাই আর কিছু নিজের ভাবি না আমি। সবই মোহ, একমাত্র আমি আছি আমার নিজের। আর আমি চাইলেও আমার মতো একটা অনাথ মেয়েকে এই সমাজ চাইবে না। কখনও চাইবে না।

১৩.
সামনে সেমিস্টার ফাইনাল তাই সারাদিন পড়ার টেবিলে বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে বসে থেকেই আমার দিন চলে যাচ্ছে। এই এর পড়াশোনা আছে যে কখনও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকা করে নি আর আমাকে এই সমাজের বুকে একটু মাথা গুজার ঠায় দিয়েছে।

হঠাৎ প্রায় অনেকদিন পর ইবনীহার ফোন পেয়ে অনেকটাই অবাক হলাম। একসময় আমরা বেশ ভাল ফ্রেন্ড থাকলেও কালে পরিক্রমায় দুইজন দুই দিকে। তাই আর আগের মতো কথা হয় না, দেখাও হয় না অনেকদিন।

ইবনীহার সাথে অনেকদিন পর কথা বলে বেশ ভাল লাগছে। অনেক কথায় হল কিন্তু ফোন কাটার আগে ইবনীহা যেটা বলল তা শুনে আমার আবার কেমন যেন লাগতে লাগল, বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কিছু একটা জোরে জোরে হাতুরি পেটাচ্ছে ।
ইবনীহা আমাকে ফোন করেছে বিহঙ্গর কথায়। বিহঙ্গ নাকি আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ওকে বলেছে। ওর শেষ কথা ছিল আমি যেন বিহঙ্গর নাম্বারটা আনব্লক করে দেয়। বিহঙ্গ আমার সাথে কথা বলতে চায়, খুব জরুরি কথা। এই এক জরুরি কথার ছুতোই তো ও আবার এসেছিল। তাহলে আবার কেন?

আমি বিহঙ্গর নাম্বারটা ব্লক লিস্ট থেকে রিমুভ করে দিলাম। আর প্রায় সাথে সাথেই বিহঙ্গর কল আসল।

চলবে,,,

জাকিয়া সুলতানা

{ বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here