মনের দুয়ারে দাড়িয়ে পর্ব ১

#মনের_দুয়ারে_দাঁড়িয়ে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১

____________________
বিয়ের সাজে গুমোট মুখে ড্রয়িং রুমে বসে আছে তানহা। বিয়ে বাড়ি হিসেবে আশেপাশে কোন হৈহুল্লোড় নেই। আর না আছে বরযাত্রী বেসে নতুন মুখেদের আগমন।কেবলই বিরাজ করছে চারিদিকে স্তব্ধতার সাগর। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকা সকলে একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আবার মাঝেমধ্যে তানহা কেও তাক করছে। তানহার ভাবি জান্নাত বলে উঠল,
” প্রেমিক যখন ছিলই বলোনি কেন? আমরা তো আর তোমাকে জোর করিনি বিয়ের জন্য। বিয়ের ঘর যখন এসেছিল তখন বলে দিলেই পারতে তোমার অন্যদিকে সম্পর্ক আছে। তাহলে তো আর আজকের এই অপমান জনক দিন আমাদের কারোই দেখতে হতো না। ”
তানহা মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশ থেকে মা তাহমিনা বেগম বলেন,
” ছেলেটির সাথে কত বছরের সম্পর্ক তোর?”
তানহা চুপ। তাহমিনা বেগম আবারও বললেন,
” কী হলো? চুপ করে আছিস কেন? বল কত বছরের সম্পর্ক? ”
” আহা তাহমিনা….থামো তো।”
বলেই জামাল সাহেব দরজার সাথের চেয়ার ছেড়ে উঠে তানহার পাশের চেয়ারে এসে বসলেন। বললেন,
” তোমাদের ব্যবহার না সত্যিই অমানবিক। মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না? তাছাড়া নিজের সন্তানের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
” ও আমাদের কথা বলায় দোষ? আর তোমার মেয়ে সাধু? এতকিছুর পরও তোমার মেয়ে সাধু? এরজন্যই তো মেয়ের এই অবস্থা। যেই পরিবারের বাবা ঠিক থাকে না, ছেলেমেয়েদের ভুল কাজে কখনো শাসন করে না সেই পরিবারের ছেলেমেয়ে আর কত ভালো হবে? আমারই ভুল যে এদের ভালোমন্দ দেখতে গিয়ে নিজের জীবন দিনের পর দিন বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই মুখ ভেংচি কেটে ড্রয়িং রুম ছেড়ে চলে গেলেন তাহমিনা বেগম। আর তার পিছু ছুটল জান্নাত। তবে তানহার ভাই তমাল সেই দলে যুক্ত হলো না। দু পা এগিয়ে তানহার পাশের চেয়ারে এসে বসল। পাশ থেকে জামাল সাহেব বললেন,
” ছোট থেকে যে বড় হয়েছিস, কখনো দেখেছিস বাবা তোদের দু ভাই বোনদের উপরে কিছু চাপিয়ে দিতে? নিজের মনগড়া সিদ্ধান্ত ফোর্স দিয়ে তোদের মুখের সিদ্ধান্ত বানিয়েছে…. দেখেছিস? বোধহয় দেখিসনি। তাহলে এতবড় সিদ্ধান্ত কীভাবে তুই নিলি? তাও আবার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে!”
তানহা এবারও বোবা। কথা বলার জন্য যে শব্দমালা গুলো প্রয়োজন সেগুলো যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আর জামাল সাহেব পাশ থেকে তার সুক্ষ্ম দৃষ্টি প্রয়োগ করে তানহার সেই চাহনি গুলোর বিশ্লেষণ করতে লাগলেন। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন তানহার এই মুহূর্তে নিঃসঙ্গতাকে বেশ প্রয়োজন। এবং গভীর ভাবেই প্রয়োজন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
” তানহা মা, এখন ঘরে যা। হাত মুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর। দেখবি ভালো লাগবে।” তানহা হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না।তবে বসা থেকে দাঁড়িয়ে এগোতে লাগল নিজ রুমের দিকে। তবে যাওয়ার আগে মায়ের রুম থেকে চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো সে শুনল……” আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছিলে না? যার জন্যে আজ এই অবস্থা। সারাজীবন বলে এসেছি এত আহ্লাদ দিও না, নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে পুরো স্বেচ্ছাচারী বানিয়ে ফেলেছ। আচ্ছা, তুমি কি মানুষ? এতকিছুর হয়ে যাবার পর সাথে মান সম্মান হারানোর পরেও এত ভালো কথা মুখ দিয়ে আসে কী করে?”
তাহমিনা বেগমের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানহা টুশব্দটি করল না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে ঘরের দুয়োরটা আটকে দিল।
.
পরনের গয়নাগাটি, ভারী শাড়ি সব খুলে সুতি একটি সেলওয়ার কামিজ পড়ে এলোমেলো চুলকে সঙ্গী করে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে তানহা। নোনা জলে টইটুম্বুর ঝাপসা দৃষ্টিপথ বাড়ির বাইরের জনমানবশূন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তার অলিতে গলিতে। মাথায় ঘুরছে নানান চিন্তা। তবে সবগুলোই কু-চিন্তা। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তানহার। ইচ্ছে তো করছে এক্ষুনি গায়ে আগুন ধরিয়ে ছাই হয়ে যাক। কিন্তু সেটা কেবল ইচ্ছেতেই সীমাবদ্ধ। মুসলিম সন্তান হয়ে জন্মেছে সে। চাইলেই মৃত্যুকে আপন করে নেয়ার শক্তি কিংবা ক্ষমতা কোনটাই তার নেই।
ফলস্বরূপ বাঁধ না মানা নোনাজলই তার এখন নিত্যদিনের সঙ্গী হবে।
ভেবেই এক ফোঁটা নোনা জল ছেড়ে দিল চোখের কোণ জুড়ে। আর ওমনি বেজে উঠল ফোনের রিংটোন। তবে এই মুহূর্তে তানহার মোটেও ইচ্ছে করছে না ফোন নামক বস্তুটি ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু ওদিকে একের পর এক ফোন বেজেই যাচ্ছে। একপ্রকার বিরক্তি নিয়েই তানহা বিছানার দিকে এগুলো। দু পা তুলে বিছানার উপর বসে মোবাইল হাতে নিতেই দেখে তিহানের নাম্বার থেকে ৭ টা মিসড কল এসেছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তানহার। ইচ্ছে করছে মোবাইল টা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। নিজে তো আর কামাই করে না যে, যখন যা ইচ্ছে হবে তাই করবে। ইচ্ছে হলে জিনিস নষ্ট করবে আবার ইচ্ছে হলেই কিনে নিবে। ঘুরেফিরে তো সেই আবার বাবার কাছেই হাত পাততে হবে। তাহলে লাভ কী ভেঙে?
ভেবেই বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল তানহা। এরই মাঝে তিহানের নাম্বার থেকে আবার কল এলো। কিন্তু তানহা ফোন কিছুতেই রিসিভ করবে না। তাই ফোন বাজার সাথে সাথেই কেটে দিল। কিন্তু না, তিহানও থামল না। একের পর এক কল করে যাচ্ছে আর তানহা একের পর এক কল কেটে যাচ্ছে। কিন্তু তিহানও হার মানার পাত্র নয়। অগণিত কল করে যাচ্ছে। একপর্যায়ে তানহা বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করেই ফেলল। ভারী গলায় বলল,
” কী হয়েছে? পাগল হয়ে গিয়েছ? দেখতে পারছ না বারবার ফোন কেটে দিচ্ছি? বুঝতে পারছ না তোমার সাথে আমার কথা বলার রুচি নেই। তারপরও বেহায়ার মত এভাবে ফোন দিচ্ছ কেন?”
” এভাবে কথা বলছ কেন তানহা? মাথা ঠান্ডা করো। চড়া মেজাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, জানো না? ”
” দেখো তিহান তোমার এসব ছেঁচড়াপনা এবার বাদ দাও। নিজের রাস্তা মাপো আর আমাকে মুক্তি দাও।সত্যিই আমার এসব আর ভালো লাগছে না। আমি মুক্তি চাচ্ছি দয়া করে আমাকে মুক্তি দাও।”
” মুক্তি দেয়ার ইচ্ছা থাকলে আজ অবশ্যই তোমার বিয়েটা ভেঙে আসতাম না। এ জীবনে আমার থেকে মুক্তি অন্তত তোমার নেই তানহা। আর ছেঁচড়াপনা সেতো আমারই নিজেস্ব চরিত্র। যেটা তোমার উপর এতদিন এপ্লাই করে এসেছি আর সারাজীবন করে যাবো। এর থেকেও মুক্তি নেই তোমার।”
তানহা এবার মাত্রাতিরিক্ত রেগে গেল। উঁচু স্বরে বলল,
” তুমি কি চাও একটু সত্যি করে বলবে? সেদিন তুমিই বললে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে না। এ জীবন থাকতে আর আমার মুখাপেক্ষী হবে না। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিয়ের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়েছি। আবার সেই তুমিই এসে সব ভন্ডুল করে দিলে। আবার এখন বলছ তোমার থেকে মুক্তি নেই। মানে কি এসবের? কেন করছ এরকম? ”
” এর উত্তর হয়তো আমার থেকে ভালো তোমার জানা আছে তানহা। ”
” সব জানাও কিন্তু সবসময় সঠিক হয় না তিহান। কিছু অজানাও মাঝেমধ্যে সঠিক রূপ নিয়ে থাকে। ”
” মানে?”
” এই যে ধরো গত কয়েকদিন আগের কথা, আমি কি কখনো ভেবেছি রাগের ছলে হলেও তুমি আমাকে জীবন থেকে বাদ দেয়ার কথা বলবে? ভাবিনি তো…..কিন্তু তুমি বলেছ। ক্ষনিকের জন্য হলেও বিচ্ছেদ ঘটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এ পুরো ঘটনাই তো আমার জানার বাইরে ছিল। চিন্তাশক্তির বাইরে ছিল। কিন্তু তুমি তো তা করে দেখিয়েছ।তোমায় ঘিরে সবকিছু জানার মাঝে কিছু অজানা অনুভূতি জন্ম দিয়েছ। তাই বললাম অজানার মাঝেও কিছু সঠিক রূপ থাকে। কারণ তোমার কাছে সেগুলো সঠিক লেগেছে বলেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছ। হোক সে আমার জন্যে অজানা অনুভূতি। ”
কাঁপা স্বরে তানহা প্রতিটি কথা উল্টো পালটা বললেও তিহানের নিকট যেন প্রতিটি কথা সরল বাক্যে পরিণত হলো। তানহা হয়তো নিজেও জানে না সে কীভাবে কী বলছে।কতটা অগোছালো শব্দ দিয়ে কথামালা গাঁথছে। কিন্তু তিহানের সেগুলো বুঝতে সামান্য কষ্টও হলো না। সেই অগোছালো কথামালা গুলো খুব সহজেই নিজের মাঝে ধারণ করে ফেলছে। আর শান্ত কন্ঠে বলল,
” আমার পাগলী টা বড্ড কষ্ট পেয়েছে তাই না?”
তিহানের মুখে পাগলী ডাক শুনে তানহার চোখ ভরে উঠল। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে তিহানকে জাপটে ধরতে।আর চোখ জলে ভাসিয়ে দিতে জমে থাকা রাগ অভিমানের শত পাহাড় গুলোকে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়লো তিহানের বলা সেদিনের কথাগুলো। গায়ে যেন আবারও ধাউ ধাউ করে অগ্নিশিখা জ্বলে উঠল।তানহা কয়েক সেকেন্ড থেমে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” তোমার সাহস কতবড় আমার বাড়ি বয়ে এসে আবার আমারই সামনে আমার বিয়ে ভেঙে যাও! কী পেয়েছ তুমি? আর কী-ই বা মনে করো নিজেকে? ”
” নিজেকে কিছুই মনে করি না। আর না বিয়ে ভেঙে নিজের সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছি। আমি তো বিয়ে ভেঙেছি জীবন বাঁচাতে। হ্যাঁ, নিজের জীবন বাঁচাতেই তোমার বিয়ে ভেঙেছি।এখন এতে যদি আমার জেল ফাঁসি হয় হবে। আই ডোন্ট কেয়ার। ”
” তুমি আমায় কী পেয়েছ খেলার পুতুল? তোমার হাতের খেলার পুতুল আমি? যখন যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই খেলবে আমার সাথে? আমার কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই?সবটাই তোমার?”
” যদি বলি হ্যাঁ সবটাই আমার….তখন কী করবে? ”
তানহা স্বল্প স্বরে হাসল। বলল,
” বেহায়া তো বলে রাজ্য আমার। তাই বলে কী সত্যিই রাজ্য তার?”
তিহান কিছুটা জোরেই হেসে ফেলল। বলল,
” ভালোই কথা শিখেছ। যাই হোক কাল সকালে একটু দেখা করোতো কিছু জরুরি কথা আছে। ”
” আমার তোমার সাথে কোনো জরুরি কথা নেই। অতএব দেখা করার প্রশ্নই আসে না।”
” সেটা তোমার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। জোর করব না তোমাকে। তবে এটা মনে রেখো আমি আসব। প্রয়োজন হলে রাত অবধি অপেক্ষা করব। এখন তুমি আসবে কী আসবে না সেটা সম্পূর্ণই তোমার বিষয়। ”
” শুধু রাত কেন, রাত গিয়ে যদি ফের ভোর নেমে আসে তারপরও আমি আসব না। অর্থাৎ অকারণে এসে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করো না। ”
” আমার সময় নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে। শুধু এটা ভেবে মনকে তৈরি করো যে, আমি আসব আর অপেক্ষাও করব। রাখছি ফোন।”
বলেই ফোন কেটে দিল তিহান। তানহা রাগে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। একপর্যায়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বিছানার উপরই ফোনটা ছুঁড়ে মারল। আর উল্টো দিক ফিরে শুয়ে পড়ল।
.
সকাল ১০ টা। মেইন রোডের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তিহান। পরনে ক্রিম কালার শার্ট আর নীল হার্ড জিন্স। চোখে চশমা। শার্টের হাতা ফোল্ড করে একহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে অন্যহাত উঁচিয়ে চুল নাড়ছে আর রাস্তার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু না, তানহার আসার নাম গন্ধও নেই। তবে তিহান মোটেও হতাশাগ্রস্থ নয়। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে তানহা আসবে। আর সময় মতোই আসবে। ভেবেই মুচকি হেসে সামনে তাকাতে দেখে তানহা আসছে। কালো রঙের একটি সুতি কামিজ পড়ে তিহানের দিকে ছোট ছোট পা দিয়ে এগিয়ে আসছে। তিহান কিছুটা এগিয়ে গেল। দুষ্টু স্বরে বলল,
” উফফ আবার সেই কালো…..মেরে ফেলার ফন্দি আঁটছ না-কি তুমি? এই কালো কালো পড়ে যে দিনের পর দিন আমাকে তিলে তিলে শেষ করছ সেই খেয়াল আছে? ”
তানহা ভ্রু কুচকে তাকালো। বলল,
” ডেকেছ কেন?”
” অবশ্যই কোনো একটা কারণ আছে। এমনি এমনি তো আর আমি ডাকি নি। এখন সেই কারণ টা কি এখানে বলব না-কি কোথাও বসে?”
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here